রাস্তার ধারে গাড়ির গ্লাসে চুল ঠিক করছি। গাড়িটা কার জানিনা। বেশ দামী গাড়ি। গ্লাস কালো। ভিতরে কেউ আছে কিনা দেখা যাচ্ছে না। কেউ থাকলে দেখে মজা পাবে। ধনীদের সব দিকেই মজার উপকরণ ছড়ানো থাকে। চুল-দাড়ি ঠিকঠাক করছি। তখন গ্লাসটা নেমে এলো।
“কি রে, এখানে কি করছিস? “প্রশ্ন শুনে চমকে তাকালাম। কালো সানগ্লাস পরা একজন লোক। এসব গাড়ি সম্ভবত কালো সানগ্লাস পড়ে চালাতে হয়। বয়স ত্রিশ- পয়ঁত্রিশ হবে। সুদর্শন পুরুষ। আমার বোঝতে সময় লাগলো, ইনি আমার মামা। বয়স পঁয়তাল্লিশ। “উঠ! গাড়িতে উঠ। কথা আছে তোর সাথে। ” উঠে এলাম। পিছনে মামাতো বোনটা বসা। হাসি থামাতে বাচারির বেগ পেতে হচ্ছে। কোশলাদিও জিজ্ঞেস করতে পারছে না। কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিশোরী মেয়ে কিনা, সরল। নইলে চট করে স্বাভাবিক হয়ে যেত। “গাড়ি কিনেছেন মামা?” “আরে নাহ্। এতো টাকা আছে? পার্টির গাড়ি।” চুপ করে থাকলাম। একটা ডেভেলপমেন্ট গ্রুপে শেয়ার আছে উনার। আরো কি কি বিজনেস করেন, ঠিক জানিনা। “এতো কাছে থাকিস, তোর মামি ফোন দেয়, বাসায় আসিস না কেনো? ”
“এইতো মামা একটু বিজি।”
“পড়াশুনা -চাকুরী একসাথে করা যায়! পড়াটা শেষ কর ভালো ভাবে।”
এসব ব্যাপারে চুপ থাকাই ভাল। আর মামার বউ দু’জন। একজন কুমিল্লার বাড়িতে থাকেন। আরেকজন এখানে। জিবনে এদের একজনের সাথেও ফোনালাপ হয়নি আমার। “মারিয়ার স্কুলে থেকে ফিরছিলাম। এই এলাকার কাশেম নেতা আছে না! উনার সাথে একটু দেখা করে আসলাম। তুই কোথা থেকে? ” “ওই তো ভিতরের দিকে একটা মেসে থাকি।” গাড়ি থামলো মামার বাড়ির একদম ভিতরে এসে। নতুন রং করা চকচকে বাড়ি। এমন বাড়িতে ঢুকতে অস্বস্তি হয়। অপরিচিত বোধটা বেড়ে যায়। “চল, উপরে চল।”
আর মামাতো ভাই বোন সুরুম, তাপসী ওরা ঘরেই আছে । দু বছর আগে নানীকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম। তখন এদের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। তাপসীর বয়স দু বছর মে বি। একে দেখি নি আগে। ওদের সাথে দুষ্টুমী করে ওদের হাতে আমার কয়েক শ চুল নিহত হয়েছে। গ্যান্জির সাইজ বদলে গেছে।মামি নিজের ছেলের মতো আদর-যত্নের চূড়ান্ত করলেন।
আমার বাবা বেঁচে নেই, মা অসুস্থ, চাকুরী করেও পড়াশুনা করে যাচ্ছি-এমন নানান কথায় খুব সমবেদনা প্রকাশ করলেন। মামা বাড়িটা করতে গিয়ে কত টাকা ঋণ করেছেন, ব্যাবসার কি করুণ পরিণতি, চার তলার নতুন ভাড়াটিয়া’রা কি কি ঝামেলা করছে, ভাড়া উঠাতে কত সমস্যা–ছোট্ট তাপসী দুষ্টুমী করে শুধু ব্যাথা পায়, সুরুম পড়তে বসে না,ওদেরকে নিয়ে চিন্তিত আছেন। কিছুই বাদ রাখলেন না। এক ফাঁকে কুমিল্লার বাড়িতে উনার সতীন কত সুখ-আয়েশে আছে তাও বললেন। অনেক কথা হলো মামির সাথে! এখানে প্রথমবার এসেছি। মামি কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। ফিরতে প্রায় রাত হয়ে গেলো। মামার শরির ভালো লাগছিল না। মামি আফসোস করলেন, একটা ড্রাইভার নেই বলে, গাড়িটা দিয়ে মেস পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া গেলো না।
রাস্তায় হাঁটছি। রাতের রাস্তায় হাঁটা আর সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে ভালো লাগছে। রাতের রাস্তায় অবশ্য ভয়েরও কারণ আছে। নানী ফোন দিয়েছেন। “ভাই তোমার শইলডা ভালা ? ” “জ্বি নানী। কেমন আছেন? ” ” আরে ভাই, আর ভালা ” এমন পর্যায়ে এসে নানী কেঁদে দেন। তার ডায়াবেটিস বেড়ে আছে, নানা অসুস্থ, কতক সমস্যা। আমি যেনো মামাকে বলি, তাদেরকে ফোন দিতে। নানীর পাশে নানার আলতো কন্ঠ শুনা যায়। ”তে পুলাপাইন মানুষ, কি কইবো? থাক কিচ্ছু কওন লাগবো না।”
বুঝলেন ভাই, খুব দু’টানায় পড়ে যাই। কষ্ট লাগে। যেখানে কিছু করার থাকে না সেটা এড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। বুদ্ধিমানেরা দু’টানায় পড়ে না। আমি তা নই; এড়াতে পারি না। কিছু করতেও পারিনা, সইতেও না। এ বড়ই অস্বস্তির। বৃদ্ধ হলে সবার পরিণতি এক হয় না। তবে প্রকৃতির হিসেব স্মূক্ষ; নির্ভুল। কারো হিসেব বাকী রাখে না।
সমাপ্ত