ক্লাসে ঢুকেই অর্ক’র পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। আজও হবে! তৃতীয় দিন চলছে আজ। তথ্যটা যদিও জানতো, তারপরেও পেট মোচড়ালো। দু’দিন তো হলো, আর কেন বাবা! সামনের সারিতেই বসে আছে থার্ড সেমিস্টারের বীর ভাইয়েরা! কয়েকজন টেবিলের ওপর। ঠ্যাং দোলাচ্ছে। গতকাল ওদেরই আর একটা গ্রুপ এসেছিল। খুব হিরো হিরো ভাব নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কাল অর্কদের ব্যাচের ওপর র্যাগিংপর্ব চলেছে।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হতে হলো শেষমেষ। কিচ্ছু করার ছিলনা, বাবা তো বলেই দিয়েছিলেন, দোকানে বসিয়ে দেবেন, ভাগ্যিস মা কেঁদেটেঁদে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায় তার ভাইয়ের বাড়ি। মামা ধরে ভর্তি করে দিলেন প্রাইভেট একটা ইউনিভার্সিটিতে। এখনই দোকানে বসিয়ে দেবে মানে! আমার ভাগনে বলে কথা! জিজ্ঞেস করলে লোকজনের কাছে কী বলবো? পড়া বন্ধ করে দোকানে কাজ করে! যতই হোক বাবার দোকান!
অ্যাই, তোর নামের মানে বল।
সূর্য।
তা বাবা সূর্য কুমার পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, না সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, বল্ তো দেখি।
সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে!
অ্যাই ঠিকমত জবাব দে।
ভুল হলে শেখাও! বড় ভাই তোমরা। আমরা তো শেখার জন্যই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি না কি! কাল বই নিয়ে আসি তোমার রুমে? অর্ক স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে।
অ্যাই, তুই বলে খুব মেয়ে ঘেষা, সারাক্ষণ তোকে মেয়েদের সাথে দেখা যাচ্ছে। কথা ঘুরিয়ে বলে এক বড়ভাই।
তাই তো নিয়ম বস্। উল্টোটা হওয়া কি ঠিক! তোমাদের কি উল্টো স্বভাব নাকি! ইন্টারনেটের কল্যাণে দুনিয়ার সব রকম খবরই তো পাই!
চারজন একসাথে তেড়ে এসেছিল অর্কর দিকে। তার আগেই রিপন মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাকে বাঁচায়।
দু’দিন এসব হয়েছে। প্রথম যেদিন র্যাগিংপর্ব শুরু হয়েছিল অর্ক বুঝে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় দিনে অবশ্য কোনো রকম চালিয়ে নিয়েছে। ব্যাপারগুলো তৃতীয় দিনও চলবে বুঝতে পেরে, ব্যাচের যে দু’চারজনের সাথে পরিচয় হয়েছে তাদের সাথে রাতেই ফোনে কথা চালাচালি করে ঠিক করে নিয়েছিল কি ভাবে টেক্কা দিতে হবে!
মাত্র দু’সেমিস্টার উঁচু ক্লাসে পড়ে দাদাগিরি করতে এলে এসব বাক্য সামলাতে হবেই! শেষের দিকে যেসব কাব্য উপস্থাপন করেছে দাদারা, তাতে মেয়েদের অবস্থা খুব করুণ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যেই অবশ্য অনেকে ম্যানেজ করে নিয়েছে। অর্পিতাকে একজন বললো, বাসর রাতে প্রথম তুমি যে কথাটা তোমার বরকে বলবে সেটা আমাদের অভিনয় করে দেখাও।
অর্পিতা প্রথমে একটু লাল হলেও ম্যানেজ করে নিল। ডাটিয়াল মেয়ে, জিনস পড়ে ক্লাসে আসে, একটুও না ঘাবড়ে বললো, বলবো, এই শালা তুই বেতন কত পাস্ রে? ঠিক ঠিক বলবি, হাতে রেখে বলবি না, নাহলে শালা তোকে উল্টো করে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে পেট থেকে কথা বের করার ব্যবস্থা করব। জানিস, আমার মামা ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চে চাকরি করে! হো হো করে হেসে উঠেছিল সবাই অর্পিতার কথা শুনে।
কাল মধ্যরাতে অহনা কাঁদ কাঁদ হয়ে তাকে ফোন করেছিল। অহনা তাদের এলাকার মেয়ে। একটু নরম প্রকৃতির। একই ক্লাসে ভর্তি হয়েছে তারা। একটা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ওর। রাতে নাকি কয়েকটি সিনিয়র মেয়ে ওর রুমে গিয়ে ওকে ওদের মাথা বানিয়ে দিতে বাধ্য করেছে।
‘মাথা বানানো’ মানে কি? জিজ্ঞেস করেছিল অর্ক।
মাথা বানানো হলো গুছি গুছি চুলের গোছা ধরে টেনে টুনে মাথা ম্যাসাজ করা! কাঁদ কাঁদ হয়ে বলেছিল অহনা। আরও বলেছিল সে এখন হোস্টেলে তার রুমের দরজায় বসে আছে পিঠ ঠেকিয়ে। সারা রাত এখানেই সে বসে থাকবে। বিছানায় বসতেই তার ভয় লাগছে।
বিছানায় বসতে ভয় লাগছে কেন? কণ্ঠে খানিকটা প্রেম প্রেম আবেগ নিয়ে বলার চেষ্টা করে অর্ক।
কারণ ঐ মেয়েগুলো আমার বিছানায় শুয়ে আমাকে আদেশ করেছে। ওরা বিছানায় শুয়ে চুল এলিয়ে দিয়ে আমাকে বলেছে নিচে বসে মাথা বানিয়ে দিতে। অর্ক আমি আর এই হোস্টেলে থাকতে পারবো না। কালই আমি দিনাজপুর চলে যাব। অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা হলে তারপর আমি ঢাকায় ফিরবো। না হলে দিনাজপুরের কোনো কলেজে ভর্তি হয়ে যাব। এই পর্যন্ত বলে অর্পিতা ফোঁপায়।
অর্ক তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য নানা ধরনের কথাবার্তা বলে বোঝাতে গেলে অহনা আরও যে ভয়ংকর কথাটা জানিয়েছিল তা হলো, ওদের মধ্যে একটা মেয়ে বলেছে, ওর একটা ভীষণ রকম বদরাগী ভাই আছে যার সাথে অহনাকে প্রেম করতে হবে। কি আহ্লাদের কথা! ওর নিজের কোন বান্ধবী ওর ভাইয়ের সাথে প্রেম করতে রাজী হচ্ছে না কারণ ভাই ভীষণ বদরাগী। ভাই প্রেমে পড়লে মেয়েটির জন্য সুবিধে হয়। মেয়েটি একজনের সাথে প্রেম করে কিন্তু বদরাগী ভাইয়ের জন্য কোনোভাবেই তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ভাই জানলে ছেলেটির শার্টের কলার ছিড়ে মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে। মেয়েটি অহনাকে বলেছে অহনা রাজী না হলে তাকে হোস্টেল ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকতে হবে। হোস্টেলে থাকা চলবে না। অহনা তাই ভাবছে হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে যাবে।
মেয়েটি ওর ভাইয়ের ছবিও সাথে এনে দেখিয়েছে অহনাকে। মাস্তান ও রাগী প্রকৃতির চেহারা ভাইয়ের। অহনা দেখতে না চাইলেও ওরা ওকে জোর করে ছবি দেখতে বাধ্য করেছে। তবে ভাইয়ের সম্পর্কে ওরা যতটা বলেছে ছবি দেখে ততটা ভয়ঙ্কর মনে হয়নি অহনার কাছে।
সব শুনেটুনে অস্থির হয়ে পড়ে অর্ক। আইল্যায় তান্ডব হওয়ার আগে যে পূর্বাভাস ছিল সেরকমই মনে হয় তার কাছে! রেজাল্ট ততটা ভাল না হওয়ায় বাবা যখন তাকে ঢাকায় পড়তে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তখন এরকম অস্থির হয়েছিল অর্ক। বললেই হলো আর কি! তার সব বন্ধুরা নতুন ব্যাগ ট্যাগ কিনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। বিশেষ করে অহনা। অহনা ঢাকায় পড়বে আর সে দিনাজপুর আর দোকান সামলাবে! প্রশ্নই আসে না। সেই অহনা এখন বলছে সে দিনাজপুর চলে যাবে! না সে কিছুতেই অহনাকে ঢাকা ছেড়ে যেতে দিবে না। অহনা ঢাকায় না থাকলে তারও যে সব আনন্দ উৎসব ঢাকা পড়ে যাবে, অর্থহীন হয়ে যাবে! এই কথাটা অবশ্য অর্ক বলতে পারে না অহনাকে, কোথায় যেন বাঁধে। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা রকম কথা বলে বোঝাতে হয়েছে।
ভোর চারটের দিকে অহনা দরজার কাছে লেপ্টে বসে থাকা থেকে সরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লে ফোন বন্ধ করে অর্ক। তার কান জ্বালা করছে। ফোন অনেকক্ষণ কানে ধরে থাকলে তার কান জ্বলে।
তৃতীয় দিনের র্যাগিংপর্ব কোনো ভাবেই জমে না। যুদ্ধে লড়ার রণকৌশল মোটামুটি সবাই বুঝে গেছে, কেউ আর তেমন অপ্রস্তুত হচ্ছে না। প্রতিপক্ষের সামনে কী করে ঢাল ব্যবহার করতে হয়, মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে সবাই। অহনার যখন ডাক পড়লো অর্ক ভাবলো, কেঁদেটেদে একেবারে ভাসিয়ে না দেয়। তাকে ছিঁচ কাঁদুনে বলা হলে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু অর্ক অবাক হয়ে দেখে ডাক পড়ার সাথে সাথে অহনা ওড়না পেঁচাচ্ছে কোমরে। তাকে বলা হয়েছে র্যাম্পে হাঁটতে। বলা মাত্রই অহনা কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে চমৎকার স্টাইলে হেঁটে যায় সামনের দিকে, কোনো দ্বিধা নেই। তার দেহের ভাষাই বদলে যায়। চেহারাও বেশ হাসি হাসি। রাতে যে দরজায় পিঠ লাগিয়ে বসে কান্নাকাটি করে হোস্টেল ছেড়ে চলে যাওয়ার শপথ নিয়েছে, তার কোনো চিহ্নই নেই। অহনার হাঁটা দেখে থার্ড সেমিস্টারের বড় ভাইয়েরা মুগ্ধ চোখে কন্ঠে, মায়াবন হরিণীর সুর তোলে।
মাস খানেক পর এক শুক্রবারের দুপুরে ফোন না করেই হঠাৎ অহনার হোস্টেলে হাজির হয় অর্ক। ছুটির দিন দুপুর বেলা অহনা হোস্টেলে অবশ্যই থাকবে, ভাবে সে। তেমন কোথাও প্রোগ্রাম থাকলে অর্ককে আগেই জানায় অহনা। অতএব এই সময়ে হোস্টেলে না থাকাটা যৌক্তিক নয়। দুপুরে দুজনে হোস্টেলে না খেয়ে বাইরে কোথাও বসে খেয়ে আসবে, মনে মনে পরিকল্পনা করে অর্ক। হোস্টেলের গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে সেলফোন বের করে অহনার নাম্বার টিপে কানে লাগায়। মাথার ওপরে কড়া রোদের তাপ বুঝে একটু ছায়া খোঁজে অর্ক। গেট দিয়ে মেয়েদের যাতায়াত দেখে আর অপেক্ষা করে অহনার আহ্লাদী কন্ঠস্বর শোনার। কিন্তু ফোন ধরতে এত দেরি করছে কেন অহনার! অস্থির হয়ে অর্ক গেটের দারোয়ানকে খোঁজে, ভেতরে গিয়ে খবর দিয়ে আসার জন্য। কিন্তু দারোয়ানকে পাওয়ার আগেই একটা ঝকঝকে মোটর সাইকেল ঘ-র-র আওয়াজ তুলে গেটের উল্টো দিকটায় এসে থামলে বিরক্ত চোখে সেদিকে তাকায়। চালক মুখ থেকে হেলমেট সরিয়ে সেলফোন কানে লাগানোর আগেই মাথায় ওড়না দেওয়া মেয়েটিকে গেটের দিক থেকে এসে মোটর সাইকেলের পেছনের সিটে বসতে দেখে অর্ক। হেলমেটটা জায়গা মতো লাগিয়ে চালক মোটরসাইকেল স্টার্ট নেওয়ার মুহূর্তে অর্কর বিরক্ত চোখ বিস্মিত হয় মেয়েটির মুখ দেখতে পেয়ে। হাসি হাসি মুখে অহনা পেছন থেকে চালককে জড়িয়ে ধরে। হেলমেট খোলার সময়ে অর্ক চালকের মুখটা দেখেছিল, অনেকটা রাগী রাগী!