-“আপা আপনার কাছে চারশো টাকা হবে? প্রেশারের রুগী আমি! প্রেশারের আর ঘুমের ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছে!চারশো টাকা হলে অল্প কিছুদিনের ওষুধ হয়ে যেত!” অনেকটা কাছুমাছু করেই জয়নাল সাহেব তার প্রতিবেশী ধনকুবের মহিলা নূরজাহান বেগমকে কথাটি বললো। কথাটি বলার সময় জয়নাল সাহেব দুই হাত দিয়ে নিজের দুই হাতকে সমানে মুচড়িয়ে যাচ্ছিলো।কারন ধার চাইতে তার লজ্জা লাগছিলো। লজ্জা লাগাটা অস্বাভাবিক না কারন সারা জীবন দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকুরী করেও আজ ৬৫ বছর বয়সে এসেও জয়নাল সাহেবের ধারদেনা করা লাগছে।
–“ভাই টাকাতো আছে কিন্তু তা আলমারির ভিতরে,এখন আলমারি খুললে শব্দ হবে আর এতে আমার মেয়েটার ঘুম ভেঙে যাবে।টাকার যদি বেশি দরকার হয় তাহলে কাল সকালে নিতে হবে।” জয়নাল সাহেব শুকনা করে মৃদু হেসে চলে আসলো আর ভাবতে লাগলো কি অদ্ভুত দুনিয়া! একজনের টাকা বের করার শব্দে ঘুম ভেঙে যাবার ভয় আর আরেকজনের টাকার অভাবে ঘুমের ওষুধ কিনতে না পেরে, নির্ঘুম রাত কাটানোরভয় ।
ঘর থেকে বের হয়ে এসে সিঁড়ি ঘরে থমকে দাঁড়ালো। বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।আলোর ঝলকানির পরপর বিকট শব্দে বাজ পড়ছে।জয়নাল সাহেব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার ভঙ্গুর ছাতাটি মাথায় দিয়ে হাটা শুরু করলো।ছাতাটির তিনটে দাত ভাঙা তবুও এই ঝড়বাদলে এই ছাতাটির জুড়ি নেই।আজ ৯ বছর ধরে ছাতাটি জয়নাল সাহেবকে ঝড়বাদল থেকে রক্ষা করে চলেছে। ছাতাটি মাথাই দিয়ে বের হওয়ার দুমিনিটের ভিতরেই জয়নাল সাহেবের পাঞ্জাবী ভিজে চুপসে গেল।সামনে একটি দোকান দেখেও সে থামলো না কারন দোকানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বন্ধের জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না।এমনিই দুইরাত ঘুম হয়নি। আজকে যে করেই হোক ওষুধ নিয়ে বাসাই যেতে হবে।এখন জয়নাল সাহেব তার এক পূর্বপরিচিত অফিস কলিগ মাহাবুবের বাসাই যাচ্ছে।দেখবে সেখানে কিছু টাকা ধার পাওয়া যাই কিনা।
–“তোমার আব্বু বাসাই আছে?”
–“হ্যা আছে, আমি ডেকে দিচ্ছি”
বলেই মেয়েটি ঘরে ঢুকে গেলো। জয়নাল সাহেব ছাতিটা বন্ধ করে তাদের বারান্দায় উঠে দাঁড়ালো।একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টির জলের ছন্দময় শব্দের সাথে জয়নাল সাহেব আরো কিছু শব্দ শুনতে পেলো।ভিতর থেকে মাহাবুব তার মেয়েকে বলছে,
–“বাহিরে গিয়ে বল আব্বু বাজারে গিয়েছে।এখন ওই লোকের সামনে গেলে কিছু টাকার গচ্ছা যাবে আমার।”
এই কথা শুনে জয়নাল সাহেব তার মেয়ের আসার অপেক্ষা না করেই ছাতিটা খুলে বৃষ্টিতেই আবার বেরিয়ে পড়লো।কয়েক পা যেতেই মেয়েটা পিছন থেকে,
–“কাকা” বলে ডাক দিলো।কিন্তু পিছন না ঘুরেই জয়নাল সাহেব বললো,
–“তোমার বাবা তো এই সময় বাজারে থাকে সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম,এখন মনে পড়েছে মা! আসলে বলো যে আমি এসেছিলাম”
–“বাবা আজাদ! কিছু টাকা লাগতো”
–“কত টাকা কাকা?”
–“লাগতো তো ছয়শর মত কিন্তু তুমি তো হাজারের নিচে টাকা দাওনা তাই এক হাজার হলেই চলবে”
–“এই নিন কাকা এক হাজার টাকা”
জয়নাল সাহেব আজাদের হাত থেকে এক হাজার টাকার নোট নিয়ে বাইরে চলে এলো।আজাদ ছেলেটা খুবি ভাল। তার কাছে টাকা চেয়ে টাকা পাইনি, এমন কখনো হয়নি।তাছাড়া সে কখনো আলমারি খোলার শব্দের ও বাজারে যাওয়ার উছিলাও দেখাই নি।যখনি টাকা চেয়েছে তখনি টাকা বের করে দিয়েছে, কখনো কেন টাকা দরকার সেটাও শোনেনি।তবে ওর সুদের হারটা একটু বেশি চড়া।প্রতি হাজারে একশো টাকা লাভ দেয়া লাগে ওকে। কিন্তু তাতে কি! এভাবে চাওয়া মাত্র আর কজন টাকা বের করে দেই এই যুগে! ডিসপেনসারির সামনে গিয়ে জয়নাল সাহেব সেলসম্যানকে বললো,
–“খুশখুশে কাসির জন্যে ওষুধ দেন তো”
–“কতদিনের কাশি?
–“১০-১২ দিনের!” সেলসম্যান একটি সিরাপ ও ৮টা এন্টিবায়োটিক দিয়ে বললো,
–“সিরাপটা তিনবেলা খাবেন দুচামচ করে আর এন্টিবায়োটিকটা প্রতিদিন একবার করে খাবেন।”
–“কত হয়েছে?”
–“চারশো টাকা”
বৃষ্টি থেমে গেলেও সারা রাস্তাতেই তার সৃতি রেখে গিয়েছে।গাছ গুলিও এখনো ভেজা আছে।জয়নাল সাহেব ছাতা বন্ধ করে হালকা কুজো হয়ে হাটছে।কুজো টা বয়সের ভারে না ঋণের ভারে সেটা জানার আগ্রহ নাই।কারন এই ৬৫ বছর বয়সে এসেও লক্ষের অধিক দেনা তার।সারাজীবন সরকারি ভাল পোস্টে চাকরি করেও সরকার যে কটা টাকা বেতন দিয়েছে তাতে ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ বহন করে সংসার চালিয়ে পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি। তবুও ছেলেগুলি যদি মানুষের মত মানুয় হত তাহলে আজ হয়তো তার এত ধার দেনা হত না। জয়নাল সাহেব বাসাই পোঁছে গিয়েছে।পকেট থেকে ওষুধ এর প্যাকেটটি বের করে প্যাকেটের মুখ থেকে পিন খুলে তার ছোট মেয়ে রিফাকে ডাক দিলো।
–“রিফা! এই রিফা!”
–“জ্বী বাবা বলো?”
–“এই সিরাপটা ভরা পেটে দৈনিক তিনবার দুই চামচ করে খাবি আর ক্যাপসুলটা দৈনিক একবার করে খাবি।”
–“আচ্ছা বাবা”
বলেই খুব হাসিমুখে ওষুধ গুলি নিয়ে পাসের রুমে চলে গেলো। জয়নাল সাহেবের ছোট মেয়ে রিফার আজ কদিন হল খুব কাশি হয়েছে। সারারাত কাশতে থাকে মেয়েটি আর এই কাশির শব্দেই তার সারা রাত ঘুম হয়না। আজকে ওষুধ গুলি খেলে হয়তো একটু আরামে ঘুমাবে মেয়েটা। সেই সাথে জয়নাল সাহেব নিজেও।