ঝোলাভাতি

ঝোলাভাতি

সকাল থেকেই উত্তেজনার পারদ তরতর করে বাড়ছে। তুখোড় শীতে কাবু হয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে রুম্মান। কিন্তু ঝোলাভাতি খেলার উত্তেজনায় রীতিমত ঘামছে। দুপুরের পর শুরু হবে মূল রান্নাবাড়া। পুষ্পু, খুশবু, কাসেম, রাসেল, হাজেরা, ইকবাল, রুবি, জোসনা, মুকসুদা সবাই সকাল থেকেই দৌঁড়ের উপর আছে। কেউ থালাবাসন, কেউ হলুদ মরিচ, কেউ লাকড়ি, কেউ পেয়াজ, আলু, শাক নানান হাবিজাবি জিনিস জোগাড়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। বালক বালিকার দলকে সমানতালে উৎসাহ দিচ্ছে কিছুটা কিশোরে পরিনত হওয়া দলটা।

এটা ওটা চুরি করে কিংবা হাত ছাপাই করে তারা মহান কর্মে সহায়তা করছে। তাদের উদ্দেশ্য মন্দ না, হারিয়ে যাওয়া সময়টাকে তারা অন্যের মাধ্যমে উপভোগ করতে চাইছে। কিশোরের দলটা যাকে বলে দুষ্টের শিরোমণি। মাসুদ আজ তার নেতৃত্ব দিচ্ছে। কেননা ঝোলাভাতির মূল আয়োজনটা হবে তাদের রসুইঘরে। কিছুটা ফাঁকা এবং একলা বাড়ি। বড়দের শাসন বারনের ঝামেলা কম। তাছাড়া একলা বাড়ি হওয়াতে মাসুদের মা বলতে গেলে সারাদিনই তাদের পুরনো বাড়িতে গিয়ে থাকে। মাসুদের সাথে আরো যারা আছে তারা তক্কে তক্কে আছে কখন রান্নাটা শেষ হবে আর ভুজং ভাজং দিয়ে খাবারে ভাগ বসাবে।

এরমধ্যে মতিন একটু ভীতু কিচিমের, যখন তখন মালকোচা মেরে বসে থাকে। কেউ সামান্য আওয়াজ করলে দে দৌঁড়। জুয়েল চিঁচকাদুনে, আম্মা মারবো বলে চেঁচিয়ে উঠে। সোহাগ ছিল ডানপিঠে, যখন তখন এটা সেটা নিয়ে আসতে পারে। শুকুর ছিল ওদের চেয়ে বয়সে বড় কিন্তু রুম্মান আজকে তার সাথে লেপ্টে আছে। কার্য উদ্ধারে তাকে লাগবে। তার ভাগ্যে পড়েছে মৎস আহরন। মাছ ধরায় এ তল্লাটে শুকুর আর তার বাপের জুড়ি মেলে না। সকাল থেকেই মাসুদদের বাড়ির পাশের কুয়ায় মাছ ধরার উৎসব চলছে। নানান বয়সের ছেলে, বুড়ো, মেয়েছেলে মাছ ধরায় মত্ত। এই কুয়া আবার শিং মাছের জন্য বিখ্যাত। রাসেল, পুষ্পু, জোসনা আর হাজেরার ভাগ্যে পড়েছে শাক তুলে আনা।

সেই কর্ম সম্পাদনে তারা সকাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। কিছুটা পশ্চিমে চরের দিকে আলু ক্ষেতের মাঝে মাঝে ভেতে শাক, লাল শাক, ধনে পাতা পাওয়া যায়। মালিকের অগোচরে সবাই দুপদাপ শাকপাতা তুলে আনে আর সুযোগ পেলে নতুন বেড়ে উঠা আলু যে তুলে আনে না তা হলফ করে বলা যাবে না। ইকবাল গেছে হলুদ মরিচের খোঁজে। সমস্যা হল তার বাপ সারাক্ষণ মায়ের ভূমিকা পালন করে। সব সময়ই ঘরে বসে থাকে। এ নিয়ে ইলবাল কিঞ্চিৎ চিন্তিত। তার বাপের চোখ ফাঁকি দেয়া চাট্টিখানি কথা না। কাসেম আছে থালা বাসনের জোগাড়ে ব্যস্ত। সে মোটামুটি ঝাড়া হাত পায়ে আছে। বাপ-মা নেই, কবেই মরে গেছে। খুশবু, রুবি আর মুকসুদা লাকড়ি আনতে গেছে। মোটামুটি সহজ কর্ম। বাগান থেকে সুপারি গাছের ডাল, পাতা কিংবা নানান লাঠি জোগাড় করা ব্যাপার না। না পেলেও অসুবিধা নাই, কারো না কারো রসুইঘর তো আছেই। সুযোগ বুঝেই নিয়ে চম্পট। সবাই মহাযজ্ঞে নেমে পড়েছে।

রুম্মান পড়ল পাপড়ে। শীতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মালকোচা মেরে নামতে যাবে কুয়ায় কিন্তু বিধিবাম। তার বাপ সাইকেল নিয়ে চরের দিকে যাচ্ছিল। ছেলের হাবভাব দেখে বুঝল মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাইকেল থামিয়ে বলে গেল, ‘রুম্মান, কুয়াত কিন্তু ল্যাতা হিং আছে! কাতা দিলে বিষ্ষে ধরবো। খবরদার নামবি টামবি না’। রুম্মান কিছুটা মিয়িয়ে গেল। কুয়াতে নামতে পারল না। তার বাবা সাইকেল চালিয়ে সোজা পশ্চিমে চলে গেল, চরের দিকে। তার কাছে অস্থির লাগছে। সবাই সব কিছু নিয়ে আসল দেখা গেল সে মাছ নিতে পারল না। দ্বিতীয়বার না ভেবে সে মালকোচা মেরে সোজা কুয়ায় নেমে গেল। কুয়ার পাড় ছিল কিছুটা ঢালু এবং খাড়া। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে সে খানিকটা নিচের দিকে দেবে গেল।

সবাই হইহই করে উঠল, ‘রুম্মাইন্না ডুইব্বা গেছে’। কিন্তু না, রুম্মান কোন রকমে নাক উঁচু করে বলল, ‘বেশি হানি খাই নাই’। পাড়ে পাড়ে ঝোঁপঝাড়ের নিচে মাছ হাতড়াতে লাগল। কিছু কুচো চিংড়ি আর ছোট ছোট কয়েকটা পুঁটি মাছ ছাড়া তেমন সুবিধা করতে পারল না। এবার শুকুরকে বায়না ধরল, ‘শুক্কুর মামা, আফনের জালডা আমি ধরি, আফনের লগে লগে টাইনা নিমু’। শুকুর ঘাঁইগুই করেও শেষ পর্যন্ত রাজি হল। দু’জন জালের দুইপাশ ধরে গলা পানিতে নেমে টানতে লাগল। রুম্মান পাড়ের কাছাকাছি থাকল। পাড়ের একেবারে শেষ মাথায় এসে তারা জাল চাপা দিল। শুকুর গলা হাঁকাল, ‘ আতা আতা, ছাইচ জালের মাতা জেন না উডি যায়।’ রুম্মান ছোট ছোট হাত দিয়ে জালের উপর স্পর্শ করে কিন্তু মাছের কোন আলামত তার হাতে লাগে না। সে কিঞ্চিত হতাশ বোধ করে।

গলা আরো কিছুটা ডুবিয়ে হাতড়াতে লাগল। কিছু একটা তার হাতের নিচে নাড়া খেল। তার বুকের মধ্যে ধুকপুক করতে লাগল। হাত এদিক ওদিক নাড়ানাড়ির এক পর্যায়ে সে বুঝতে পারল কিছু একটাতে সে খোঁচা খেল। তবে তা হাতে নয় পায়ে। সে আমল দিতে চাইল না, মাছ তাকে আজ ধরতেই হবে। কিন্তু সে বুঝতে পারল ক্রমাগত কিছু একটা তার পায়ে কাঁটার মত খোঁচা দিচ্ছে। সে পানি থেকে উপরে উঠে আসল। আর আবিষ্কার করল একটা ছোট শিং মাছ তার ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে লেগে আছে। তার বাবার ভাষায় যেটার নাম ল্যাতা শিং। মাছটা তার আঙ্গুলের চেয়ে খুব বেশি বড় হবে না। সবাই আতঙ্ক বোধ করল। ল্যাতা শিং এর বিষ নামানো সহজ ব্যাপার না। রুম্মান হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘ বিষ্ষে ধরে নাই’। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে এবার সে কাঁদতে শুরু করল, ‘ আম্মাগো আঁর ঠ্যাং লই যায় গো’। মোটামুটি একটা জটলার মত লেগে গেল। কেউ বলল, ‘ শেফালিরে খবর দে’।

আবার কেউ বলল না,’ এই বিষ নামান অত সোজা না, রইমার মারে খবর দে’। বালক সবার কথা বার্তা শুনে আরো জোরে কাঁদতে লাগল সাথে মাটিতে গড়াগড়ি। ইত্যবৎসরে তার বাবা এসে হাজির হল। বাপ সন্দেহ করেছিল, ছেলে তার কথা অমান্য করবেই। যে কারনে তিনি সামান্য এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন। লোকজনের ভিড় ঠেলে তিনি ছেলের সামনে এগিয়ে গেলেন। কোন কিছু বুঝার আগে তিনি তার পায়ের জুতা খুলে নিলেন। দুপদাপ জুতার বাড়ি লাগিয়ে দিলেন। ছেলে মাটিতে গড়াগড়ি বাদ দিয়ে পা ল্যাংছাতে ল্যাংছাতে দৌঁড় দিল। বাপ দৌঁড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। ছেলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, ‘আব্বা আর করতাম না, মাফ করি দেন’। বাপ টানতে টানতে তাকে বাড়ির দিকে নিয়ে গেল।

আজ ঝোলাভাতির ভাগ্যে কি আছে কে জানে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত্রি হয়। ইকবাল তার বাপের কাছে হাতে নাতে ধরা খেল। সাথে সামান্য মার খেল। বেশি না গোটা চারেক চড় থাপ্পর সাথে দৌঁড়ানি। শাকবাহিনী বিরস মুখে প্রায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে না বলে বলা খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাসুদদের বাড়িতে এসে হাজির হল। রাসেল আর হাজেরা মোটামুটি বিধ্বস্ত।

সে তুলনায় জোসনা কিঞ্চিৎ প্রফুল্ল আছে কেননা তাকে তো কাউকে বয়ে নিয়ে আসতে হয় নি। শুধু সামান্য একটু সমস্যা হয়েছে পুষ্পুকে নিয়ে। তেমন কিছু না শুধু রাসেল আর হাজেরার কাঁধে বর দিয়ে আসতে হয়েছে। হয়েছে কি তারা চারজন চরে গিয়ে ঘুরেঘুরে দেখতে লাগল কোন ক্ষেতে আলুগাছ বড় হয়েছে। যাতে শাকের সাথে বেশি না দু’একটা আলু আনা যায়। একটি বড় আলু ক্ষেত দেখে তারা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। গাছগুলোও বেশ বড় বড়। তাদের চোখ চকচক করে উঠল। আনন্দের আতিশয্যে তারা লক্ষ্য করল না পাশেই চাষী তার প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনে ব্যস্ত আছে। যেই না তারা গাছে হাত দিল, চাষী চোর চোর বলে চিৎকার দিতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা বিহবল হয়ে পড়ল।

কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। ধাতস্থ হয়ে রাসেল চিৎকার দিল, ‘দৌঁড়া, জোরে দৌঁড়া, ধইরা হালাইবো’। সবাই দৌঁড়াচ্ছে তো দৌঁড়াচ্ছে, কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুসরত পেলো না। হঠাৎ আবিষ্কার করল পুষ্পু তাদের মাঝে নেই। ব্যাপারটা বুঝতে তারা কিছু সময় নিল। কিছুটা দূরে দেখল পুষ্পু পা থেকে কি যেন টেনে বের করছে। তারা পিছন দিকে দৌঁড়ে আসল। আসলে হয়েছে কি তারা তো দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দৌঁড়াচ্ছে, ক্ষেতের আলের পাশে যে খেজুরের কাঁটাওয়ালা ডাল রাখা আছে তা কেউই খেয়াল করে নি। অন্যরা বেঁচে গেলেও পুষ্পু গেল ফেঁসে। যার ফলাফল রাসেল আর হাজেরার কাঁধে ভর করে হাঁটা। পুষ্পু কাঁদোকাঁদো স্বরে বলতে লাগল, ‘ আম্মা মারি হালাইবো’।

ঝোলাভাতির জন্য যে চাল লাগবে তা তাদের মাথায় আসে নি। দেখা গেল সেই চালই সবার আগে এনে হাজির করল রুবি। খুশবু আর মুকসুদা নিয়ে আসল লাকড়ি। কিন্তু ততক্ষণে বাড়িতে হিরোশিমা আর নাগাশাকির বিষ্পোরণ ঘটেছে। রুম্মানের পা ফুলে ঢোল হয়ে আছে, তাকে গরম পানির বালতিতে পা চুবিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সুতা আর সুই প্রস্তুত করা হচ্ছে। তার পা থেকে বিষ রক্ত বের করা হবে।

অন্যদিকে পুষ্পুর অবস্থা আরো বেগতিক, খেজুরের কাঁটা ভেতরে রয়ে গেছে। যুগি বাড়িতে কলা পাঠানো হয়েছে পড়ে আনার জন্য। কলা পড়া খাবার পরে কাঁটা যে কোন দিক বের হয় তা চিন্তা করে সে কাহিল হয়ে পড়েছে। রাসেল আর হাজেরা বাড়ির চৌকাঠ মাড়াল না, ভয়ে। ইকবালকে আশেপাশে খুঁজে পাওয়া গেল না। খুশবু, রুবি আর মুকসুদা মন খারাপ করে মাসুদের মায়ের কাছে বসে রইল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত