অমিমাংসীত কাব্যিক প্রেম

অমিমাংসীত কাব্যিক প্রেম

পৃথিবীতে কষ্ট বহু রকমের হয়। হারানোর যন্ত্রণার কাছে না পাওয়ার বেদনাটা বড়ই তুচ্ছো। মানুষটাকে হারিয়ে ফেলে আমি শ্বাস রোধ হবার মত বর্ণনাহীন যন্ত্রণা অনুভব করেছি। আমার দিন রাত্রির মাঝে ব্যবধান ছিল না। সারাক্ষণ ফোনটাকে বুকে আঁকড়ে ঘরের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে থেকেছি। মনে হতো আমার এই মুঠো ফোনের ভেতরে মানুষটা আছে, এই বুঝি সে মেসেজ করবে, এই বুঝি সে ফোন করে বলবে-

–“আঁখি আমি আসছি”

আকাশ দেখার ভয়ে আমি জানালা খুলিনী, আকাশে যে রোজ তারা ওঠে! ঐ তারার প্রদীপ গুলো দেখলেই যে আমার হৃদয় ছিদ্র হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে এক দিন দেখলাম আমি কাঁদছি কিন্তু চোখে অশ্রু নেই। মনে হলো পাথর হয়ে গেছি বোধ হয়, অথবা চোখের জল শেষ হয়ে গেছে। ভালবাসা বোধ হয় এলকোহলের মত নেশা জাতীয় কিছু হবে! ওর ফিরে আসার জন্য দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছি।

সময় এমন একটা টনিক যা স্মৃতি গুলোকে ধীরে ধীরে ঝাপসা করে দেয়। তাই তো দিনে দিনে কষ্টের রঙ হালকা হয়ে গেলো। একটু একটু করে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। এই সামলে নিতে আমার পাঁচ বছর লেগে গেলো। তারপর আমার বিয়ে হয়ে গেলো। এটাই বাস্তবতা এটাই সত্যি। ভালবাসার মানুষটির জন্য হয়ত আমার আরো অনেক বছর অপেক্ষা করা উচিত ছিল কিন্তু আমি নারী, আমি চাইলেই সব কিছু পারি না। সামাজিকতা যখন আইবুড়ি বলে তখন যতোটা কষ্ট হয় তার চেয়েও বেশী কষ্ট হয় যখন কেউ রাস্তায় দাড় করিয়ে আমার বাবাকে বলে-

–” আপনার মেয়ের বিয়ে হয় না কেনো?” কষ্ট হয় যখন মাকে পাড়ার চাচী জেঠীরা এসে বলে-

–“মেয়েকে কি ঘরের খুঁটি বানিয়ে রাখবে নাকি আঁখির মা?”

ঐ বেকসুর মানুষ দু’টোকে অপমান করার কোনো অধিকার আমার নেই। বিবাহিত জীবণে হাজার রকমের দায়িত্ব কর্তব্যের ভীড়ে সারাক্ষণ ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে ভাবার ফুসরত পেতাম না। সময় এমন একটা কঠিণ জিনিশ যা জীবণের বড় বড় ঘটনাকেও স্মৃতিপট থেকে ঝাপসা করে বিলিন করে দেয়। তবুও সে কেনো কিছু না বলে চলে গেলো সেই প্রশ্নটা মনের কুটিরে থেকেই গেছিল। আমি আমার মত করে উত্তরও খুঁজে নিয়ে ছিলাম। অনেক পরে বুঝে ছিলাম যে, –

–“একজন লেখকের প্রবাহমান ভালোলাগার একটা বস্তু ছিলাম আমি।”

নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতাম, লেখকদের ভাল লাগা গুলো কেনো এত ভয়ংকর হয়? ওদের ভালোলাগা গুলোকে মাঝে মাঝে দূর থেকে ভালোবাসার মতই দেখা যায়। তাই আমার চোখের ভুলটাকে মেনে নিয়ে ছিলাম।
আমি জানি না যে, ওর বন্ধ নম্বরটা আবার ওপেন হবে কি না। আমি জানি না সে আদৌ আমার সাথে যোগাযোগ করবে কি না। সে কেনো নিঃশব্দে চলে গেলো সেই কারণটা আমি কখনো জানতে পারবো কি না সেটাও আমি জানি না। আমি জানি না ঐ এক আকাশ সমেত তারার প্রদীপ কাকে ভালোবেসে এখনো জ্বলছে।

আমার স্বামী মানুষটা খুব ভালো। হয়ত লেখকদের মত সে রোমান্টিকতায় ভরপুর নয়, হয়ত তার ভালবাসার রঙটা আলাদা। তাকে নিয়ে উপস্থাপন করার মত তেমন কিছুই নেই। সে খুব ব্যস্ত একজন মানুষ, আমাকে দেবার জন্য তার তেমন সময় নেই। এটা নিয়ে অবশ্য আমার কোনো অভিযোগ বা অভিমানও নেই। আসলে অভিমানের উৎসটা হচ্ছে ভালোবাসা থেকে। হয়ত আমার মনের নদীটা ওর মনের সাগরে কখনো পৌছাতেই পারেনী। তার চেয়ে বড় কথা আমার মত শান্ত নদী গুলো কখনোই অভিমান বা অভিযোগ করতে শিখে না।

বই পড়তে ভালোবাসতাম বলেই সে মাঝে মাঝেই আমার জন্য বই কিনে আনতো। আমার অবসরটা বই গুলোকে সঙ্গী করেই শেষ হতো। একদিন ওর নিয়ে আসা ছয় সাতটা বইয়ের মধ্যে একটা উপন্যাস বইয়ের নাম দেখলাম- “অমীমাংসিত কাব্যিক প্রেম” নিচে লেখকের নাম দেখলাম “রেজওয়ান খন্দকার কাব্য” বইটা দেখেই আমার ভেতরটাতে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। আমি ডুব দিলাম ছয় বছর আগের স্মৃতির অতল গভীরে-

হ্যা আমি যে ছেলেটিকে ভালবাসতাম তার নাম কাব্য। সে খুব নাম করা এক জন লেখক, সে খুব ভাল লিখতো। আমি প্রথমে ওর লেখার প্রেমে পড়লেও কাব্য হয়ত আমার আঁখি নামটির প্রেমে পড়ে ছিল। আঁখি নামটা বোধ হয় বাবা আমার ডাগর চোখ দেখেই রেখে ছিল। ছয় বছর আগে ঐ লেখক তার লেখনীর অন্তরালে আমাকেই রেখে ছিল। কিন্তু ভাবিনী সে জীবণ থেকে হারিয়ে যাবার পরেও তার লেখনীর অন্তরালে আঁখিকেই রাখবে।

কাব্য-“জানো আঁখি ঐ যে মাথার উপর একটা বিশাল নীল চাঁদুয়ার মত যে আকাশটাকে দেখছো, ঐ আকাশটাকে আমি কিনেছি তোমার জন্য। ঐ এক আকাশ সমেত তারার প্রদীপ গুলোও শুধুই তোমার জন্য। ঐ জ্বলন্ত প্রদীপ গুলো তোমার জন্য আমার ভালবাসা, যা তুমি হাজার জনমেও গুনে শেষ করতে পারবে না। তুমি রোজ হাত বাড়াবে আর আমি রোজ তোমাকে এক’শ টি করে তারার প্রদীপ দেবো। কোনো এক সময় তোমার আর আমার আয়ু শেষ হয়ে যাবে কিন্তু ঐ তারার প্রদীপ শেষ হবে না।”

কাব্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে কথা গুলো বলছিল, অনেক ভালবাসায় ওর দুটি চোখ তারার মতই উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। কাব্য লেখা লেখি করে, সে অসাধারণ লেখে। আমি ওর লেখার প্রেমেই পড়ে ছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে কাব্যর প্রেমে থমকে আছি। সেও আমাকে ভালবাসে তবে সেই ভালবাসার ভাষাটা বড্ড কঠিণ। রোজ নতুন নতুন কাব্য কথায় সে আমাকে তার ভালবাসা বর্ণনা করে। আমি অবাক হয়ে শুনি। আমার ভালবাসার অনুভূতি গুলোও ওর মত করে বর্ণনা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাব্যর মত কাব্যিক জ্ঞান ভাষা কোনোটাই আমার নেই; তাই সেভাবে কিছুই বলি না। কাব্যর ঐ এক আকাশ সমেত ভালবাসার মত উপমা আমার কাছে যে নেই।

–“কাব্য আকাশে তো কোনো জ্বলন্ত প্রদীপ দেখছি না”
–“আরে দিনের বেলা তারা দেখা যায় নাকি? রাতে দেখে নিও আর আমি যেটা বললাম সেটা মনে করিও ok”
–“তো আকাশটাকে কোন্ মহাজনের কাছ থেকে কিনলা শুনি?”
–“সে তুমি চিনবা না”
–“হুম বুঝলাম”
–“তুমি যদি চাও তবে আকাশের রঙ বদলে তোমার পছন্দের হলুদ রঙ করে দেবো” মাঝে মাঝে ওর উদ্ভট কথায় হাসিও পেতো।
–“নীলটাই ঠিক আছে তোমাকে কষ্ট করে হলুদ রঙ করতে হবে না”

এভাবেই প্রায় ওর সাথে আমার কথা হতো। কাব্য বেশ চঞ্চল টাইপের ছিল। ফড়িং এর মত সব সময় উড়ে বেড়াতে চাইতো। মাঝে মাঝেই আমাকে বলতো-

–“তুমি একটা শান্ত নদীর মত। একটু খরস্রোতা হলেও তো পারো!” ওর কথা শুনে আমি চুপ থাকতাম। ওর মত উত্তাল সাগর আমি যে হতে পারি না। কেনো যে পারি না সেটা জানি না।

–“জানো আঁখি, ভাবছি তোমার জন্য একটা বিশাল পাহাড় কিনবো, সেই পাহাড়ের চুঁড়ায় একটা ছোট্ট সুন্দর বাড়ি বানাবো তোমার জন্য। তুমি জানালা দিয়ে বাহিরে হাত বাড়াবে আর আমি তোমাকে এক’শ টি করে তারার প্রদীপ দেবো”

–“তো এই পাহাড়টার মহাজন কে শুনি?”
–“সে তুমি চিনবা না”

আমি জানি লেখকদের এমন কাব্য কথা গুলো বড্ড কাল্পনিক হয়। কাব্যর ঐ কাল্পনিক বহিঃপ্রকাশ থেকে আমি তার ভালবাসা গুলো ছেঁকে নিতাম। আর কাব্যর কাব্য কথা গুলোকে কোনো এক উপন্যাসের কয়েকটা লাইন ভাবতাম; যে উপন্যাসের লেখক সয়ং কাব্য নিজেই। ওর প্রায় প্রত্যেকটি লেখার মাঝেও এমন কাল্পনিক অনেক কথাই আমি পড়েছি।

–“জানো আঁখি গত কাল জোনাক পোকার সাথে দেখা হয়ে ছিল। ওকে বলেছি যে আঁখির জন্য বানানো নতুন বাড়িটাতে সাঁঝ থেকে প্রভাত অব্দি জোনাকীদের দল বেঁধে থাকা চাই। জোনাকীরা অবশ্য রাজী হয়েছে”
–“জোনাকীরা কেনো থাকবে?”
–“বা রে আমার আঁখির জীবণে একটুও আধার থাকা চলবে না যে!”
–“তুমিই তো আমার জীবণের আলো”
–“যদি কখনো হারিয়ে যাই তবে যে আধার তোমাকে ভয় দেখাবে আঁখি। তাই তো তারার প্রদীপ আর জোনাকী এসব তোমার জীবণে রাখছি” আমি ওর এ ধরনের উদাসীন কথায় মাঝে মাঝে খুব ভয় পেতাম। এমন আজব আজব কথা শুনে কোন্ প্রেমিকাই বা ভয় না পাবে? আমি ভয়ার্তস্বরে বললাম-

–“তুমি হারিয়ে যাবে? মানে?”
–“হুম যেতেই পারি কোনো এক একলা দ্বীপে”
–“আমাকে সাথে নেবে না?”
–“না” ওর মুখে ‘না’ শব্দটি শুনে আমার বর্ণনাহীন কষ্টে বুকটা চেপে এলো। তবুও সাহস করেই বললাম,
–“কেনো?”
–“আমি একলা স্তব্ধ দ্বীপে বসে বসে দেখবো তুমি পাহাড়ের চুঁড়ার ঐ বাড়িটার জানালা দিয়ে বাহিরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে এক’শ টি তারা নিচ্ছো” ওর কথা গুলো মাঝে মাঝে খুব রহস্যময় মনে হতো। কেনো সে এসব বলতো আমি বুঝে উঠতে পারতাম না। মনে হতো আমি কোনো এক ভয়ানক খেলায় মেতেছি।

–“জানো আঁখি, লেখকদের জীবণটা খুব বিদঘুটে হয়। এদের জীবণটা পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত নয়। সারাক্ষণ লেখা লেখির ভাবনায় ঝাঁক খানেক মিথ্যা গিজ গিজ করে।”
–“তাই বুঝি?”
–“হুম”
–“কাব্য তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?”
–“না”

ওর মুখে এই ‘না’ শব্দটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। এক লহমায় আমার দু’চোখ ছলছল হয়ে গেলো, এই বুঝি টপ করে জল গড়াবে। ভাঙাস্বরে আমি বললাম-

–“কেনো?”
–“মরণ পর্যন্ত তোমাকে ভালবাসতে চাই, মরার পরে যদি আরো বেশ কয়েকটা জীবণ থাকে তবে সে গুলোতেও তোমাকে ভালবাসতে চাই আঁখি! শুধু তোমাকেই ভালবাসতে চাই!”

–“এর সাথে বিয়ে না করার কি সম্পর্ক?”
–“আছে সম্পর্ক, আমি পারিনা রোজ বাজারের ব্যাগের ভেতরে আমার আঁখিকে হারিয়ে ফেলতে। তুমি আমার হৃদয়ের রানী, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিশ এর মাঝে তোমাকে কেনো হারাবো?”
–“তাহলে আমি কি করবো?”
–“সুপুরুষ দেখে বিয়ে করবে। এক জন কাছে থেকে তোমাকে ভালবাসবে আর আরেক জন ভালবাসবে তোমাকে অনেক দূর থেকে। দুইটা পুরুষের দু’ রঙের ভালবাসায় তুমি পরিপূর্ণ থাকবে”

ওর কথা গুলো সত্যিই খুব আলাদা ছিল যা অন্য কারোর সাথে একেবারেই মিলতো না। তবুও আমি ওর কথা গুলোকে উপন্যাসের কয়েকটা লাইন ভেবেই শান্ত থাকতাম। কারণ গভীর ভাবে যদি ওর কথা ভাবতে যাই তবে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো। কারণ আমি এই মাঝ পথে এসে কাব্যকে ছাড়তে পারবো না। সে সত্যি মিথ্যা যা-ই ভালবাসুক না কেনো, আমি তা নেবো।

–“জানো আঁখি নতুন একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছি, এই উপন্যাসের নায়িকা তুমি। আমার জীবণের আগামী সব উপন্যাসের নায়িকা তুমিই হবে। কাহিণী আমি যে গ্রহ থেকেই আনি না কেনো, নায়িকা হবে আঁখি।”

ওর কথা শুনে একটু অবাক হয়ে ছিলাম। পরে অবশ্য ভেবেছি যে, হয়ত সে আঁখি নামটাকেই তার উপন্যাসের নায়িকা ভাবে।কারণ লেখকদের মতিগতি সাধারণ মানুষের বুঝা বেশ দূর্বিসহ।আর আমার মত সাধারণ চিন্তা ধারার মানুষের পক্ষে তো তা বুঝা একদম অসম্ভব।

–“তুমি কি জানো আঁখি তোমার চোখ দুটো কতটা অসাধারণ সুন্দর? ঐ চোখের গভীরতায় ডুব দিয়ে হাজার হাজার বছর ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তোমার চোখের মাঝে জেগে থেকে স্বপ্ন দেখতে।” কাব্যর এমন কাব্যময় আবেগে ডুব দিয়ে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছিল। আমি কাব্যকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় পেতাম। কারণ ওর কাল্পনিক স্বপ্নের সাথে আমার বাস্তব স্বপ্ন গুলো বেমানান ছিল। আর কাব্য সেটাই প্রমাণ করে দিয়ে ছিল।

হঠাৎ কাব্য উধাও হয়ে গেলো। ওর ফোন বন্ধ, কোনো ভাবেই ওকে খুঁজে পেলাম না। সে চলে যাবে সেটা সে অনেক ভাবেই বুঝিয়ে ছিল। কিন্তু কিছু বলে তো যেতে পারতো। সে যে এমন ভাবে ফেরার হবে সেটা কখনো ভাবতেই পারিনী। কাব্যকে হারিয়ে আমি দূর্বিসহ জীবণ কাটিয়েছি। সব কষ্ট বর্ণনা করা যায় না। গোপন ব্যাথা গুলো চিরমেয়াদী হয়ে হৃদয়টাকে ক্ষত করে রাখে। আমি স্মৃতি থেকে চেতনায় ফিরলাম,তারপর “অমিমাংসীত কাব্যিক প্রেম” উপন্যাসটা পড়ছি আর আমার শরীরটা একটু একটু করে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। গোটা বইটা পড়ার পড়ে মনে হলো আমার সারা শরীর বরফ শীতল হয়ে গেছে।

উপন্যাসটার মূল বক্তব্য হলো- উপন্যাসটার নায়িকার নাম আঁখি। লেখকের মনের মহলের রানী সে। লেখক ওর জন্য একটা পাহাড় কিনেছে এবং পাহাড়ের চুঁড়াতে আঁখির জন্য একটা ছোট্ট সুন্দর বাড়ি বানিয়েছে। আঁখি তার লম্বা চুল গুলো ছেড়ে যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখন লেখক আঁখির ঘরে গিয়ে ওর শিওরে বসে আঁখিকে তার মনের সব অনুভূতি গুলো ব্যক্ত করে। কিন্তু আঁখি ঘুমন্ত বলে একটাও প্রতিউত্তর দিতে পারে না। লেখক শুধু অবিরাম নিজের সব কথা বলে যায়। তারপর প্রভাতের আলো ছড়িয়ে যাবার আগেই লেখক অদৃশ্য হয়ে যায়। এভাবেই বহু বছর ধরে চলছে লেখকের ভালবাসা জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টা। বইটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লেখক তার মনের রানী আঁখির প্রতি অনুভূতি গুলো ব্যক্ত করেছে। সেখানে লেখা ছিল- “জানো আঁখি তোমার খোলা লম্বা চুল গুলো যখন বাতাসে উড়ে আমার দু চোখ ছুয়ে দেয় তখন আমার মনে হয় এমন একটা ঘুমের দেশে চলে যাই, যেখানে তোমার চুল গুলো অবিরাম আমার দু চোখ ছুঁবে”

“জানো আঁখি, আমার মনের মন্দিরের এক অপার সুন্দর প্রতিমা তুমি। তুমি উপভোগ্য নও, তুমি পূজনীয়। আমি তোমাকে উপভোগ করতে পারি না। আমি পারি না আঁখি তোমাকে ভোগ করতে!” এমন অনেক অনেক অনুভূতি দিয়ে পুরো উপন্যাসটা সাজানো ছিল। শেষ লাইন গুলো হলো- “জানো আঁখি ঐ তারা সমেত আকাশটাকে তোমার নামে লিখে দিয়েছি। ঐ আকাশের বুক আঁকড়ে থাকা চাঁদটা হলো তুমি। আমি সূর্য নই আঁখি, তোমার জীবণে সূর্য হয়ে আমি থাকতে চাই না। চাঁদের কাছা কাছি যে সন্ধ্যা তারাটাকে দেখছো, ওটাই আমি। চিরকাল তোমাকে পাহারা দেবার জন্য আমি জেগে থাকবো আঁখি, কথা দিলাম।”

গোটা বইটার কোথাও লেখা নেই সে কেনো এভাবে আঁখির জীবণ থেকে চলে গেছে। সত্যিই আজো সেই প্রশ্নটা আমার মনের ভেতর ঘুরপাক খায়। কাব্যর লেখা অন্যান্য উপন্যাস গুলোও আমি পড়েছি। প্রত্যেকটি উপন্যাসের নায়িকা হলো আঁখি। সেই উপন্যাস গুলোর কাহিণী যতোই অপরিচিত হোক না কেনো, কোনো না কোনো ভাবে সে তার কাহিণীতে আঁখিকে উপস্থাপন করেছে। যেমন-

লেখকের মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যাবার পর আঁখির ভাবনায় সে আহত হয়েছে। কোনো এক জোছনা রাতে হঠাৎ সে আঁখি বলে চিৎকার করে কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আঁখির স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে তার সকালটা শুভ্র হয়েছে। সে হাটতে হাটতে হঠাৎ আঁখির কথা ভেবে পথ ভুল করেছে। বৃষ্টির রাতে সে আঁখিকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে সে তার আঁখির কথা ভেবে বাড়ি ফিরে এসেছে। ঘুমের ঘোরে সে আঁখি আঁখি বলে ডেকে উঠেছে। তার নিস্তব্ধ একাকী সময়ে হঠাৎ আঁখির আত্মা তার কাছে এসে বসে বসে গল্প করেছে।

এমন ভাবে তার লেখা বহু উপন্যাসে সে আঁখিকে উপস্থাপন করেছে। এবং প্রত্যেকটি উপন্যাস সে আঁখিকে উৎসর্গ করেছে। জানি না সেই আঁখি নামের মানুষটাই আমি কি না। নাকি আমার নামটাই তার উপন্যাসের রানী। লেখকদের ভালোলাগা ও ভালোবাসা গুলো সত্যিই ভয়ংকর আর নির্মমও। এর মানে বুঝা বা পার্থক্য বুঝা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। জীবণটা আসলেই এমন, প্রাপ্তির চেয়ে শূন্যতাই বেশী থাকে। গোটা একটা জীবণ শূন্যতা দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। একটা গোটা জীবণ জুড়ে এত বড় একটা শূন্যতাই বা কম কিসে?

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত