আমার ননাসের ছোট ছেলে মন্টু। বয়স ২৮, গায়ের রং কালো, বাপের ব্যাবসা জমি দেখাশোনা করে। মন্টুর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গেলাম। দর্শনা। গ্রামের নাম মনে নেই। মেয়ের নাম শিউলি, বয়স১৮, উজ্জ্বল শ্যামলা, প্রচন্ড মায়াবি মুখ। আমরা ওদের বাড়িতে পৌছানোর কিছু পরে দেখলাম শিউলিকে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকানো হলো। দু” বেনি চুল — ক’দিন যে খোলা হয়নি আল্লাহই জানে। পায়ে মাঠের কাদা লেগে আছে, ওড়নায় পেয়ারা বা কুল বাধা।ছোট একটা ছাগলের বাচ্চা শিউলির গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সাজিয়ে গুছিয়ে আমাদের সামনে আনা হল। জানালার বাইরে দেখলাম ওর খেলার সাথীরা উকি মারছে। মেয়ে আমাদের পছন্দ হলো। পাকা কথা দেয়া হলো। আগামী শুক্রবারে বিয়ে। শিউলির বিয়ে, শিউলি নিজেই খুব খুশি। এবার আর ছোট ভাইয়া যখন তখন ওর চুল টানতে পারবেনা। মা বকা দেবেনা পা না ধুয়ে ঘুমোতে গেলে।
সমস্যা শুধু আব্বা হাট থেকে যা কিনে আনবে সে গুলো দুভাই মিলে খেয়ে নেবে। টুনু মুনু(( ছাগলের বাচ্চা দুটো) ওকে খুজে পাবেনা রাজ হাঁসের খাবার ওর মা কেই জোগাড় করতে হবে। কি আর করা যাবে। মন খারাপ করে লাভ নেই। টুনু মুনু কে নিয়ে যাবো। শিউলির বড় চাচার মেয়ের বিয়ে হয়েছে গত বছর,। কি সুন্দর লাগে সুখু বু কে। দুলাভাই এর সাথে মটর সাইকেলে করে যখন আসে বেড়াতে। শিউলি ও অমন করে বেড়াতে আসবে। আচ্ছা ওই লোকটার কি মটর সাইকেল আছে? শুনেছি বড় লোক। দোতলা বাড়ি, দুটো ট্রাক আছে। মটর সাইকেল না থাকলে আব্বা কে বললেই আব্বা কিনে দেবে।
সাত দিন মায়ের চোখের পানি, বাবার বড় বড় নিশ্বাস আর ভাইদের অতি আদরে কেটে গেল। কাল শিউলির বিয়ে আজ শিউলির বিয়ে। লাল বেনারসিতে মেয়েটাকে হুর পরির মত লাগছে। আচ্ছা বেহেশতের হুর কি শ্যমলা নাকি দুধে আলতা? কে জানে কেমন। তবে শিউলিকে দেখে দুনিয়ার সবচে বেশি মিষ্টি মেয়ে মনে হচ্ছে আজ। ওর বান্ধবিরা আত্তিয় স্বজন সবাই ওকে ঘিরে হাসি – তামাশা করছে। শিউলি দেখলাম উসখুস করছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
— কি হয়েছে শিউলি?
— শাড়িটা খুব ভারি।
— আগে কোন দিন শাড়ি পরেছো?
— সবেবরাতের রাতে মা এর শাড়ি পরে নামাজ পড়ি, সখী বুর হলুদেও পরেছিলাম,। সে গুলো এতো ভারি ছিল না।
— এটা বেনারসি তো, তাই ভারি। ওবাড়ি যাবার পরে বদলে হাল্কা শাড়ি পরিয়ে দেবো।
মাথা নাড়িয়ে স্বস্তি প্রকাশ করল শিউলি। বিয়ে পড়ানোর সময় শিউলির মুখ থেকে ” কবুল” শব্দটা আমি শুনিনি। পাশ থেকে কেউ একজন ” কবুল” বলল মনে হল। আমি আপত্তি জানালেও তাদের যুক্তির কাছে হার মানলাম। এমন করে বিয়ে শুদ্ধ হয় কিভাবে আমি জানিনা। যাক, খাওয়া দাওয়া, হৈ চৈ শেষে বিদায়ের পালা। বর কে একটা চেয়ারে বসিয়ে টেবিলে একটা প্লেট রাখা হল। শিউলির আপন জনেরা সবাই বর কে নিজের পরিচয় দিয়ে প্লেটে — ঘড়ি, মোবাইল, টাকা, মটর সাইকেলের চাবি রাখলো। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ মজার মনে হল। মন্টু মিয়ার বেশ ভালোই ইনকাম হল আজ–হিহিহি।
মেয়ে বিদায়ের ব্যাপারটা আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিনতম বিষয় বলে মনে হয়। এর চে কষ্টের আর কিছুনেই। আমার নিজের বিদায় নেবার দিন টা চোখের সামনে চলে এলো। আমি আমার আব্বার গলা জড়িয়ে ধরে বলছিলাম আব্বা আমি যাবোনা,। আমি তখন ২৩ বছর বয়সি শহরের মেয়ে ছিলাম। আর শিউলি ১৮ বছর বয়সি গ্রামের সহজ সরল বালিকা। আমি আগে ভাগেই গাড়িতে এসে বসলাম। শিউলিকে তার ঘরে ফুল দিয়ে সাজানো খাটে বসানো হল। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে, কুমকুম এর রং সারা মুখে ছড়িয়ে গেছে তবুও কি অপরূপ লাগছে মেয়েটাকে। চারিদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। যেন বনের পাখি খাঁচায় এলো।
পরদিন ছোট খাটো একটা বউভাত হল। শিউলির বাবা, ভাই, মামা সহ আরো অনেকে এলো। শিউলি তার টুনুমুনু, রাজহাঁস, মা , বিড়ালছানা সবার খোঁজ নিলো ওদের কাছ থেকে। বাবার হাত যেন কতদিন ধরেনা এমন ভাবে বাবাকে আঁকড়ে থাকল এই বালিকা বধূ। বিকেলে আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম তিন বছর পরে আবার শিউলির সাথে দেখা হল। ততদিনে শিউলির ছোট্ট কাঁধ সাত জন মানুষের সংসারের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছে। কোলে এসেছে ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে ( পিউলি)। শিউলির মায়াবী মুখের খিলখিল হাসি ঢুকে গেছে মৃদু হাসির বাক্সে। মেয়েদের অত জোরে হাসতে নেই,। কান্ন! সেতো চুলোর ধোয়ার সাথে মিশে যায় রোজ। শখ — আহলাদ বলতে ওই ফুটফুটে মেয়েটার নরম আদর। মেয়েকে আমার কোলে দিয়ে একবাটি সুজি দিয়ে বলল–
— মামী, মনাকে খাইয়ে দেবেন একটু।
— অবশ্যই দেবো। একি! সুজিতে দুধ দাওনি?
— না মামী, মা( শাশুড়ি) বলে বাচ্চাদের সুজিতে দুধ দিতে হয়না।
— কি! বাচ্চারা দুধ খাবেনা? ওমা! এটা তো শুনিনি কখনো। শিউলির শাশুড়ি মানে আমার ননাস এসে বলল–
— আমি ৫ টা বাচ্চা মানুষ করেছি। কাকে কি খাওয়াতে হবে আমার চেয়ে বেশি জানো? আমার চুল কি বাতাসে পেকেছে?
দুইদিন ছিলাম শিউলির শশুর বাড়িতে। পালিয়ে চলে আসতে ইচ্ছে করেছিল পরদিন ই। প্রতিবাদ করেছি মৃদু, তিরস্কার পেয়েছি শক্তিশালী। শিউলির অনেক দোষ ইনিয়ে, বিনিয়ে শুনতে হল,। সব চে বড় দোষ শিউলি” মেয়ে জন্ম দিয়েছে”। অথচ শিউলির দুই ননদের দুই মেয়েকে রাজকন্যা বলে ডাকে তাদের নানা — নানী। বিদায় নেবার সময় শিউলি কিছু বলতে চাইলো ঠোঁট নাড়লো শব্দ বের হলোনা। আমি ও শুনতে চাইলাম তবুও কান বন্ধ হয়ে গেলো আমার। শিউলির শশুর বাড়ির লোক আমার ও শশুর কুলের আত্তীয়। ৬ মাস হল শিউলির সারা শরীরে ব্যাথা। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছে শিউলির বাবা। মেয়ের ব্যথা কিছুতেই কম পড়ছে না। শিঊলির শরীর খারাপ হবার সাথে সাথেই তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় বরাবর। শিউলির শশুর ধিরস্থির ভাবে বলে দিল
— তুমি যদি রান্না – বান্না, কাজ – বাজ না পারো তাহলে এখানে রেখে কি লাভ? বাবার বাড়ি যাও, সুস্থ হলে এসো।
আমার মাথায় ঢোকেনা এই মানষিকতার লোকেরা ” তাগড়া দেখে একটা বুয়া ঘরে আনলেই পারে। বুয়া নিজের ঘরের কাজ ও করবে, অন্যের বাড়ির কাজ করেও টাকা আনবে। শুধু শুধু শিউলিদের তুলে এনে পিসে মারে কেন?
যাই হোক, শিউলিকে ইন্ডিয়া পাঠানো হল। চিকিৎসার জন্য। আমার ছোট দেওর রফিক প্রায় ই ইন্ডিয়া যায় ব্যাবসার কাজে। আমার দেওর মানে শিউলির মামা শশুর। ইন্ডিয়ার ডাক্তার ওষুধ দিল আর বলল– মেয়েটা রেস্টে রাখতে হবে।আমার বাসা যেহেতু বেনাপল বর্ডারের কাছে তাই আত্তীয় স্বজন ইন্ডিয়ায় যাওয়া আসার পথে এখানে যাত্রা বিরতি করে। শিউলিকে ডাক্তার দেখিয়ে আমার দেওর এখানে রেখে খুলনা চলে গেলো। মন্টুকে বলল শিউলিকে নিয়ে যেতে।
মন্টু আমাকে ফোনে বলল— মামী আমি এখন যেতে পারবনা, আপনি শিউলিকে ট্রেনে তুলে দেন, আমি এখান থেকে নামিয়ে নেবো।
আমি বললাম — শিউলি তো হাটতে পারছেনা, ধরে ধরে বাথ রুমে নিয়ে যাচ্ছি, ওর ডান হাতে খুব ব্যথা আমি ওকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছি। এই অবস্থায় কি করে পাঠাবো? শিউলি একটু সুস্থ হলে আর তোমার কাজ শেষ হলে এসে নিয়ে যাইও, ততদিন আমার কাছে থাক। ৫ দিন হল শিউলি এসেছে আর ভেতরে শিউলির শশুর- শাশুড়ী একটা ফোন ও করেনি। শিউলির মা ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে। শিউলি মায়ের ফোন পেয়েই কেঁদেকেটে বলে– এ মা আমারে হাসপাতালে ভর্তি কর। নইলে বিষ কিনে দে। আমি শিউলিকে আমার সমস্ত মায়া – মমতা, বিচার বুদ্ধি দিয়ে বুঝাই সারাদিন—
— আত্তহত্যা মহাপাপ, ওষুধ খাও সেরে যাবে।
মন্টু এসেছে, সাথে শিউলির ভাই ও এসেছে। শিউলিকে শিউলির বাপের বাড়ী নিয়ে যাবে। মন্টু আমাকে চুপি চুপি বলল–
— মামী, শিউলি মনে হয় সুস্থ হবেনা , ওকে বাদ দিয়ে দেবো,। শিউলি বিদায় নেবার সময় বলল-
— মামী দোয়া করবেন যেন সংসারটা করতে পারি।
আমার সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে আছে। মন্টুর কথা গুলো কানের ভেতরে শুধ ইকো হচ্ছে। রিক্সায় বসে শিউলি হাত নেড়ে বিদায় নিল। রাস্তায় হকার হাক মারছে —
— পুরোনো বাতিল জিনিষ বিক্রি করবেন?