জহির সাহেবের একমাত্র মেয়ে তুলি।সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের কৃতী ছাত্রী। তুলি শহরের আর দশটা মেয়ের মতো না।সে একটু আলাদা।কখনো ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে যায় না।কখনো তাকে ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে দেখেনি।কেউ তার দিকে রাগী চোঁখে তাকালেই সে কেঁদে ফেলে।ইন্টারনেট,ফেসবুকে তার কোন আগ্রহই নেই।
ক্লাস অফ থাকলে চুপচাপ লাইব্রেরীতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদের “দেবী” পড়ে।বইটা সে কম হলেও ২৫-৩০ বার পড়েছে।কখনো তার কাছে পুরাতন মনে হয়নি।তুলির জীবন বলতে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস,পড়াশোনা,আর তার বাবা।তুলির জীবনটা এগুলোতেই সীমাবদ্ধ। সে সবসময়ই নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায়। হোই হুল্লোড়,আড্ডাবাজি,হাসি-তামাশা তুলির নিতান্তই অপছন্দের।ভার্সিটিতে প্রথম কয়েকটা বছর তাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।তুলি দেখতে ভীষণ সুন্দরী সেই সাথে পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় অনেকেই তার বন্ধু হতে চেয়েছে।কেউ বা তার থেকেও বেশি কিছু হতে চেয়েছে।কেউ আবার তার কন্টাক্ট নাম্বার,ফেসবুক আইডির জন্য ঘুরেছে।অথচ তারা জানেই না ভার্চুয়াল জগতে তার কোন অস্তিত্ত্বই নেই।
আজ তুলির জন্মদিন।অবিশ্য এ নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নাই।তার কাছে সব দিনই একরকম।কিন্তু তাতে কি! জহির সাহেব তাকে ঠিকই কোন না কোন সারপ্রাইজ প্রেজেন্ট করবে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তুলিকে নিয়ে।সে সহজে সারপ্রাইজ্ড হয়না। রাত ১২ টা। তুলি তখন পড়ছিলো।জহির সাহেব দরজার ওপাশে হাতে একটা কেক এবং র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা বক্স নিয়ে ১২ টা বাজার অপেক্ষাতেই ছিলো। সে রুমে ঢুকতে ঢুকতে “হ্যাপি বার্থডে তুলি।” বলে চেচিয়ে উঠলো।
সে ভেবেছিলো তুলি চমকে যাবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তুলি শুকনো গলায় একবার “থ্যাংক য়্যু” বলেই আবার বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে দিলো।এতে জহির সাহেবের মন ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ হয়ে গেল। সে কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকলো।কিছুক্ষন পর তুলি বইয়ের থেকে মূখ না তুলেই বললো,”আর কিছু বলবে বাবা?”। এতে জহির সাহেবের কষ্টের মাত্রা গগণ-পাতাল হয়ে গেল। তবুও কষ্ট চাপা হাসি দিয়ে খুসি-খুসি গলায় বললো,”কেকটা কাটবি না মা?” তুলি উঠে এসে কেক কাটলো।দু’জনে দুই পিচ কেক খেল।তারপর জহির সাহেব মেয়ের ভাবের কোন উন্নতি না দেখে কোন কথা না বলেই ধুপ ধাপ শব্দ করে বেরিয়ে গেল।তুলিকে সারপ্রাইজ্ড করার জন্য যে বক্সটা এনেছিলো মেয়ের এমন ব্যাবহারে সে বক্সটা দিতেই ভুলে গেল।
তুলি প্রতিদিনের মতো সেদিনও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো।সে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে জানালা বন্ধ করে।সারাদিন তার ঘরের সমস্ত জানালা বন্ধ থাকে রাত ১০-১১ টার দিকে শহরের কোলাহল কমে এলে সে জানালা খুলে দেয়।রাতে শুয়ে-শুয়ে খোলা জানালা দিয়ে তাঁরা দেখা তার বহুদিনের অভ্যাস।আজকে সে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে খানিকটা চমকে গেল।জানালার লোহার সিকের খাজে একটা চিরকুট এবং কয়েকটা বেলীফুল দেখা গেল।তুলি চিরকুটটা হাতে নিয়ে দেখল সেখানে কেবল একটাই বাক্য লেখা,”শুভ জন্মদিন নীলু।”
সে চিরকুট আর ফুল দেখে যতটা না অবাক হলো চিরকুটে লেখা নীলু নামটা দেখে তার থেকে বেশি অবাক হলো।তার নাম তো তুলি।কিন্তু চিরকুটে নীলু লেখা কেন!তার প্রিয় “দেবী” উপন্যাসের নীলু চরিত্রটা তার অনেক ভালো লাগে।এজন্যই হইতো সে চিরকুট কে দিলো সেটার চেয়ে চিরকুটে নীলু লেখা কেন সেটা জানার জন্যই বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠলো।কিন্তু জানার কোন উপায় না থাকায় বেশ খানিকটা বৃথা চেষ্টা করে তাকে থামতে হলো। আজ পহেলা ফাল্গুন অর্থাৎ বসন্তের প্রথম দিন।আজও ঠিক একই কান্ড।জানালা বন্ধ করতে গিয়ে আজও তুলি সেরকম একটা চিরকুট এবং কয়েকটা বেলীফুল পেল।কেউ একজন তাকে বসন্তের শুভেচ্ছা জানিয়েছে।আজকেও চিরকুটের শেষে নীলু নামটা লেখা ছিলো।
আজকে আর থেমে থাকলে চলবে না,তুলির জানতেই হবে কে এই ভদ্রলোক।কেন তাকে বিশেষ দিনগুলোতে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে? তুলির মনে এখন বেশ কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরছে। এই লোকটা কে? আমার জন্মদিনের কথা সেইবা কেমন করে জানলো? সে আমাকেই বা কেন গভীর রাতে লুকিয়ে এভাবে আমাকে চিরকুট দিচ্ছে? লোকটা আসলে কি চায়! তুলি আর ভাবতে পারছে না।এতোসব প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ।অথচ কোন প্রশ্নের উত্তরই সে জানে না। তুলি মনে মনে ঠিক করলো,সে লোকটাকে একটা চিঠি লিখবে।পরক্ষনেই তার মনে হলো,চিঠি পাঠাবে কোন ঠিকানায়! ঠিকানা জানুক আর নাই জানুক।তুলি চিঠি লিখবেই।তার মনে যত প্রশ্ন আছে সবই সে চিঠিতে লিখবে।লিখে জানালার কাছে রেখে দিবে।যদি কোনদিন লোকটা আবার আসে,এই আশায়।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল।তুলির মন থেকে লোকটার বিষয়ে তার প্রশ্নগুলোও ঝাপসা হয়ে গেল।তার লেখা চিঠিটাও সে জানালার খাজ থেকে তুলে নিলো।সে আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করলো। এরই মধ্যে সে আবারও জানালার কাছে একটা কাগজ এবং আবার সেই বেলীফুল পেল।এবারের কাগজটা বেশ বড়।মনে হচ্ছে চিঠি।তুলি আর দেরি করলো না।সাথে সাথেই কাগজটা মেলে পড়তে শুরু করলো। “প্রিয় নীলু কেমন আছো তুমি? নীল শাড়িতে তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।” চিঠিতে আর একটা অক্ষরও লেখা নেই,সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।তারপরও তুলি চিঠিটা কয়েকবার উল্টে পাল্টে দেখলো।কিছুই পেল না।
তুলি স্বভাবতই কারো উপর রাগে না,কিন্তু আজ রেগে গেলে।রাগে তার মুখ অগ্নিমূর্তির রুপ ধারণ করলো। রাগে,দুঃখে,অভিমানে তার চোঁখে অশ্রুবারি শুরু হয়ে গেল।সে অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছে না।তাকে যে কোন মূল্যেই জানতে কে এই পত্র লেখক? তুলি এখন নীল রংয়ের শাড়ি ছাড়া কোন কিছুই পরে না।বাড়িতে বাইরে সবসময়ই সে নীল শাড়ি পরে। তুলির চোখ জোড়া সারাক্ষণ সেই পত্র লেখককে খুজে বেড়ায়।কিন্তু খুজে কি হবে! সে কি করে চিনবে তাকে? তুলি কোনকিছুই এখন ঠিকমতো করতে পারছে না।নিয়মিত ক্লাসেও এটেন্ড করছে না।পড়াতেও মন বসাতে পারছে না।এমনকি সে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করছে না।
জহির সাহেব মেয়ের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে বেশ খানিকটা চমকে গেল।তুলিকে হাজারটা প্রশ্ন করেও কিছুই জানতে পারলো না।তুলির একমাত্র বান্ধবী তৃণাকে নানা রকম প্রশ্ন করা হলো কিন্তু তৃণাও কিছু বলতে পারলো না। এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেল। তুলি আবারও ঠিক করলো সে লোকটাকে একটা চিঠি লিখবে।এবার আর সরাবে না।যতদিন না লোকটা আসে চিঠিটা ওখানেই থাকবে। কিন্তু কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসেই থমকে গেল।চিঠির সম্বোধন কি হবে! অনেক ভেবেও কোন সম্বোধন খুজে পেল না।সে বাধ্য হলো সম্বোধন ছাড়াই চিঠি লিখতে। “আপনি চিরকুটে নীলু লিখছেন কেন? আমার নাম তো তুলি।
আপনি কে? আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? আপনি এমন করছেন কেন আমার সাথে? আপনাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন।প্লিজ একবার দেখা দিন। আচ্ছা শুনুন,আমি আপনার একটা নাম দিয়েছি।নামটা কি জানতে চান? নামটা হলো ‘মুহি’। আপনার নাম মুহি।নাম পছন্দ হয়েছে? এই নামের ব্যাখা জানতে চান? শুনুন তাহলে,মুহি নামটা আসছে হুমায়ূন স্যারের বিখ্যাত সৃষ্টি “হিমু” চরিত্র থেকে।আপনি হলেন হিমুর মতো।কিন্তু হিমুকে হাজার লোকের ভিড়েও তার বিখ্যাত হলুদ পাঞ্জাবি আর খালি পা দেখে চেনা যায়।কিন্তু আপনাকে চেনা যায় না।রুপা মাঝে মাঝে হিমুর দর্শন পায়।কিন্তু আমি আপনার দর্শন পাই না।এজন্যই আপনি মুহি।বুঝতে পেরেছেন?”
চিঠিটা একবার পড়েই ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেললো তুলি।চিঠিতে নেহাতই অবান্তর কথা লিখে ফেলছে।তাছাড়া কথাগুলো এমনই অগোছালো,কেমন বেঢপ লাগছে। তারপর আবার লিখতে শুরু করলো। নাম আর নামের ব্যাখা বাদে বাকি কথাগুলো লিখলো পত্রের শেষে আরো কি একটা বাক্য যেন লিখেছিলো,সেটা জানা যায়নি। এবারের চিঠিটা বেশ গোছানো,তার নিজেরও খুব পছন্দ পছন্দ হলো। চিঠিটা বেশ কয়েকবার পড়ে যথাস্থানে রেখে দিলো। মিনিট,ঘন্টা,দিন পেরিয়ে প্রায় ৭ মাস কেটে গেলে কিন্তু কেউ চিঠিটা নিতে এলো না।তুলি রোজ একবার করে চিঠির ধুলো মুছে চিঠির সাথে কিছু কথাবার্তা বলে যথাস্থানে রেখে দেয় (চিঠির সাথে তুলির কথোপকথন উল্লেখ করলে তুলি লজ্জা পেত বলে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম)।
এরই মধ্যে তুলির জন্মদিন ঘনিয়ে আসছে।তুলি কখনো তার জন্মদিন মনে রাখে না।কিন্তু এইবার রাখছে।খুব আগ্রহ নিয়ে সেই দিনের অপেক্ষা করছে।তার কেন যেন মনে হচ্ছে লোকটা আবার আসবে। জন্মদিনের আগের দিনগুলো যেন ফুরোতেই চাই না। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এসে গেল।তুলি এখন শুধু তাকে চিঠি দিয়েই থেমে থাকতে নারাজ।সে সারারাত জানালার দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে।লোকটাকে তুলি নিজ চোখে দেখতে চায়।এবং আজ রাতেই দেখতে চায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গড়িয়ে ভোর হতে চললো কিন্তু কেউই এলো না।
তুলির ভেতরটা যেন ভেঙ্গে চুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।কোনভাবেই সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।দুই চোখে এরই মাঝে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে এবং ক্রমেই সেটা বেড়ে চললো।কাদতে কাদতে কখন যে তুলি অজ্ঞান হয়ে গেল বোঝা গেল না। তুলি সজ্ঞানে আসলো বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে।চোখ খুলেই তুলি জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো হলুদ রঙের একটা চিরকুট এবং তার রাখা চিঠি নেই। তুলির সারা শরীরে বিদ্যুত চমকে গেল।অজানা শিহরনে তার সারা শরীর কেপে উঠলো।চিরকুট হাতে নিয়ে সে মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে উত্তেজনায় পড়তেই ভুলে গেছে।কয়েক মূহুর্ত পর সাময়িক ধ্বকল কাটিয়ে উঠলো। এইবারও একই কান্ড “শুভ জন্মদিন নীলু।” ছাড়া আর কিছুই লেখা নেই। আবারও তুলির মন খারাপ হলো তবে এই ভেবে স্বস্তি পেল যে,তার লেখা চিঠিটাতো সে পেয়েছে।এইবার নিশ্চয় জবাব দিবে।
তুলি তার জবাবের অপেক্ষায় থাকে কিন্তু জানালার খাজে কোন চিঠি আসে না।সে প্রতিটা রাত নির্ঘুম কাটায়।প্রতিটা মূহুর্ত সে চিঠির জবাবের অপেক্ষা করে। দিন যায়, মাস যায়,বছর যায় চিঠির কোন জবাব আসে না। এরই মাঝে একদিন হঠাৎ করেই তুলির বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।তুলি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে। তুলির আত্মীয়-স্বজনরা তুলিকে নিতে আসে।কিন্তু সে কিছুতেই যেতে রাজি হয় না।সে অপেক্ষা করবে।তার চিঠির জবাবের জন্য অপেক্ষা করবে।দরকার হলে অনন্তকাল অপেক্ষা করবে। ৩ বছর পর তুলি এখন মানুষিক ভারসম্যহীন।গত তিন বছরের একাকীত্ব আর বাইরের দুনিয়ার সাথে সংযোগহীনতা সাথে উদ্ভট সব চিন্তা ভাবনা তাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।
এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।হলুদ পাঞ্জাবি পরা কাউকে দেখলেই সে মুহি মুহি করে তার কাছে ছুটে যায়।তখন তাকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়।অনেকেই রেগে গিয়ে চড়-থাপ্পড়ও মারে। ৩ বছর আগে তুলির বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন ছিলো কিন্তু বর্তমানে কেউ নেই।কারণ এখন সে রাস্তার পাগলী।কে এই পাগলীর দায়িত্ব নিবে? কেউ না। হঠাৎ একদিন তুলির সাথে তার প্রিয় স্যার আসাদ বাবুলের দেখা হয়ে যায়। আসাদ বাবুল স্যার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি পড়াতেন তখন তুলি তার প্রিয় ছাত্রী ছিলো। এতোদিন পর দেখা,তাছাড়া ৫ বছর আগের তুলি আর এখনের তুলির মধ্য আকাশ-পাতাল পার্থক্য।তখন তুলি ছিলো দারুণ রুপবতী।
আর আজ রুপ তো দূরে থাক তাকে দেখে মানুষ ভয় পায়।শরীরের হাড়ের একটা ফ্রেমই শুধু বোঝা যায়।তাছাড়া কুচকে যাওয়া চামড়া ছাড়া শরীরে কিছুই নেই। আসাদ স্যারের পক্ষে কোনভাবেই তুলিকে চেনার কথা না।কিন্তু তিনি চিনতে পারে।মানুষের শরীরিক যতোই পরিবর্তন হোকনা কেন,তার চোখ সবসময় একই রকম থাকে।প্রথম দেখাতেই তিনি তুলিকে চিনতে পারে।হয়তো চোখ দেখেই চিনতে পারে। তারপর তিনি স্থানীয় পান বিক্রেতা মতি মিয়ার থেকে তুলির জীবনে ঘটে যাওয়া গত ৫ বছরের সমস্ত ঘটনা জানতে পারে।তিনি সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় তিনি নিজে তুলির চিকিৎসা করবে। ৫ বছর আগে হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়েই আসাদ স্যার ঢাকা থেকে উধাও হয়ে যায়।কেউই তার কোন খোজ বের করতে পারেনি।
এতোদিন তিনি কি একটা অদ্ভুত সমস্যার জন্য খুলনার একটা গ্রামে পড়ে ছিলো।এখন তার মনে হয়েছে হইতো এতোদিনে সব ঠিক হয়ে গেছে।তাই তিনি গতকালই ঢাকায় এসেছেন।আর আজই তারতুলির সাথে দেখা। আসাদ স্যারের বয়স ৮০ ছুই ছুই।তবুও তুলিকে কোলে করে রিক্সায় তুলতে তার তেমন বেগ পেতে হলো না। কিইবা বেগ পাবে তুলির বর্তমান ওজন ২০ কেজির আশ পাশে কিছু একটা হবে।তিনি তুলিকে সোজা তার বাসায় নিয়ে আসলো।এবং সেখানে রেখেই তার চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত নিলো। আসাদ সাহেবের বাড়িতে টুলু আর তিনি ছাড়া কেউ থাকে না।টুলুর বয়স ১১ বছর।টুলুকে তিনি খুলনা থেকে নিয়ে আসছেন তার সংসারের টুকিটাকি কাজ করার জন্য।আসাদ সাহেবের আপন বলতে তেমন কেউ নেই।
যৌবনে তার প্রেয়সী তার সাথে ছলোনা করে আরেকজনের হাত ধরেছিলো।তারপর আর আসাদ সাহেব কারো হাত ধরেনি।বৃদ্ধ বয়সে এসে অবশ্য এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলো। থাক সে কথা। আসাদ সাহেব এখন সারাটা দিন তুলির চিকিৎসার কাজে ব্যাস্ত থাকে। শারীরিক অবস্থার বেশ উন্নতি হলেও মানুষিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়না। তবুও আসাদ সাহেব নাছোড়বান্দা তিনি মনে মনে শপথ নিয়েছেন,তুলি যতদিন না সুস্থ্য হবে তিনি চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন।যে কোন মূল্যে তিনি সুস্থ্য করে তুলতে চান। আসাদ সাহেব তুলির জন্য অনেকগুলো নীল শাড়ি কিনেছেন।নিজের জন্যও কয়েকটা চকচকে হলুদ পাঞ্জাবি কিনেছেন।
তিনি সারাদিন তুলিকে নীল শাড়ি পরিয়ে রাখেন।নিজে হলুদ পাঞ্জাবি পরে।দুজনে মুখোমুখি বসে থাকে।তুলিকে তিনি যা বলতে চান সবই হলুদ চিরকুটে লিখে বলেন।আর প্রতিটা শব্দের শেষেই নীলু নামটা লিখে দেন। খানিকটা এরকম যে,” কেমন আছো নীলু?” “নীল শাড়িতে তোমাকে দারুণ লাগছে নীলু।” ইত্যাদি। তুলি কোন কিছুরই উত্তর দেয় না,সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে আসাদ সাহেব আর চিরকুটের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসাদ সাহেবের বিশ্বাস তিনি তুলিকে সারিয়ে তুলবেন।খুব দ্রুতই তুলি সুস্থ হয়ে যাবে।