ইদানীং বেশ যন্ত্রণায় রয়েছি। কথা নেই বলা নেই হুট করে বলে দিলো এই সপ্তাহ রাতে ডিউটি করতে হবে। শুধু রাত হলে সমস্যা ছিলো না। রাত সাড়ে ন’টায় এসে বেলা সাড়ে এগারোটা অব্দি কি টানা অফিস করা যায় ? মানুষ আমি ; যন্ত্র না। কিন্তু এই কথাটা কর্পোরেট জনকদের কে বোঝাবে ?
রাত দু’টো অব্দি কাজ করার পর পেটের মাঝে হাল্কা একটু ক্ষুধার জন্ম নেয়। সেই হাল্কা ক্ষুধা কে মহাকালের কোন এক হিংস্র ব্লাকহোল বানানোর জন্য কেবিনের সবাই দু’ঘন্টা ব্রেক নিয়ে অফিসের ছাদে গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে ; তারপর ছাদের অপর পাশে খোলামেলা ক্যান্টিনে বসে যায় খাবার খেতে।
লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিকের তৈরি খাবার টেবিল আর চেয়ার। হ্যালোজিন আর এনার্জি বাল্বের আলোর সংমিশ্রণে সেই চেয়ার-টেবিলগুলো দেখলে মনে হয় কেউ সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে ক্ষুধা নামক জ্বালাটা মেটানোর জন্য। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। খেলা শেষে সবাই যখন ব্যস্ত বাসা থেকে নিয়ে আসা খাবার নিয়ে নিজ নিজ পছন্দের টেবিলে চেয়ার টেনে বসতে ; আমি তখন জুতো মুজো খুলে প্রস্তুতি নিচ্ছি পিয়ন মানে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য বিছানো পাটিতে আরাম করে বসার জন্য।
যদিও আমি একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ; মাস তিনেক চাকরী করলে প্রমোশন পেয়ে হায়ার লেভেলে চলে যাবো তথাপি আমি বাঙালী বলে কথা। ফ্লোরে লেটা মেরে না বসে আমার দ্বারা খাবার খাওয়া সম্ভবপর নয়। টিফিন বাটিটা খুলে সবেমাত্র প্লেটটা বের করেছি এমনি সময় নেহা ম্যাম আমায় বললেন , ” কি এমন আনো তুমি খাওয়ার জন্য যে আমাদের সামনে বের করতে লজ্জা পেয়ে পিয়নদের সাথে বসে খাও ? ”
নেহা ম্যাম সবসময়ই এমন করে খোঁচা মেরে থাকেন। এটা তার একটা গুণ নাকি বদগুণ তা আমি জানি না। অফিসে তিনি আমার একদিন আগে জয়েন করেছেন ; কিন্তু ভাবখানা উনার এমন যেন আমার দশ বছর আগে জয়েন করেছেন। সারাদিনে আমি দশ থেকে বারো বার অফিসের বাইরে গিয়ে চা পান করে আসি। অফিসের কেউ কোনদিন জিজ্ঞাসা করলো না কোথায় যান অথবা যাও ? কিন্তু নেহা ম্যামের কাছে জবানবন্দী দিতে হয়। শুধু আমার সাথে এমন করেন তা নয় তাই আজ না পেরে টিফিন বাটিটা আবার হাতে নিয়ে তার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম , ” আজ কি এনেছেন আপনি ? ”
নেহা ম্যাম পাঁচ টাকা দামের একটা হলুদ রঙের ছোট প্লাস্টিকের বাটির ঢাকনা খুলে দেখালেন। তাতে দেখতে পেলাম দুই পিস মাঝারী সাইজের মুরগীর মাংস, এক টুকরো আলু আর একদম লাল টকটকে ঝোল। ঝোলের রঙ দেখেই বুঝা যাচ্ছে এটা হোটেল থেকে কিনে আনা। আমি হেসে বললাম , ” আপনার ঘরে মনে হয় কিছু রান্না হয় নি। এটা থার্ড ক্লাশ কোন হোটেলের তরকারী। এবার আমারটা দেখুন। বলেই টিফিন বাটির লকটা খুলে প্রথম বাটিটা দেখালাম। সেটা ভর্তি ডাল। নেহা ম্যাম তা দেখে একটা যুদ্ধজয়ের হাসি দিলেন। এরপর দ্বিতীয় বাটি খুললাম। সেটায় দুই পিস মাছ ভাজা, বেগুন ভাজা, টমেটো ভর্তা।
এবার আমি তৃতীয় বাটি খুললাম। সেটায় হলো একপাশে দুই পিস বড় চিংড়ী দো’পেয়াজি করা আর একটা ডিম সেদ্ধ করে মশলা মাখিয়ে তেলে ভেজে দেয়া। এবার আমি নেহা ম্যামকে বললাম , ” কি খাবার এনেছি বুঝেছেন ? আমার লেটা মেরে আরাম সহকারে খাওয়ার অভ্যাস। তাই নিচে বসি। ” নেহা ম্যাম রাগে কিছু বলছে না। এমনটা হবে তিনি ভাবতে পারেন নি। তার এমন বিব্রত অবস্থা দেখে আশেপাশে সবাই হাসছে।
এমন সময় নিচে বসা এক পিয়ন ; নাম মজনু। সে তার টিফিন বাটিটা খুলতেই পাতলা খিচুড়ি তেল আর রসুনে বাগাড় দেয়ার ঘ্রাণটা নাকে আসলো। আমার ক্ষুধা আরো বেড়ে গেলো। আর সেই ঘ্রাণটা পাওয়ার সাথে সাথে নেহা ম্যাম চিল্লিয়ে মজনু কে বললেন , ” এই তোর খিচুড়ির বাটি বন্ধ কর। রোজ রোজ একই জিনিস নিয়ে আসিস। আমি খেয়ে নেই। তারপর খাবি। ফালতু জিনিসের ঘ্রাণ আমার সহ্য হয় না। ”
বেচারা মজনু আবার বাটিটা বন্ধ করে ফেললো। মজনুর বয়সটা আমার মতোই তেইশ কি চব্বিশ হবে। রোগা পাতলা শরীরে পুষ্টিহীনতা ও রক্ত স্বল্পতার দরুন বয়সটা আরো পাঁচ বছর কমে গেছে। দেখলে মনে হয় সবে আঠারোয় পা দেয়া কোন যুবক।
আমি মজনু কে বললাম , ” মজনু ভাই !! খিচুড়ির বাটিটা নিয়ে আমার পাশে এসে বসো। ” মজনু চুপচাপ বসে আছে। নেহা ম্যামের কথায় খানিকটা লজ্জিত হয়েছে মজনু। আমি একটু ধমকের সুরে আবার বললাম , ” কি হয়েছে ? বসের কথা শুনো না। এটা কেমন বেয়াদবি ? ” এবার মজনু খিচুড়ির বাটিটা নিয়ে উঠে আসলো। একটা বেগুনি রঙের চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলো।
আমি ওর খিচুড়ি বাটির ঢাকনাটা আবার খুললাম। আবার সেই তেলে রসুনে বাগাড় দেয়া ঘ্রাণ। আহা!!! কি যে ঘ্রাণ!! ভালো করে চেয়ে দেখি বিভিন্ন সবজি মিলিয়ে পাতলা করে রান্না করা খিচুড়ি। খিচুড়িগুলো আমার প্লেটে নিয়ে মজনুকে আমার খাবারগুলো দিয়ে বললাম , ” তুমি আমার খাবার খাও। তবে ডিমটা বাদে। আমি ডিম কারো সাথে শেয়ার করি না। ”
আমি খেতে শুরু করলাম। কিন্তু মজনু চুপচাপ বসে আছে। আমার যতটুকু মনে পরে মজনুকে যতবারই খেতে দেখেছি ; খিচুড়িই খেতে দেখেছি। তাই আমার টিফিন বাটির ভাতগুলোর দিকে মজনু ক্ষুধার্ত বাঘের দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। তবে নিম্ম-মধ্যবিত্ত হওয়ার যে ভদ্রতাবোধ ; তার জন্য মজনু না খেয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। হয়তো ভাবছে সবাই খেয়ে উঠার পর খাবে। আমি খিচুড়ির লোকমা মুখে দিয়ে মজনুকে বললাম , ” মজনু ভাই !! খাওয়া শুরু করো। আর একটা খিচুড়ির গল্প শুনো। ” এবার মজনু প্লেটে ভাত বেড়ে নিতে লাগলো। আর আমি বলতে লাগলাম –
” জন্মের পর যখন থেকে সবকিছু বুঝার জ্ঞান হয়েছে তখন আমার বাবাকে দেখতাম দু’টো জিনিসের সাথে বেশ সখ্যতা। একটা হলো গোল্ডলিফ সিগারেট। আর দুই হলো বিভিন্ন অসুখ। তার অতিরিক্ত ধূমপানের কারণে তিনি ক’দিন পরপরই বড় ধরনের অসুখ হতো। ” কথাটা বলতে বলতে চোখের কোণে জলে এসে গেলো। বাবার কথা মনে পরে গিয়েছে। হুশ ফিরলো মজনুর প্রশ্ন। সে জিজ্ঞাসা করলো , ” বস তারপর ? ”
আমি বলতে লাগলাম, ” ২০০৫ সালের কথা। বয়স আমার তখন সবে এগারো। আমার বাবার টি.বি. রোগ হয়েছে। যা তার একটি ফুসফুস অকেজো করে ফেলেছে। এতো বড় রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমাদের শহরের বাড়ীটা বিক্রি করে দিয়ে মা আর বাবা একটা ভাড়া বাড়ীতে উঠলো। আমার ঠাঁই হলো জামালপুরে ; কাকার বাসায়। ” কাকার কথা আসতেই যেন আমি আবার আমার শৈশবে ফিরে যেতে লাগলাম। আবারো হুশ ফিরলো মজনুর প্রশ্নে। এবারো সে গল্পের বাকী অংশ জানতে চেয়েছে। আমি বললাম , ” কাকারও তখন প্রচুর অভাব। তিনবেলার জায়গায় একবেলার খাবার যোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়। কাকা-কাকী আর তাদের পাঁচ ছেলে মেয়ের সংসারে আমি হলাম অস্টম সদস্য।
অভাবের সংসারে এতোগুলো মানুষের খাবারের চাহিদা মেটাতে আমার কাকী রোজ সকালে পাতিলে এক পোয়া চাল নিতেন। এরপর রান্নাঘরে থাকা তরকারীর ঝুঁড়ি হাতরে পরে থাকা দু’তিন পিস সিম, চার-তিন পিস আলু, অর্ধেক খাওয়া ফুলকপি, পুতিয়ে যাওয়া এক-দুই পিস বেগুন,এক পিস মুলো আর এক মুঠো ডাল নিয়ে ভালো করে ধুয়ে চালের সাথে পাতিলে রাখতেন। ” কথাটুকু বলেই কয়েক লোকমা খিচুড়ি খেলাম। এরপর আবার বললাম, ” তারপর একটা পেয়াজ কুঁচি কুঁচি করে দিতেন। সামান্য হলুদের গুড়া ও বাড়ীর উঠোনে দারোয়ানের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আকাশী মরিচ গাছ থেকে কয়েকটা মরিচ ছিঁড়ে নিয়ে আসতেন। ”
কথার মাঝে মজনু জিজ্ঞাসা করে বসলো , ” আকাশী মরিচ কি ? ” আমি হেসে বললাম , ” এটাও কাঁচামরিচ। তবে সবুজ বা গাড় নীল রঙের হয় না। এটার রঙ হয় আকাশী, ফ্যাকাসে অথবা অফ হোয়াইট। আর এই মরিচ উল্টো দিকে ধরে। গাছের ডাল থেকে মাটির দিকে না ঝুলে উল্টো হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রয়।”
মজনু বললো , ” বুঝলাম স্যার। ” আমি আবার বলতে লাগলাম , ” মরিচগুলো পাতিলে দেয়ার পর কোন তেল ছাড়াই লবণ দিয়ে মাখিয়ে পানি দিয়ে চুলোয় বসাতেন। যখন সব সেদ্ধ হয়ে যেতো ; তখন কড়াইয়ে তেল ঢেলে তাতে রসুন ভেজে তা দিয়ে বাগাড় দিতেন। ” এটুকু বলেই আমি কেঁদে ফেললাম। আমার বলা গল্পটা শুধু মজনু না আশেপাশে অনেকেই শুনছিলো। তাদেরই কেউ একজন বললো , ” আরে ভাই কাঁদো কেন ? তারপর কি হলো বলো না কেন ? ”
আমি বাম হাত দিয়ে চোখু মুছে বলতে লাগলাম , ” সেই এক পোয়া চালের খিচুড়ি আমরা আটজন মানুষ খেতাম। পেট ভরতো কি না মনে নেই ; তবে আমাদের সবার মন ভরতো। আর এই কৃতিত্বের একমাত্র অধিকারী ছিলেন আমার কাকী। এরপর কেটে গেলো কত বছর। আমি ঢাকায় চলে আসলাম। বছর তিনেক আগের শীতে আমার সেই মা সম কাকী গত হলেন।
কাকা এখন রাজনৈতিক দলের বড় মাপের নেতা ; উনার বড় ছেলে এখন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ; মেজো ছেলে বাস ড্রাইভার সাথে আবার পরিবহণ শ্রমীকদের নেতা ; ছোট ছেলে এমেরিকায় থাকে – ওখানে সিটিজেনশীপও পেয়েছে উনার বড় মেয়েটার ডিভোর্স হয়েছে রিসেন্টলি। তবে এক মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ীতে সেও রাণীর হালেই আছে। আর ছোট মেয়ের স্বামী নেভির অফিসার। আর আমিও ছোট মাপের একজন বড় ব্যক্তি। যাকে কয়েকজন মানুষ আবার স্যালুট করে। কিন্তু মজার বিষয় হলো আমাদের কারো সাথে আজকাল কারো কোন যোগাযোগ নেই। কোন সম্পর্ক নেই। যে যার মতো দিব্যি বেঁচে আছি। এটাকে ভালো আছি বলে কি না জানি না।
টাকা পয়সা কোন কিছুরই কমতি নেই। কামাচ্ছি,খাচ্ছি,উড়াচ্ছি। কিন্তু তবুও বেলা শেষে কমতি রয়েই যায়। আর কমতিটা হলো আমার কাকীর ; কমতিটা হলো সবাইকে একসাথে বেঁধে রাখার ভালবাসার ; কমতিটা হলো মায়ার,মহব্বতের। কমতিটা হলো আটজনের সংসারে এক পোয়া চালের খিচুড়ির ; যেই পাতিল থেকে উপচে উপচে ভালবাসা পরে।