অভিনয়

অভিনয়

প্রায় বছর তিন’য়েক পরে একটা রেস্তোরায় আমি আর সে সামনাসামনি বসে আছি। আমরা কখনো রেস্তোরায় এভাবে সামনাসামনি বসেছি কি না খেয়াল নেই। সে সবসময় ই আমার পাশে বসতো। যখন আমি চোখ রাঙিয়ে বলতাম সামনে গিয়ে বসো তখন সে বলতো সামনে থেকে নাকি চুলের ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। অথচ আজ দিব্যি সামনে বসে আছে।

বেশকিছুক্ষণ দু’জন ই চুপচাপ বসে আছি। ওয়েটার কয়েকবার অর্ডার কি দিবো জানতে চেয়েছে। উত্তর দেওয়া হয় নি। এইবার আমিই বললাম আমার জন্য একটা কোল্ড কফি, শাওন তুমি কি নিবে? সে ইতস্তত হয়ে বললো তুমিই অর্ডার দাও। আমি দুটো কফির অর্ডার দিয়ে দিলাম। তারপর আবার ও চুপ।

“আচ্ছা, ফারিয়া খুব সুখে আছো বোধহয় তাই না?”

“হয়তো বা। সুখ কিংবা দুঃখ তো আপেক্ষিক। নিজে নিজেকে যেমন উপলব্ধি করে মানুষ সেরকম ই থাকে”

“হাহা! বড্ড গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছো দেখছি” (আমি জবাব দিলাম না)

“ফারিয়া একটা কথা বলবে?”

“কি কথা?”

“তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা টা কি বড্ড কম ছিলো?”

“আমাদের ভালোবাসা টা ভুল করে হয়েছিলো”

“তুমি কি আমায় কখনো ভালো ই বাসো নি?”

“পরিস্থিতি এখন এই প্রশ্ন এর উত্তর দেওয়ার সুযোগ রাখে নি” শাওন টেবিলে একটা ঘুষি দিয়ে সিগারেট ধরালো। জ্বলন্ত সিগারেট এর মতো ওর চোখেও আগুনের ফুলকি। রক্তলাল ঐ চোখদুটো বড্ড ভয়ঙ্কর লাগছে।

“সিগারেট কি রোজ খাওয়া হয়?”

“সিগারেট প্রেমিকার মতো ধোঁকা দেয় না।”

“আগে তো কয়েকমাসে একটা খেতে”

“তখন আমার প্রেমিকা ছিলো। সে দুঃখ ভুলিয়ে দিতো”

“তুমি এখনো অবুঝের মতো অভিমান করে আছো”

“তাতে তোমার কি? তুমি তো দিব্যি স্বামীর সাথে ভালোই আছো। হাহা। যাই হোক শুধু মজাই নিবে নাকি বাচ্চাকাচ্চা ও নিবে দু’একটা?”

“মুখের ভাষা সংযত রাখো। তুমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছো” সেই লালচোখ দুটো আমার দিকে আরো এগিয়ে এসে হিংস্র হয়ে বললো “সংযত? সংযত? তুমি রাতের পর রাত অন্যের বিছানায় থাকো আর আমার সঙ্গী থাকে নিকোটিন। তুমি আমায় সংযত থাকতে বলছো? তুমি জানো প্রেমিকা অন্য কারোর হওয়াতে প্রেমিকসমাজ যতটা না পুড়ে তার চেয়ে বেশি পুড়ে এটা ভেবে যে তার প্রেয়শীর শারীরিক অধিকার অন্য কারোর”

“ছিঃ”

“ছিঃ বলছো? কোনো প্রেমিক ই শুধু মন ভালোবাসে না। মনের সাথে দেহ ও চায়। আর যাঁরা বলে তারা শুধু মন ভালোবাসে হয় তারা ভন্ড নয়তো অতি মাত্রায় বোকা।”

“আমার উঠা উচিত”

“ফারিয়া ! স্যরি আরেকটু বসবে?”

“কি বলবে?”

“আমি এভাবে বলতে চাই নি। তুমি গত তিনবছর ধরে আমার থেকে দূরে। দুইবছর ধরে তুমি অন্য কারোর সম্পত্তি। বলো কি করে সহ্য করবো? আমাদের কত পরিকল্পনা ছিলো! একটা দুষ্টু মিষ্ট সংসার ও সাজিয়ে নিয়েছিলাম কিন্তু !” “এটা হওয়ার ই ছিলো। আমরা সব জেনেও ভুল করেছিলাম” আমি আর এক মূহূর্ত বসলাম না। ব্যাগ টা নিয়ে উঠে আসলাম। জানি শাওন আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আমি পিছু ফিরতে পারবো না। অতীত মায়ায় পড়া এখন বড্ড পাপ। হঠাত্ রাস্তায় দেখা হলো বিধায় ই না এইখানে একটু বসা হল!

সময় টা ছিলো বসন্ত এর শুরুতে। তখন আমি সদ্য ষোড়শী। তাই হয়তো বসন্ত এর ছোঁয়া লেগেছিলো তীব্রভাবে। অনিশ্চিত ভবিষ্যত জেনেও মনপ্রাণ উজার করে দিয়েছিলাম শাওন কে। কারোর হাত ধরে হাঁটার তৃপ্তি টা শাওনের সাথেই পেয়েছিলাম। আর ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করাটাও। একটা বিশ্বস্ত কাঁধ যেখানে মাথা রেখে আমি কিছু সময় এর জন্য সব দুশ্চিন্তা ভুলে হাওয়ায় ভাসতাম। এখন সব ফিকে হয়ে গেছে। শাওন ছিলো আমার থেকে দু’বছর এর সিনিয়র।

শাওন যখন আমার জীবনে আসে তখন আমি সবে বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেছি। আবেগের খেলায় স্বপ্ন এর মতো যাচ্ছিলো দিনগুলো। কিন্তু সময় আর পরিস্থিতি বারবার কড়া নেড়ে বলছিলো আমরা ভুলের সাগরে ভাসছি। আমার পরিবারে মা ছাড়া কেউ ছিলো না। তাই আর্থিক অবস্থা ও ছিলো করুণ। একজন অভিভাবক এর ও বড্ড প্রয়োজন ছিলো। তাই মা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য ছিলো মুখিয়ে। তা আমি বুঝেছিলাম দেরিতে যে কলেজ লাইফ শেষ করতে না করতেই আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে। আগে বুঝলে হয়তো বা শাওনের জীবন টা আমার জন্য নষ্ট হতো না কিন্তু আমার কি ই বা করার ছিলো! আমি শাওনকে তো সব বলেছিলাম।

ও তো আমার চেয়ে বড় ছিলো ও কেন এই সহজ সমীকরণ টা মিলাতে পারলো না? আমি খুব ভালো করে জানতাম শাওনের পরিবার কখনো আমার মতো মেয়েকে মেনে নিবে না। সামাজিক স্ট্যাটাস বলে একটা কথা আছে না! কিন্তু শাওন আমাকে আশ্বস্ত করেছিলো যে করেই হোক ও নাকি সবাইকে মানিয়েই আমাকে ঘরে তুলবে কিন্তু এরজন্য চাই ওর কিছু সময়। সংখ্যা টা কম ছিলো না। ছয় কিংবা তার অধিক বছর অপেক্ষা করতে হতো। যা আমার মা কখনোই করতে দিতো না। হাজারহোক জন্মদাত্রী মা! তার অধিকার তো সবার উপরে। তাঁকে আর কতই বা কষ্ট দেওয়া যায়। বাবা-মা এর ইচ্ছেমতো বিয়ে না করলে তো আর তাদের মন থেকে যে আর্শীবাদ আসে তা পাওয়া যায় না। শাওন এর জেদের কাছে হেরে ওর বাবা-মা রাজি হলেও কি মন থেকে মেনে নিতো? হয়তো নিতো বা না। তবে না হওয়ার সম্ভাবনা ই বেশি!

তাইতো চুপ করে সরে এসেছিলাম। সেদিন দেহের সবগুলো হাড় গুড়ো হওয়ার মতো তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলাম কিন্তু কেউ তা দেখে নি। মানসিক ব্যথা কেউ দেখে না। হাহ! প্রেমিকা অন্য কারোর বিছানায় এটা নাকি প্রেমিক সমাজ সহ্য করতে পারে না! যারে মন দেওয়া যায় না তাঁকে শরীর দেওয়ার কষ্ট টা তারা কোনোদিন জানবে ও না! শুধু ঐ মেয়েটা ই বুঝে তার ভিতর দিয়ে কি বয়ে চলে। কোনোদিন ও জানবে না দাঁতে দাঁত চেপে চোখ দিয়ে যে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে সে জল কোন বেদনার!

শুনেছিলাম আল্লাহ্ নাকি জন্মের আগেই সঙ্গী ঠিক করে রাখে। হয়তো আমি শাওনের সঙ্গী ছিলাম না। সাব্বিরের সঙ্গী ছিলাম! হ্যাঁ কলেজের রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার আগেই আমার হাত মেহেদির রঙে রেঙেছিলো। এই দিনটা তো আসবে জানাই ছিলো। তাই তো আগে থেকে সরে এসেছিলাম। কিছুটা হলেও তো কষ্ট কম হয়েছিলো। চুম্বক যত কাছে থাকে ততো আকর্ষণ থাকে। ততো দূরে সরানো কষ্ট হয়। তেমনি দুটো মন যত কাছাকাছি থাকে ততো বেশি তাদের মাঝে ভালোবাসা, আকর্ষণ, অনুভূতি এইসব বেশি থাকে। দূরে গেলে এগুলো হারিয়ে না গেলেও ধীরে ধীরে অনেক টা ই কমে যায়। পৃথিবীর চিরন্তন সত্য জিনিসগুলো হারায় না তাই ভালোবাসার অনুভূতি ও সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে পারে না। অন্য সবার মতো আমরাও ভেবেছিলাম আমরা বোধহয় একজন আরেকজন কে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। কথাটা খুব মিথ্যে ও ছিলো না। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে সবার শারীরিক মৃত্যু না হলেও মানসিক মৃত্যু ঠিক ই হয়।

সাব্বির ছেলেটা সবদিক দিয়ে ভালো। পড়ালেখা, চাকরি আর চেহারা ও। সবাই বলে অনেক ভাগ্য করে নাকি এমন স্বামী পেয়েছি। প্রথম প্রথম সাব্বিরকে মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হতো। সাব্বিরের প্রতিটা স্পর্শ আমাকে শাওনের কথা মনে করিয়ে দিতো। আর মনে হতো আমার দেহে বুঝি আগুন লেগেছে এমন যন্ত্রণা হতো। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো অনেক গভীর হয়। তাদের ভিতর মোহব্বত স্বয়ং আল্লাহ্ থেকে আসে। তাই হয়তো সাব্বিরের প্রতি ও এখন আমার ভালোবাসা চলে এসেছে। সাব্বির ও আমায় বড্ড ভালোবাসে। এমন ভালোবাসা দেখে যেকোনো স্ত্রী বলবে পুনর্জন্ম বলে যদি কিছূ থাকে সে জন্মেও যেনো আমি তোমার ই অর্ধাঙ্গিনী হই গো! আমিও অবাক হই। গর্ব ও করি! প্রতিটি নারীর সর্বশ্রেষ্ঠ গর্ব ই তো তার স্বামীর ভালোবাসা কিন্তু তবুও প্রথম প্রেম এর জন্য একটা লুকায়িত অনুভূতি থাকে। এই অনুভূতি টা বড্ড বেশি বেহায়া। ছেড়ে যেতেই চায় না।

শেষবার যখন শাওনের সাথে কথা হয়েছিলো তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম বিয়ে করবে না? তাচ্ছিল্য করে বলেছিলো সব মেয়েই নাকি স্বার্থপর। একা জীবন কাটানো ই সবচেয়ে ভালো। আমি জবাব দেই নি শুধু মুচকি হেসেছিলাম। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তো আল্লাহর হাতে। আমি জানতাম ও একদিন ঠিকই ওর জীবনসঙ্গিনীকে খুঁজে পাবে। আমি ঠিক ছিলাম। শুনেছি ওর মা নাকি ওর জন্য একটা লাল টুকটুকে বৌ এনেছে। জীবনের সমীকরণ টা কি অদ্ভুত না? স্বপ্ন ছিলো আমার আর শাওনের একটা ছোট্ট সংসার হবে। রাগ, অভিমান, হাসি, মিষ্টি ঝগড়ার কিচ্ছুটির অভাব থাকবে না। কিন্তু! দিব্যি আমরা অন্যের সাথে সংসার করছি। তাঁকে ভালোবাসছি।

মানুষ বাহবা দিচ্ছে বলছে আহা! এরকম সম্পর্ক দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু মনের এক কোণে যে অন্য কারোর বাস তার জন্য হৃদয় ক্ষরণ হয় সেটা কারোর চোখে পড়ে না। আচ্ছা সাব্বির কিংবা শাওনের স্ত্রী ও কি অন্য কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো? হয়তো হ্যাঁ বা না। এইসব নিয়ে কেউ আলোচনা করে না। সংসারে অশান্তি আসে। বরং এইসব আড়াল রেখে একজন ভালো স্বামী কিংবা স্ত্রী হওয়ার অভিনয় চালিয়ে যায়। ব্যক্তিগত জীবনে সবাই এক একজন দক্ষ অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত