মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি।ফাইজা ইসলাম।এস এস সি পাস করার পরই বাবা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন।বাবার উপর কথা বলার সাহস এখনো হয়নি।বড়বোন চেয়েছিলো তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে।কিন্তু বাবার এক কথা”যদি নিজ ইচ্ছায় যেতে চাও তবে চলে যেতে পারো”..এই একটি বাক্য আমার মাথায় সেট হয়ে গিয়েছে।তাই কখনো নিজের মনে প্রেম ভালোবাসার বীজ বপন করি নি।আমার অজান্তেই ছেলেপক্ষ দেখতে আসে।ছেলের নাম আসাদ।
বেশ শিক্ষিত,,ভালো একটা চাকরিও করে।বাবার ছেলে পছন্দ হয়েছে।বিয়ের পাকাপোক্ত কথাও সেরে ফেলেছেন।দিনক্ষণ ও ঠিক করে ফেলেছেন।কি অদ্ভুত তাই না??না ছেলেকে আমি দেখলাম,না সে আমাকে দেখলো…সেও হয়তো আমার মতো রক্তের সম্পর্কের বেড়াজালে বন্ধী।এসব ভাবতে ভাবতেই জল গড়িয়ে পড়েছে গাল বেয়ে। আজ আমার বিয়ে। বউ সেজে বসে আছি।চারদিক কেমন ঝাকঝমকে ভর্তি।সবাই কতো খুশি।তাদের খুশিতেই আমার খুশি।হঠাৎ সবাই চিৎকার করে গেইটের দিকে ছুটে চলল।বর এসেছে।আমার বর।কি হাস্যকর।তাই না??নিয়ম মাফিক আমাদের বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়।নিয়ে আসা হলো শশুড়বাড়ি।সবাই খুব আদরে বরণ করলো আমায়।
আজ আমার বাসর রাত।বসে আছি খাটের উপর।আমার স্বামী ভেতরে এসে আমার পাশে বসলেন।চোখ তুলে তাকাতেই দেখি অপূর্ব সুন্দর এক চেহারা।কিন্তু আমাকে দেখে তার চোখে বিন্দুমাত্র ও বিস্ময় নেই।আমি অবাক হলাম।আমার চেহারায় হয়তো সেটা প্রকাশ পেয়েছে।তাই তিনি নিজ থেকে বলতে শুরু করলেন আজ তোমাকে আমার প্রথম দেখা না।স্কুলে যাওয়ার পথে তোমাকে আমি রোজ দেখেছি।বলতে পারো এই মায়াবী চোখ দু’টোর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম এসব তখন তোমাকে বলতে যাবো,তুমি না করে দেবে।তাই বাবাকে বলে সোজা আমার ঘরণী করে নিয়ে এসেছি।আমি মুচকি হাসলাম। শুরু হয়ে গেলো আমাদের দাম্পত্ত জীবন।নিজেকে।মাঝে মাঝে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়।কোনো ভালো কাজের ফল হিসেবে হয়তো এমন স্বামী পেয়েছি আমি।পরম সুখে কাটতে থাকে আমাদের জীবন। একটা বছর কেটে গেলো আমাদের বৈবাহিক জীবনের।কিন্তু আমাদের কোনো সন্তান নেই।লোকে নানা কথা বলতে শুরু করেছে।আমি আর এসব নিতে পারছি না।মানসিকভাবে অনেকখানি ভেংগে পড়েছি…
—চলো আমারা কোনো ভালো ডাক্তারের কাছে যাই (আসাদ)
—কেনো?তুমি কি মনে করছো আমি অসুস্থ?? (আমি)
—তা কেনো হতে যাবে?? তবে ডাক্তারের কাছে যেতে দোষ কি বলো?? (আসাদ)
—ঠিক আছে তুমি যখন বলছো যাবো কাল (আমি)
পরের দিন ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা।বেশ সময় ধরে অপেক্ষা করার পর।আমাদের সিরিয়াল আসে।ভেতরে গিয়েই দু’জন দু’টি চেয়ারে বসে পড়ি..ডাক্তারকে আমাদের সব সমস্যার কথা খুলে বলি।তিনি আমাদের দু’জনকেই কিছু টেস্ট করতে বলেন।হসপিটাল থেকে সেই টেস্টগুলো করে আমি বাসায় ফিরে এলাম আর আসাদ রিপোর্টগুলো দেখিয়ে একেবারে বাসায় ফিরবে।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত।আসাদ বাসায় ফিরেছে।চোখেমুখে ক্লন্তির ছাপ।কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম…
—ডাক্তার কি বলেছে?? (আমি)
—আমার জামা কাপড় দাও ফ্রেশ হবো (আসাদ)
—আগে ডাক্তার কি বলেছে সেটা তো বলো (আমি)
—ভাত বেরে রাখো..অনেক ক্ষিদে পেয়েছে (আসাদ)
—এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে আগে বলবে তো ডাক্তার কি বলেছে (আমি)
—তুমি কখনো মা হতে পারবে না….
খুব জোরালো আওয়াজে এই কথা বলে ডুকরে কেঁদে উঠে আসাদ আমার পুরো পৃথিবী দুমরে মুচরে যাচ্ছিলো কিছু সময়ের জন্য পিন পতন নীরবতা পালন করে আসাদকে জামা কাপড় দিয়ে বললাম ফ্রেস হয়ে এসো।ভাত বেরে দিচ্ছি…তোমার অনেক ক্ষিদে পেয়েছে এরপর কেটে গেলো অনেকটা দিন।আমি এখন প্রায় জীর্ণশীর্ণ। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে।চুল উসকো খুসকো হয়ে পড়েছে চেহারায় নেই কোনো মায়া…
—চলো তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো (আসাদ)
—কই নিয়ে যাবে??? (আমি)
—গেলেই বুঝতে পারবে (আসাদ)
—তার কথামতো রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
একসাথে রিকশায় যাচ্ছি..অনেকদিন পর প্রিয় মানুষটার সাথে বের হওয়া..মন্দ লাগছে না রিকশা এসে থামলো একটা অরপানেজ এর সামনে।একটু অভাক হলাম।আসাদ আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।গিয়ে অফিসকক্ষে বসলাম।আসাদ আমাকে রেখে কই জানি চলে গেলো..কিছুই বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে..কিছুক্ষণ পর আসাদ ফিরে আসে একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে নিয়ে।
এনে আমার কোলে দিলো।আমি পরম যত্নে তাকে কোলে নিলাম।আসাদ আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো “ফাইজা..তোমাকে কখনো তেমন কিছু দিতে পারি নি আমি।না পেরেছি তোমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে।তবে আজকে হয়তো তোমার জীবনের সেরা উপহারটা আমি তোমাকে দিতে পেরেছি। বাচ্চাটাকে কেউ একজন রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে রেখে চলে গেছে..কেউ একজন বাচ্চাটাকে এনে অরপানেজে রেখে গেছে। অরপানেজের লোকজন ফোন দিলো।কারণ আমি তাদের আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম।এখন সবার সাথে পাকাপোক্ত কথা বলে এসেছি এবং সই করে এসেছি..আজ থেকে এটা আমাদের সন্তান অনবরত আমার চোখের জল ঝরছে।মানুষটা আমাকে কতোই না ভালোবাসে।
আল্লাহ্র কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আসাদকে আমার জীবনসঙ্গী করে পাঠানোর জন্য। ঘটা করে আমার বাবুটার নাম রাখা হলো আসাদ আর ফাইজার সাথে মিলিয়ে রাখা হলো “আফাজ” আমার চোখের মনি,,আমার কলিজার টুকরা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আফাজ যতো বড়োই হোকনা কেনো,ওকে কখনো তার অজানা রহস্যটা জানতে দেবো না ওকে একটা সেকেন্ডের জন্য চোখের আড়াল করতে পারি না..কি যেনো অজানা কষ্টে বুক ভারী হয়ে আসে..আল্লাহ্ আমাকে সন্তান দেন নি ঠিকই,,তবে জন্ম না দিয়েও একটা ছেলের মা হয়ে উঠার ক্ষমতাটা দিয়েছেন কেটে গেলো ২৫ টি বছর আমি,আসাদ দু’জনেরই অনেক বয়স হয়ে গেছে।আমার আফাজ ও অনেক বড় হয়ে গেছে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করতে চলেছে। একদিন আফাজের ফোন এলো
—মা আমাদের কলেজে আগামীকাল একটা অনুষ্ঠান আছে। তোমাকে আর বাবাকে কিন্তু অবশ্যই আসতে হবে (আফাজ)
—এই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাই কি করে বল??(আমি)
—অতো শতো বুঝি না,,,তোমারা আসবেই ব্যাস (আফাজ)
—আচ্ছা ঠিক আছে তুই বলেছিস মানে তো জেতেই হবে (আমি)
—ঠিক আছে মা কাল কিন্তু দেখা হচ্ছে (আফাজ)
পরের দিন সকালবেলা আমি আর আসাদ রওনা হলাম কলেজের উদ্দেশ্যে।পৌঁছাতে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লেগে গেলো।খুব ক্লান্ত লাগছে।কিন্তু আমার ছেলেটাকে দেখছি না কোথাও।ফোন ও রিসিভ করছে না হঠাৎ এক ছেলে এসে বললো আন্টি,,আপনি আফাজের মা না??
—হ্যাঁ বাবা..কিন্তু তুমি কে?? (আমি)
—আমি আফাজের বন্ধু।আফাজ একটা কাজে গেছে।আমাকে বলছে আপনারা আসলে দেখাশোনা করতে আপনারা বসে পড়ুন।একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবে।
—আচ্ছা আফাজ আসলে বলে দিও আমরা এখানটায় আছি….
আচ্ছা বলে চলে গেলো ছেলেটি অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।আমি আর আসাদ বসে আছি।একের পর এক ছেলেরা নিজদের স্পিচ দিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ আফাজের নাম এনায়ুন্স হলো।তাকে তার ফ্যামিলি,ক্যারিয়ার, ফিউচার নিয়ে কিছু বলতে বলা হলো কিন্তু আমার ছেলেটি কোথায়??আমার চোখ মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে হঠাৎ কানে ভেসে আসলো একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর।
আমাকে আমার ক্যারিয়ার, ফিউচার এসব নিয়ে বলতে বলা হয়েছে।কিন্তু আমি আজ ভিন্ন কিছু বলতে চাই।এক মমতাময়ী মায়ের গল্প বলতে চায়।এমন এক মা যে মা তার সন্তানকে জন্ম দেন নি,কিন্ত নিজেকে সেরা মা হিসেবে প্রমাণ করেছেন।হুম..আমার “মা”..আমি এক ডাস্টবিনের ময়লা মাত্র।সেই ময়লাকে আমার মা মাথায় তুলে রেখেছেন।আমার ব্যথায় যেনো নিজেই ব্যাথা পেয়েছেন।আমার একটু জ্বর হলেই সারারাত জেগে জলপট্টি দিয়েছেন।আমাকে পড়াতে গিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছেন পড়ার টেবিলে..মাছ মাংস তার কখনো ই পছন্দ ছিলো না..এই বাহানায় আমাকে খাইয়েছেন সব..আরো কিছু বলতে গেলে বলে শেষ করতে পারবো না..শেষে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই আমার জন্মদাতা কে।উনি আমাকে ডাস্টবিনে ছেড়ে না গেলে আমি আমার মায়ের সন্ধান কখনো পেতাম না “ভালোবাসি মা” আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না।
কঠিন সত্যটা আমি কখনো তাকে জানতে দেই নি। কিন্তু আমার ছেলে যে এতোটা বড় হয়ে গেছে সেটা আমি বুঝতে পারি নি।দৌঁড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরলাম আমার কলিজার টুকরাকে।সেও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে..আসাদ দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছে..আমি আসাদের কাছে গেলাম জানো তো তুমি আমাকে হীরা মুক্তায় ভরিয়ে রাখতে পারো নি ঠিকই..কিন্তু তার চাইতেও বহুগুন মূল্যবান কিছু তুমি আমাকে দিয়েছো আমার কলিজার টুকরা “আমার আফাজ”