পাপ

পাপ

শান্তনুকে খাইয়ে দিচ্ছিলাম।ও বই পড়ছিল।হঠাত ও মাথা তুলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,বস চলেন মুভি দেখি!” আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ওকে বললাম,” না রে,সকালে অফিস আছে।রাত জাগলে সকালে উঠতে দেরী হয়ে যাবে!শান্তনু কিছু বলল না,আবার মাথা নিচু করে খেতে খেতে বই পড়া শুরু করলো।

আমি রায়হান,দুই বছর আগে এমবিএ শেষ করে একটা প্রাইভেট ফার্মে ছোট খাট একটা চাকুরী করি।বাড়িতে মা-ভাই আর ভাবি আছে।ভাই ব্যবসা করে,তার ইনকাম ভালোই।তাও আমি মাকে প্রতিমাসে কিছু হাতখরচ পাঠাই!
শান্তনু, আমার রুমমেট।গত ৩বছর ধরে আমরা একরুমে থাকি।এর মধ্যে ৪ বার বাসা পাল্টালেও শান্তনু আমার পিছু ছাড়েনি।অনেক চঞ্চল!এতদিনে আমি ওকে শুধু হাড়ে হাড়ে না,শিরায়-উপশিরায় চিনে ফেলেছি।আমার আপন ছোট ভাই থাকলে তাকে এত আদর করতাম কিনা কি জানি! হয়ত না!

শান্তনু একটা বেসরকারি ভার্সিটিতে ফোর্থ ইয়ারে পড়ে।বেশ স্বচ্ছল পরিবার।বাবা ব্যবসায়ী, মা সরকারি চাকুরীজীবি।ছোট বোন গতবছর রাজশাহী মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় ওর মা দেন- দরবার করে রাজশাহী পোস্টিং নিয়েছে। তারা ওখানে কোয়ার্টারে থাকে।শান্তনুর সাথে ওর বাবার বনিবনা হয়না,তাই পড়াশোনার চাপের অজুহাতে ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতেই মেসে উঠেছে।যদিও প্রতি সপ্তাহে সে বাসায় যায়। আমিও ওর সাথে বেশকয়েক বার ওদের বাসায় গিয়েছি।ওর পরিবারের সবাই বেশ আন্তরিক।

শান্তনু বাসা থেকে শুধু টিউশন ফি আনতো,আর বাকি টুকটাক খরচ নিজেই চালাত! আমি ওর সম্পর্কে জানতে পারি প্রথম দিনেই! অনেক চঞ্চল ছেলে তো,সারাদিন বকবক করে মাতিয়ে রাখে।আমার বিপরীত চরিত্র! আমি বই পাগল- আর ও মুভিখোর! যেন মুভি দেখে না,গিলে খায়। ওর পাল্লায় পরে আমিও বেশ কিছু মুভি দেখেছি,কিন্তু ওকে আমি তেমন বই পড়াতে পারিনি।কোন বই পড়তে দিলে,সে সেটার উপর হাত রেখে তাতে গাল ভর দিয়ে মুভি দেখতো! আমি গ্রামে বড় হওয়া,তাই শহুরে ঘোরাঘুরি আমার ভালো লাগেনা,কিন্তু শান্তনু ক্লাস না থাকলে সন্ধ্যার পর জোর করে চা খাওয়াতে নিয়ে যেত। সারাদিন আমাদের দেখা হত না,তাই রাতের খাবারের সময় ওর গল্পের ভান্ডার যেন উপচে পড়তো! মাঝে মাঝে কান ঝালাপালা লাগতো,প্রায়ই বকা দিয়ে থামিয়ে দিতাম।ও তখন বলতো,শুধু রাতে খাওয়ার সময় আপনাকে একটু বিরক্ত করি,এমন করলে বই পড়ার সময়ও বিরক্ত করবো! আমি ভয়ে চুপ থাকতাম, আর তার দুনিয়াদারির গল্প শুনতাম!

এক সোমবার,আমি অফিস থেকে রুমে ফিরেছি।দেখি রুমের লাইট অফ করা,রুম অন্ধকার।শুধু শান্তনুর ল্যাপটপের স্ক্রিনের আলো জ্বলছে।আমি লাইট জ্বালিয়ে দেখি শান্তনু ওর রিভলভিং চেয়ারে বসা।মুখ থমথমে। আমি গত ৩ বছরে কখনো ওকে এভাবে দেখিনি।ভাবলাম মেয়েঘটিত কোন জটিলতা নাকি,কিন্তু সেরকম কিছু হলে তো পৃথিবীর আর কেউ না জানলেও আমি জানবো! তাহলে কি বাসায় কোন সমস্যা? আজ তো ওর ক্লাস অফ ছিল, হয়ত বাসায় গিয়েছিল।

জিজ্ঞাসা করলাম,কি রে,কি হইসে তোর? ও জবাব দিলো না।টাই আলগা করে টেবিলের পাশে ওর খাটে গিয়ে বসলাম।আবার জিজ্ঞাসা করলাম,কি রে,বল না! এবারো কিছু বলল না।আমি চুপ করে আছি,জানি, ও না বলতে চাইলে বোমা মেরেও লাভ নেই।একসময় ইজি হয়ে গেলে নিজেই বলবে।আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে শান্তনু জিজ্ঞাসা করলো,বস চলেন মুভি দেখি!

ভাবলাম,হয়ত ইজি হচ্ছে।একসাথে মুভি দেখতে বসলে হয়ত কথা বলা শুরু করবে।বললাম,আচ্ছা ছাড় দেখি!
আমি ওর পাশে বসে ওর মুখের দিকে তাকালাম,ওকে বোঝার জন্য।হঠাত ওর ঠোটে একটা অনরকম হাসি দেখলাম,যার অর্থ আমি জানিনা।এই হাসি আমার পরিচিত না।ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম।ও একসাথে ছয়টা ফাইল সিলেক্ট করে প্লে বাটনে চাপ দিল।আমার কাছে ব্যাপারটা খটকা লাগলো।হঠাত শান্তনুর হাসিতে আমার আত্মা উড়ে যাওয়ার মত অবস্থা! দেখি ও অপ্রকৃতস্থর মত হাসছে।যেন ওর উপর খারাপ কোন কিছু ভর করেছে।ওর চোখ চকচক করছে আর পানি জমছে।আমি স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আমার সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল।মনে হচ্ছিল যেন আমার পা’দুটো কেউ মাটিতে গেড়ে দিয়েছে।

শান্তনু পর্ণ প্লে করেছে। বাসায় ভিডিও করা।আর এই পর্ণ মুভির নায়ক আর কেউ না,স্বয়ং শান্তনুর বাবা।আর নায়িকার চরিত্রে ছয়জন ভিন্ন নারী। বোঝাই যাচ্ছে,সবাই সেই ক্লাসেরই! চার মাস পরের ঘটনা: শান্তনু এখন মেন্টাল ক্লিনিকে আছে,যাকে সোজা বাংলায় পাগলাগারদ বলে।সেদিন মেন্টাল শক ও নিতে পারেনি।ওর ছোট বোনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ওর মা সব মেনে নিয়েছে।যদিও তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই,তবুও তারা একসাথে থাকে।

আর আমি,গত চার মাস ধরে প্রত্যেক দিন রাতের খাবার শান্তনুর সাথে খাই।আগে ওকে খাইয়ে দেই,পরে আমি খাই।আর এই পুরোটা সময় ওর গল্প শোনার চেষ্টা করি।কিন্তু ও গল্প করেনা,আমার দেয়া বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে।আমি তাও এটা সেটা বলে গল্প করার চেষ্টা করি,কিন্তু ও চুপ থাকে।আর মাঝে মাঝে হঠাত বলে ওঠে, বস চলেন মুভি দেখি!” আমিও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ওকে বলি,” না রে,সকালে অফিস আছে।রাত জাগলে সকালে উঠতে দেরী হয়ে যাবে”……

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত