ডাঙ্গায় ডলফিন

ডাঙ্গায় ডলফিন

অভিষেক ডুবে যায়।

ছোটবেলায় সে একবার মামা বাড়ির পুকুরে ডুবতে ডুবতে বেঁচে গিয়েছিল। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। চলন বিলে বর্ষার পানি নেমে গিয়েছে কদিন আগেই। পাড়ার ছেলেদের সাথে সেই কাদা মাখা পানিতে চলেছে মাছ ধরার খেলা। স্যার পড়াতে আসবেন বলে চয়ন ভাই আগেই উঠে এসেছেন । অভিষেক ফেরার পথে টের পায় সারা শরীর তার কাদায় ভরে গেছে। বাড়িতে গেলে নির্ঘাত মার বকুনি ঠেকানো যাবে না। ভাবলো, পুকুর ঘাটে সিঁড়ির কাছেই নেমে একটা ডুব দিয়ে কাদা ছড়িয়ে তবেই যাবে। ঢাকা থেকে মামা বাড়িতে বেড়াতে আসা অভিষেক তখনো সাঁতার শিখেনি। হয়তো বা পুকুর ঘাটের সিঁড়ি থেকে একটু দূরেই চলে গিয়েছিলো অসাবধানে। হঠাৎ মনে হলো পা পিছলে গেছে। ডুব দিয়ে আর উপরে উঠতে পারছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন নিজেকে আবিষ্কার করেছে মামা বাড়ির উঠোনে। মায়ের কোলে মাথা। ভাগ্যিস মিজান মিস্ত্রী অজু করতে পুকুর ঘাটে এসেছিল!

অভিষেক আজো ডুবে যাচ্ছে। ভিন্ন রকম ডুবে যাওয়া। কনিকা ঘুমিয়ে গেছে ন’টা না বাজতেই। শীতের রাত বলে কথা! চুমকির পরীক্ষা শেষ। খালার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। আমিনা ঘর-দোর গুছিয়ে কিচেনের মেঝে শুয়ে পড়েছে মশারি খাটিয়ে। একবার ডেকেছিল।

খালু, খাইবেন না?

আমি খাবো না। পেটে খিদে নেই। তুই ঘর গুছিয়ে শুয়ে পড়।

রাত এখন একটা। অভিষেক গিলেই চলেছে। ব্লাডিমেরী। যাত্রা বিপরীতমুখী হলেও ফল একই। খুব আনন্দ আর ভীষণ বেদনা দুটোতেই তার পরম বন্ধু ব্লাডিমেরী। অভিষেক ইদানিং ডুবতে বড় বেশি ভালোবাসে। সে কিছুতেই সামান্য আনন্দ পায় না, সামান্য দুঃখ পায় না। তার হর্ষ আর বিষাদ দুই-ই অসামান্য, গভীর। বর্ণালীর কথা মনে পড়ে যায়। অভিষেকের নাম দিয়েছিল ‘ম্যাগনেফায়িং গ্লাস’। সে নাকি সব ছোট জিনিসকেই বড় করে দেখে। অন্যের কাছে যা সামান্য কষ্ট তার কাছে তা এক পৃথিবীর বিষাদ। অন্যের কাছে যা হয়তো ঠোঁটের কোণে নিয়ে আসে এক চিলতে হাসি অভিষেকের কাছে তা আনন্দের বন্যা। কী করবে সে! মানুষ কি নিজেকে বদলাতে পারে!

ব্লাডিমেরীর স্রোতে বিষাদের অতলে ডুবতে থাকে সে। বর্ণালীর কথা ভাবে। শুধু কি ম্যাগনেফায়িং গ্লাস! সে তো উত্তল কাঁচ। শুধু একটু আলোর ছটা পেলে ঘনীভূত করে আগুন ধরাতে পারে অবলীলায়। সে আগুনে বর্ণালী কী সুন্দর শুভ্রতায়ই না জ্বলে উঠেছিল। সে কতকাল আগের কথা! বর্ণালী বলতো ওটা নাকি মায়া। অভিষেকের কাছে তা প্রেমেরও অধিক। বর্ণালীর একটা চুমুর জন্য সে সারা পৃথিবী বাজি রাখতে পারতো। এখনো পারবে। সেই মেয়েটাই কিনা একদিন…

প্রথম চুমুর কথা মনে পড়ে। বর্ণালী বলেছিল, “জানো আমি কোনো কিছুতেই তেমন কষ্ট পাই না। আমি কষ্ট পাই কেবল তোমার কষ্ট পাওয়া দেখে। আর তুমি তো সব কিছুতেই কষ্ট পাও। তোমার কষ্টে কষ্ট পাওয়া মানে এখন আমার সব কিছুতেই কষ্ট পাওয়া।” বলেই সশব্দে হেসে উঠেছিল। তারপর অভিষেক কিছু বুঝে উঠার আগেই খুব আলতো করে একটা চুমু খেয়েছিল ঠোঁটে। পৃথিবী কী সত্যি এতো মধুর! অভিষেকের জানা ছিলো না। বর্ণালী একটুও লজ্জা পায়নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। যেনো তারা গুনছে। তারপর চোখে এলো বৃষ্টির ধারা। এবারে অভিষেকের পালা। চুমু খেতে গিয়ে বর্ণালীর চোখের নোনতা জলে তার ঠোঁট ভিজে গেল। চুপচাপ কেটে গেছে অনেকটা সময়। নিরবতা ভেঙ্গে বর্ণালী বলেছিল, “তোমার মতো এতো কোমল মনের একটা মানুষ এতো কঠিন এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে কেমন করে তা ভাবতেই আমার অবাক লাগে।” সীমার বিয়ে হয়ে যাবার পর জুয়েলের উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে অভিষেক মনে খারাপ করে ছিলো অনেক দিন। করিম স্যারের ছোট ছেলেটা যখন নিউমোনিয়ায় মারা যায় তখন নিজেই বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেছে, যেনো তার নিজের সন্তান। রাস্তায় কোনো পকেটমারকে বা ছিঁছকে চোরকে মার খেতে দেখলেও তার এমনি কষ্ট হয়। সত্যিই তো পৃথিবীর সব কিছুতেই অভিষেকের কষ্ট হয়। আর কেউ খেয়াল না করলেও বর্ণালী ঠিকই খেয়াল করেছে। এই মেয়েটাকে ছাড়া সে কীভাবে বেঁচে থাকবে!

অথচ বর্ণালীকে ছাড়াই সে দিব্যি বেঁচে আছে। হয়তো জীবন্মৃত। তার স্ত্রী-সন্তান, বিত্ত-বেসাত, সামাজিক প্রতিপত্তি সবই আছে ভালোভাবে চলে যাওয়ার মতো। কিন্তু আবার কিছুই নেই। বিয়ের এতো বছর পরও কনিকা আর সে নিজেদের আলাদা আলাদা বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারেনি। দুজন রয়ে গেছে দুই জগতের মানুষ। অভিষেকের প্রতিটি রোমকূপ আবেগে ভরা। প্রেমে, আবেগে, যৌনতায়, চায়ের কাপে, আড্ডায়, বিছানায় সর্বত্রই সর্বগ্রাসী। চল্লিশ পেরিয়েও কৈশোরের উদ্দামতায় ছেদ পড়েনি একটুও। এখনো আগের মতোই অল্প আনন্দে আত্মহারা হয়, অল্পতেই কষ্ট পায়। চুমকি বান্ধবীদের সাথে বসুন্ধরায় বেড়াতে যেতে চাইলে বারণ করে। কিন্তু ওর মন খারাপ দেখলে কষ্টও পায়। অফিসের পিয়নটার মা মারা গেলে কষ্ট পায়। ক্যাশিয়ার কামালকে সাসপেন্ড করেছে পরপর দুইবার টাকা চুরিতে ধরা পড়ার পর। কিন্তু নিজেই আবার কষ্ট পেয়েছে। ছেলেটা যে বউ বাচ্চা নিয়ে উপোস করবে। মুচলেকা দিয়ে ফিরে আসতে বলেছে।

কনিকাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু বর্ণালীকে ভুলতে পারে না। প্রত্যেকটা ভালোবাসাই কি আলাদা! বর্ণালীর প্রতি ভালোবাসায় ছিল উদ্দাম আবেগ, কনিকার প্রতি ভালোবাসায় সৌম্য স্নিগ্ধতা।

কনিকার ভালোবাসা আর আনুগত্যেও কোনো খাঁদ নেই। কিন্তু তার কাছে ভালোবাসা মানে আনুগত্য, স্বামী আর কন্যার যত্ন নেয়া, ছুটির দিনে মজার কিছু রান্না করে খাওয়ানো, গুছিয়ে সংসার করা আর অভিষেকের জন্মদিনে ফুল কিনে দেয়া, এটুকুই। অভিষেকের তাতে স্বাদ মেটে না। সে চায় অফিস থেকে ফিরে দেখবে কনিকা সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে খোঁপায় বেলী ফুলের মালা পড়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। দুজনে একসাথে চা খাবে। সিডিতে বাজবে ‘আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি সেথায় চরন পড়ে তোমার…’ কিংবা ‘দেয়ালেও রাখিনিগো রাখিনি অ্যালবামে…’। সে চায় কনিকার মনের ভালোবাসা শরীরেও উদ্ভাসিত হোক। প্রতি রাতেই তাকে চুমুতে ভরিয়ে দিক, বর্ণালীকে ভুলিয়ে দিক। সে চায় ক্লাব, আড্ডা, রেস্তোঁরা বা অফিসে রাতভর কাজ নয়, কনিকার টানে প্রতি সন্ধ্যায়ই ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু কনিকা তাকে টানতে পারে না। সপ্তাহে দুই কি এক রাত বিবস্ত্র হতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু তাই বলে প্রতিদিন চুমু খাওয়া, দুজনে মিলে চাঁদ দেখা, জড়িয়ে ধরে পাশাপাশি বসে থাকা, রাত জেগে কখনো গান শোনা, কখনো খুনসুটি করা, কখনো এডাল্ট মুভি দেখা! সংসারে আর কি কোনো কাজ নেই! অভিষেকের এই সব চাওয়া কনিকার আদিখ্যেতা মনে হয়।

অনেক তো বয়স হলো। আর কতো! দুদিন বাদে তো মেয়ের বিয়ে দেবে।

মেয়ের বিয়ে দিয়ে বাবারা কি পুরুষত্বহীন হয়ে যায়?

বাদ দাও ওসব কথা। আমার ভালো লাগে না। আল্লাহ খোদার নাম নিলেও তো পারো।

অভিষেক জানে কনিকার কোনো দোষ নেই। মানুষ কি চাইলেই বদলাতে পারে! সে তো তাকে ভালোবাসে তার নিজের মতো করে। অভিষেক সেই ভালোবাসায় আনুগত্য খুঁজে পায়, কর্তব্যবোধ খুঁজে পায়, মমতা খুঁজে পায়, আস্থা খুঁজে পায়। কিন্তু প্রেম খুঁজে পায় না। সে প্রেম মিস করে। অথচ প্রেমের চেয়ে প্রিয় তার কাছে কিছু নেই। কনিকার পড়নে সোনালী শাড়ি নেই, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা নেই। কনিকা তাকে টানতে পারে না। তাকে টানে অফিসের রাত জাগা কাজ, ওভারসীজ ক্লায়েন্টের ফোন কল, ক্লাব, গলফ আর ব্লাডিমেরী।

আজ কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছো। চলো আজ যমুনা সেতু পর্যন্ত ড্রাইভ করে আসি। ঈদের ছুটি সেরে মানুষ এখনো ঢাকায় ফেরেনি। রাস্তা বেশ খালি।

তোমার কী যে আজেবাজে ভাবনা। আমার টায়ার্ড লাগছে। একটু পরই ঘুমিয়ে পড়বো। বিকেলে রেশমা আপার সাথে শপিংয়ে গিয়ে পা ব্যথা হয়ে আছে।

তাতে কী! আমরা তো গাড়িতে যাবো। দুটো নাপা খেয়ে নিও। কতোদিন ড্রাইভ করতে করতে তোমার গান শুনি না।

রাখো তোমার রোমান্টিসিজম। আমি পারবো না। আমার ভালো লাগছেনা এই সব।

অভিষেক আর কথা বাড়ায় না। বোতল আর গ্লাস নিয়ে বসে। কনিকা ঘুমিয়ে পড়ে খানিক বাদেই। অভিষেক ডুবে যায়। সে ডুবতে থাকে বিষাদের অতলে।

দুই.

আজো কি ঘুমাতে দেরি হবে তোমার?

হ্যাঁ। আগামী সপ্তাহে একটা কনফারেন্স আছে। একটা পেপার প্রেজেন্ট করতে হবে। ওটা প্রিপেয়ার করছি কদিন ধরে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তন্দ্রা উঠে যায়। আজো সে একাই ঘুমাবে। হয়তো এপাশ ওপাশ করবে অনেকক্ষণ। হয়তো উঠে ভ্যালিয়াম খেতে হবে। মঈন আসবে মাঝ রাতের পর। পা টিপে টিপে এসে গুটি শুটি হয়ে পাশে শুয়ে পড়বে। দুমিনিটের মধ্যেই পাওয়া যাবে নাক ডাকার শব্দ। সেই শব্দে কখনো তন্দ্রার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আর ঘুম আসেনা সকাল অবধি। সব সময় এমন হয় তা নয়। ইউনিভার্সিটির সেমিস্টারের চাপ না থাকলে অথবা পরীক্ষা নেয়া কিংবা ডিপার্টমেন্টাল কনফারেন্স না থাকলে মঈন একেবারে সুবোধ বালক। বাসায় ফিরে ফ্রেস হয়ে ডিনার। তার পর কিছুক্ষন টিভির সামনে বসে থাকা। জেনিফার আর জেসমিনের পড়ার খোঁজ খবর করা। ন’টার সংবাদ দেখে বিছানায়। ইচ্ছে হলে সপ্তাহ কিংবা দুসপ্তাহে একবার লাঙ্গলের ফলায় উর্বরা ভূমিতে অভিযানে নামা। কোনো প্রস্তুতি নেই, পূর্বরাগ নেই। কেবলি ঝাঁপিয়ে পড়া। তন্দ্রা হাঁপিয়ে উঠেছে। তার রীতিমতো এভারশান হয়, কামশীতলতা।

তন্দ্রার স্বপ্ন ছিলো আকাশ জোড়া। বিয়ের সময় মঈন অষ্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি শেষ করেছে। ফিরে গিয়েই ডিপার্টমেন্টে জয়েন করবে। ইমিগ্রেশন হয়ে যাচ্ছে। দেখতে রাজপুত্রের মতো সুন্দর। কথাবার্তায় স্মার্ট। দেখে আর এক বেলা কথা বলে মনে হয়েছিল এই ছেলে অরন্যকে ভুলিয়ে দিতে পারবে। রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। রোমান্সেও নিশ্চয়ই পারদর্শী হবে। এক দিনেই কি সব কিছু পরখ করা যায়! হয়তো এমন একজনকেই তার চায়। অরন্য যেদিন ওকে ছেড়ে মৃত্তিকাকে বিয়ে করে সেদিন তন্দ্রা অঝোরে কেঁদেছিল। মঈনকে নিয়ে তন্দ্রা সেই কান্না ভুলে যাবে।

ভুল ভাঙ্গতে দেরি হয়নি বেশি দিন। মেলবোর্নে এসে মনে হলো সে কি এমন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের জীবন চেয়েছিলো? বন্ধুত্ব, প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক, সামাজিকতা, ছুটির দিনের দাওয়াত সব কিছুই যান্ত্রিক। সারাদিন একাকী বাসায়। মঈন ইউনিভার্সিটিতে। তখনো জেনিফার আর জেসমিনের জন্ম হয়নি। সারাটা দিন তার কীভাবে কাটে! মঈন সুদর্শন এবং স্মার্ট। কিন্তু আবেগহীন রোবট। ক্লাশ, রিসার্চ আর টিউটোরিয়াল ছাড়া কিছুই বোঝে না। তন্দ্রা সারাদিন উন্মুখ হয়ে থাকে। মঈন বাসায় ফিরলে সন্ধ্যায় দুজনে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চা খাবে এক সাথে। মঈনকে কবিতা পড়ে শোনাবে। মঈন ওর চুলে বিলি কেটে দেবে। ডিনার শেষে দুজন এক সাথে বসে গান শুনবে বা টিভি দেখবে। খুনসুটি করতে করতে কোনোদিন হয়তো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাবে। আবার কোনোদিন হয়তো বিছানায় উঠাবে উদ্দাম ঝড়।

কিন্তু তন্দ্রার স্বপ্ন তন্দ্রাচ্ছন্নই থেকে গেছে, বাস্তবায়িত হয়নি তেমন। মঈন ইউনিভার্সিটি থেকে এসে বই আর জার্নাল নিয়ে বসে। তন্দ্রা টিভি দেখে, বাংলাদেশি দোকান থেকে আনা নাটক বা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখে, গান শুনে। তারপর অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। যেদিন মঈনের ইচ্ছে হতো সেদিন ঘুম থেকে জাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো। তাও আস্তে আস্তে কমে এসেছে। এখন মাসে বড় জোড় দুই তিন রাত। এই আরোপিত যৌনতা তন্দ্রার ভালো লাগে না। প্রেমহীন মনে হয়। হয়তো মঈনের কাছে এটাই প্রেম, এটাই দাম্পত্য ভালোবাসা।

তাই বলে মঈন কেয়ারিং না এমন অভিযোগ করতে পারে না তন্দ্রা। শাড়ি, গহনার সাধ্য মতো কোন অভাব রাখেনি। ছুটিতে দুএকবার এদিক সেদিক বেড়াতেও নিয়ে গেছে। ওর কখনো শরীর খারাপ হলে ছুটি নিয়ে এসে বাসার কাজে এমনকি রান্নার কাজেও সাহায্য করে। মঈনের অন্য সহকর্মীদের স্ত্রীরা কিংবা অন্যান্য বাঙালি মেয়েরা এখানে সেখানে ছোটখাটো চাকরি করলেও তন্দ্রাকে সে কোথাও চাকরি করতে দেয়নি। তন্দ্রার একবার ইচ্ছে হয়েছিল বাসায় ফ্যামিলি ডে-কেয়ার করবে। অনেকেই তো অফিসের সময়ে বাসায় কর্মজীবিদের দুএকটা বাচ্চা রেখে সময় কাটাচ্ছে আবার কিছু কামিয়েও নিচ্ছে। খারাপ লাগবেনা। একাকীত্বও কাটবে। মঈন রাজি হয়নি। বলেছে, “আমার এতো টাকার দরকার নেই। তোমার যা লাগে আমিইতো কিনি দিচ্ছি। আমার বউ অন্য মানুষের বাচ্চার ন্যাপি চেঞ্জ করবে তা কেন হবে! তার চেয়ে নিজের বাচ্চার ন্যাপি চেঞ্জের জন্য রেডি হও।”

আমি কি মেশিন, বললেই রেডি হয়ে যাবো? তুমি তো আমাকে কখনোই রেডি করো না।

রেডি করা আবার কী জিনিস! মেয়েরা তো সব সময় রেডিই থাকে।

তুমি আমার কচু জানো। প্লেজার দিতেও জানো না, নিতেও জানো না।

মানে কী?

মানে হচ্ছে তুমি আমাকে পণ্য মনে করো। আমার নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হয়। তোমার আসলে কোনো থেরাপিস্টের কাছে যাওয়া দরকার।

আমি কেন থেরাপিস্টের কাছে যাবো? আমার তো কোনো প্রোবলেম নেই। তোমার প্রোবলেম হলে তুমি যাও। তোমরা মেয়েরা সত্যি কমপ্লিকেটেড।

তন্দ্রার মন খারাপ হয়ে যায়। পুরোনো কথা মনে পড়ে। বিয়ের পর একদিন মঈনকে বলেছিল, “জানো, আমি হচ্ছি ডলফিন। তোমাকেও ডলফিন বানাতে চাই।” বলেই ভুবনমোহিনী হাসি। সে যতোই রোবট হোক এই হাসি মঈনেরও বুকের বাঁ পাশে ঝড় তোলে।

ডলফিন! সে আবার কী?

ডলফিন হচ্ছে প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে রোমান্টিক। আর সবচেয়ে সেক্স ক্রেজি। তুমি জানো না বুঝি?

আমি জানবো কোত্থেকে, আমি কি জুলজিস্ট?

একদিন মেলবোর্ন এক্যুরিয়ামে গিয়ে প্রথমবারের মতো ডলফিন দেখেছিল তন্দ্রা। কেন যেন প্রাণীটার প্রতি তার আগ্রহ জন্মে যায়। বাসায় ফিরে গুগুল করে ডলফিনের জীবনচক্র আর আচরন বিধি নিয়ে পড়তে থাকে। আগে জানা ছিল না। প্রাণীদের মধ্যে ডলফিল নাকি সবচেয়ে বেশি রোমান্টিক। দিনে একাধিকবার মিলিত হওয়া তাদের স্বভাব। ডলফিনের মধ্যে প্রেমভাব ভীষণ তীব্র। ফ্যাসিনেটিং। তন্দ্রা নিজেকে ডলফিন ভাবতে চায়। চায় না তার বোরিং এবং অন্তরীণ মানব জীবন। আহা যদি ডলফিনের জীবন হতো! রোমান্সের জন্য সে ডলফিন হতেও রাজি।

প্রিন্ট করে ডলফিন সংক্রান্ত তথ্যগুলো মঈনের হাতে দিলো।

ডলফিনের কাছ থেকে শিখো। তুমি তো আবার রেফারেন্স ছাড়া কিছুই এক্সেপ্ট করো না। তাই রেফারেন্স প্রিন্ট করেছি। চলো আমরা ডলফিন হই। প্লিজ!

প্রিন্ট করা কাগজগুলোর উপর অনাগ্রহে চোখ বুলায় মঈন।

তুমি সত্যি পাগল হয়ে গেছো। তুমি একটা পারভার্ট। তোমার সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট দরকার।

আর তুমি? তুমি একটা ফ্রিজিড। নপুংসক। হার্টলেস রোবট। ভেবেছো বউকে দুবেলা খাওয়ালে আর শাড়ি গহনা কিনে দিলেই তাদের উপর যখন খুশি ঝাঁপিয়ে পড়ার অধিকার জন্মে যায়? আমাকে বিয়ে না করে তো বই আর জার্নালকে বিয়ে করলেই পারতে।

বিয়ের আগে তো জানতাম না যে তোমার এমন খাইখাই ভাব। আমিতো একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি। কোনো ডলফিনকে বিয়ে করিনি। তুমি সত্যিই সিক।

তন্দ্রা কথা বাড়ায় না। কী হবে রোবটের সাথে কথা বলে! তার চিবুক ভিজে যায় জলে।

তারপর জীবন চলেছে গড্ডালিকা প্রবাহে। মঈনকে বদলাতে পারেনি সে। বরং ধীরে ধীরে নিজের ডলফিন সত্ত্বার মৃত্যুই মেনে নিয়েছে। এর মধ্যে জেনিফার আর জেসমিনের জন্ম হয়েছে। তন্দ্রার মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা যেন একাত্তরের যুদ্ধ-শিশু। কিংবা কোনো এক অনিচ্ছুক পরিচারিকার গর্ভে জন্ম নেয়া জমিদার কন্যা। নিজেকে বড় বেশি তুচ্ছ মনে হয় তার। এমন মানব জীবন সে চায়নি।

পরক্ষণেই তার মঈনের জন্য মায়া হয়। কী যা তা ভাবছে! ওর কী দোষ? মানুষ কী তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে কখনো? নিজেদের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের উপর গ্যে আর লেসবিয়ানদের যেমন হাত নেই, ওরা যেমন প্রকৃতির খেয়ালে গ্যে আর লেসবিয়ান হয়ে উঠে ঠিক তেমনি কারো কারো প্রেমশীতলতা থাকে। কর্তব্য, দায়িত্ববোধ আর আবশ্যিক যৌনতাকেই তারা প্রেমের সমার্থক বলে ভুল করে। তাদের কী দোষ! প্রকৃতি যদি তাদের বদলে না দেয়, অন্য মানুষ তাদের বদলাবে কীভাবে?

তার নিজেরই বা কী দোষ! প্রকৃতি তাকে ডলফিনের স্বভাব না দিলেই পারতো। যদি কোনোদিন সৃষ্টিকর্তার সাথে দেখা হয় শাস্তি যা হয় হোক, তন্দ্রা তাকে শো-কজ না করে ছাড়বে না।

মঈন স্টাডি রুমে কনফারেন্স পেপার প্রিপেয়ার করছে। আর তন্দ্রা বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। মাঝ রাত পার হয়ে গেলে মঈন ঘুমাতে আসবে। এসেই নাক ডাকবে। এভাবে কতো রাত যে চলে গেছে। তন্দ্রার চোখ ভিজে যায়। মানুষ তো একবারই জন্মগ্রহণ করে। তন্দ্রার ডলফিন কী মরেই যাবে? এই জীবনে তার ডলফিন সাগরে ভাসতে পারে না। আহা, যদি আরেকবার জীবন পাওয়া যেতো! সাগরের জীবনই বেছে নিতো।

স্টাডি রুমে মঈন পাওয়ার পয়েন্টে প্রেজেন্টেশন তৈরি করছে কনফারেন্সের জন্য। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে তন্দ্রা। ঘুম আসছে না কিছুতেই। একবার ভাবে মেয়েদের রুমে গিয়ে ওদের একজনের পাশে শুয়ে থাকবে। কিন্তু ও যদি এপাশ ওপাশ করতে থাকে তাহলে তো ওদেরও ঘুম ভেঙ্গে যাবে। তার চেয়ে লিভিং রুমে এসে টিভি ছেড়ে দেয়াই ভালো।

তিন.

তন্দ্রার শব্দ পেয়ে মঈন স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

কী তুমি ঘুমাও নি?

না। ঘুম আসছে না।

শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

না। শরীর ভালোই আছে। এমনিতেই ঘুম আসছে না। আর শরীর খারাপ হলেই বা কী! তুমি তোমার কাজে যাও।

মঈন কথা না বাড়িয়ে স্টাডি রুমে ফিরে যায়।

টিভি চলছে। কিন্তু তন্দ্রার মন নেই টিভির পর্দায়। টিভি বন্ধ করে লো ভলিয়্যুমে নজরুল সঙ্গীতের সিডি ছেড়ে দেয়। ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে… নিরজনে প্রভু নিরজনে…’

প্রভু নিরজনে খেলেন। তার লীলা বোঝা দায়। মেলবোর্নের ক্লেইটনে ডলফিনের ক্ষুধা নিয়ে তন্দ্রা জেগে থাকে। আট হাজার আটশ’ পঁচানব্বই কিলোমিটার দূরে ঢাকার ধানমন্ডিতে ডলফিনের অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে ব্লাডিমেরীর বিষাদে ডুবে অভিষেক। দুজনের দেখা হয় না। দুজনের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রথম দিনগুলো কেটেছে ঢাকা আর জেলা শহর মাদারীপুর মিলিয়ে। কখনো দেখা হয়নি। আজতো পৃথিবীর দুই প্রান্তে। তাদের কখনো কী দেখা হবে না? পৃথিবী কি এতোই বড়?

ঢাকায় রাত একটা। মেলবোর্নে ভোর পাঁচটা। কনিকা আর মঈন অঘোরে ঘুমায়। ওদেরও কখনো দেখা হয় না।

অভিষেকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রচন্ড বমি বমি লাগছে। পাকস্থলীতে ব্লাডিমেরীর বিদ্রোহ। সে বাথরুমে বমি করতে যায়। তন্দ্রার তলপেটে চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়। রক্তপাত শুরু হবে। বাথরুমে গিয়ে ট্যামপন পরে নিতে হবে।

ডাঙ্গায় ডলফিন ছটফট করে। প্রভু খেলে যান নিরজনে, এ বিশ্ব লয়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত