একদিন

একদিন

কলিংবেল বাজাতেই শ্রাবণী দরজা খুললো। আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে বললো,

-জানো পিয়াস, আজকে না পাশের বাসার ভাবী তেলাপোকা দেখে এত জোরে চিৎকার করেছিলো আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

— তোমার কি কোন কমনসেন্স নাই? আমি এখনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আর তুমি এইসব ফালতু কথা শুরু করে দিলে শ্রাবণী মুখটা গম্ভীর করে বললো,

– সরি, তুমি ভিতরে আসো আজকাল আমার স্ত্রী শ্রাবণীকে আমার খুব অসহ্য লাগে। একটা মেয়ে এতটা বাচাল কিভাবে হতে পারে সেটা শ্রাবণীকে বিয়ে না করলে বুঝতেই পারতাম না। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় একটু শুয়েছি অমনি শ্রাবণী পাশে বসে বলতে লাগলো,

– জানো পিয়াস, আজকে উপরে ফ্ল্যাটের ভাই গেইট দিয়ে ঢুকার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলো। ভাই পড়ে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিলো কেউ দেখেছে কি না কিন্তু আমি যে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি সেটা উনি বুঝতেই পারে নি এই কথা বলে শ্রাবণী হি হি হি করে জোরে জোরে হাসতে লাগলো। ওর হাসি দেখে মনে হচ্ছে পা পিছলে পড়ে যাওয়া হলো পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর জিনিস৷ ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে ওর কান বরাবর একটা থাপ্পড় মারি কিন্তু মেয়েদের গায়ে হাত তুলা ঠিক না তাই দাঁতের সাথে দাঁত চেপে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে শ্রাবণীকে বললাম,

— তোমার কি কোন কাজ নেই সারাদিন এইসব দেখা ছাড়া? কে পা পিছলে পড়ে গেলো, কে তেলাপোকা দেখে ভয় পেলো এইসব তোমায় কে দেখতে বলেছে? অবশ্য তোমার তো কোন কাজও নেই বাড়িতে বসে থাকা ছাড়া। কিন্তু আমার অনেক কাজ করতে হয়। আমি সারাদিন অফিসে কাজ করে খুব ক্লান্ত হয়ে বাসায় আসি তোমার এই ফালতু বকবক শুনার জন্য না। দয়া করে মুখটা বন্ধ রেখে আমায় একটু একা থাকতে দাও শ্রাবণী কিছু না বলে মুখটা গম্ভীর করে অন্যরুমে চলে গেলো। আর আমি বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলতে লাগলাম, কি ফালতু মেয়েরে বাবা এত অপমান করি তবুও ঠিক হয় না। সারাদিন কোন কাজ তো করেই না আর আমি কাজ করে বাসায় ফিরলে বকবক করে আমার কান নষ্ট করে ফেলে রাতে যখন খেতে বসি তখন শ্রাবণী আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

– পিয়াস, একটা কথা বললে রাগ করবে? আমি বললাম,
— কি কথা? শ্রাবণী নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
–অনেকদিন হলো বাসার টিভিটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। একটু ঠিক করে এনে দিবে কথাটা শুনে আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি ধমক দিয়ে বললাম,
— এইসব ফালতু কাজ করার মত সময় আমার নেই। আর টিভি ঠিক করে দিলে কি হবে? কোন কাজ যেহেতু নেই তাই সারাদিন বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখবে আর স্বামীকে সন্দেহ করবে।

শ্রাবণী কিছু বললো না। মুখটা গম্ভীর করে রান্না ঘরে চলে গেলো। আর আমি মুরগীর গোশত দিয়ে ভাত খেতে খেতে ভাবতে লাগলাম, মেয়েটা আর কাজ করুক আর না করুক রান্নাটা ভালো পারে টিভিটা অবশ্য আমিই নষ্ট করেছিলাম। আমি যখন টিভিতে খেলা দেখছিলাম তখন শ্রাবণী কানের কাছে বকবক করছিলো আর সমানে বলছিলো এই প্লেয়ারের নাম কি ওর নাম কি। আমি কিছু বলছিলাম না দেখে ও বললো কি সব ফালতু খেলা এইগুলো। এই কথা শুনে রাগে আমি টিভে ফেলে দিয়েছিলাম অফিস থেকে ৫ দিন ছুটি পেয়েছি শুনে শ্রাবণী হাসতে হাসতে বললো,

-চলো না বাবার বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি। অনেকদিন ধরে যাওয়া হয় না। আমি শ্রাবণীকে বললাম,
— তুমি কয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসো।

আমি এই কয়দিন একটু শান্তিতে একা থাকতে চাই বুঝতে পারছিলাম আমার কথাশুনে শ্রাবণী কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কিছু করার নেই কারণ এই কয়দিন আমি একা নিজের মত থাকতে চাই। শ্রাবণীর এই অসহ্য বকবকানি আমার শুনতে আর ইচ্ছে হচ্ছে না বিকালে শ্রাবণী চলে যায়। রাতে বন্ধুদের ডেকে এনে খুব আড্ডা দিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার ফলে সারাবাসা অপরিষ্কার হয়ে আছে। মনে মনে ভাবলাম আগে এককাপ চা করে খাই পরে সব পরিষ্কার করি।

রান্নাঘরে কোথায় চা পাতি আছে, কোথায় চিনি, কোথায় আদা আছে আমি এইসব কিছুই জানি না। এককাপ চা বানাতে গিয়ে শ্রাবণীকে আমার ৪ বার ফোন দিতে হয়েছে। কোথায় কি আছে শ্রাবণী আমাকে বলে দিয়েছে। সব কিছু খুঁজে পাওয়ার পরেও সামান্য এককাপ চা বানাতে গিয়ে আমার ২০ মিনিট সময় লাগলো অথচ শ্রাবণী চা দিতে ৫ মিনিট দেরি করলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। রাগে চায়ের কাপ ভেঙে ফেলতাম ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। মেঝে যখন পরিষ্কার করি তখন দেখি কোমড় নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না। ভেজা মেঝের উপর চলাচলের ফলে মেঝে শুকানোর পর খেয়াল করে দেখলাম পুরো মেঝেতে পায়ের ছাপ লেগে আছে।

বাধ্য হয়ে আবারও মেঝে পরিষ্কার করলাম রান্না করার সময় অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো আমার। এই মরিচের গুড়া আনো, হলুদের গুড়া, ফ্রিজ থেকে এটা আনো ওটা আনো। এইভাবে রান্নাঘর আর ডাইনিং রুম চক্কর দিতে দিতে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। কষ্টকরে রান্না শেষ করে যখন কাপড় ধুতে গেলাম।তখন সাদা কপড়ের সাথে রঙিন কাপড় ভিজেয়ে ফেলেছি। ফলে সাদা শার্টে রঙ লেগে পুরো শার্ট নষ্ট হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও দাগ উঠলো না দুপুরে খাওয়ার পর শরীরটা আর কাজ করছিলো না। তারপরও কষ্ট করে থালা বাসন গুলো পরিষ্কার করলাম। তারপর বিছানায় এসে দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে উঠার পর কিছু ভালো লাগছিলো না। ভাবলাম একটু টিভিতে খেলা দেখি কিন্তু টিভিটা যে নষ্ট আমার খেয়াল ছিলো না।

সন্ধ্যার পর মেনের ভিতর কেমন জানি হাহাকার সৃষ্টি হলো। নিজেকে খুব অসহায় আর একা মনে হতে লাগলো। একবেলা রান্না আর একদিন ঘর গুছিয়ে আমার যতটা কষ্ট হয়েছে টানা ৭ দিন যদি অফিসের কাজ করতাম তারপরও আমার এতটা কষ্ট হতো না। অথচ আমি সব সময় শ্রাবণীকে বলতাম তোমার তো কোন কাজ নেই।
একা একা সময় কাটানো যে কতটা কষ্টের সেটা আমি একদিন থেকেই বুঝতে পেরেছি। ঘরের টিভিটা পর্যন্ত ঠিক ছিলো না যে শ্রাবণী কাজ শেষে একটু টিভি দেখে সময় পার করবে।

আমি সারাদিন অফিস করতাম। কগিলদের সাথে কত কথা বলতাম। অথচ শ্রাবণীর একটা কথা বলার মানুষ ছিলো না। সারাদিন হয়তো কথাগুলো জমাতো আমাকে বলার জন্য অথচ আমি ওর কোন কথা শুনতাম না। এই রকম অবস্থায় আমি একদিন থেকেই হাঁপিয়ে উঠেছি অথচ শ্রাবণী দিনের পর দিন এই রকম ভাবে পার করেছে রাত ১২ টা বেজে ৪৭ মিনিট। আমি শ্রাবণীদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। শ্রাবণীকে ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলতেই তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলো। আমাকে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

– কি হয়েছে পিয়াস, তুমি ঠিক আছো তো? এত রাতে এলে যে? আমি শ্রাবণীকে বললাম,
— তোমায় একটা মজার জিনিস বলতে এসেছি.. শ্রাবণী অবাক হয়ে বললো,
– কি? আমি হাসতে হাসতে বললাম,
— উপরের ফ্ল্যাটের ভাই আজকেও গেইট দিয়ে ঢুকার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলো। শ্রাবণী আমার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বললো,

– এই ফালতু জিনিস শুনানোর জন্য আমায় এত রাতে নিচে নামালে। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে জুতা গুলো পর্যন্ত পড়ে আসি নি এমন সময় শ্বশুর শ্বাশুড়িও নিচে নামলো। শ্বশুর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
~বাবা, কি হয়েছে? এত রাতে এলে যে? আমি বললাম,
— বাবা, শ্রাবণীকে নিতে এসেছি। শ্বশুর অবাক হয়ে বললো,
– তাই বলে এত রাতে? শ্বাশুড়ি তখন শ্বশুরের কানে কানে কি যেন বললো। শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা শুনে মুচকি হেসে বললো,

~আচ্ছা বাবা নিয়ে যাও। তবে চাইলে আমাদের বাসাতেও থাকতে পারো। আমরা বুড়ো মানুষ ঘরের এককোণে নাক ডেকে ঘুমাবো। তোমাদের কোন সমস্যা হবে না আমি বললাম,
— না বাবা, আমি কাল আসবো। আজ শ্রাবণীকে নিয়ে গেলাম…

এখন মাঝরাত । আকাঁশে পূর্ণ জোছনা। মেয়েটি পিচঢালা পথে খালি পায়ে হাটতে পারছিলো না দেখে ছেলেটি মেয়েটিকে কোলে নিলো। বাবা মা কি না কি মনে করেছে এই কথাটি ভেবে মেয়েটি এখনো রাগে লাল হয়ে আছে। আর ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আজ থেকে তোমার ঐ ফালতু কথাগুলোই আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনবো, তোমার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে আমিও জোরে জোরে হাসবো। আর হে আজ থেকে তুমি যখন সিরিয়াল দেখবে তখন কানের কাছে বকবক করবো আর বললো, এইসব ফালতু জিনিস কিভাবে দেখো..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত