রং পেনসিল

রং পেনসিল

এ্যাই যে, হুনছেন? একটু কথা আছিলো আপনার লগে। কি হইছে? কি কথা? কইয়া ফালাও, জয়নালের মা। জয়নাল দুপুর থেইকা না খাইয়া আছে।স্কুল থেইকা আওয়ার পর থেইকা কারো লগে কথা কইতা ছে না। জিগাই লাম, কি হইছে?কথা কয় না। চুপ কইরা আছে। কই ওয়? ডাক দাও। জয়নাল। জয়নাল। ওই বাপ জয়নাল। তোর আব্বায় ডাকে তোমারে।

কালাম মিয়া কুপির বাতিতে শার্টের বোতাম সেলাই করছিলো। যেকোনো মুহূর্তে বাতাসে কুপির বাতি নিভে যেতে পারে। তাই দ্রুতো সেলাই করছিলো। এদিকে আবার ডান পা ব্যাথায় চিন চিন করছে। এ্যাই, মরার ব্যাথা যে কবে যাইবো? আব্বা কি আমায় ডাক ছিলা? হ। কি হইছে তোমার?দুপুর থেইকা বলে কিছু খাও নাই।

এমনেই আব্বা। খাইতে মন চাইতা ছিলো না। তাই খাই নাই। লেখাপড়া কেমন চলতাছে? ভালো। কি হইছে, আব্বা? আমারে কও। মা বকা দিছে? না আব্বা। স্কুলে সবাই রং পেনসিল দিয়ে ছবি আঁকে। আজকা জসিমের রং পেনসিল একটু নিছি লাম। জসিম খারাপ কথা কইছে। এল লেগা মনটা খারাপ। জসিম, কি কইছে? বাদ দাও। শুনলে কষ্ট পাইবা। আর কি কস্ট পামু? আমার পোলায় কস্টে আছে, আমি কি আনন্দে থাকুম? কও। কি কইছে? কয়। তুই ছবি আইক্কা কি করবি? তুই রিকশা চালা গা। তোর বাপে রিকশা চালায়। তুইও গিয়া চালা। সবাই ওর কথা শুইনা সারাদিন আমারে রিকশাওয়ালার পোলা কইয়া ক্ষেপাইছে। তাই মন খারাপ।

আহারে। আমার পোলার এ্যাই কথা হুইনা না খাইয়া আছে? আমি রিকশাওয়ালা এর লেইগা তোমার মন খারাপ? নাকি তোমার রং পেনসিল নাইকা এর লেইগা মন খারাপ? আব্বা। তুমি কস্ট কইরা রিকশা চালাও। ওর বাপের মতো তো ধান্ধামী করো না। বাটপারের পোলা। থাক। তুমি কিছু কইয়ো না। আমি কালকা তোমার লেইগা রং পেনসিল কিন্না নিয়া আমু নে। তুমি তোমার মা রে একটু গরম পানি দিতে কও। আর যাইয়া ভাত খাও। আমারে পায়ে অনেক ব্যাথনা উঠছে। আব্বা। তুমি ডাক্তার কাকুর কাছে কেন যাও না। এই যে দুই দিন পর পর ব্যাথায় পা ফুলে যায়। এটা তো ভালা না। তোমার পায়ে কি হইছিলো, আব্বা? তোমারে পরে কমু নে। এখন যাইয়া তোমার মা রে একটু কও। আচ্ছা।

রাতের বেলা পায়ের ব্যাথায় কালাম মিয়ার প্রচন্ড জ্বর এসে পরলো। জ্বরে কালাম মিয়া আবোল তাবোল বলা শুরু করলো। সুফিয়া বেগম সারা রাত স্বামীর মাথায় পানি পট্টি দিলো।শেষ রাতের দিকে একটু জ্বর কমলো। কালাম মিয়া ঘুমালো। কই যান, আপনি? জ্বর নিয়া বাইর হইতাছেন কেন? আজকা রিকশা না চালাইলে হয় না?

সারাদিন চালামু না। দুই তিনটা ক্ষেপ মাইরা আইয়া পরুম। জয়নালের রং পেনসিল কিনতে হইবো। পোলা টা অনেক শখ কইরা আছে। তারাতারি আইয়া পইরেন। আচ্ছা। জয়নাল। দেখ তোর আব্বা কি আনছে তোর লেইগা জয়নাল রং পেনসিল দেখে অবাক। আনন্দে পাগলপ্রায়। কালকা জসিমের দেখাইয়া দেখাইয়া ছবি আকুম। ওয়, অনেক খারাপ কথা কইছে, আব্বার নামে। ওয়াক, ওয়াক, ওয়াক জয়নাল, জয়নালের মা দৌড়ে আব্বার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। গিয়ে দেখে,আব্বা বমি বমি করতে করতে ঘর ভাসাইয়া ফেলছে।

জয়নাল দৌড় দিয়া ডাক্তার কাকাকে ঢেকে নিয়ে আয়। তোর বাপের অবস্থা ভালা না। দৌড় দে, বাপ। জয়নাল হাতে রং পেনসিল নিয়ে দৌড়। ডাক্তার কাকাকে নিয়ে এসে দেখে,ঘর ভর্তি সবাই। বাবা নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। আর মা চিৎকার করে কান্না করছে।জয়নাল হাত দিয়ে আরো শক্ত করে রংপেনসিল ধরে রাখছে মা। আব্বা পায়ে কেমনে ব্যাথা পাইছিলো? জয়নালের কথা শুনে সুফিয়া বেগম চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। মা। কও না? আব্বার পায়ে কি হইছো লো?

তোর বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় বোমার আঘাত ডান পায়ে লাগছিলো।সেই থেকে তোর বাবা পঙ্গু। এ্যাই, মানুষটা দেশের জন্য নিজের পা হারালো। ব্যাথা নিয়ে রিকশা চালিয়ে মৃত্যু বরন করলো। কোনো দিন কাউকে বলেও নি। আমি তোর বাবাকে যখন বলতাম, চেয়ারম্যানের কাছে যান। বলেন, আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। শুনলে হাসতো আর বলতো – দয়া পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধ করি নি। দ্যাশ কে ভালোবেসে যুদ্ধ করেছি। আমার ছেলে স্বাধীন দেশে বুক ফুলিয়ে ঘুরবে, এ্যার জন্য যুদ্ধ করছি।শরীরে ব্যাথা নিয়ে রিকশা চালাতো আর রিকশা চালাতে চালাতে মরে গেলো কথা বলতে বলতে সুফিয়া বেগমের দুচোখ দিয়ে অজোর ধারায় কান্না। জয়নাল হাতে রং পেনসিল নিয়ে মায়ের কান্না দেখছে…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত