আমাদের এই অফিসে বেশিদিন এমপ্লয়ি টেকে না; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্য কোথাও শিফট করে। প্রায় সবারই লক্ষ্য থাকে মন্ট্রিল বা টরেন্টোতে চলে যাওয়ার। শুধু এই শহরের স্থানীয় কজন আর আমিই যা হোক এখানে পাকাপাকিভাবে আছি। মায়াবতীকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে আসতেই টের পেলাম আমার কলিগরা নিজেদের মধ্যে খুব গুজগুজ করছে। আমাকে দেখেই জোসেফ উঠে এলো। মাঝবয়সী লোকটা। দুই ছেলেই মন্ট্রিলে থাকে ওর। বউ নেই; দু’বছর হলো মারা গেছে। মার্থার কথা মনে হলে খারাপ লাগে খুব। মায়াবতীকে খুব ভালোবাসতো বুড়ি। দুজনে দেখা হলেই কুটকুট করে রাজ্যের গল্প ফাঁদতো।
জোসেফের বউ মার্থা। টুকটুকে লাল স্কার্ট পরতে পছন্দ করতো যেই মার্থা। আমার মায়াবতীর টুকটুক নানু।
আট বছর আগে যখন এখানে প্রথম আসি, মার্থা আর জোসেফই তখন মাথার ওপর ছায়া হয়ে এগিয়ে এসেছিলো। আজ জোসেফকে দেখে আবার পুরনো কথা মনে পড়ছে।
– কী হয়েছে বলো তো জোসেফ?
– নতুন এমপ্লয়ি এসেছে, ইয়াং ছেলে। দেখতেও খুব ভালো।
বলেই আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো বুড়ো। ও মেয়ের মতো দেখে আমায়, আগেও বেশ ক’বার দুজন বলেছে আমায় আরেকটা বিয়ে করতে। না হলে নিদেনপক্ষে এক আধটা ডেট যেন করি। আমিই পারি না আমার বাঙালি সেন্টিমেন্ট থেকে বের হতে। তাছাড়া আমার মায়াবতীও তো আছে, আমার ছোট পরীটা।
আমি হেসে জোসেফকে বললাম, “দেখতে ভালো হলে তো তোমার নতুন মানুষ নিশ্চিত কোথাও এনগেজড। সুন্দর ছেলেরা কি আজকাল সিংগেল থাকে?”
জোসেফ বোধহয় বুঝে গেছে আমি এটা নিয়ে আর এগোতে চাইছি না। ও তখন মাথা নেড়ে বললো, “সন্ধ্যায় মায়াকে নিয়ে এসো, আমি আজ পাবে যাবো না।”
জোসেফের নতুন মানুষের সাথে দেখা হলো স্ন্যাক্স ব্রেকের সময়, সত্যিই সুদর্শন ছেলেটা। বয়সে বোধহয় আমার চেয়ে দুয়েক বছরের ছোটই হবে। কালো চুল, গভীর কালো চোখ। আমি ওর চোখের দিকে দ্বিতীয়বার আর তাকালাম না। এরকম গভীর কালো চোখ দেখলে ভয় পাই আমি। উজানের ওরকম চোখেই ডুবে গিয়েছিলাম আমি। সেও তো দশ বছর হয়ে গেলো।
– হ্যালো! আমি রুপার্ট, রুপার্ট নিক্টার।
ওর বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে হাসিমুখে বললাম, ” আমি নীতু আনজুম।”
মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম, আবারো উদ্ভট উচ্চারণে “নেটু এঞ্জুম ” শোনার। এখানে খুব ঘনিষ্ঠজন ছাড়া সবাই এঞ্জুম ডাকে আমায়। জোসেফদের মতো ঘনিষ্ঠ কজন ডাকে নেটু। আমায় অবাক করে দিয়ে রুপার্ট বললো, ” নীতু? বাঙালি?”
সাধারণত আমার ফিচার দেখে সবাই জিজ্ঞেস করে আমি ইন্ডিয়ান কিনা। এখানে প্রথম কেউ আমায় জিজ্ঞেস করলো আমি বাঙালি কিনা। অদ্ভুতরকম ভালো লাগলো। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই ও বললো, “তাহলে তুমি আমায় রুপ কিংবা রুপু বলে ডাকতে পারো। আমার মা আমায় রুপু বলে ডাকতেন।”
রুপার্টের ফিচারে কিছুটা বাঙালি ভাব আছে। আমার চোখে বোধহয় এই প্রশ্নটা ভেসে উঠেছিলো কোনভাবে, ও তখন মাথা নেড়ে বললো, “ঠিকই ভাবছো। আমার মা বাঙালি ছিলেন। ”
(২)
গ্রাজুয়েশনটা করার পরপরই কানাডার ইমিগ্র্যান্ট ছেলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসে। এত দ্রুত বিয়ের কথা ছিলো না আমার। কিন্তু উজান– ওর চোখ দুটো এত গভীর, সেদিকে একবার চাইতেই ডুবে গেলাম আমি। রাজি হয়ে গেলাম বিয়েতে। বিয়ের কিছুদিন পরই উজানের সাথে আমিও কানাডায় চলে আসি, টরেন্টোতে। ব্যস্ত শহর। ব্যস্ত উজান। তবুও আমরা একসাথে ছিলাম। ওর ভীষণ সন্দেহ করার স্বভাব ছিলো, আমি তাই বাড়িতেই থাকতাম। আমাদের ছোট এপার্টমেন্টটায়। রোববার গুলোতে যখন বাইরে যেতাম, উজান সাথে যেতো। এখনো বিশ্বাস হয় না, এক কালের এত স্বাধীনচেতা নীতুর ফোন, কললিস্ট, ব্রাউজিং হিস্টরি– সব একটা মানুষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো। কিভাবে সহ্য করেছিলাম ওকে আঠারোটা মাস?
(৩)
রুপের সাথে মায়াবতীর ইদানীং খুব ভাব হয়েছে। লিটল স্কুলে ছুটি বেশ তাড়াতাড়িই হয়ে যায় বলে আমি প্রায়ই ওকে স্কুল ছুটির পর অফিসে নিয়ে আসি। ছোট শহরের এই সুবিধা। কর্পোরেট চাকচিক্য ভালো লাগে না আমার। আমার মায়াবতীও এখানে মানুষ হচ্ছে, জ্যাস্পারে না এসে টরেন্টোতে থাকলে কি তা হতো?
রুপ মায়াবতীকে প্রথমদিন দেখেই বাচ্চাদের মত লাফঝাঁপ শুরু করে দিয়েছিলো।
“এই নীতু জানো, মায়াবতীকে দেখতে না খুব মায়াবতী। একদম আমার মায়ের মত।” বাংলায় বলেছিলো কথাগুলো।
রুপার্টকে রুপ ডাকি আমি, আর মায়াবতী ডাকে ‘রুপুটুপু’। কোত্থেকে যে এসব অদ্ভুত ডাক পায় মেয়েটা কে জানে!
(৪)
কনসিভ করার পর উজান আমায় একদিন বললো, আজকাল খরচ এত বাড়ছে ও কুলাতে পারছে না। আমি কিছু বলিনি তখন, গত কয়েক মাসে ওকে আর সহ্য হচ্ছে না আমার।
– আমরা একজন পেয়িং গেস্ট রাখি নীতু? কিছু বাড়তি পয়সাও আসবে আর তোমাকেও একা থাকতে হবেনা।
আমি আর কী বলবো? উজান যা বলে তাই ফাইনাল। চেরিল নামের ছটফটে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েটা উঠলো আমাদের বাড়িতে। ব্যানফে হোমটাউন ওর। টরেন্টোতে এসেছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। উনিশ বছরের সদ্যতরুণী। চেরিল বেনেডিক।
(৫)
মায়াবতী হঠাৎ করেই ওর বাবার কথা জানতে চাইলো, চমকে উঠলাম ওর প্রশ্ন শুনে। আট বছরের বাচ্চা আমার মেয়েটা, ওকে কিভাবে সব বলবো আমি? কিছুক্ষণ চুপ করে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলাম ওকে, কোলে নিয়ে আমাদের ছোট্ট বাড়ির বারান্দায় চলে গেলাম। বুকে চেপে নিয়ে বললাম, ” দুইটা মানুষের মধ্যে বিশ্বাস না থাকলে তাদের একসাথে থাকা ঠিক না মা। তোমার বাবার কথা এই আট বছরে ভুলে গেছি আমি।” মায়াকে কতটা বোঝাতে পেরেছি জানি না। তবে ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার মুখে গাল ঘষতে ঘষতে বললো, “তুমি কিন্তু সবচেয়ে সুইট আম্মু।”
আমি আমার ছোট পরীটাকে বুকে চেপে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাই। বাবার রাজকন্যা হিসেবে বড় হয়েছিলাম আমি, মায়াবতীকে আমি শৈশবের এই জায়গাটুকু থেকে বঞ্চিত করছি না তো?
ডেলিভারি ডেটের ঠিক এক সপ্তাহ আগে জানতে পারি চেরিলও প্রেগন্যান্ট। তিনমাস চলছে ওর। অবাক হইনি, পাশ্চাত্য তরুণী। বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক বা প্রেগন্যান্সি অস্বাভাবিক কিছু না ওদের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই রাতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে যখন দেখি উজান পাশে নেই, ওকে খুঁজতে গিয়ে যখন লিভিং রুমে চেরিলকে চুমু খেতে দেখি ওকে, সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়ে ফেলি। চেরিলকে চড় মারার শব্দটা কানে বাজে এখনো। মেয়েটা তখনই জানায়, ওর বাচ্চাটা উজানের। ভারী শরীরটা নিয়ে সেরাতেই এক কাপড়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম। একা না, মায়াবতীর অস্তিত্ব সাথে নিয়ে।
(৬)
– কিছু বলবে রুপ?
– বলতাম, কিন্তু বাঙালী মেয়েরা কতটা অভিমানী হয় জানি বলেই এখনো কিছু বলিনি। মনে হয় বলবোও না।
ভ্রু কুঁচকে তাকালাম রুপের দিকে। আমার আর মায়ার সাথে বাংলায়ই কথা বলে ও। চমৎকার একসেন্ট। তবে বাঙালী মেয়েরা অভিমানী হয় বলে কি বোঝাতে চাইছে বুঝতে পারছি না।
– বাদ দাও নীতু। মায়াবতীর স্কুল ছুটির সময় হয়ে যাচ্ছে, আজকে আমি আনতে যাই ওকে?
যেতে দিলাম ওকে, নিজের মধ্যে দ্বিধা কাজ করছে।
মায়াবতীকে নিয়ে ও ফিরে এলো ঘন্টাখানেক পরেই। আজ কেমন বেশি হাসিখুশি আচরণ করছে রুপ সবার সাথে। মায়া জোসেফের কাছে যেতেই ও আমার কাছে এসে হাসিমুখে বললো, “নীতু জানো, আমার সতেরো বছর বয়সে আমার মা আত্মহত্যা করেছিলেন।” আমি চমকে তাকাই ওর দিকে। এরকম একটা কথা ও এমন হাসিমুখে বলছে কিভাবে?
“আমি অবশ্য এখনো কারণ জানি না। এক রাতে মা এসে আমার সাথে বাংলাদেশের খুব গল্প করলো, বললো, তার খুব হাতভর্তি শিউলি ফুল নিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। নীতু, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ কেমন? খুব মিষ্টি?” আমি কিছু না বলে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও মাথাটা একটু এপাশ-ওপাশ নেড়ে আবার বলতে শুরু করলো, “তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ কোনোভাবেই আমার মায়ের শরীরের ঘ্রাণের থেকে মিষ্টি না। এটা আমার আলাদা দিক। কানাডায় ছেলেমেয়েরা তীব্র মা মা গন্ধটা পায় না। আমি পেতাম। বাঙালী রক্তের জন্যই কি নীতু? পরদিন সকালে লিভিং রুমে মায়ের নিথর শরীরটা পড়ে থাকতে দেখি আমি। কতটা অভিমান হলে একটা বাঙালী মা সব ছেড়ে চলে যেতে পারে?” রুপ কাঁচের জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকায়। জ্যাস্পার খুব ছোট শহর, তবে এখানেও বাচ্চারা তীব্র মা মা গন্ধটা টের পায় না।
পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে রুপকে কোথাও দেখলাম না। জোসেফকে জিজ্ঞেস করতেই অবাক হলো।
– ও তোমাকে কিছু বলেনি? কাল তো সবাইকেই বললো। ছুটি নিয়েছে ও কিছুদিনের, বাংলাদেশে নাকি ঘুরতে যাবে। আমি ওকে বলেছি আমার জন্য একটা ফোক ডিজাইনের পাউচ আর সিলেটী চা নিয়ে আসতে। তুমি একবার ওগুলোর খুব প্রশংসা করেছিলে নেটু। মনে আছে আমার।
জোসেফের বকবকানি শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। রুপ তবে মায়ের স্মৃতি খুঁজতে গেছে! নিজের ডেস্কে এসে বসতেই দুটো খাম দেখলাম। একটার ওপর বাংলায় মায়াবতী লেখা, আরেকটায় নীতু। কার লেখা বুঝতে পারছি। আমার খামটা খুলতেই সাদা কাগজে হাল্কা কমলা কালিতে লেখা চিরকুট পেলাম, কবিতা লেখা তাতে।
“এই শহরে নীল জল হ্রদ,
জমাট বরফ-
আকাশ থেকে তুষার ঝরে,
বৃষ্টি অচেনা খুব।
ম্যাপল পাতার ভীরে
চেনামুখ মানচিত্র হয়ে যায়।
তুমি,
তোমার চোখ, ভ্রু, মুখাবয়ব–
নীতু জানো,
এই শহরে শিউলি ফোঁটেনা–
এখানে শরৎ আসে শুধু
রাশকরা লাল পাতার
নিশ্চুপ কোলাহলে।
অথচ,
আমি একবার গুচ্ছ শিউলি মুঠোয় নিতে চেয়েছিলাম।
প্রিয় নীতু,
তুমি আমার আকাশ হবে?”
উফফ্! আমার চোখদুটো এত বাজে কেন? আমি কিছুতেই কান্না থামাতে পারছি না কেন? মায়াবতী লেখা খামটা ব্যাগে রেখে বের হই, এক্ষুণি মায়ার কাছে ওর শৈশব পৌঁছে দিতে হবে। কাঁদছি আমি এখনো, সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, থাকুক।