রোজকার একঘেয়ে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও একটুখানি অবসরের জন্য মনটা আকুপাকু করতে থাকে। এমন এক চাকুরীজীবী আমি যে, কর্মস্থল থেকে বছরে যদি দুদিনও ছুটি পাই সেইই ঢের। তবে হাওয়া বদলের দরকার ছিলো। কাজে মন বসছিলো না। তাই বসও এবার আপত্তি করলেন না। টানা ৪দিনের ছুটি দিলেন। কিপটেরা সব দিক থেকেই কিপটে হয়। বাক্সপেটরা মা’ই গুছিয়ে রেখেছিলেন আগে আগে। যদি ছুটি না পেতাম জোর করেই পাঠিয়ে দিতো বাইরে। মমতাময়ী মা তো, সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য কোনো কিছুর সাথে আপোষ করেন না।
হাওয়া বদল মানেই শহুরে জীবন থেকে কিছুদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকা। মামা এসে গ্রামে নিয়ে গেলেন। বোধ হয় শেষবার গ্রাজুয়েশনের আগে গিয়েছিলাম। আজ প্রায় ৫বছর পর আবার গ্রামে যাচ্ছি। শীতকালীন গ্রাম্য প্রকৃতি অতুলনীয়। বেশ কাটবে সময়টা। যদিও গ্রামের অধিকাংশই উন্নয়নের দিকে ধাবিত তবুও কিছুটা অংশে এখনো নির্মলতার ছোঁয়া অবশিষ্ট আছে। সকাল সকাল ঘন কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা চারপাশ, একহাত দূরের জিনিসও নজরে আসে না। ঘাসগুলো শিশিরে ভেজা থাকে। গাছিরা খেঁজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে আর বাড়িতে বাড়িতে রস জ্বাল আর পিঠে বানানোর তাগিদ। বেশ লাগে কিন্তু।
সোয়েটারের ওপর মোটা শাল গায়ে দিয়েও কাঁপছি। তবুও ভালো লাগছে। কুয়াশার মধ্যেও আবছা বোঝা যাচ্ছে কারা যেন ধানের নাড়া জ্বালিয়ে আগুনে হাত পা শেকছে। হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হলো। কটুক্তি আর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি। একটু সামনে এগিয়ে দেখলাম আগুনের ধারে একটা মহিলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের জরাজীর্ণ বস্ত্রখণ্ড শীত নিবারণ দূরে থাক লজ্জা নিবারণেও অপারগ। মহিলাটা মানসিক ভারসাম্যহীন।
সম্ভবত, শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার তাগিদে একটুখানি আগুনের তাপ পাবার আশায় এসেছিলো। তাতেই ক্ষেপেছে সবাই। হারাধন বুড়ো তো খেঁকিয়েই উঠলো, ” তরে না কইছি চক্ষের সামনে যহন তহন আইতে না! অপয়া মাইয়া কোনহানের! মাইনসের সুখে নজর লাগাইবার চাস! সারাদিন থাহস আধা লেংটা হইয়া। পোলাপান গো নজর খারাপ করস! বেহায়া কোনহানের। যা ভাগ!” ভুট্টাও কম না বুড়ো থেকে। সেও শুরু করলো,” এমনেই সময় খারাপ যাইতাছে তাট উপ্রে সক্কাল সক্কাল অপয়াডা চক্ষের সামনে আইলো। না জানি কি হয়! ” বেচারি কিছুই বুঝতে পারলো না সামান্য আগুন চাওয়া কি এমন দোষের! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মুখ ফুটে কেবল বললো, একটুখানি আগুনই তো চাইসি। এমন করো ক্যান! ঠান্ডা বুঝি আমার লাগে না!” বেচারির করুণ আকুতি কেউ বুঝলো না। দুর ছাই করে তাড়িয়ে দিলো।
মহিলাটাকে দেখছি সেই ছোটবেলা থেকে। শ্বশুরঘরের অকথ্য নির্যাতনের পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বের করে দিয়েছিলো ঘর থেকে সন্তানসহ। ভিক্ষে করে দুই ছেলেকে মানুষ করেছিলো। সেই ছেলেরাই চাকরি পেয়ে পাগলিনী মা কে ফেলে গেছে। একমাত্র কন্যাও তিনমাস বয়সে মায়ের কোলে শেষবার হেসেছিলো। এরপর আর সেই মিষ্টি পরীর হাসি কেউ দেখে নি। শোকে পাথর মা সন্তান হারানোর দায়ে অপয়া হওয়ার শাস্তি পেলো।
ওখান থেকে এসেই ব্যাগে যা কাপড় চোপড় ছিলো তার মধ্য থেকে গরম কিছু কাপড় নিয়ে দিতে গিয়েছিলাম মহিলাটাকে। ভাঙা একটা দালানের একটা অংশে গুঁজে বসে আছে। শীতের প্রকোপ থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাপড়গুলো দেখে মলিনমুখে হালকা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছিলো। হায় জননী! প্রসবের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে যে সন্তানের জন্য দিয়েছো আজ তারা তোমার কষ্ট নিবারণে অক্ষম। ভিক্ষে করে পোশাকের অভাব পূরণ করেছিলে যাদের, তারা আজ তোমার লজ্জা নিবারণ হেতু এক টুকরো বস্ত্র প্রদানে অক্ষম। নিজে না খেয়ে যাদের মুখে অন্নের গ্রাস তুলে দিয়েছিলে, সেই সন্তানরাই ক্ষুদায় কাতর মা যখন কুকুরের মুখ থেকে খাবার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তার মুখে এক মুঠো ভাত তুলে দিতেও অপারগতা প্রকাশ করে। তুমি আসলেই অভাগী জননী!
চলে আসার আগ পর্যন্ত যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি সেই অভাগী মানুষটাকে সামান্য হলেও ভালো রাখতে। আসার আগে মামাকে বলে এসেছিলাম যতটা সম্ভব করতে। এরপর যাওয়া হয়নি আর। কাজের মধ্যে হয়তো ভুলেও গিয়েছিলাম।
পরের বছর ছুটি পেয়েই চলে যায় গ্রামে। কয়েকটা নতুন শাড়ি, গরম কাপড়, কম্বল কিছু শুকনো খাবার নিয়ে ছিলাম ওনার জন্য। এবার ভাবছি বোনাসের টাকা দিয়ে ওনাকে একটা ছোট ঘর বানিয়ে দেবো। কিন্তু হায় বিধি! সেসব দেওয়ার মানুষটাকেই আর পেলাম না।
কিছুদিন আগে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে বেচারি ভুল করে ঢুকে পড়ে। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কি আর অতোসতো বোঝে! এই কথা তো আর তথাকথিত ভদ্রসমাজের লোকজন বুঝবে না। রেহায় পায় নি বেচারি। অপয়া ছিলো কি না! শুভ অনুষ্ঠান যে অপবিত্র হয়ে গেলো। শীতের রাতে পুকুরপাড়ে বাঁধা হলো তাঁকে। শাস্তি দেওয়া হবে এই চরম অন্যায়ের। অকথ্য গালিগালাজ তো ছিলোই সাথে লাঠির আঘাত। “ছাইড়া দাও” এই মিনতি কারো কানে গেলো না। অবশেষে আনা হলো তাঁর সুপুত্রদের। মায়ের এইরূপ আচরণে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো। যে জননী সমস্ত দুঃখ কষ্ট থেকে আগলে রেখেছিলে দুই সন্তানকে, সেই জননীই আজ ভালোবাসার প্রতিদান পেলো।
পরদিন কেবল তাঁর রক্তাক্ত অসার দেহটাই পড়েছিলো বাঁধা অবস্থায়। প্রাণপাখি তো সন্তানের করা প্রথম আঘাতেই খাঁচা ছেড়ে দিয়েছিলো। কেউ বুঝতেও পারেনি। নিজ ভিটেতে সাড়ে তিন হাত জমিও নসিব হয়নি। মামাদের কয়েকজনের উদ্যোগে পাশের এক কবরস্থানে সম্পূর্ণ রীতি মেনেই দাফনকার্য সম্পন্ন হয়। দেখতে গিয়েছিলাম সেই অভাগীর কবর। গন্ডদেশ বেয়ে কেবল নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। মনের মধ্যে চাপাকান্নারা বারবার বলছে,”জননী গো, তুৃমি জিতেও হেরে গেলে।”