আমি যে বাসাটাতে থাকি সে বাসাটাতে ছাদ নেই। সিঁড়ির কাছে ছোট্টমত একটা জায়গা আছে। সেখান থেকেই আমার বৃষ্টি বিলাস, জ্যোৎস্না বিলাস হয়। প্রায় রাতের বেশিরভাগ সময়ই সেখানে কাটে। যদিও আমি ভীতু টাইপের একটা মেয়ে তবে মন খারাপের সময়টাতে আমার কোনরুপ ভয় কাজ করেনা। রাতের ঐ শীত শীত ঠান্ডা বাতাসটা গায়ে মাখতে ভীষণ ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালোলাগা কাজ করে এজন্য যে, এই সময়টাতে বেশিরভাগ মানুষইই ঘুমিয়ে থাকে। শান্তিপূর্ণ কোলাহল মুক্ত পরিবেশ।
বাসাটা হাইওয়ের পাশে হওয়াতে একটু পরপর গাড়ির হর্ণ বেজে ওঠে। সাঁই সাঁই শব্দে ছুটে যায় গাড়িগুলো। আমার অবশ্য খারাপ লাগেনা বরং একটু বেশিই ভালো লাগে। এই গাড়ির শব্দগুলো আমার কাছে অন্য রকম লাগে। মনটা কেমন ব্যাথিত করে তোলে। আমাকে আনেকটা কষ্ট প্রিয় মানুষ বলা যায়। তাই হয়ত এই একঢিলে দুই পাখি অর্থাৎ একই সাথে ভালোলাগা আর কষ্ট কষ্ট ব্যাপারটা উপলব্ধি করা যায় বলে ভালো লাগে। এটা বেশ মজার। সিঁড়ির দেয়াল বয়ে একটা মাধবীলতা গাছ বেয়ে উঠেছিল। যেটা সিঁড়ির ছোট্ট জায়গাটার অধিকাংশ স্থানই দখল করে রেখেছিল। রাত বাড়ার সাথে সাথে মাধবীলতার গন্ধ তীব্র হত, আমার মন খারাপ ও তীব্র হত। একসময় অবশ্য কমেও যেত। অশ্রু পালা শেষ করে হাসি হাসি মুখ নিয়ে রুমে চলে আসতাম।
সিঁড়ির ঐ জায়গাটা থেকে এখন আর আকাশ দেখা যায়না। মাধবীলতা গাছটাও কেটে ফেলা হয়েছে। এখন বসে আছি আমার রুমের জানালার পাশে। এখান থেকে তেমন একটা আকাশ দেখা যায়না। একটু ভয় ও লাগছে কিন্তুু কি করার!! ঝিঝি পোকার একঘেয়েমি ডাক বারতেই আছে। তবে মন্দ লাগছে না। আমার মন খারাপ তো কি হয়েছে ওদের বোধকরি আজ আনন্দের দিন।।।।। অনেকদিন পর আজ মৃন্ময়ের সাথে আজ দেখা হয়েছে। মন খারাপের এক এবং একমাত্র কারণ এটাই। ক্লাস শেষ করে রিকশা না পেয়ে হাঁটছিলাম, তখনই অঘটন টা ঘটলো।। ওহ বলাই হয়নি আমি একটা স্কুলে পড়াই। পুরোদস্তুর ম্যাডাম।।
অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম “মানসী” বলে কেউ অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে। আওয়াজ টা অনেকটা মৃন্ময়ের কন্ঠের মত। প্রথমে ভেবেছিলাম হ্যালুসিনেশন। এখানে কি করে আসবে মৃন্ময়!!! কবেই তো চেনা শহরটা ছেড়ে এই মফস্বল শহরটাতে চলে এসেছি। নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছি চেনা সবার কাছ থেকে। খুব একটা যোগাযোগ ও নেই কারো সাথে। নিজের মনেই ভাবছিলাম এসব।।। আওয়াজ টা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো । হ্যাঁ, মৃন্ময়ই তো!!! হঠাৎ যেন বুকের ভেতরে সজোরে ধাক্কা লাগলো। মনের মধ্যে হাজার কিলোমিটার বেগে সাইক্লোন শুরু হয়ে গেল। কি করে সম্ভব এটা!!!!
– কেমন আছো মানসী?
-তুমি তুমি এখানে?? সমস্ত উৎকন্ঠা চেপে রেখে বললাম।
– আজই বদলি হয়ে এখানে এসেছি।
মেয়েটাকে সাথে নিয়ে দেখছিলাম শহরটাকে। তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল হঠাৎ। অন্যমনস্ক হয়ে হাটছিলে তুমি। অনেকক্ষণ থেকেই তোমার পিছু হাঁটছি। এতোক্ষনে খেয়াল করলাম মৃন্ময়ের হাত ধরে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিষ্পাপ একটা চেহারা।
– এটা তোমার মেয়ে? আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম।
-হুম। ওর নাম অবনী। সবে দুই বছরে পা দিয়েছে।
– খুব সুন্দর নাম। “অবনী মানে পৃথিবী “। হঠাৎ মনে হলো আমাদের মেয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলাম “অবনী “।
আমাদের পৃথিবী। মৃন্ময় আর আমার ভালোবাসার পৃথিবী, অবনী। মনের মধ্যে কিন্চিত ভালোলাগা কাজ করলো। কোলে তুলে নিলাম বাচ্চা টাকে। ওর গালে আস্তে করে একটা চুমু দিয়ে ব্যাগ থেকে ঘড়িটা বের করে দিলাম। যেটা বহুকাল আগে মৃন্ময়ের জন্য কিনেছিলাম। কিন্তুু শেষ পর্যন্ত দেয়া হয়ে ওঠেনি।আজ অবনীকে দিয়ে তারই ঋণ শোধ করলাম।।
আমাদের সম্পর্কটা প্রায় ছয় বছরের। বলা যায় পৃথিবীর গভীরতম ও শুদ্ধতম প্রেম। মৃন্ময় প্রচন্ড বাস্তববাদী ধরনের ছেলে। তবে, আমার সমস্ত অবাধ্য. চাওয়া গুলো পূরণ করার এক অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল ওর। সবকিছু ঠিক ছিল। পারিবারিক ভাবেও জানাজানি ছিল আমাদের ব্যাপারে। অনেকটা সম্মতিওও ছিল দু পরিবারের। “কিন্তুু নিয়তি বলে একটা কথা আছে যেজা আমাদের অনুকূলে ছিল না। বিধাতা কখন, কার সাথে নিয়তি বেঁধে দিয়েছেন বা দিবেন সেটা একমাত্র তাঁরই অবগত কয়েকদিন থেকেই দেখছিলাম মৃন্ম কেমন যেন আত্মোভোলা হয়ে আছে। আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তুু বলতে পারছে না। কেউ যেন সেই সময়ে ওর কন্ঠে স্বর রুদ্ধ করে দেয়। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারি। একরকম জোর করেই একদিন জিজ্ঞেস করলাম
– মৃন্ময়, তুমি কি কোন কারণে চিন্তিত? মৃন্ময় যেন এই প্রশ্নটারইই অপেক্ষা করছিল। ও বললো..
– হ্যাঁ মানসী। কথাটা তোমাকে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা। তবে, তোমার জানা দরকার বুকটা কেঁপে উঠলো। কি বলবে মৃন্ময়!!! না, সেদিন তেমন কিছু বলেনি মৃন্ময়। শুধু বলেছিল,
– মানসী, যদি বিধাতা আমাদের সহায় হন তবে এই গোলাকার পৃথিবীতে ফের আমাদের দেখা হবে।
কোন কারণ ছাড়া ওর আকস্মিক এই অপ্রিয় কথাটার কারণ জানতে চাইলাম। কিন্তুু ও বললো না। এরপর বছরখানেক আর কোন খবর পাইনি ওর। মাঝেমাঝে ওর বাড়িতে যেতাম, তাতে তেমন লাভ হয়নি। মৃন্ময় কোথাও কোন ঠিকানা রেখে যায়নি। তীব্র অভিমান জমেছিল ওর প্রতি। কিছুদিন পর আমার নামে একটা চিঠি আসে। চিঠিটা মৃন্ময়ের পাঠানো। সেখানেই জানতে পারি সবকিছু। মৃন্ময়ের বিবেকবোধ প্রখর সেটা জানতাম তবে এতোটা বেশি সেটা ভাবতে পারিনি। ওর চিঠিটা ছিল এরকম,” মানসী, ভুল বুঝোনা আমায়। আমি এক এবং একমাত্র তোমাকেই ভালোবাসি। তবে, আজ আমি বিবেকের কাছে হেরে গেছি। সেদিন বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। আমি দোষ করেছি তবে ক্ষমা চাইবো না কারণ সে মুখ আমার নেই। তুমি ভালো থেকো।
মৃন্ময় বিয়ে করেছিল ক্যান্সার আক্রান্ত একটা মেয়েকে। মৃন্ময় পেশায় ডাক্তার ছিল। ওই অসুস্থ মেয়েটার বাঁচার তীব্র আকুতি হয়ত মৃন্ময়ের চোখেও সেঁটে গিয়েছিল। ওর বিবেক হয়ত ওকে বাধ্য করেছিল এই অসুস্থ মেয়েটার স্বপ্ন রক্ষক হতে। তাকে একটা নতুন জীবন দিতে।।। না আমার সেসবে আক্ষেপ নেই। আমার অভিমানের জায়গাটা ভিন্ন। কেন সেদিন মৃন্ময় বলেনি আমাকে? আমিতো ওকে বাঁধা দিতাম না। বরং ওর বিবেকের ইচ্ছা কে শ্রদ্ধা জানাতাম। আর যাই হোক কোন মৃত্যুপথযাত্রী কারো সাথে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে পারে না। এমনকি এই মেয়েটার জায়গায় অন্য কেউ হলে তার সাথেও না। আমি বরং ওর সহযোগী হতাম।।। এর দুই মাস পরেই বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেন তার বন্ধুর ছেলের সাথে। ছেলেটা আমার সম্পর্কে সবকিছু জেনেই রাজি হয়েছিল। মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতে আসত।
আমার পক্ষে মৃন্ময়ের জায়গায় অন্য কাউকে বসানো সম্ভব না “এই কথাটা বাবাকে বারবার বলেছিলাম। না পেরে উঠে শেষ পর্যন্ত ছেলেটাকে বলি, কিন্তুু তাতেও লাভভ হয়না। সে নাকি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কি আশচর্য. দু দিন দেখেই ভালোবাসা হয়ে গেল!!!! সমূহ সমস্ত পথ বন্ধ, এটা বুঝতে পারি। কাউকে কিছু না জানিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরি। আসার আগে চিরকুটে লিখে দেই “আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না। লাভভ হবেনা। তারপরেই চলে আসি এই মফস্বল শহরে। জায়গাটা জেলা বান্দরবানের কাছাকাছি। মৃন্ময়ের থেকে পালানোর বৃথা চেষ্টা করেছিলাম শুধু। সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পারি পৃথিবীর কোন প্রান্তে গিয়েই ওকে ভোলা আমার সম্ভব না। তবে, নিয়তি কে মেনে নিয়েছিলাম।
এখানে আসার পরে মৃন্ময়কে একটা চিঠি পাঠাই। সঙ্গত কারণেই কোন ঠিকানা রাখি না চিঠিতে। প্রিয়তমেষু, যদিও এটা বলার কোন অধিকার আমার নেই তবুও বলছি জীবনে প্রথমবার আর শেষবার। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিস কি জানো মৃন্ময়? সেটা হল ভালোবাসা। একপাক্ষিক ভাবে নিজের মত করে চাইলে সারাজীবনও একজনকে ভালোবাসা যায়। আমি কখনই তোমার ভালোবাসা ভাগ করতে পারব না। আমার প্রতি তোমার কোনরুপ দুর্বলতা থাকুক সেটাও চাইনা। ঠিকও হবেনা সেটা। জীবন থেকে পালাতে পারলাম না তাই তোমার থেকে পালিয়ে গেলাম।
আমি প্রকৃতির ছন্দ আর ছন্দপতন খুব কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তুু বারবারই আমার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃতি কোথাও শূন্য রাখেনা আবার তার সাথে অসামন্জস্যপূর্ণ. কোন কিছুকে ছুঁড়ে ফেলতেও দ্বিধা করেনা। আমার জায়গা থেকে আমি কখনই শূন্যস্থানে বসতে চাইনা, কাউকে বসাতেও চাইনা। প্রকৃতি হয়ত আমাকে শূন্য রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে।। খুব সযত্নে ছুঁড়েও ফেলেছে। আমার প্রিয় সবকিছুকে মাঝপথে নিষ্ঠুর ভাবে কেড়ে নিয়েছে।। তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। এটাই আমার নিয়তি। করুণাময় আমার নিয়তিতে তোমায় লিখে দেননি। নিয়তি খন্ডানোর অধিকার বা ক্ষমতা কোনটাই আমাদের নেই। তোমার প্রতি শেষ একটা অনুরোধ, তুমিও তোমার নিয়তিকে মেনে নাও। তুমি তাকে ভালোবাসো যে তোমার হয়ে এসেছে। আজ হঠাৎ মৃন্ময়ের সাথে দেখা হওয়ায় পুরনো সবকিছু চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।। কলিং বেল বাজছে …
– এই মিনু দেখতো কে এলো?
মিনু অনেকদিন থেকেই এ বাড়িতে আছে। বিশ্বস্ত ও বলা যায়। পরিবারের একজন সদস্যদের মত। ও টুপুকে দেখাশোনা করে। মিনু দরজা খুলে দিলো
-মৃন্ময়!! বাসার ঠিকানা পেলে কি করে?
– সেটা জানাটা কি খুব বেশি দরকার মানসী?
-না, ঠিক সেটা না। তবে এই অসময়ে তোমাকে প্রত্যাশা করিনি। তাছাড়া তুমি বাসা চিনলে কি করে? প্রশ্ন সেটাই।
সোফায় বসে কথা বলছি। টুপু দৌড়ে এসে কোলের মধ্যে বসে পড়ল।
– এটা বুঝি তোমার মেয়ে? বিয়ে করেছো? মৃন্ময়ের চোখে স্পষ্ট জিজ্ঞেসা, কপালে হালকা চিন্তার ভাঁজ।
– না, বিয়ে করিনি তবে টুপু আমার মেয়ে। মৃন্ময়ের চোখে স্পষ্টতা লক্ষ্য করলাম। ওর জিজ্ঞাসু চাউনি বুঝতে পেরে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলাম।
– বান্দরবান আসার পর বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। জানোই তো একটা অচেনা শহর একটা অসহায় মেয়ের জন্য কতটা প্রতিকূলে থাকতে পারে? জীবন সংগ্রাম কতটা কঠিন তা হয়ত বাড়ি থেকে না বেরুলে উপলব্ধি করতে পারতাম না। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিলাম। ইংরেজী তে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা মেয়েরওও চাকরির বাজারে কদর নেই আজকাল। তখনই টুপুকে দেখলাম। চাঁদের আলোর মত মুখশ্রী । সম্ভবত মা, বাবা নেই। আমাকে দেখেই মা, মা বলে কাছে এলো। বিধাতা হয়ত ওর মায়ের আদলে আমাকে গড়েছেন। এই অচেনা শহরে আমার মত টুপুও একা এটা ভেবে আর কোথায় যেতে দেইনি ওকে নিজের কাছেই রেখে দেই।
-তারপর কি করলে টুপুকে নিয়ে? তোমার তো নিজেরই কোন আশ্রয় ছিল না। জিজ্ঞেস করলো মৃন্ময়।
– মৃন্ময়, এই পৃথিবীতে যেমন খারাপ মানুষের অভাব নেই তেমনি এখনও কিছু ভালো মানুষ আছেন। হয়তবা তার জন্যই পৃথিবীটা এখনও টিকে আছে।
নবির চাচাই এই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। মিতা, কে জানোতো, আমার বান্ধবী ওরই দূর সম্পর্কের আত্মীয় নবির চাচা। ইনাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। একদিকে অচেনা শহরে বেগতিক অবস্থা আমার তার ওপর টুপুকে নিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরছি। নবির চাচা সাহায্য না করলে এসব সম্ভব হত কিনা জানিনা!! এরপর অবশ্য আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের জীবন সংগ্রাম টা ভালো করেই বুঝে নিয়েছিলাম। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই একটা পজিশন চাই, সেটা বুঝে গিয়েছিলাম।
মৃন্ময় এরপর আরো কয়েক দিন বাসায় এসেছিল ওর মেয়েকে সাথে নিয়ে। অবনী আর টুপুর বেশ সখ্যতা হয়েছে এ কয় দিনেই। দুজন একই স্কুলে পড়ছে। অনেকটা দু বোনের মত। কেউ কাউকে ছাড়া কিছু খেতেও চায়না।
টুপু আর অবনীর কথা ভেবে মৃন্ময়কে আর কিছু বলিনি। অবশ্য অবনীর প্রতি ও কেমন একটা দুর্বলতা, না, ঠিক দুর্বলতা না মায়া, জন্মে গেছে। ওর জন্যে ও মাতৃত্ববোধ কাজ করে। ওদের দুজনকে আমার দুটো পৃথিবী মনে হয়। যেন একটাকেও ছেড়ে থাকা অসম্ভব আমার। ব্যাপারটা যদি এমনও থাকতো তাও ঠিক ছিল হঠাৎ একদিন মৃন্ময় প্রস্তাব করলো
-মানসী, আমরা কি নতুন করে সবকিছু ভাবতে পারি না?
মৃন্ময়ের এই কথাটাতে আমার কোন অনূভুতি কাজ করেনি। ওকে ভালোবাসি এটা অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই তবে এটাও সত্যি মৃন্ময়কে গ্রহণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মৃন্ময়ের প্রতি তীব্র অভিমান আমাকে ওর থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে দুজনের মধ্যে সেটা অতিক্রম করার ক্ষমতা আমার নেই। সে চেষ্টা ও বোধকরি করব না কখনও।। ওর প্রতি সমস্ত আবেগ, অনূভুতি এখন জলের মতই স্থির। তীক্ষ্ণ স্রোতস্বিনী ঝরনা এখন শান্ত নদী। সে অদ্যবধি স্থির, ধ্রুব।।
– না, মৃন্ময় সেটা সম্ভব না। শান্ত দৃষ্টি তুলে বলে দিলাম।।
জানিনা মৃন্ময় সে দৃষ্টিতে কি দেখেছিলো!! তবে ঘৃনা বা ভালোবাসা দেখেনি সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। হয়তবা দৃঢ়তা দেখেছিলো, কপটতা দেখেছিল। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টির নতুন আদলে গড়ে ওঠা অস্পৃশী মানসীকে দেখেছিল। তবে যাই দেখুক সে নিয়ে আমার কিন্চিত উৎসাহ নেই। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন মৃন্ময় আসেনি। এদিকে অবনীকে কয়েকদিন না দেখে আমারও মন কেমন করছে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই টুপুকে নিয়ে মৃন্ময়ের বাসায় যাই। দরজায় একটা তালা ঝুলছে দেখে মনটা বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তবে কি অবনীকে আবনীকে আর পাবনা!!!! এই শঙ্কা টা খুব করে পেয়ে বসলো। দারোয়ান কে জিজ্ঞাসা করলাম
– তোমার স্যার কোথায় গেছেন? দারোয়ান একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো “অবনীকে তোমার বাসায় রেখে এসেছি। জানি তুমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করো।। প্রায় পাগলের মত ছুটে বাসায় চলে আসলাম। অবনীকে বুকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগলাম।
– টুপু চোখের পানি মুছিয়ে বললো “মা, কাঁদছো কেনো?
-ও কিছুনা মামণি। চোখে কিছু পড়েছে মনেহয়।।
সময় বহমান নদীর স্রোতের মত বয়ে গেছে। অবনী আর টুপু মিলে আমার দুটো পৃথিবী আর ওদের দুজনকে ঘিরে আমার দ্বিতীয় পৃথিবী। জীবনের বাঁকে বাঁকে সুখ, দুঃকে ঘিরে আমার দ্বিতীয় পৃথিবী ও চলছে আপন গতিতে। টুপু সবে উচ্চতর ডিগ্রী শেষ করে দেশে এসেছে আর অবনী বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে পড়ছে।
এখন মাঝেমাঝে যখন জানালার গ্রীল ধরে আকাশ দেখি, তখন অজান্তেই চোখের কোন ভিজে ওঠে। শূন্যতা ভরা একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে। ওরা দু বোন জরিয়ে ধরে বলে “মা, তুমি আবারও কাঁদছো! চোখের কোণ মুছে হেসে বলি “কই নাতো মামণি, কাঁদছি না, চোখে কিছু পড়েছে মনেহয়। ওরা দুবোন আরো শক্ত করে আমাকে জরিয়ে ধরে বলে, মিথ্যা কেন বলছো মা! তোমাকে বুঝি।। বলেই কেঁদে ফেলে।। আমি এখনও শূন্যতা ভরা দীর্ঘ শ্বাসের কারণ খুঁজি। শূন্যতার প্রতিটা খাঁজ ছুয়ে দেখার চেষ্টা করি।। নাহ!!!! আমার দীর্ঘ শ্বাসের কোন কারণ নেই।। সত্যিই নেই!!!