জুতোগুলো পড়ার পরে খেয়াল করলাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুল জুতোর ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। একজোড়া নতুন জুতো কেনা দরকার। বাধ্য হয়ে এই ঠান্ডায় চটি জোড়া পায়ে দিলাম। ঠান্ডার কারনে একটা সুবিধা অবশ্য হয়েছে, জ্যাকেটের কারনে রঙচটা শার্টটা দেখা যাচ্ছেনা। নাস্তার টেবিলে সকাল সকাল আমাকে দেখে আম্মা বললেনঃ
–কিরে এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস?
–আপনার বৌমার সাথে ঘুড়তে যাচ্ছি।
–সহজ কথার সহজ উত্তর দেয়া যায়না?
বাবা-মায়েদের মাথায় কি চলে বুঝিনা। একটু পরিপাটি হয়ে বের হলে সন্দেহের চোখে তাকাবে ছেলে কোথায় যায়, কিন্তু যখন সত্যটা বলি তখন বিশ্বাস করতে চায়না। অনেক রাতে বাসা ফিরে যদি বলি, পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলো আড্ডা দিতে দিতে দেরি হয়ে গেছে। তখন মুখের কাছে নাক এনে শুঁকে বলবে, সত্যি করে বল কিছু খাসনি তো? আর কখনো কিছু খেয়ে ফিরে যদি বলা যায়, বন্ধু বিলাতি মাল এনেছিলো খেতে বসেছিলাম দেরি হয়ে গেছে। তখন মুখ শুঁকে দেখা তো দূরের কথা সন্দেহের চোখেও তাকায়না। তাই এসব ক্ষেত্রে সত্যটাই বলি।
নাস্তা শেষ করে বললামঃ
–আম্মা কিছু টাকা দরকার।
–তোর আব্বাকে বল।
–থাক লাগবেনা, আব্বার ফোনটা এনে দেন একটা কল করবো।
বিকাশ থেকে দুহাজার টাকা মেরে দিলাম। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা করে ঘি তুলতে হয়।
শুধু খেয়াল রাখতে হবে যাতে এক সপ্তাহ্ আব্বাহুজুরের চোখের সামনে না পড়ি। চোখের সামনে পড়লেই খবর আছে। রিক্সা থেকে নামতেই তাসফিয়ার মুখ চালু হয়ে গেলোঃ
–আপনার এতোক্ষন সময় লাগে আসতে। কতোক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
–সরি।
–সরি বললে হবেনা, একটা ছেলে তখন থেকে আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, শিস বাঁজাচ্ছে। যান একটা থাপ্পর দিয়ে আসেন।
–কিহ্ কার এতো বড় সাহস? কোন ছেলে একবার দেখিয়ে দিন শুধু কান ধরে উঠবস যদি না করাই।
–ওই যে ওটা।
ছেলের দিকে তাকিয়ে আমার হাওয়া বের হয়ে গেছে। ছেলের যা স্বাস্থ্য তাতে আমাকে এক হাত দিয়ে তুলে দশ হাত দূরে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
–আসলে মারামারি ঠিক না। ছেলেটাকে আমার পরিচিত পরে তাকে বুঝিয়ে বলবো।
–হুম জানি আপনার সাহস কতো, আর সাফাই গাইতে হবেনা। বললেই তো হয় তাকে দেখে ভয় পেয়েছেন।
-মানুষের জন্য ভয় অত্যান্ত জরুরি, ভয় মানুষকে বিপদ থেকে দূরে রাখে। আচ্ছা অতো কথা বাদ এতো সকাল সকাল ডেকেছেন কেন?
–কেন আপনি না কাল বললেন একদিনের জন্য আপনার গার্লফ্রেন্ড হতে, তাই ডেকেছি।
–আমি তো ফান করছিলাম।
–ও তাহলে আর কি আমি বাসা যাই।
–আরে নাহ্…
তাসফিয়া অনেক চেষ্টা করছে নিজের হাসি থামানোর কিন্তু পারছেনা। মুচকি মুচকি হাসছে। তাসফিয়ার বিশেষত্ব হলো এই মেয়ে কাজল ছাড়া কোন কিছু ব্যবহার করেনা। একটু শ্যামলা তাই হয়তো, কিন্তু তার এই সাদামাটা ভাবটাই যেন তার সৌন্দর্যটাকে আরো ফুটিয়ে তুলে। তাসফিয়ার সাথে যতো সময় কাটিয়েছি ততোটাই তাকে জানতে পেরেছি, যতোই জেনেছি ততোই বেশি যেন তার প্রেমে পড়েছি। অন্যদের মতো একবারে প্রেমে পড়া না, একটু একটু করে অনেকখানি প্রেমে পড়া যাকে বলে। কিছুদিন যাবদ ভাবছি তাসফিয়াকে মনের কথাটা বলেই ফেলবো, কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিনা। ও সামনে এলেই সাজানো কথাগুলো এলামেলো হয়ে যায়। মনের কথা আর ঠোঁট পর্যন্ত আনতে পারিনা। কিন্তু আজ বলতেই হবে, যেভাবেই হোক বলতে হবে।
–এই যে মিস্টার কি ভাবছেন?
–না কিছু না।
–তো বলেন এখন কি করতে হবে। প্রেম তো কখনো করিনি জানিনা গার্লফ্রেন্ডদের কি কি করতে হয়।
–না কিছুনা।
–আচ্ছা ভালো তাহলে চলেন আমার একটা কাজ সেরে ফেলি।
–কি কাজ?
–গেলেই বুঝতে পারবেন।
মেয়েদের সাথে পৃথিবীর সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব কিন্তু তাদের সাথে কোন কিছু কেনার জন্য যাওয়া টর্চারের তুলনায় কোন অংশে কম না। কেনাকাটা শেষ করতে তখন বিকেল প্রায়। ক্ষুধার কারনে পেট ভেতরে ঢুকে গেছে, কেন যেন মনে হচ্ছে প্যান্ট ঢিলা হয়ে গেছে যে কোন মুহূর্তে টুপ করে হাটুর নিচে পড়ে যাবে। তখন আরেক মুশকিল তাকে আটকানো বা তোলাও সম্ভব হবেনা কেননা আমার দুহাত ভর্তি ব্যাগ। এতোদিন জানতাম এই মেয়ে কথা বলে শান্তি পায় এখন দেখছি টাকা খরচা করেও শান্তি পায়। দুপুরের খাবার শেষ করলাম বিকেলে। খাওয়া শেষ করে রিক্সায় পাশাপাশি বসেছি। চুপচাপ বসে আছি, মনে সাহস যোগাচ্ছি আজ যেভাবেই হোক মনের কথাটা খুলে বলতেই হবে। কেন যেন মনে হচ্ছে আজ নয় তো কখনো নয়।
–তাসফিয়া
–হুম
–কটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
–হুম বলেন।
-আপনি বিষয়টা কিভাবে নিবেন সেটা বুঝতে পারছিনা। যদি রাগ করেন সেই ভয় পাচ্ছি। রাগ করবেন না সেই অভয় দিলে বলতে পারি।
–আচ্ছা আপনি অভয়ে বলতে পারেন, রাগ করবোনা।
–আমি… মানে…
–এমন সংকোচ করছেন কেন?
আপনি যেমন করছেন মনে হচ্ছে এখনি প্রপোজ করবেন। হা হা হা হা কিছু বলার আগেই রিক্সা থেমে গেলো। রিক্সা থেকে নেমে কুরিয়ার সার্ভিসে গেলাম। তাসফিয়া নিজের নাম পাল্টে কাকে যেন গিফ্ট পাঠাচ্ছে।
–কি ব্যাপার কার নাম দিলেন?
–পরে বলছি।
–আচ্ছা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। দুজনে চায়ের দোকানে বসলাম। আজ বেশ ঠান্ডা পরেছে। সারাদিন সূর্যের দেখা পাইনি। ঠান্ডা বাতাস শরিরে শিহরন তুলছে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে তাসফিয়া চুমুক দিচ্ছে, ঠান্ডা হাওয়ার কারনে ওর ঠোঁট মৃদু কাঁপছে।
–আজ বেশ ঠান্ডা।
–হুম… আচ্ছা এখন বলেন কাকে গিফ্ট পাঠালেন?
–সেটা পরে আগে আপনি বলেন তখন কি বলতে চাচ্ছিলেন।
–আগে আপনি।
–রাগাবেন না, আপনাকে বলতে বলেছি আপনি আগে বলবেন। নাহলে গরম চা মাথায় ঢেলে দিবো।
–“আপনাকে আমার ভালো লাগে।”
কথাটা বলার পরে নিজেই অবাক হয়ে গেছি। তাসফিয়া চোখের পলক না ফেলে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকালো তারপর স্বাভাবিক ভাবেই বললোঃ
–আমিও আপনাকে পছন্দ করি।
–এ পছন্দ অন্যরকম।
–সেটা সম্ভব না।
–কেন?
–আপনি জানতে চাচ্ছিলেন না আমি নাম পাল্টে কাকে গিফ্ট পাঠিয়েছি।
তার নাম কাব্য, একসাথেই পড়তাম। কিন্তু ভালোবাসার কথা কখনো বলতেই পারিনি। হয়তো কখনো বলতেও পারবোনা। কেননা তাতে করে হয়তো তার বন্ধুত্বটুকুও হারিয়ে ফেলবো। কিছুক্ষন চুপ থাকার পরে বললাম,
–তাসফিয়া আমাদের আর যোগাযোগ না থাকাই ভালো।
–কেন?
–সেটাই ভালো হবে।
–বন্ধু হয়ে থাকা যায়না?
-ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে মাঝে মাঝে তার হাতটা ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করে, শীতে মৃদু কম্পিত ঠোঁট আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। দূরে থাকলে হয়তো এই ইচ্ছেগুলো থাকবেনা। অপ্রাপ্তি থাকবেনা, ভালোবাসা থাকবে কিন্তু তা প্রকাশের মাধ্যমটা পাল্টে যাবে।
–ভালোবাসা মানেই কি শরির ছোঁয়া?
–স্পর্শ করার অর্থ মানেই যৌন আকাঙ্খা নয়। মাঝে মাঝে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখতে হয়। ভালোবাসার স্পর্শ মানেই যৌনতা নয়।
–তাহলে কি করতে চাচ্ছেন?
-আজকের পর আপনি আপনার মতো, আমি আমার মতো।
–আপনি এতো স্বার্থপর কেন?
–যদি বলি বন্ধুত্ব দিয়ে আটকানোর মানে স্বার্থপরতা তবে কি ভুল বলা হবে? আসলে আমরা সবাই স্বার্থপর। কাউকে ভালোবাসি নিজের জন্যই। ভালোবেসে পেতে চাই নিজের জন্য। নিজের ভালো থাকার জন্য।
–এটাই কি তবে শেষ দেখা?
–হুম…
–এই শার্টটা আপনার জন্য কিনেছিলাম। নিলে খুশি হবো। শেষ কথাটা নিশ্চই রাখবেন।
তাসফিয়া বসে আছে, আমি হাঁটছি। পেছন ফিরে শেষবারের মতো ওর মুখটা দেখতে বড় ইচ্ছে করছে। কিন্তু সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই। শার্টটা আমার হাতে। হুম তাসফিয়ার শেষ চিহ্ন। তবে এটার কোন প্রয়োজন নেই কেননা যাকে সবসময় অনুভব করা যায় তার শেষ চিহ্নের কোন প্রয়োজন পড়েনা। তবে এই শার্টটা কি করা যায়?
কাব্যকে কি পাঠিয়ে দেয়া যায় তাসফিয়ার নামে, সাথে একটা চিঠি। নিশ্চই তা তাসফিয়ার লিখা নয় আমার লিখা কিন্তু অনুভূতি তো তার। নিজেকে এখন হালকা হালকা লাগছে। চিঠিটা পাঠিয়ে দিয়েছি, সাথে উপহারটাও। ফোনটা বাঁজছে…
–হ্যালো আব্বাহুজুর।
–তুই বিকাশ থেকে টাকা সরিয়েছিস?
–জ্বী…
–তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন?
–একটু ঠান্ডা লেগেছে।
–টাকাটা দরকার ছিলো। তোর যদি খুব বেশি দরকার না হয় তাহলে কিছুদিন পরে নে। বাবার সংকোচ পূর্ণ কন্ঠশুনে মনে হলো, মাত্র কয়টা টাকা কিন্তু কতোটা জরুরি। নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে।
–আব্বাহুজুর সমস্যা নাই, রাত্রে পুরো টাকাটাই পেয়ে যাবেন।
–হুম ভালো। কন্ঠটা শুনে মনে হলো মুহূর্তেই মানুষটার কতোটা দুশ্চিন্তা দূর হলো।
–আব্বাহুজুর…
–কি?
–একখান গান শুনান তাইতে টাকা ফেরত দিমু নাইলে দিমুনা। ওই গানটা, ও গোরি তেরি গাওঁ মে। ওই যে একদিন বাথরুমে গাইছিলেন মুই লুকায় লুকায় শুনতেছিলাম। তারপর যখন কইলাম আব্বাহুজুর খালি গান ক্যারে একখান ড্যান্স ও দেন দেখি।
–চুপ হারামজাদা, থাবড়া খাবি, বেদ্দপ, টুট টুট টুট
আমাদের মনে কষ্ট নিয়ে চললে হয়না। সবসময় হাসি মুখে থাকতে হয়। মনকে বুঝাতে হয় বেটা তুমি ভালো আছো, হুদাই প্যারা নাও ক্যারে। ওহ্ হ্যাঁ বাসা ফেরার পথে সকালের সেই স্বাস্থ্যবান ছেলের সাথে দেখা হয়েছিলো, থাপ্পর একটা অবশ্য দিয়েছি কিন্তু তারপরে বেশ কিছুক্ষন আমার দুটো কান পিনপিন করছিলো। একটু আগে কানগুলোতে অল্প অল্প শুনতে পাচ্ছি। মানুষ এতো খারাপ ক্যারে একটার বদলে এতোগুলা মারে। গান্ধির মতো হতে পারলিনা, কেউ একগালে থাপ্পর দিলে অন্যগাল এগিয়ে দিতি।।