সবে শীত পেরিয়ে বসন্ত এসেছে। নব বসন্তের আমেজে মত্ত রয়েছে সবকিছু। এমনি বসন্তমত্ত বিকেলের স্নিগ্ধ রোদ মেখে শহরের বড় পাকা রাস্তার ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলছে মেহের। নব বসন্তে পাখিরা কোলাহল করছে ডালেডালে। সুমধুরকণ্ঠে কোকিল করছে গান। আকাশের নীলের মাঝে খেলা করছে চড়ুই। বসন্তের দক্ষিণা বাতাস ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে নবমুকুলীত আমের ডাল। সেসব কিছুই চোখে পড়ছে না মেহেরের। সে আপন মনে এগিয়ে চলছে সামনে। তার পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে কত রঙ-বেরঙের গাড়ি; তাতে বসে থাকা কত আবেদনময়ী রমণী, সেদিকে তার খেয়াল নেই। আকাশের সোনালী সূর্যটা পশ্চিমে নেমে গিয়ে লাল রঙ ধারন করেছে সে এগিয়ে চলছে সামনে।
২.
ছোট একটা ঘরের ভেতর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে জেরিন। তার মুখে টেপ লাগানো। এমন অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে প্রথমে ভড়কে যায় সে। তারপর দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। খুব শক্ত করে পিঠমোড়া করে চেয়ারের পেছনের দিকে বাঁধা রয়েছে। সে কয়েকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু বিফল হয় প্রতিবার। তাই অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে চারিপাশ।
তার পাশে আরো একটা চেয়ারে বাঁধা রয়েছে নোমান। তারও হাত-পা বাঁধা। মুখে লাগানো টেপ। একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে চেয়ারে। কোনদিকেই তার খেয়াল নেই মনে হচ্ছে। ঘরে জ্বলতে থাকা ডিমলাইটের হালকা আলোয় তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আসন্ন বিপদের কোনোকিছুই টের পায়নি সে।
নোমানের দিক থেকে মনযোগ সংযত করে আবার হাত-পা খোলার চেষ্টায় মনোযোগী হয় জেরিন। কিন্তু এবারও তার চেষ্টা বিফলে যায়। কিন্তু অবিরাম চেষ্টা করার ফলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে শরীর। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে, আজ ভালোবাসা দিবসের এই দিনে নোমানকে নিয়ে কত প্লান ছিলো তার। প্রথমে একসাথে পাশাপাশি রিকসায় বসে ঘুরবে অনেকটা পথ, তারপর পার্কে গিয়ে কোনো একটা সুন্দর অথচ নির্জন স্থানে পাশাপাশি বসে অনেকটা সময় গল্প করবে দুজন। এরপর বিকেলের স্নিগ্ধ রোদে নদীর ধারে নোমানের কাঁধে মাথা রেখে বসে নদীতে সূর্যের খেলা দেখবে; সন্ধায় পার্টিতে তার বান্ধবীদের সাথে পরিচিত করাবে নোমানকে।
কিন্তু তার কোনোটাই হয়ে উঠলো না। বিকেলে পাশাপাশি বসে বাদাম খেতে খেতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তারপর এখানে বাঁধা অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে। এখন কোথায় আছে? এটা শহরের মাঝে? নাকি শহর থেকে দূরে কোনো এক ফাঁকা মাঠের মাঝে একটি ঘরে? কিছুই বুঝতে পারছে না।
হাত পা না নাড়াতে পারায় নোমানের দিকে ফিরে মুখ দিয়ে শব্দ করে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। তার নিথর দেহটা পড়ে থাকে চেয়ারে।
খুব ভয় করে জেরিনের। সে চোখ বন্ধ করে নিশ্চল বসে থাকার চেষ্টা করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে, অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। বুক ফেটে চিৎকার বের হয়ে আসতে চায়, কিন্তু মুখ আটকা থাকায় ব্যর্থ হয়।
৩.
অনেকক্ষণ হলো সে চোখ বন্ধ করে বসে আছে চেয়ারে। তার পঞ্চইন্দ্রিয় নিস্তেজ হয়ে আছে মনে হচ্ছে। কোনোকিছু বুঝতে পারছে না তারা।
হঠাৎ কিছুক্ষণ পর দরজার বাইরে থেকে শব্দ করে একজন ভেতরে প্রবেশ করে। কালো চেহারার মানুষটিকে দেখেই ভয়ে কুঁকড়ে যায় জেরিন। সে কাঁদতে শুরু করে।
লোকটি দরজা বন্ধ করে ভেতরে এসে পানির ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফেরায় নোমানের। তারপর তাদের মুখ খুলে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে ঠিক সামনে।
অনেক সময় পর মুখ খোলা পেয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে দুজনে। সবকিছু স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এরপর নীরবতা ভেঙে নোমান প্রথমে বলতে শুরু করে।
– আমাদের এখানে এভাবে বেঁধে রেখেছো কেন? কে তুমি?
কালো চেহারার লোকটির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসতে থাকে। এরপর হাসি থামিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে– তোমাদের মাঝে সম্পর্ক কী?
লোকটির পাল্টা প্রশ্নে ভড়কে যায় দুজন। এরপর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে নোমান বলে– আমি আর জেরিন একে অপরকে ভালোবাসি।
নোমানের কথা শুনে আবার হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে– ভালোবাসা! হুহ! ভালোবাসা! এ জগতে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। কিচ্ছু নেই, মায়া বলো ভালোবাসা বলো কিচ্ছু নেই এ জগতে। যা আছে সবই ধোকা; স্বার্থপরতা। এর বাইরে আর কিছুই নাই। আমি তো তোমাদের চোখে কোনো ভালোবাসা দেখছি না; যা দেখছি তা হলো একে অপরের প্রতি মুগ্ধতা, কৌতূহল। তাই যখন তোমরা তোমাদের সমস্ত কৌতূহল মিটিয়ে ফেলবা তখন তোমাদের আর কোনো মুগ্ধতা থাকবে না; আর কোনো ভালোবাসা থাকবে না।
লোকটার কথায় এবার রেগে যায় জেরিন। সে প্রশ্ন করে– কে তুমি? আর কেনই বা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো?
যে কোনো মানুষই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে এ ধরনের প্রশ্ন শুনে দমে যেতে পারে। কিন্তু লোকটার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। সে বলতে শুরু করে– আমার নাম মেহের। এই শহরের কোনো এক অভিজাত এলাকার একটা ডাস্টবিনে আমার জন্ম। ডাস্টবিনে জন্ম বলছি এর কারণ হচ্ছে, আমার বর্তমান বাবা যিনি আমাকে লালন-পালন করেছেন তিনি আমাকে একটা ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পায়।
লোকটা কিছুক্ষণ থামে। তার চোখে মুখে বেদনা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তার মুখ মলিন হয়ে গেছে একেবারে। কিছুক্ষণ আগেও যে চোখে ছিলো রাগ, ক্ষোভ, অভিমান এখন সেটা মুছে সেখানে স্থান নিয়েছে মলিনতা; চোখে লোনা জল। লোকটা আবার শুরু করে– তোমাদের মতো তরুণ-তরুণীর মিথ্যা ভালোবাসার ফসল এই আমি। তাদের আনন্দের জন্যেই বলি হতে হয়েছে আমাকে।
লোকটার কথায় অবাক হয়ে নোমান জিজ্ঞেস করে– কিন্তু আমাদের এভাবে আটকে রেখেছো কেন?
নোমানের প্রশ্নে লোকটার চেহারা বদলাতে থাকে। রাগে চোখ লাল হয়ে ওঠে। সে গর্জন করে বলতে শুরু করে– আজ এই ভালোবাসা দিবসে তোমরা আনন্দ করবে। একসাথে রাত কাটাবে। আর তোমাদের এই আনন্দের বলি হয়ে আরো একটা প্রাণ আসবে পৃথিবীতে। কোনো এক সময় তাকেও হয়তো আমারি মতো কোনো একটা ডাস্টবিনে পাওয়া যাবে। নয়তো কোনো এক গভীর জঙ্গলে পুতে দিবে তাকে। নইলে কোনো খরস্রোতা নদীতে ভাসিয়ে দিবে সাগর পানে। তাইতো? এটাই তো করবে? এছাড়া আর কিই বা করতে পারো তোমরা? কিছুই পারো না করতে। তাই তো আজ এখানে তোমাদের ধরে এনেছি আমি। যাতে তোমাদের কৌতূহল, আনন্দ আর মিথ্যা ভালোবাসার জন্যে নষ্ট না হয় কোনো প্রাণ। আর তোমাদের দ্বারা শিক্ষা দিতে চাই তাদের, যারা মিথ্যা ভালোবাসার নামে নোংরামি করে বেড়ায়।
৪.
সকাল দশটা। প্রতিদিনের মতো আজও কাজে বেরিয়ে পড়ে মেহের। ব্যস্ত শহরে কারো প্রতি মনোযোগ নেই তার। রাস্তার ফুটপাথে ছোট একটা বাচ্চা পত্রিকা বিক্রি করছে। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় হেডলাইন, ভালোবাসা দিবসে একজোড়া তরুণ-তরুণীর খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার। নিচে লেখা, শহরের একটা অভিজাত এলাকার একটা ডাস্টবিন থেকে খন্ড-বিখন্ড লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। খুব নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের। হৃদপিন্ড আর চোখ দুটো টেনে বের করে এনেছে। তাছাড়া আর তেমন কোনো ক্ষত চিহ্ন নেই শরীরে।
মেহের খেয়াল করে না সেদিকে। সে এগোতে থাকে। তার পাশ দিয়ে এগিয়ে চলে ব্যস্ত শহর; শহরের লোকজন। কোনোদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এগিয়ে চলেছে আগামীর পানে।