ধর্মসাক্ষী

ধর্মসাক্ষী

মঞ্জুর একেবারে মাটির মানুষ।
ঝগড়া বিবাদ অশান্তি কিছুই পছন্দ করেনা।
তেমন বেশি সাহসীও নয় সে।
মঞ্জুর খুবই সাধারণ ও সাধামাটা স্বভাবের। পড়ালেখাতেও বেশি দূর এগুতে পারেনি।
ছোটকালেই বাপ মরা এতিম ছেলে সে। গ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিলো তাদের স্কুল ঘর। ক্লাশ এইট পর্যন্ত পড়ে আর যাওয়া হয়নি।
মা সামান্য জমি বেচে দোকানটা করে দিয়েছিলেন।। ভিটের ঘরটা ছাড়া, ছোট্ট দোকান এইটুকুই এখন তার সম্বল, সম্পত্তি।
মা অবশ্য বেশিদিন বাঁচেননি। তার বিয়ের দেড়বছরের মাথায় দুইদিনের জ্বরেই মারা গেছেন।
এমন অজঁপাড়া গাঁ তাদের, স্কুল, মাদ্রাসা, ডাক্তারখানা সবকিছুই হাতের নাগালের বাইরে।
সে মক্তবখানায় কোরান পড়েছে অবশ্য। শুধুই গড়গড় করে কোরান পড়া আর কয়েকটা সুরা মুখস্থ করা ছাড়া ধর্ম সম্পর্কিত আর কোনো জ্ঞান নেই তার এবং গ্রামের অন্যান্য সবার।
মক্তবে চিল্লিয়ে আলিফ যবর আ
বা যবর বা এভাবে এই শিখিয়েছে । সাথে হুজুরের মুখে মুখে, আলহামদুলিল্লাহী রাব্বিল আলামিন…

প্রেম ভালোবাসা বলে পৃথিবীতে কিছু আছে, তাও যেন তার অজানা। বিয়ের আগে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে চায়নি সে।
অবশ্য এমন অজপাড়া গাঁয়ে খোলামেলা প্রেম করাও নাই। দুই একজন যে চুরি করে প্রেম ভালোবাসা করতোনা তা নয়।
এমনকি দুই একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকাকে তো ধরা পড়ে, হুজুর ডেকে বিয়েও দিয়েছে সমাজের মুরুব্বীরা!
বিয়ের পর তাদের প্রেম দরজা, জানালা, ঘরের বেড়ার ফুঁটো সব জায়গা দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। সারাদিন ঝগড়া ঝাটি, অশান্তি, ডেকচি ছোঁড়াছুড়ি!
মঞ্জুর ভাবে, গোপনে তাদের এতো ভালোবাসা বাসি সব এই কয়দিনে কই হারালো!
ধরা না পড়লে কি তবে তারা বিয়ে করতোনা?
প্রেম করেছে কি, এমনি এমনিই! বিয়ে পর্যন্ত যেতো না তবে !
তবে এই কিসের আকর্ষণে তারা এক হতে আসতো?
মঞ্জুর মাথায় এতো প্যাঁচগোছ ঢুকতো না। সে সারাজীবন তা থেকে দূরেই ছিলো।
একেবারে বিয়ের বয়স হলে বিয়ে করেছে সে।
তবে সে হিসেবে বউ আরিফা কিছুটা রগচটা। এরপরেও অনেকটা বিবাদহীনভাবেই ছয় বছরের বিবাহিত জীবন কেটে গেছে তাদের। মঞ্জুর বা আরিফা দুইজনই দুইজনকে অনেক ভালোবাসে, বিশ্বস্ত একে অপরের প্রতি। বিয়ের আগের প্রেম, পরেই পেলো না হয় সে। তাতেই মঞ্জুর অনেক খুশি।
সে প্রেমে দুই সন্তানের মা বাবাও হলো তারা।
পাঁচ বছরের মারুফ আর দুই বছরের কন্যা মালা।
মালা তো মঞ্জুরের জন্য পাগল। ঘর ফেলে বিশ কদম দূরে তার মুদি দোকান। মারুফকে সাথে করে দিনে দশবারের বেশি তাকে দোকানে পাঠাতে হবে। নইলে বাবা বাবা বলে কেঁদে কেটে গলায় রক্ত আনবে, এমন মরাকান্না জুড়ে দেবে সে!
আরিফা, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ভাইবোন দুইজনের বাপের দোকানে যাওয়া দেখবে। মেয়েটা বেশি চঞ্চল, ভাইকে হাত ধরতে দিবেনা। একা একা সে চেনে, ঠিক ঠিক দোকানে ভাইয়ের আগে পৌঁছে যাবে।
আরিফা, মঞ্জুরকে বকে,
“নিশ্চয় কাটি চকলেট খাওয়ায় মেয়ের অভ্যাস খারাপ করে দিছো। সারাদিন বাপ বাপ, ঘরে তার মন টিকেনা। তোমার দোকানদারি কিছু হয়, এ্যা? কয়েকদিন চকলেট দিবা না। তাইলেই আর যেতে চাইবেনা, বুঝছো?””””
“হ, বুঝছি।” জবাবে বলে সে।
মুখে বলে দেবেনা কিন্তু মেয়ে চাইলেই দিয়ে দে।
“বাবা, চকি দাও, চকি…”
এমন করে বলে, কিভাবে সে মুখ ফিরিয়ে নেবে!
সেদিনও মঞ্জুর মেয়ে নিয়ে দোকানদারি করছিলো।

আশেপাশে অনেক ঘর আর তাদের বাচ্চাদের সাথে ছেলে খেলছিলো। এখনো তাকে স্কুলে দেয়া হয়নাই। স্কুল এই গ্রামে নাই। তাই আরেকটু বড় হলে পাঠাবে ভেবে রেখেছে। ছেলে এখন মক্তবে, কায়দা বইয়ে আলিফ বা পড়ে শুধু।
হুজুরের ঘর ধরতে গেলে মঞ্জুরের ঘরের পাশেই। হুজুরের সাত ছেলেমেয়ে। দুই মেয়ে বারো তেরো বছর হতেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে মারুফের প্রিয় বন্ধু।
মঞ্জুর কোনদিন তার বন্ধুদের ঘরে আনেনা। সে নিজেও কখনো কারো ঘরে যায়না। বন্ধু বলতে রমিজ, তোফায়েল, আমজাদ এই তিনজন।
তার মধ্যে রমিজের চোখ খারাপ! এখনো সে বিয়েও করেনাই।
বিয়ে করলে নাকি রহস্য শেষ!
কি রহস্য মঞ্জুর বুঝতে পারেনা। মঞ্জুরের এসব কথা ভালো লাগেনা কিন্তু বাকি বন্ধুরা তার কথা শুনে খুব হাসে। সে রসিয়ে রসিয়ে মন্দ কথা বলতে ওস্তাদ।
সেই রমিজ আরিফের ঘরের দরজায়, মঞ্জুরের নাম ধরে ডেকে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে।
আরিফা, দরজা খুলে বলে,
“উনি তো বাসায় নেই ভাই। এখনো দোকানে।”
“দোকান তো বন্ধ দেখলাম।” রমিজ বলে।
“কি বলেন, মেয়েও তো সাথে আছে!”
“তাইলে আশেপাশে কোথাও গেছে, চলে আসবে। তা ভাবী, আমি কি ঘরে বসে অপেক্ষা করতে পারি?”

আরিফা লজ্জা পায়। তখনো সে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিলো।
মঞ্জুরের বন্ধুরা ঘরে কখনো আসেনা, তাই সে বুঝে উঠতে পারেনা কি জবাব দেবে।
“অ ভাবি, কি চিন্তা করেন! এক গ্লাস পানি হলেও খাওয়ান। দেবর লাগিতো আপনার।” রমিজ তার স্বভাব সুলভ রসাত্বক আলাপ জুড়াতে চায়।
“আসেন, ঘরে আসেন।” লজ্জিত আরিফা দরজা ছেড়ে দেয়।
আরিফা পানি’র সাথে ঘরে দোকান থেকে আনা কলা আর গাছের পেয়ারা ছিলো। একটা প্লেটে করে তাও দেয়।
রমিজ, পেয়ারা খেতে খেতে আরিফাকে বলে,
“একটা বউ দেখেন না ভাবী। রাইত তো কাটতে চায়না।”
“কার বউ কে আপনাকে দেবে, হিহিহি…”
রমিজের কথা শুনে হাসি পায় আরিফার।
সে আবার প্রশ্ন করে,
“আপনে এখনো বিয়ে করেন নাই!”
“আপনার মতো মাইয়া পাইলে কবেই করতাম!”

এইসময় মঞ্জুর, মেয়ে কোলে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে।
রমিজের স্বভাব তার ভালোই জানা, শেষ কথাটাও কানে যায় তার।
সে রাগ ক্ষোভ সব লুকিয়ে রমিজের সাথে কিছু কথা বলে তাকে বিদায় দেয়।
রমিজ যেতেই, সব রাগ আরিফা’র উপর গিয়ে পড়ে।

“রমিজের সাথে এতো কিসের কথা, এতো কি হাসাহাসি? ”
রমিজ ঘর থেকে বের হতেই আরিফাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মঞ্জুর।
“এসব কি বলো! ঐ বেডার নাম রমিজ, তাও তো জানিনা।”
“না জেনেও তো দুনিয়ার সব গপ শুরু কইরা দিছো। রমিজ্যার মধ্যে কি পাইছো, সকল মাইয়্যা তার কথায় উঠবস করতাছো। তুমি দুই বাইচ্চার মা, চোখে শরম নাই? লইজ্জা নাই?”
“উল্টাপাল্টা কথা কইলে কিন্তু তোমার সংসার লাত্থি মেরে চলে যাবো। সন্দেহ কইরা এসব কি বলো তুমি?”
“লাত্থি মেরে যাবে, যাও। চাইলেই এখন তালাক দিয়ে দেবো। যাও রমিজ্জ্যার গলায় ঝুইল্ল্যা পড়ো, যাও যাও।”
“হ, যামুই তো। তোমার চেয়ে ভালোই হইবো মনে হয়।”

বেঁড়ার ঘর মঞ্জুরের। চারপাশে সব প্রতিবেশীদের ঘরবাড়ি । সবাই তাদের মাঝারি উচ্চের স্বর স্পষ্ট শুনতে পায়।
মেয়ের দল, সাথে কিছু পুরুষও ঘর ঘিরে রাখে। আরো কি হয় শুনতে চায় সবাই।
হুজুরের বউ তো ছেলেকে দিয়ে তার জামাইকেও আনিয়ে নিয়েছে এবং তার কানে কানে বলে দিয়েছে,
মঞ্জুর তার বউরে তালাক দিছে। বউ নষ্টামি করতে গিয়ে ধরা খাইছে!
হুজুর মঞ্জুরের ঘরের সামনে আসলে, সব মেয়েরা মাথার ঘোমটা টেনে দূরত্বে সরে দাঁড়ায়।
হুজুর গলা খাঁকড়ি দিয়ে মঞ্জুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। না শুনলে তার নাম ধরে ডাকেন।
“অ মঞ্জুর…
একটু শুনে যাও।”
ঘরে মঞ্জুর আর আরিফা’র কথা কাটাকাটা থেমে গেছে অনেক আগেই।
আসলে, চরিত্রহীন বন্ধুকে একলা ঘরে বউয়ের সাথে কথা বলতে দেখায় তার শান্ত মাথায়ও আগুন উঠে গিয়েছিলো।
সেতো জানে, আরিফা কেমন মেয়ে! আরিফা যে একটু রগচটা তাও মঞ্জুরের ভালো জানা।
পরে না হয়, রমিজ সম্পর্কে আরিফাকে বুঝিয়ে বললেই হতো। তা না, ঘরে ঢুকে রমিজকে দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছে তার। তাও ধৈর্য ধরে রমিজরে বিদায় করলো। আর রমিজের উপরের সব রাগ ঝাড়লো আরিফার উপর!

মঞ্জুর ভাবে, না,ব্যাপারটা একদম ঠিক হয়নাই।
আরিফা থেকে মাফ চেয়ে, রমিজের চরিত্র কেমন তা জানিয়ে সাবধান করে দিতে হবে তাকে।
বাইরে হুজুর ডাকেন কেনো, দেখতে গিয়ে মঞ্জুর খানিকক্ষণ হা হয়ে যায়।
বাড়িসুদ্ধ সব মানুষ, তার ঘর ঘিরে রেখেছে!
“আসসালামু আলাইকুম হুজুর চাচা। ডাকছেন?” মঞ্জুর জানতে চায়।
“ওয়াইলেকুম সালাম। কামটা তো তুমি ভালা করলানা মিয়া!”
“কি করছি আমি!”
“বউরে তালাক দিলা।”
“কই তালাক দিলাম?”
“বাড়িসুদ্ধ মানুষ কি তবে মিছা কয়? এত্তোগুলা সাক্ষী!
বউ আকাম করছে, তারে শাস্তি দিবা, মারবা, বিছানা আলাদা করবা। তারপরও ঠিক না হইলে তালাক দিতা।
“আমার বউ কখন আকাম করলো হুজুর? কি কন আপনে!”
“যা হইছে, হইছে। এবার বউ বিদায় করো। তালাক বউয়ের সাথে এক ঘরে….ছিঃ ছিঃ ছিঃ
এখন তুমি তার জন্য পরপুরুষ! ”
“হুজুর শুনেন, আমি কোন কারণে বউয়ের সাথে রাগারাগি করছি, সত্য কথা। গলার আওয়াজ একটু বড় হইছে, এইটাও সত্য কিন্তু তালাক দিই নাই। বউও কোনো আকাম করে নাই। বুঝছেন?”
“বুঝি নাই। বউরে বিদায় করো, পরের কথা পরে। কি বলেন গ্রামবাসীরা? তালাক শুনছেন না সবাই?”
“শুনছি।”
সমস্বরে চিল্লিয়ে বলেন তারা। আজ তাদের গলায়ও জোর বেশী। প্রতিদিন তো এমন বিনোদন আর হয়না গ্রামে। মাঝেমধ্যে হয়। তখন কাঠের আগুনে, শুকনো ঘাস আর ফুঁ দিয়ে আগুন বাড়িয়ে দিয়ে সৌন্দর্য্য দেখন লাগে তাদের।
” যাও বউরে বাইর হতে বলো।” হুজুর বলেন।

ঘরের ভেতর থেকে আরিফা সব শুনছে। সে এমনিতেও মঞ্জুরের উপর রেগে আছে।
এতো মানুষের সাক্ষী এবং হুজুরের এসব কথা শুনে বড়ই অপমানিত বোধ করে সে। অনেক কাঁদে আরিফা । ইচ্ছে করে গলায় ফাঁস দিতে। কিন্তু তার দুই বাচ্চা ধরতে গেলে এখনো একেবারে দুধের বাচ্চা। তার উপর সেতো কোনো পাপ করে নাই, ফাঁস খাইবো কেনো?
তার সুখের ঘরে কার নজর লাগলো! মনে মনে ঐ রমিইজ্জ্যারে অনেক গালি পাড়ে আরিফা। কোন কুক্ষণে যে, সেই শয়তান ঘরে এসেছিলো!

তারপর, আরিফা মেয়ে কোলে ঘর থেকে বেড়িয়ে ছেলে মারুফের হাত ধরে হাঁটা ধরে। মেয়ে বাপ বাপ বলে চিল্লায়। বাপের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, বাপ পাগলি মেয়েটা। ছেলেটা আগামাথা কিছুই বুঝেনা। চুপচাপ মায়ের হাতের মুঠোর ভেতর তার ছোট্ট হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে থাকে।
মঞ্জুর চিল্লিয়ে বউরে ডাক দেয়। পাশে গিয়ে মেয়ে কোল থেকে কেড়ে নিতে চায়।
বাড়ির মানুষ বাধা দেয় তাকে।
বলেন,
“বউয়ের উপর আর কোনো হক নাই তোমার!”
বউ ফিসফিসিয়ে বলে,
“সব ঝামেলা শেষ হোক, তারপর আসবোনে।”
সে দুই বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ির পথ ধরে।
তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। দুই ছেলেমেয়েতে দুই হাত বান্ধা তার, চোখ মুছতে পারেনা সে।
বাপের বাড়ি বেশি দূর নয়, পঁচিশ ত্রিশ মিনিট পথ চললেই তার গ্রাম এসে যাবে।
সবাই যে যার ঘরে চলে যায়।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। মঞ্জুর তার ছোট্ট উঠানে মাটির উপর বসে থাকে।
ভাবে, কি হতে কি হয়ে গেলো!
সামান্য ঝগড়া হলো। জামাই বউয়ের মধ্যে কি ঝগড়া হয়না! প্রতিদিনই তো হতে দেখছে সে। হ্যাঁ, তালাক শব্দটা সে মুখে উচ্চারণ করেছে। আর তা দেবেও বলেছে, দেয়নি তো!
রাগের মাথায় হলেও মঞ্জুর মুখে কি বলেছে, তা তার স্পষ্ট মনে আছে।
কিন্তু এতোগুলো মানুষ কি শুনতে কি শুনলো! ভালোভাবে না শুনেই সাক্ষী দিয়ে দিলো! রায় দিয়ে দিলো!?
মঞ্জুর এই বিচার মানেনা।

মঞ্জুরের ঘরটায় কবরস্থানের নীরবতা। অন্ধকার, ল্যাম্পের আলো জ্বালানো হয়নি। ঘর মুখো হতে ইচ্ছে করেনা তার।
মঞ্জুর আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে।
শক্তিহীন পায়ে মাতব্বরের ঘরের দিকে চলতে থাকে।
পুরো রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশেপাশের প্রত্যেক ঘর থেকে মোম বা ল্যাম্পের হালকা আলো দেখা যাচ্ছে বেড়ার ফাঁক দিয়ে। যাদের ঘর মাটির বা টিনের, তাদের ঘর ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। সন্ধ্যা হতেই পুরো গ্রাম নিরব হয়ে যায়।
ইলেক্ট্রিসিটি, টেলিভিশন, রেডিও কিছুই নেই কারো ঘরে। পড়ালেখার আওয়াজ আসে অল্প কিছু ঘর থেকে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শুনা যায় আর দুই একটা ব্যাঙ ডাকাডাকি করছে শুধু। পথে দুই একটা পরিচিত কুকুরের দেখাও মিলে। তারা নি:সংগ মঞ্জুরের সাথে সাথে নিঃশব্দে হাঁটে।

বাইরে থেকে অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর মাতব্বর আসে।
“মঞ্জুর দোকানদার নাকি! কি ব্যাপার, শুনলাম বউ তালাক দিছস?”
মাতব্বর পঞ্চান্ন বা সাতান্ন এমনতর বয়সী। মঞ্জুরের বাপের বয়সী হবে।
“না, মাতব্বর চাচা। তালাক দিই নাই।”
“সবাই যে শুনলো, তালাক দিছস।”
“রাগের মাথায় বলছি, এমন করলে তালাক দিবো। কিন্তু দিইনাই। আপনি বিচার করেন। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।”
“আমি আর কি বিচার করুম। সবাই যা শুনেছে, এতো সাক্ষী সাবুদ। আমার একজনের বিচার কে মানবো। উল্টা আমি সমাজে খারাপ হয়ে যাবো।”
“তাইলে কি করুম চাচা?”
“বউ আবার ঘরে আনতে চাস?
তবে হিল্লা বিয়ে করে আন।”
“হিল্লা বিয়ে! ফয়েজ ভায়ের বউয়ের মতো? না না চাচা। উনার বউনা বিষ খেলো?”
“ওর বউ বিষ খাইছে বলে, তোর বউও খাবে নাকি? সবাই কি একরকম বেকুব হয়?
এর আগে তোদের ঐদিকে সোবহান মিয়াও হিল্লা বিয়ে করলো, মনে নাই?”
মঞ্জুরের সব মনে আছে।
ফয়েজ রাগের মাথায় বউকে তালাক দিয়েছিলো। আবার শান্ত হলে, বউ আনতে চায়। এদিকে বিচারে মাতব্বর জানিয়েছিলেন, আগে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে।
হিল্লা বিয়ে মানে হচ্ছে, তালাক দেয়া বউকে আরেকজনের কাছে বিয়ে দিয়ে আবার তার থেকে তালাক নিয়ে প্রথম স্বামী বিয়ে করবে।
আর ফয়েজের বউকে মাতব্বর হিল্লা বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মাতব্বরের সাথে বিয়ের দিন রাতে ফয়েজের বউ বিষ খেয়ে নেয়। ডাক্তার, বৈদ্য না পাওয়ায় অনেকক্ষণ কষ্ট পেয়ে সে বউ মরেছে। হুজুর তার জানাজাও পড়ে নাই।
এমন মরাতে নাকি জানাজার নিয়ম নাই। ফয়েজ ভাইকে কবরস্থানেও যেতে দেয়নি, পরপুরুষ বলে!
বউটাকে কয়েকজন একটা তক্তার সাথে বেঁধে, তাদের হাঁটুর নিচে ধরে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসছিলো। খাটে শুয়ানো যাবেনা, কাঁধেও নেয়া যাবেনা বিষ খাওয়া মরদেহ, এটাই নিয়ম নাকি! সব মনে আছে মঞ্জুরের।
বিষটাও যে ফয়েজ ভাইয়ের বউ, তার দোকান থেকে কিনিয়েছিলো!
দশ বছরের ছেলেকে পাঠিয়ে ছয় পেকেট ইঁদুরের বিষ!
ছেলে বলেছে,
“মা বলছে, নানার বাড়ির সব ঘরে বেশি ইঁদুর হইছে। তাই বেশি করে বিষ দিতে।”

তার বুক অজানা আশংকায় কাঁপতে থাকে।
সোবহান চাচার বউকেও তো মাতব্বর চাচাই বিয়ে করেছিলো একদিনের জন্য! যেহেতু তিনি গ্রামের মাথা, সবকিছু সমাধানের মালিকও তিনি। তারই সব দায় মনে করেন। তিনিই দয়া করেন।
তাই একরাতের জন্য বিয়ে করে গ্রামবাসীকে সাহায্য করেন! হিল্লা বিয়ের পর, সোবহান চাচার বউ, চাচিটা ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিছেন। তাকে দেখলে নাকি, অন্যান্য মহিলারা ফিসফাস করেন!
মাতব্বর চাচা আবার কথা বলে উঠেন,
“কি ভাবছিস?”
তোর ছেলের মায়ের কাছেও খবর পাঠা, আমি একদিনের জন্য হিল্লা বিয়ে করতে রাজি আছি। তারপর তোর বউ তোর ঘরে। আমার কি? তোদের সাহায্য করাই তো আমার কাজ, আমার ধর্ম।
যা, ভেবে দেখ, নইলে নতুন আরেকটা বিবাহ কর। বেটা মানুষ, সমস্যা কি! বউ গেলে বউ আসে। তোদের ভালোর জন্যই হিল্লা বিয়ের কথা কইলাম। এ হলো ধর্মের কথা।”

মঞ্জুরের বিশ্বাস হয়না, এ কোনো ধর্মের কথা হতে পারে। সে ধর্মের কথা বেশি জানেনা। জানাবার জন্য মানুষও নাই এই গ্রামে।
যে হুজুর, তালাক দেয়নি সে, তবুও তালাক দিয়েছে বলে, সে অন্তত ধর্ম সম্পর্কে ভালো জানেনা। আর তার ধর্ম নিশ্চয় এতো নিষ্ঠুর না যে, একজনের শাস্তি আরেকজনকে দেবে। রাগের মাথায় তালাক দিয়ে অপরাধ করে ছেলেরা, হিল্লা বিয়ে দিয়ে শাস্তি দিবে মেয়েদের, এ কেমন আইন, কেমন বিচার! এতো ধর্মের বিচার হতে পারেনা।

মঞ্জুর মাতব্বরের কোনো কথার জবাব দেয়না।
সে তার ঘরের দিকে ফিরতি পথ ধরে। কুকুর দুইটা কোথাও ঘাপটি মেরে ছিলো এতোক্ষণ। মঞ্জুরের সাথে আবার পথ চলা শুরু করে তারাও।
ঘরে ঢুকার আগে দোকানে ঢুকে মঞ্জুর। বৈয়ম থেকে কিছু খোলা বিস্কুট দেয় কুকুরদের।
মানুষের চেয়ে ভালো মনে হয় তাদের।
তার আগে মোম জ্বালিয়ে অন্ধকার দোকান আলোকিত করে।
তার মাথায় কিছু খেলছে হয়তো।

মাতব্বরের বউ তাদের সব কথা শুনেন। মাতব্বর ঘরে ঢুকতেই বলে উঠেন,
“আরেকজন মাইয়ার জীবন নিয়ে খেলতে চান, এ্যা?”
“কি কও তুমি?”
“বুঝেন না কি কই? এতো বিয়ার শখ হইলে আরেকটা বিয়া করেন। একরাতের জন্য কেনো? সে তো বললো, তালাক দেয় নাই। হিল্লা বিয়ে আসে কিজন্য?”
“চুপ কর মাগি। তোরেও তালাক দিয়ে হুজুরের সাথে হিল্লা বিয়ে দিয়ামু।”
বউ চুপ হয়ে যায়। আর কিছু বলেননা। সে ভালোই জানে, এর দ্বারা তাও সম্ভব!

মঞ্জুর বুকটা ঠনঠন করছে মালা’র জন্য। শুধু মালা নয়, মারুফ, আরিফার জন্যও তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে।
না জানি, আরিফার উপর দিয়ে কত ঝড় যাচ্ছে!
সেতো মঞ্জুরের উপরও রেগে আছে। তার থেকে মাফ চাওয়াও হয়নি।
কি হতে কি হয়ে গেলো সব!
সামান্য দশ পনেরো মিনিটের ঝগড়া, তাদের জীবনটা এলোমেলো করে দিলো।

মঞ্জুর দোকানে ঢুকে পলিথিনে শুকনো কিছু খাবার নেয়, বিস্কুট জাতীয়।
জিনিষ বিক্রির জমা সব টাকা লুঙিতে গুঁজে নেয়। এবার সে ঘরে যায়। নিজের, ছেলেমেয়ে এবং বউয়ের দুই একটা শাড়ি একটা চাদরে বেঁধে নেয়। তারপর, ঘরে তালা দিয়ে হাঁটা শুরু করে।
একটা ব্যাটারি চালিত টর্চ ছিলো, তাও হাতে রাখে, জ্বালায়না।
কুকুর দুইটা আবার সংগ নেয়। ভালোই লাগে মঞ্জুর। একা একা পথ চলার চেয়ে সংগী পেলো সে।
মঞ্জুর গ্রামের শেষ মাথায় বন্ধু আমজাদের ঘর। আমজাদের গাছ বেচার ব্যবসা আছে। ভালোই আয়। কি ভেবে আমজাদের ঘরে টোকা দেয় সে।
দরজা খুলে আমজাদ অবাক হয়। মঞ্জুর কখনো কারো ঘরে যায়না।
“কিরে বন্ধু, ঘাট্টি বোসকা বেন্ধে কই যাস? তা রাতের বেলায় আমার ঘরে, কি মনে করে!”
“বিপদে পড়ে আসছি। তোর কিছু টাকা হবে? এই নে দোকানের চাবি। যা আছে আমাকে দে। আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
মঞ্জুর সংক্ষেপে ঘটনা বলে।
আমজাদ জোর করে তাকে বসিয়ে চারটা ভাত খাইয়ে দেয়। তারপর হাজার পাঁচেক গাছ বেচা টাকা ছিলো, তাও দিয়ে দেয়।
মঞ্জুর বলে,
“বন্ধু, আমি কখনোই এই দোকানের দাবি চাইতে আসবোনা। পারলে আমার বাপ দাদার ভিটে বাড়িটা দেইখা রাইখো। যদি বেঁচে থাকি কখনো দেখতে আসবো।”
দুই বন্ধু কেঁদে বিদায় নেয়।
আবার হাঁটতে থাকে। কুকুরদের বলে,
“আমি আমার দরকারে হাঁটি, তোরা এবার তোদের ঘরে যা..”
ঘেউঘেউ করে কুকুর কি বলে, বুঝতে পারেনা মঞ্জুর। তবে তারা ক্লান্তিহীন ভাবে ওর সাথে হাঁটতেই থাকে।
মঞ্জুরের শ্বশুরঘর দেখা যায়। একেবারে নীরব ঘর। নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে।
মঞ্জুর দরজায় টোকা দেয়।
শ্বশুর দরজা খুলে তাকে দেখে রাগ হয়।
“কি হইছে তোমাদের, এ্যা? মাইয়া কান্দে, নাতিন কান্দে।”
“বাবজান, ভুল বুঝাবুঝি হইছে। আমাকে মাফ দেন। বাড়ির সকলে বলতেছে, আমি আরিফাকে তালাক দিয়েছি। কথা সত্য নয়, মিথ্যা। আরিফাকে জিজ্ঞেস করেন।”
আরিফা আসে।
“জ্বি, বাবা। কথা সত্য। সে আমারে তালাক দেয় নাই। ”
মঞ্জুর বলে,
“আমি বিচারের জন্য মাতব্বরের কাছে গিয়েছি, সে বলে, আরিফাকে তিনি হিল্লা বিয়ে করে তালাক দিবেন। তারপর আমি বিয়ে করতে পারবো।”
“কি!”
চিল্লায় উঠে আরিফা।
“বেটা শয়তান! আমাদের কি তালাক হইছে যে, সে আমারে বিয়া করবো?”
“সেইজন্য পালিয়ে আসছি। এখানেও হুজুর নয়তো মাতব্বর এসে ফতোয়া দিবে। চলো আজ রাতেই আমরা শহরে চলে যায়। আমি তোমাদের কাপড় চোপড়ও নিয়ে আসছি।”
আরিফার মা বাপ, কেঁদেকেটে মেয়ে বিদায় করে।
তাদেরও অতো শক্তি নাই, মাতব্বরের বিরুদ্ধে লড়বে।
আরিফার মা, তার কানের একমাত্র সোনার দুল জোড়া খুলে মেয়ের হাতে দিয়ে দেন। বলেন,
” সাথে রাখ, বিপদআপদ কালে বিক্রি করিস।”
ঘুমন্ত মেয়েকে কাঁধে তুলে নেয় মঞ্জুর। মেয়ে বাপের গায়ের গন্ধ চিনে, একটু জোরেই জড়িয়ে ধরে ঘুমন্ত অবস্থায়।
সে আরেক হাতে খাবার আর কাপড়ের পুটলিটা নেয়।
আরিফা ছেলের হাত ধরে হাঁটে। ছেলের ঘুম ভেঙে গেছে, বাপ নানার কথার আওয়াজে। আর ঘুমাতে চাইছেনা সে।
কুকুর দুটিও তাদের সাথে হাঁটতে থাকে। যেন তাদের পাহারা দিচ্ছে, মঞ্জুরদের তাদের গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তারা।
মঞ্জুর ছেলেকে বলে,
“মারুফ..”
“জ্বি বাবা।”
“কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে?”
“না বাবা।”
“শোন, তোরে বড় মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিবো, ঠিক আছে?”
“আইচ্ছা বাবা।”
“শোন, অনেক বড় বড় পাশ দিয়ে হুজুর হবি। অনেক বড় হুজুর, মৌলানা। সবাইকে ধর্মের সঠিক সত্য কথা বলবি, ঠিক আছে?”
“হুম।” ঘুম জড়ানো গলায় জবাব দেয় সে।
“কিরে ঘুম পাই তর?”
“হুম।”
“অ মারুফের মা, মেয়ে তুমি নাও, ছেলে আমাকে দাও, তুমি পারবেনা।”

মঞ্জুর নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে। বউ ছেলেমেয়ে সাথে আছে। আর কোনো দুশ্চিন্তা তাকে ছুঁতে পারেনা।
“বুঝলে, মারুফের মা, মেয়েকেও অনেক অনেক পড়াবো। ওরা দুইজন আমাদের শেখাবে, হাজার হাজার লক্ষ মানুষকে সঠিকটা শেখাবে। তারপর আমরা আবার গ্রামে এসে যাবো।”
“হুম।”
জবাব দেয় আরিফা। কিন্তু তার মনে অনেক ঝড়ঝাপটা যাচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছে তারা?
কোন অজানায়? কিভাবে সব শুরু করবে? তারা কি পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছেনা!
গ্রামে থাকলে কি হতো…!
তা ভেবে আবার শিউরে উঠে সে। বাপের চেয়েও বুড়া মাতব্বরের একরাতের বউ….!!
না, আর ভাবতে চায়না সে। মঞ্জুর সাথে আছে, আর কোনো ভাবনা নাই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত