লুকোচুরি

লুকোচুরি

“সেদিনও দেখলাম লিচুতলায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন ছাত্রকে জ্ঞান দিচ্ছেন। আচ্ছা, দেশটা কি আপনার একার? এত চিন্তা কেন আপনার দেশের জন্য? নিজের জন্য একটু ভাবলেও তো পারেন। যবে থেকে দেখছি সেই দুটো ফতুয়া, মোটা ফ্রেমের সেই আতেল মার্কা চশমা আর জুতোজোড়া যে ক’বছর হয়েছে কে জানে। নিজের টিউশনির টাকা খরচ করে লিফলেট বানিয়ে মানুষের কাছে বিলি করে আপনি দেশের কি উপকারটা করছেন, শুনি? অফহোয়াইট কালারের প্যান্টটা আর পরবেন না। গোড়ালির কাছে অনেকটা ছিঁড়ে গেছে। তা দেখে আমার চোখে অশ্রু জমা হলেই বা আপনার কি এসে যায়। –শ্যামলতা”

একটা ফুলের তোড়া, একটা ফতুয়া, একটা প্যান্ট আর সাথে এই চিঠি। কেউ একজন মেসে সাবকাতের নাম করে দিয়ে গেছে। কে দিল এগুলো? চিঠিতে থাকতে পারে ভেবে তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল। পড়া শেষে বোকা বনে গেল সে। আশ্চর্য এক চিঠি! সারাদিন এই আজব চিঠিটার কথা ভেবেই চলে গেল সাবকাতের। কোন হদিস পেল না। সে মেয়েদের সাথে খুব কম মেশে আর যাদের সাথে মেশে তাদের মধ্যে থেকে এমন কাউকে খুঁজে পেল না যে এমন চিঠি লিখতে পারে। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আবার সে তার নিজের কাজে লেগে পড়ল। কয়েকদিন পর আবার সেই আজব চিঠি। এবারে অনেক চোট করে লেখা

“এত মাথা নিচু করে হাঁটেন কেন? সামনে পিছনে কে আসছে যাচ্ছে একটু চোখ তুলে তাকালে বুঝি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? এমন মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে যেদিন কোনোকিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে হাত-পা ভাঙবে সেদিন মজা বুঝবেন। – শ্যামলতা”

কয়েকদিন পর আবার এলো সেই চিঠি। এই চিঠিতে সাবকাতের বান্ধবী লিনার বিষয়ে লেখা। কথাগুলো ছিল এমন– “অই লিনা নামের মেয়েটার সাথে আপনার এত কিসের ভাব? সে কেন কথা বলতে বলতে আপনার গায়ে ঢলে পড়ে? একটু না হয় সে ফর্সা, তাতে কী? আমিও কম যাই নাকি! একটু শ্যামা, তবে আমার চুল আর চোখ দেখে কত ছেলে প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছে জানেন! ওকে যেন আর আপনার ধারে কাছেও না দেখি। না হলে আমার লম্বা চুলের গোছা আপনার মুখে গুঁজে দিব। শুনুন, রাগ করেছি জন্য মুখ গোমড়া করে থাকবেন না যেন। – শ্যামলতা”

সাবকাতের মনটা আজ ভীষণ খারাপ ছিল। তাদের ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের একটা মেয়ে তাকে আজ একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে অপমান করল। সাবকাত কি জানতো নাকি মেয়েটা অমন ঝগড়ুটে! সে ভেবেছিল অন্য সবার মতো এই মেয়েটাও তার নোট ফলো করে তাই রিমঝিমের সাথে কথা বলতে বলতে ওই মেয়েটাকেও বলেছিল– “কোনো জায়গায় বুঝতে সমস্যা হলে সংকোচ না করে বল, বুঝিয়ে দেব।” এম্মাহ মেয়ের কথার কি ঝাঁঝ!

“আপনি কি নিজেকে বিদ্যাসাগর বা আইনস্টাইন ভাবেন? কী মনে করেছেন, আপনি একাই মেধাবী? আর বাকি সবাই মাথায় গোবর নিয়ে ঘোরে?”

সাবকাত ঘটনাচক্রে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। এই ধানি লঙ্কাটা এতদিন কোথায় ছিল? সে মিনমিন করে বলল, “আসলে রিমঝিমের সাথে তোমাকে দেখে মনে করেছিলাম তুমিও…”

সাবকাত কথা শেষ করতে পারেনি। ওই ঝগড়াটে মেয়েটা আবার তেতে উঠল, “কি মনে করেছিলেন? আমি অন্যসব হ্যাংলা মেয়েদের মত পড়া বুঝে নেওয়ার ছলে আপনার গায়ে ঢলে পড়ব? আর আপনি গোবেচারার মত মুখ করে তা উপভোগ করবেন?”

সাবকাত অসহায় দৃষ্টিতে রিমঝিমের দিকে তাকায়। রিমঝিম তাকে প্রথম থেকেই এমন করতে মানা করছিল। এবার সে অনেকটা জোর করেই সেই মেয়েটাকে টেনে নিয়ে গেল। রিমঝিমের কথা শুনে সাবকাত বুঝতে পারল মেয়েটার নাম প্রত্যাশা। মেয়েটা আর রিমঝিম চলে যাওয়ার পর সাবকাত চারদিকে খুব সাবধানে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিল কতজন এই দৃশ্যটা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। তবে আশার বাণী এই যে সাবকাতের পরিচিত কেউ দেখেনি। আর যারা আশপাশে আছে তারাও যে খুব গুরুত্ব দিয়েছে এমনটাও মনে হল না তার। এখন অহরহ যত দুর্ঘটনা ঘটছে, তাতে কে কাকে বকা দিল না দিল তাতে কার কি এসে যায়। কাঁচুমাচু মুখ করে ক্যাম্পাস ছেড়েছিল সাবকাত কিন্তু মেসে এসেই মনটা ভালো হয়ে গেল তার। কিন্তু কেন? সে তো এই চিঠিটাকে আপদ ভেবেই আসছে সবসময়। এটা কখন তার অভ্যাসে পরিণত হল? কিন্তু এই শ্যামলতাকে সে কোথায় খুঁজবে? কিভাবে দেখা পাবে তার? তবে হাল ছাড়ল না সে। লিনাকেও বলল ব্যাপারটা। লিনা তো হেসেই খুন। আরো কয়েকজন বন্ধুকে দেখালো চিঠিগুলো। হাতের লেখায় যদি মিল খুজে পাওয়া যায় তাহলেও হয়তো বের করা সম্ভব। এর মধ্যে আবারো এল সেই কাঙ্ক্ষিত চিঠি।

“মাঝে মাঝে আপনার কাঁধে মাথা রেখে ভরা জ্যোৎস্না রাতের পূর্ণিমা চাঁদটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আপনি আমায় একটুও বোঝেন না। আমি না হয় একটু পাগলাটে, আপনার সাথেই তো শুধু পাগলামি করি। কেন বোঝেন না আপনি? আর আপনার ওই বান্ধবী লিনাকে কেন আমাদের চিঠিগুলো দেখিয়েছেন? তার কি সাধ্য আছে আমাকে খুজে বের করার! আর কোনো চিঠি তাকে দেখালে চিরকালের জন্য আঁড়ি বাঁধবো আপনার সাথে। কথাটা মনে রাখবেন। বিঃ দ্রঃ আমি কিন্তু খুব অভিমানী। মনে রাখবেন।”

সাবকাত ভেবে কূলকিনারা পায় না। এই মেয়ে তার আশেপাশেই চলাচল করছে কিন্তু দেখা দিচ্ছে না। কেন? কেন তার সাথে এই লুকোচুরি খেলা খেলছে মেয়েটি?

আর কাউকে চিঠি দেখায়নি সাবকাত। তবুও কেন যেন মেয়েটির চিঠি আর আসে না। সাবকাতের দিনগুলো কেমন যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগল। হারিয়েই যদি যাবে তাহলে এসেছিল কেন তার জীবনে? আবার নিজের উপরও তার খুব রাগ হতে লাগল। অচেনা অজানা একটা মেয়ের জন্য তার কেন এত খারাপ লাগছে? এমনও তো হতে পারে তার কোনো বন্ধুই মজা করার জন্য এমনটা করেছিল? সামনেই পরীক্ষা অথচ বিন্দুমাত্র পড়াশোনায় মন নেই সাবকাতের। ক্যাম্পাসে গিয়েও বেশিক্ষণ থাকে না। এর মাঝে একদিন রিমঝিম কোথা থেকে দৌড়ে তার সামনে চলে এল।
“ভাইয়া একটু দরকার ছিল।”

শুকনো গলায় সাবকাত বলে, “হ্যা বল।”

“ভাইয়া একটা নোট চেক করে দেওয়া লাগত।”

“আচ্ছা দাও। আমি চেক করে দুএকদিনের মধ্যেই দিয়ে দিব। আসলে ভাইয়া তাড়াতাড়ি দিলে ভালো হয়। এটা অন্য একজনের নোট।”

“আচ্ছা কালকেই দিয়ে দেব। কেমন?”

“ওকে ভাইয়া।”

রিমঝিমের হাত থেকে নোটখাতাটা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে মেসে চলে আসে সাবকাত। রাতে সেই নোটটা খুলেই হতবাক হয়ে যায় সে। এতো সেই হাতের লেখা! এটা কার খাতা? কে লিখেছে এগুলো? সেই ঝগড়ুটে মেয়েটা না তো? না না সে কি করে তাকে চিঠি লিখবে সে তো তাকে দেখতেই পারে না। এই তো কয়েকদিন আগেই সাবকাতকে দেখে কেমন মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল। ফোনবুক কয়েকবার চেক করার পরও রিমঝিমের মোবাইল নম্বরটা খুঁজে পেল না সে। দু’তিন জায়গায় ফোন করেও ওর নম্বর সংগ্রহ করতে পারল না। সকাল হওয়ার অপেক্ষা করা ছাড়া সাবকাতের হাতে আর কোন উপায় নেই। সারারাত নির্ঘুমে কাটানোর পর সকাল সকাল গিয়ে উপস্থিত হল রিমঝিমের মেসের সামনে। গেস্টরুমে সাবকাতকে এত সকালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল রিমঝিম।

“তুমি একটা সত্যি কথা বলবে আমাকে?” সাবকাতের চোখমুখে গম্ভীরতার ছাপ। একটু ভীতু গলায় রিমঝিম বলে, “কেন বলব না, ভাইয়া। বলুন কি জানতে চান।”

“গতকাল যে খাতাটা আমাকে দিয়েছিলে ওটা কার?”

“আসলে ভাইয়া, আপনি রাগ করবেন জন্য বলিনি। ওটা আমার বান্ধবী প্রত্যাশার।”

সাবকাত যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারল না। প্রত্যাশা! এর চেয়ে অন্য কোন অসম্ভব কথা বললেও বুঝি সে খুব সহজে হজম করতে পারত। কিন্তু প্রত্যাশা তাকে এরকম সুন্দর সুন্দর ভাষায় এমনভাবে প্রেম নিবেদন করেছে এটা বিশ্বাস করতে পারল না সে। তাই সে একটু রাগী স্বরে বলল, “তুমি কি আমার সাথে মজা করছ রিমঝিম?”

“মোটেই না ভাইয়া। আমি কেন আপনার সাথে মজা করতে যাব। বরং আমি দুঃখিত যে প্রত্যাশা আপনার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করার পরও আমি ওর নোটটা আপনাকে সলভ করতে দিয়েছি। এটা ও জানতে পারলেও আমার অবস্থা খারাপ করে দিবে।”

“ওকে একটু ডেকে দিবে?”

মাথা নিচু করল রিমঝিম। “ভাইয়া ও তো কিছুদিন থেকে হাসপাতালে।”

“কেন, কী হয়েছে ওর?”

“ভাইয়া ওর ক্যানসার। লাস্টস্টেজ।”

আবারও একটা ধাক্কা খেল সাবকাত।
“কি বলছ রিমঝিম? প্লিজ মজা করো না আমার সাথে। প্রত্যাশার সাথে দেখা করা আমার সত্যি খুব দরকার। অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার আছে ওর কাছে। ওকে ডাকো।”

“তাহলে চলুন আমার সাথে।”

রিমঝিম সাবকাতকে যে জায়গায় নিয়ে এলো তাতে সত্যি খুব অবাক হল সে। আজ কি তার অবাক হওয়ার দিন! রাশিচক্র সে বিশ্বাস করে না কিন্তু আজকের ঘটনাগুলো দেখে তার মনে হচ্ছে রাশিচক্র দেখে বেরুনো উচিত ছিল। সাবকাত এখন প্রত্যাশার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে রিমঝিমও আছে। সাবকাত রিমঝিমকে বাইরে যেতে বলল কিছুক্ষণের জন্য। রিমঝিম বাইরে চলে গেলে সাবকাত প্রত্যাশার চোখে চোখ রেখে বলল, “কেন এমন করলে আমার সাথে? কী ক্ষতি করেছিলাম তোমার আমি?” সাবকাতের চোখে আগুন দেখতে পেল প্রত্যাশা। সে অবাক হয়ে বলল, “ আমি কী করলাম আপনার সাথে?”

প্যান্টের পকেট থেকে চিঠিগুলো বের করল সাবকাত। “এগুলো কেন লিখতে আমায়? আর এতই যখন ভালোবাসো তখন এমন খারাপ ব্যবহার করতে কেন আমার সাথে?”

“এগুলো যে আমিই লিখেছি তার কী প্রমাণ আছে?”

“তোমার হাতের লেখার সাথে আমি মিলিয়ে দেখেছি। হুবহু একি লেখা। কেন আমার সাথে এমন লুকোচুরি খেলা খেললে? বল।”

মাথা নিচু করে প্রত্যাশা বলল, “কী করব বলুন? বিধাতাই যে আমার সাথে লুকোচুরি খেলা খেলছে। জন্মের সময় মাকে হারিয়েছি। ছোট খালা আমার আর বাবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। একদিন বাবাও আমাকে ফাঁকি দিয়ে মার কাছে চলে গেল। দেখুন না, এখন বাবা- মা ওখানে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আর তাদের কতদিন অপেক্ষা করিয়ে রাখি বলুন তো।”

কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে প্রত্যাশা। সাবকাতও তাকে সময় দেয়। তারপর বলে, “কিন্তু আমাকে এভাবে স্বপ্ন দেখালে কেন?”

“ আসলে আমি নিজেই স্বপ্ন দেখতে ভয় পেতাম। আপনাকে দেখার পর সেই ভয়টা কেটে গেল। কিন্তু আমার ভাগ্য কখনোই আমার প্রতি সুপ্রসন্ন হয়নি। যাকেই ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি সেই হারিয়ে গেছে। আপনার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করতো। পাছে আমার দুর্বলতা আপনার কাছে প্রকাশ পায় তাই আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। কিন্তু যাকে এত ভালোবাসি তাকে যদি জানিয়ে যেতে না পারি তাহলে যে মরণেও আমার তৃপ্তি মিলবে না। তাই চিঠি লিখতাম আপনাকে। আমার ইচ্ছাগুলো, আপনাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো জানাতাম। আপনি আমাকে ভালোবাসবেনই এই আশায় লিখিনি আপনাকে। শুধু নিজের তৃপ্তির জন্য লিখেছিলাম।”

প্রত্যাশার গাল বেয়ে অঝোর ধারায় বয়ে যাওয়া অশ্রুর বন্যাকে থামাবার সাধ্য হয়তো সাবকাতের নেই কিন্তু মুছে দেবার সাধ্য তো আছে।

কয়েকদিন পর হাসপাতালের ছাদে প্রত্যাশা আর সাবকাত বসে আছে। একটা পূর্ণ চন্দ্রের অপেক্ষায় ছিল ওরা। প্রত্যাশা সাবকাতের কাঁধে মাথা রেখে পূর্ব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ যে ভরা পূর্ণিমা। চাঁদটা কেমন মেঘের সাথে বারবার লুকোচুরি খেলছে। প্রত্যাশা ক্ষীণ গলায় বলল, “দেখেছেন চাঁদটাও আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে।”

সাবকাত কোনো কথা বলছে না। তার কণ্ঠস্বর কে যেন রূদ্ধ করে রেখেছে। হলেও হতে পারে এটাই প্রত্যাশার জীবনের শেষ পূর্ণিমা! কিন্তু সাবকাত কী আর কোনোদিন চাঁদ দেখবে?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত