জানালার বাইরে ঝাঁ ঝাঁ দুপুর, পথের পাশে গাছটির নীচে ঘেয়ো কুকুরটি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। পিঠের ঘাগুলোতে মাছি ভনভনিয়ে উড়ছে। রাস্তায় তেমন একটা রিক্সা নেই, মনে হচ্ছে সকালের সুদর্শন রাস্তাটা দুপুরে অন্যমনস্কতায় বিভ্রান্ত। জানালা দিয়ে মোড় পর্যন্ত দেখা যায়।
কনক উদাস হয়ে বিষন্ন দুপুরগুলোর অলসতা ছুঁতে থাকে। ঘুমালে বেশি বিষাদ লাগে। ঘুম ভাঙার পরে তাই সব দিন ঘুমায় না। রাতেও তেমন ঘুমাতে পারে না, নিরব ঘুমাতে দেয় না। নিরবের আহ্লাদী চাওয়ায় জেগে থাকতে হয়।
কনকের মাঝে মাঝে রাগ হয়– সকালে তোমার অফিস, ঘুমাও।
নিরব ওর কান কামড়াতে কামড়াতে বলতে থাকে– অফিস থেকেও তুমি বড়। গুল্লি মারি অফিস।
– তোমার জীবনে না এলে কি করতে তখন?
কনকের কথায় আরও জোরে চেপে ধরে নিরব– ভাবতেই পারি না সেটা, ভালোবেসেছি যখন, যে করেই তোমাকে পাবো, এটাই জানি শুধু।
– কিন্তু আমি তো তোমার বস এর…
নিরব মুখের কথা শেষ করতে দেয় না, কনকের ঠোঁট তখন বন্দী নিরবের মুখের ভিতর। নিরব এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায় প্রতিবার। কনক জানালা ছেড়ে বিছানায় এলিয়ে দিলো নিজেকে। তার জানালার পাশেই একটি নিমগাছ। হাওয়া দিচ্ছে ডাল পালা, পাতাগুলো নড়ে চড়ে। তপ্ত দুপুরের অসহায় নির্বিকার কাকগুলো ডাকছে ক্লান্ত গলায়। কী সাংঘাতিক নিরিবিলি আজ কনক! সময় যেন যেতেই চায় না। নিরব তাকে আবার কলম ধরতে বলেছে। একসময় যে দুরন্ত লেখার ঝোঁক তার ছিলো আবার শানাই করতে বলেছে তাকে। কী করে সে তা করবে?
কত জল ঘোলা হলো অনুভূতির টুকিটাকি নৈঃশব্দে। হারমোনিয়াম নিয়েও একদিন বসেছিলো, জোর করে গলা সাধতে যেয়েও বুজে আসতে চাইলো কণ্ঠ তার। হয়তো সবি তার হবে, সময়ের ব্যাপার। ঘুমের সমস্যাটা খুব বাজে অভ্যেসে পরিনত হয়েছে আজকাল। বয়সের কারণে হতে পারে।
বয়স! হাসলো সে। আসলেই তো, বয়সতো কম হলো না তার। ছেলেটাও তার পনেরো পার হয়ে গেছে। আগামীবার এসএসসি দিবে। চোখে জল চলে এলো হঠাৎ। জ্বলছে কেন চোখটা। গতমাসেই অরন্যের জন্মদিন ছিলো, বাবার বাসায় গিয়েছিল কনক কেক নিয়ে । অরন্যের প্রিয় কিছু জিনিস নিয়ে, ছেলেটা সামনে আসেনি। কেউই আসেনি কনকের সামনে। বাবা, মা, ভাই কেউ না। অনাহূতের মত বসার ঘরে কতক্ষণ বসেছিলো সে।
কাজের মেয়েটা এসে শুধু অরন্যের জন্য আনা উপহারগুলো তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ভাইজান নিয়ে যেতে বলেছে এসব।
কান্না আসেনি সেদিন। মাথা নীচু করে ক্লান্ত পায়ে তার অতি আপন ঘর, এক সময়ের প্রিয় বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চন্দ্র থাকলে মায়ের কাছে দৌড়ে আসতো, সে তার বাবার সাথেই থাকে।
আজকাল রাগ হয় কনকের। প্রচণ্ড অভিমানে বুক ভার হয়ে থাকে। সব তার অপরাধ? সব? তার সুখ, আনন্দ, খুশি কেউ বুঝতে পারে না কেন? না বুঝলে না বুঝুক। নিরবের বুকে মাথা রেখে কনক নিশ্চিন্ত , নির্ভার, আনন্দিত।
ভালোবাসা কোনো শূন্যতা রাখেনি তার। সে ভালোবেসেছে, নিরব তার ভালোবাসার সম্মান দিয়েছে। যে সন্মান, মর্যাদা সে দুই দশক অনেক চেষ্টা, সাধনা করেও পায়নি । যা পেয়েছে তা হলো… হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো।
বালিশের পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে নিরবের কল –আমার ময়না পাখি কী করে?
কানে লাগাতেই নিরবের পাগলাকণ্ঠ। কনক ঠোঁট চেপে হাসলো। খুব ভালো লাগে নিরবের এইসব ছেলেমানুষি পাগলামীগুলো। বেঁচে থাকাটাও প্রাণময় হয়ে উঠে। কীভাবে যে সে বেঁচে আছে, আজ মৃত্যু যেন শিয়র ঘেঁষে নিঃশ্বাস ফেলছে।
কনক বিপর্যস্ত। চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কোনোমতে নিরবের সহায়তায় রিপনকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো। নিরব সরে দাঁড়াতেই কনক রিপনের পা থেকে জুতো জোড়া খুলতেই একটা লাথির মতো পা ঝাড়া দিয়ে উঠলো রিপন– ঐ মাগী, টাইটা আগে খোল!
কান, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো অপমানে। তাও আবার অল্পবয়সী যুবক নিরবের সামনে বলে। নিরব মাথাটা একটু নাড়িয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সেই থেকে দমকা হাওয়ার মতো নিরবের বুকের কোণে ভেঙেচূড়ে কখন জায়গা নিয়ে বসেছিলো কনক তা জানে না।
রিপনের অফিসের জুনিয়র হিসেবে নিরব কাজ করতো, অফিসের পার্টিগুলোতে সেও রিপনের সাথে সাথে থাকতো। যেদিন কনকসহ বড় কোনো ক্লাবের অনুষ্ঠানে রিপন পাড় মাতাল হয়ে পড়তো, তখন নিরবের সহায়তা ছাড়া কনক কিছু করতে পারতো না। কনক ব্যবসায়িক পার্টিতে খুব একটা যেতো না, রিপনের জেদাজেদিতে যেতে হতো প্রায়ই, নইলে খুব বাজে কথা শুনতে হতো তাকে।
এভাবেই বছরের পর বছর কনক রিপনের জীবনে ধূসর আচ্ছন্নতার মতো পড়েছিল বেরঙা দুঃস্বপ্ন হয়ে। নিরব মাঝে কি করে যেন তার অমানিশা আকাশে এক টুকরো আলোর মতো জুড়ে নিলো নিজেকে, কনক টের পায়নি।
রিপন সারারাত বাইরে কাটাতো, বিদেশ পড়ে থাকতো, কত কথা কানে ভেসে ভেসে কনকের হৃদয় পুড়িয়ে ঝড় তুলতো। সুন্দরী নারী নিয়ে পড়ে থাকা রিপনের মধুর ভালোবাসা, প্রেম, নিটোল কথা বহুবছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল কনকের জীবন থেকে। কনক ছেলে মেয়ে দুটিকে বুকে জড়িয়ে মধ্যবিত্ত রক্ষনশীলতা আঁকড়ে মুখ বুজে সয়ে যাচ্ছিলো সব।
নিরব হঠাৎ হঠাৎ ফোন করতো। সুন্দর, মার্জিতভাবে কনকের খবর নিতো। যখন মাঝে মাঝে বাসায় আসতো দূর থেকে কনকের শূন্য দৃষ্টিতে গভীর প্রত্যয় নিয়ে চেয়ে থাকতো; যেন অনুভব করতে চাইতো ভিতরের কষ্ট, বিষাদে মোড়ানো শান্ত, নিটোল এই মানবীকে।
রিপনের বেপরোয়া আচরণ যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছিলো। একরাতের পার্টিতে কনককে পাতলা আমেরিকান শিপন পরতে বললো স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরেও রুক্ষভাবে তাকে পরতে বাধ্য করলো প্রায় শরীরের সাথে মিশে থাকা শাড়িটি পরতে।
সেদিন ঢাকা ক্লাবের অনুষ্ঠানটিতে পরিচিত বন্ধুরা সব অপরূপ কনকের সুঠাম যৌবনের তারিফ করছিলো লোলুপ দৃষ্টিতে, কনক জড়োসড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছিলো যেন। রাত গভীর হলে রিপন ব্যবসায়িক পার্টনার হাসান সাহেবের সাথে কনককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নিজে অন্যদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এমনিতে ঢুলছিল হাসান সাহেব, আরও বেশি করে ড্রিঙ্ক গ্লাসে ঢেলে নিজে একটা নিয়ে কনককেও অফার করলো।
ভদ্রভাবে কনক না করে দিয়ে সোফা থেকে উঠতে যেতেই সেই মদ্যপ লোকটি তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিলো, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কনকও ধপ করে বসে পড়লো সোফায়। তখনি হাসান সাহেব আধো আলো আঁধারে জড়ানো কণ্ঠে কী সব বলতে বলতে কনকের কোমর পেঁচিয়ে ঝুকে পড়লো।
কোনোমতে সেদিন কনক হাসান সাহেবের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বারের বাইরে বেরিয়ে গেলো দৌড়ে। কোনোকিছুই নিরবের চোখ এড়ায়নি সেদিন, পরে সব শুনেছিলো তার মুখ থেকে কনক। নিরবও কনকের পিছন পিছন বাইরে বেরিয়ে গেল। মুখে কিছু বলেনি শুধু পানি খাওয়ালো, টিস্যু বের করে হাতে দিলো, কনকের সারামুখ চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিলো তখন।
বাসায় ফিরে অকথ্য ভাষায় সেদিন রিপন কনককে বকাঝকা করলো, ধাক্কা দিয়ে বেডরুম থেকে বের করে দিল। সে নাকি হাসানকে অপমানিত করেছে! তার বড় কাজটা নাকি কনকের জন্য হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
কনক স্তব্ধ। ভিতরের অঙ্গনে তোলপাড় তার। তার যাপিত জীবনের করিডোরে নিঝুম শীতার্ত তৃষ্ণা।
কত আর এলোমেলো শব্দ মিলিয়ে একটা কারুকাজ করবে, নকশা তুলবে অনুভূতির মিথ্যা মরীচিকায়। ছেলেটাও বড় হতে হতে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে কনক থেকে। বাবা মায়ের দূর্যোগ তারাও টের পাচ্ছে, বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে নিজে নিজেই, কনকের হাত থেকে ছিটকে যাচ্ছে অনন্ত।
নিরবকে মাঝে মাঝে অনেক কিছুই বলতো কনক। ঘরের কথা, রিপনের কথা, সন্তানের কথাও। নিরব আপন বন্ধুর মতো কনকের পাশে থাকতো, বুঝাতো শান্ত হয়ে। আশা ভরসার কথা বলতো। কিন্তু কখনোই নিজের আকুলতা বা কনকের প্রতি তার মনোভাবের কথা মুখ ফুঁটে বলেনি। কনক যদি কিছু মনে করে বসে, নিরবকে দূরে সরিয়ে দেয়? মনে মনে ভয় ছিলো ছেলেটার।
কনক নিজেই জানে না সে কেন কনকের কাছে সমর্পণ করে বসে আছে নিজেকে? এ এক অদ্ভুত বাঁধভাঙা অনুভূতি তার। কনক অবশ্য রিপনের আগ্রহ থেকে উঠে গিয়েছিল অনেক আগেই। সেদিন কনকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল যেদিন কানে এলো রিপনের অফিসের সুন্দরী স্মার্ট পারসোনাল সেক্রেটারী প্রেগন্যান্ট। শুধু কী তাই? এর জন্য রিপনকেই সে দায়ী করছে।
একগাদা ঘুমের ওষুধ খেলো কনক । মনে হলো বেঁচেই গেলো বুঝি নীলকষ্টের শীতল যন্ত্রনা থেকে। না, নিরব তা হতে দেয়নি। নিঃসীম, ঝাপসা প্রান্ত থেকে টেনে তুলে আনলো কনককে । দিনের পর দিন হাসপাতালে কনকের পাশে থেকে প্রাণ জাগালো কনকের নাই হয়ে যাওয়া স্বপ্ন পথে।
এরপর আর পিছে তাকায়নি কনক। তাকানোর মতো পরিস্থিতি ছিলো না, কারন রিপন ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলো।
কিছু ভাবার মতো মাথা তখন কনকের কাজ করেনি আর, নিরব যা বলেছে সে শুধু সায় দিয়েছে। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়ে নিরবের বাড়িয়ে দেয়া হাতটি ধরে নিজের ছায়াকে নিরবের ছায়ার সাথে মিশিয়ে ফেললো রোদেলা দিনটির মিষ্টি গায়ে।