নীল-অঞ্জনা

নীল-অঞ্জনা

– এই যে ভাইয়া? হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি।
– কী?
– আপনাদের দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।
– তাই বুঝি… কী নাম তোমার ?
– আমার নাম নীল।
– নীল তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমরা স্পিড বোট থেকে নেমে তোমার সাথে কথা বলবো কেমন।

নীল ধানমন্ডি লেকের পারে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে। রোদ বুঁজে গেছে। বিকালের হাওয়া নীলের শরীরে যেন প্রশান্তি বয়ে আনছে। বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার লাল পাপড়ি টুপটাপ করে নীলের মাথার উপর পরছে। আবার লেকের পানিতেও পরছে। বাতাস পাপড়ি গুলোকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

লেকের পানিতে স্পিড বোটে যুবক-যুবতী ও ছোট্ট সোনামণিরা ভেসে বেড়াচ্ছে। রঙ বে-রঙের স্পিড বোট। কোনোটি লাল, কোনোটি হলুদ, কোনোটি আবার কমলা। এই স্পিড বোটগুলি সাইকেলের মতো প্যাডেল করে চালাতে হয়। দুইজনে পাশাপাশি বসে উভয়ই একসাথে প্যাডেল করতে হয়। নীল খেয়াল করছে কিছু বোটে যুবক একাই প্যাডেল করছে কিন্তু যুবতীরা নিশ্চুপ। হতে পারে এই যুবতীরা একটু বেশি আরামপ্রিয়। তারা ভেবেই নেয় যে তাদের বয়ফ্রেন্ড থাকতে তারা কেন কষ্ট করবে। আবার হতে পারে তাদের কষ্ট হবে ভেবে যুবকরা নিজ থেকেই তাদের গালফ্রেন্ডদের প্যাডেল করতে বারণ করেছে। তবে একটু আগে যে যুবক কে নীল “ভাইয়া” সম্বোধন করে কথা বলল, সেই যুবক আর তার গালফ্রেন্ড কিন্তু একসাথে স্পিডবোটের প্যাডেল করছে। তাদের স্পিড বোটটিও দারুণ চলছে। স্পিডবোটের উপর মেয়েটি বসে আছে লাল শাড়ি পরে। কাজলের হালকা ছোঁয়াতে মেয়েটির চোখ বেতফলের মতো দেখাচ্ছে। ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক, কপালেও লাল টিপ। আর ছেলেটি পরেছে জিন্স প্যান্টের উপরে সাদা পাঞ্জাবি। যখন তাদের স্পিডবোট নীলের কাছাকাছি মানে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে আসলো তখন নীল খেয়াল করলো ছেলেটির পাঞ্জাবির বোতামের কাছে একটি দারুণ কারুকাজ করা। নীল ভাবে কিছু কিছু মানুষের জীবনেও এমন ছোট্ট ছোট্ট কারুকাজ থাকে যা এই ছোট্ট জীবনটাকে অনেক বড় করে তোলে।

নীল দূর থেকে তাদের পারস্পরিক কথা বুঝতে না পারলেও মেয়েটি যে কোকিল কণ্ঠের তা বুঝতে বাকি রইলো না। তারা দুজনে বোটের উপর খুনসুটিতে মেতে উঠে। মেয়েটির হাতের রেশমি চুরির শব্দ নীলের কাছে খুব পরিচিত পিয়ানোর সুরের মতো মনে হয়।

কী দারুণ বাতাস বইছে! নীল চোখ বন্ধ করে বাতাসের ঘ্রাণ নেয়। বাতাসে লেকের গাছগুলো শনশন আওয়াজ তোলে। এরই মাঝে একটি কোকিল কুহু… কুহু… রব তুলেছে। বসন্ত বিদায় নিলেও কোকিল কিন্তু এখনো বিদায় নেয়নি। নীল চোখ বন্ধ করেই আছে। গ্রীষ্মের বিকালে লেকের পারে বসে নীল হয়তো আজ হারিয়ে গেছে বসন্তের কোনো মাতাল সমীরণে।

সেই ছেলে আর মেয়েটি বোট থেকে নেমে এসেছে। ধানমণ্ডি লেকে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য ডিঙ্গি বোট ক্লাব ১০০ টাকার বিনিময়ে ৩০ মিনিট সময়ের জন্য প্রত্যেকটি বোট ভাড়া দিয়ে থাকে। এই ৩০ মিনিট যুবক-যুবতীদের কাছে মনে হয় যেন তারা স্বর্গের নদী মন্দাকিনীতে ভেসে বেড়াচ্ছে।

নীল লেকের পানির দিকে মুখ করে বসে আছে। নীলের পিছনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করছে কতো যুবক-যুবতি, শিশু, বৃদ্ধ, বাদামওয়ালা আরো কতো রকমের মানুষ। নীলের সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রূপ নীলকে আজ মাতাল করে তুলেছে।

এরই মধ্যে সেই ছেলে আর মেয়েটি নীলের সামনে এসে দাঁড়ায়। নীল চোখ বন্ধ করে বুক টান করে গলা উঁচিয়ে বসে আছে। ওরা দুজনই নীলকে এভাবে দেখে অবাক হয়। তারা বুঝে উঠতে পারে না নীলের চেতনা ভঙ্গ করবে কিনা। নীল চোখ বন্ধ করেই দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার আগামী দিন। সে দেখতে পায়, এই মন্দাকিনী সে তার অঞ্জনাকে নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে।

ছেলেটি খুব ক্ষীণ কণ্ঠে নীলের নাম ধরে ডাকে ।

নীল চোখ খুলে চমকে উঠে দাড়াই।

“বসো… বসো… উঠতে হবে না। আমরাও একটু তোমার পাশে বসবো”, ছেলেটি বলে।

ওরা দুজনই নীলের দুপাশে বসে।

“এখানে বসে কি করছো নীল?”, ছেলেটি নীলকে প্রশ্ন করে।

“তেমন কিছু নই। এমনি বসে আছি।”, নীল উত্তর দেয়।

ছেলেটি আবার প্রশ্ন করে, “তুমি কোথায় থাকো নীল?”

“ধানমন্ডি নয় নম্বর রোডে”, নীল বলে।

সেই মেয়েটি এবার নীলের দিকে অবাক করা দৃষ্টি রেখে বলে, “তুমি কি তাহলে আমাদের প্রতিবেশী? কারণ আমরাও তো নয় নম্বর রোডে থাকি।”

আসলে ঢাকাতে প্রতিবেশীদের মধ্যে তেমন কারনবশত ছাড়া যোগাযোগ হয় না । বাস্তবিকভাবে সবাই আত্মকেন্দ্রীক। ঠিক সেই জন্যই একজায়গায় থাকা সত্বেও নীল তাদের অপরিচিত।

নীল তাদের নাম জানতে চাইলে, ছেলেটি বলে “ আমি আনন্দ।”

আর মেয়েটি বলে “আমি জয়া।”

“বাহ্ …! দারুণ মিলেছে জয়া-আনন্দ।”, নীল অবাক হয়ে বলে।

নীল আরও বলে, “আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখে এবং আপনাদের সাথে কথা বলে খুব ভাল লাগছে। আচ্ছা আপনাদের মধ্যে অনেক মিল তাইনা?

আনন্দ তখন জয়ার চোখে চোখ রেখে বলে, “নীল, আসলে কারো মধ্যে যদি মিল না থাকে তবে মিলন হয় না।”

জয়া তার আনন্দর মুখে এই কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে মৃদু মৃদু হাসে। মেয়েটি এতো মিষ্টি দেখতে! যেমন ফর্সা গায়ের রং তেমন ছিপছিপে শরীরের গড়ন। মেয়েটি ডান পায়ে পায়েল পরেছে, আর বাম পায়ের হিলের ফিতার পাশ দিয়ে ফুঁটে উঠেছে একটি অ-কমনিয় কালো তিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তার সৌন্দর্যের কাছে গ্রীক পুরাণের দেবী আফ্রেদিতিও হয়তো হার মেনে যাবে।

“ আচ্ছা আপনাদের মধ্যে কখনো ঝগড়া হয় না?”, নীল প্রশ্ন করে।

“বিয়ের আগে পরে দিয়ে সাত বছর একসাথে আছি, তেমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে মনে পরে না।”, আনন্দ উত্তর দেয়।

আনন্দর কথা শুনে নীলের চোখে মুখে হতবাকের চিহ্ন ভেসে ওঠে, বলে “সেকি! এমনতো কখনো শুনি নাই। সবাই তো বলে সম্পর্কের মাঝে নাকি সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি ।”

নীলের কথা শুনে জয়া হাসিতে লুটোপুটি খায়। তখন আনন্দ চোখে চোখে জয়াকে কিছু একটা ইশারা করে।

জয়া তখন হাসিকে জোর করে বাঁধ দিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে বলে, “নীল আমরা কখনো ঝগড়া-বিবাদের কথা মনে রাখি না, দুঃখের মাঝেও আমরা সুখকে খুঁজে নিই।”

“শত দুঃখ্য কষ্টের মাঝেও দুজন-দুজনার পাশে থাকাটাই জীবনের সব থেকে বড় সুখ।”, আনন্দও জয়ার সাথে যোগ করে।

জয়া উঠে গিয়ে দুষ্টুমি করে আনন্দর পিঠে একটা কিল মেরে বলে, “সেই কখন থেকে বড় বড় কথা বলছো। যাও এখন কিছু খাবার কিনে নিয়ে এসো।”

“ও তাইতো, নীলের সাথে আজ প্রথম পরিচয়। কিছুতো খাওয়াতেই হবে।”, আনন্দ এই কথা বলে উঠে যায়।

নীল আর জয়া পাশাপাশি বসে আছে। জয়া আনন্দর চলে যাওয়া দেখছে আর নীল আনমনা হয়ে চেয়ে আছে লেকের পানির দিকে । নীলের এই মুহূর্তে অঞ্জনাকে খুব মনে পড়ছে। কতদিন অঞ্জনার পাশে বসা তো দূরের কথা এক পলক দেখারও সুযোগ পায় না সে।

আনন্দ এর মধ্যে পোলার টু ইন ওয়ান আইসক্রিম নিয়ে আসে। নীল ও জয়া দুজনে উঠে দাঁড়ায়। তিনজনে আইসক্রিম খেতে শুরু করে। আনন্দ সবাইকে নিয়ে সেলফি তোলে । বাতাসে জয়ার মাথার কালো চুল উড়ে এসে আনন্দর মুখে পরশ বুলিয়ে যায়। চারিদিকে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। লাল কৃষ্ণচূড়া কালো রঙের দেখায়। লেকের পানিতে সোডিয়াম লাইটের আলো পরে ঝিকমিক করতে থাকে। মসজিদ থেকে ঈশার আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। নীল দুচোখ বন্ধ করে আছে। সে কল্পনাই তার অঞ্জনাকে দেখছে। অঞ্জনা লেকের অপর পারে লাল শাড়ী পরে দাঁড়িয়ে নীলকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নীল-অঞ্জনা দুজন দুজনার চোখে চোখ রেখে দুজন দুজনার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে…!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত