– কী ব্যাপার , ব্যাগ প্যাক করছো?
– না বস্তা প্যাক করছি !
– আশ্চর্য তো । কোথায় যাচ্ছো । কয়েকদিন হলো না অস্ট্রেলিয়া থেকে আসলে । তোমার শো এর এই এপিসোডের জন্য করা সব ট্যুর তো শেষ । তাহলে কোথায় যাচ্ছো?
– দেশে ।
– দেশে মানে? কোন দেশে?
– নিজের দেশ,নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশ । রাষ্ট্রীয় নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ । আরও কিছু ?
– সীমান্ত । ফিরছো কবে?
– ঠিক করিনি ।
– মানে । তোমার নতুন একটা চ্যানেল থেকে জব অফার আছে, তাদের ইন্টারভিউ আছে নেক্সট উইকে । কী নাটক শুরু করলে এর মধ্যে । আর কেনইবা যাচ্ছো ? আজ প্রায় এক যুগ পরে,কেন যেতে হচ্ছে দেশে ? কী আছে দেশে ?
– টাকি মাছের ভর্তা ।
– পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি ।
এমনিতেও তো তোমার পরিবারের পাগলের ছোয়া আছে । এখন তোমাকেও পেয়েছে । সেই অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে কোন মাছের কারি খেয়ে তোমার টাকি মাছের কথা মনে পড়লে্া,আর পাগলের মত এই কানাডাতে এসে পাগলের মত সব বাঙ্গালি রেস্তরা, ইন্ডিয়ান রেস্তরাতে যেয়ে টাকি মাছের ভর্তা খুঁজছো । কখনো ওয়েটাররা হাসছে,আর কখনো তোমার সাথের বন্ধুরা । আর আমি, আমি পড়ছি লজ্জাজনক অবস্থায় । এখন তো আর মুখ দিয়ে কথাও বের হবে না । যা মন চায় করো । একটা কথা বল,এখন কী ব্যাগ প্যাক করে তুমি ফ্লাইট পাবে?
– না পেলে এয়ারপোর্টেই ঘুমাবো । যতদিন থাকা লাগে থাকবো । নিজের খেয়াল রেখো । আর তুমি বাহিরে গেলে আমাকে একটু জানিয়ে যেও,কোন দেশে যাচ্ছো ? আমার চিন্তা করো না । নিজের জন্মভূমিই আমার খেয়াল রাখবে । অরনী,উইশ করে দাও,যেন টাকি মাছের ভর্তা খেতে পারি ।
– ওকে সীমান্ত । টেক কেয়ার । আই লাভ ইউ ।
– মি ঠু । Bye.
– Bye
অনেক দিন হয়েছে অরনী ,সীমান্তের বিয়ের । অনেকগুলো ঋতু পেরিয়ে তারা একে অপরের কাছে পুরনো হয়েছে,কিন্তু ভালোবাসা কমেনি । এখন অরনী ,সীমান্তের পথ পানে তাকিয়ে কয়েক ফোটা চোখের পানি ফেলবে । অরনী জানে,সে যখন বাহিরে যায় তখন সীমান্তও চোখের পানি ফেলে । কিন্তু সেই পানি, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখার সময় বা সাহস কারই হয়ে ওঠে না ।
– হ্যা সীমান্ত । আমি অনেক খোজা খুজি করেছি । কিন্তু এটা তো বাংলাদেশে বিলুপ্ত মাছ । কারও বাড়ির পুকুরে টুকুরে দুই একটা থাকতে পারে । এখন কী করবো দোস বল তো?
– তুই এভাবে হাল ছেড়ে দিলে হবে অর্জুন ! তুই তো আমার আশা । সেই অতিথি পাখির মত উড়ে চলে এসেছি তোর ভরসায় । এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল দেশে । ঘোড়াঘুড়ি করছি ,আরও দেখি কত দিন থাকা যায় । তুই ধীরে সুস্থে খুজতে থাক । সেই ন্যাংটা কালের বন্ধুরা যদি খোজ না দিতে পারে তাহলে কে দেবে?
– সীমান্ত,তুই ঘাটি গেড়ে বসে থাকলে তো আর আমার সমস্যা নেই । আমি তো ভাবছিলাম, এত দিন পর দেশে এসে তুই ফাপড়ে পড়লি কী না !
– আরে না । এখনও পরিনি । ঘুড়তে বেশ লাগছে । দেশের জ্যাম,কালো ধোয়া,ড্রেনের পানি,রাস্তার কাদা ,আপাতত সবই ভালো লাগছে ।
– তাহলে থাক । খোজ মিললেই জানাবো । আর হ্যা ,তোর আর তোর বউয়ের জার্নালিজম কেমন চলছে এটাও শুনবো টাকি মাছের ভর্তা খেতে খেতে ।
– ওকে ।
সমুদ্রের পাশের ফাইভ স্টার হোটেলের বিশাল জানালা দিয়ে বিশাল সমুদ্রের এক টুকরো দেখা যাচ্ছে । কিন্তু তাও সমুদ্রের বিশালতা সীমান্তর চোখে সীমানা ছাড়িয়ে ধরা দিচ্ছে । সাথে অরনী থাকলে এতোক্ষণে লাফালাফি শুরু করে দিত রুমে । আরও একটা কাজ করতো,সেটা হল ছবি তোলা । ছবি তুলতে তুলতে মোবাইল এর মেমোরি ফুল করে সব গুগল ড্রাই ভে জমা করা শুরু করতো । ফোন বাজছে ।
– সীমান্ত দোস । পেয়ে গিয়েছি ।
– পেয়ে গেলি । একটু আগেই না কথা হল । পাঁচ মিনিটে পেয়ে গেলি ।
– হুম শোন । আমাদের পাড়ায় এক হিন্দু আন্টি ছিল না,যার বাসায় অনেক ফুলফিলের গাছ ছিল ,আর আমরা স্কুল যেতে আসতে ঠিলাতাম জলপাই গাছে ঐ আন্টির সাথে কথা হল ।
– ওনার একটা মেয়ে ছিল না ,তনুশ্রী নামে । তনুশ্রীর মা?
– হ্যা ।
– কিন্তু ওনার সাথে তোর যোগাযোগ আছে এখনো ?
– আ রে আছে আছে । আমি তো আর দেশ ছেড়ে যাই নি ।
আর এখনো মাঝে মাঝে বাড়িতে যাই,যদিও তেমন কেউ নেই । তখন তো আন্টির সাথে দেখা হয়ই । আবার আমাদের ঐ তনুর বিয়ে হয়েছে মন্ত্রীর সাথে বুঝলি । জানিস তো তনু যেমন সুন্দরী ! তো হয়ে গেল,মন্ত্রীদের সাথে জার্নালিস্টদের যদিও দা কুমড়া সম্পর্ক হয়,তবুও তনুর জামাই এর সাথে বেশ মিল হয়ে গেল ।
– উ নি টাকি মাছের ভর্তা খাওয়াবেন?
– হুম । কনফার্ম ।
এনার ফ্রিজেই আছে । রাতেই চলে যেতে বলেছে আন্টি বাসায় । তুই কী আসতে পারবি ?
– আলবৎ পারবো । ব্যাগ গুছিয়েই এয়ারপোর্টে যাচ্ছি । তারপর নেমেই গাড়ি নিয়ে পুরান ঢাকা । ভূতের গলি । আহ! শৈশবের গন্ধ পাচ্ছি,সাথে টাকি মাছের ভর্তার । আমি আসছি । সীমান্ত বের হয়ে গেল । মেঘ ফুড়ে,সমুদ্র ছেড়ে উড়ে এল পুরান ঢাকার ভেপসা গরেমে । এখনও ছোট ছোট অলি গলি । রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দ শোনা যায় এখানে । যেন ঢাকার ভিতরে অন্য ঢাকা । কোথাও কাবাবের সুঘ্রাণ,কোথাও বাকরখানির ,কোথাও বিরীয়ানির স্বাদ ভেসে আসছে বাতাসে ।
সব ছাপিয়ে টাকি মাছের ভর্তার স্বাদ,সুবাস সবকিছু পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে সীমান্তের মগজে ঢুকছে । যদিও এটা সম্ভব না । সেই পুরনো বাড়িটাই আকড়ে ধরে রেখেছে তনুশ্রীর মা । আর কারও বাড়ি এমন নেই । সব ডিভ্লোপারকে দিয়ে বহুতল ভবন এখন । সীমান্তদের বাড়ি জায়গা তো আরও অনেক বছর আগেই কাটাছেড়া হয়ে গিয়েছে । সীমান্তর স্কুল পেরোনোর পরেই সব বেঁচে পুরো পরিবার চলে গেল নতুন ঢাকায়,নতুন ফ্ল্যাট নামের বন্দী কারাগারে । তারপর ইউনিভার্সিটি শেষে সীমান্ত পুরো পরিবার নিয়ে উড়ে যায় কানাডায় । কিন্তু তনুশ্রীর বাড়িটা এখনো তেমন আছে । জলপাই এর গাছটাও আছে । শুধু বাড়ির ভিতরে টাইলস লাগিয়ে একটু আধুনিক করা হয়েছে । কিন্তু বাহিরটা অপরিবর্তনীয় । আগেই খাওয়া হল । আন্টিও সরাসরি খাবার টেবিলেই নিয়ে গেল ।
কারণ সে অর্জুনের কাছে আগেই শুনেছিল যে,তার বন্ধু শুধু টাকি মাছের ভর্তা খাওয়ার জন্য এতো দূর এসেছে । টাকি মাছের ভর্তাটা সীমান্তর কাছে মাখনের মত লাগছিল । মুখে দেয়া মাত্রই মিলে যাচ্ছিল । টাকি মাছের সাথে শুকনা মরিচ,ধনেপাতা,আর নারিকেল তেলের সুঘ্রাণ আসছিল । আন্টি নিশ্চই নারিকেল তেলে মাছটা ভেজেছিল । খাওয়া শেষে সীমান্তর মনে হচ্ছিল,মৃত্যুর আগে তার আর কিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগবে না । খাওয়া শেষে আন্টি বোরহানি নিয়ে হাজির হল । অর্জুন আন্টির সাথে সীমান্তর;পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল । বয়স বেড়ে গিয়েছে,সীমান্তও অনেক আগে পাড়া ছেড়ে যাওয়ায় আন্টি কোনভাবেই সীমান্তকে চিনতে পারছিল না । তারপর আন্টি সীমান্তকে কিছু নরমাল প্রশ্ন করলো ।
– সরি বাবা। আমি না তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
– ঠিক আছে আন্টি । পাড়ায় সেই কবে শেষ ছিলাম আর যখন ছিলাম তখনও তো আপনার সাথে খুব একটা দেখা হয়নি । এটা স্বাভাবিক ।
– তা ঠিক । তোমার বাবার নাম কী বলো তো?কী করতেন?
– নাঈমুল ইসলাম । ডাক্তার ছিলেন ।
– ও । না মনে পড়ছে না । যাই হোক,মাছের ভর্তা কেমন লাগলো বলো তো?মজা হয়েছিল? এই বয়সে তো খুব একটা রান্না করি না । কী যে করলাম !
– আপনি হয়তো আন্টি লক্ষ্য করেননি । এতোগুলো আইটেম থাকা সত্বেও, আমি শুধু মাছের ভর্তাটাই বারবার নিচ্ছিলাম । আর আন্টি,আপনি কী মাছটা নারিকেল তেলে ভেজেছেন?
– হ্যা । এভাবে টাকিমাছ রান্না করা শিখেছি এ পাড়ায় এসে । আমার এক বান্ধবী হয়েছিল পাড়ায়,খুব কাছের । মৌমিতা,ওর কাছ থেকেই শিখেছি ।
– মৌমিতা? পুরো নাম কী জানেন?
– হ্যা মৌমিতা ইসলাম । কেন?তুমি চেন?
– হ্যা,আমার মা ।
– তাই ! তুমি মৌমিতার ছেলে !
কী আজব ! আসলে আমার তো কোনদিন তোমাদের বাসায় যাওয়া হয়নি । তোমার মা বলেছিল,তোমার বাবা নাকি পছন্দ করতেন না । তবে ও তো তোমার গল্প করতো । তবে কে জানতো,তুমিই সেই সীমান্ত । কীভাবে দেখা হয়ে গেল ! তোমার মা কেমন আছে? এবার অর্জুন মুখ খুললো
– আন্টি, উনি বেচে নেই । আঙ্কেলও বেশ কিছুদিন হল মারা গিয়েছে ,কানাডাতেই ।
– ও সরি । বাবা সীমান্ত, আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম । তবে তোমার মা ভীষণ ভালো মানুষ । আমাকে সবসময় বলতো ওর সাথে নাকি কেউ মেশে না । কিন্তু ও মানুষ পাগল ছিল । একটু মানুষ পাগল ছিল আর পাগলামী করতো বলে এই ভালো মানুষটাকে সবাই দূরে ঠেলে দিত । সেকি,উঠলে যে? সীমান্ত উঠে দাড়ালো
– আন্টি আমাকে একখানে যেতে হবে ,তাড়া আছে ।
– কোথায় যাবে?
– পাবনা যাব ।
জরুরী একজনের সাথে দেখা করতে হবে । তবে আমি কানাডা যাওয়ার আগে আপনার সাথে আবার দেখা করে যাব । এখন বিদায় নিতে হবে । চল অর্জুন । আন্টি আসি । সীমান্ত ধড়ফড় করে বের হল । অর্জুন অনেকবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পেল না যে,কেন সে হঠাৎ টাকি মাছের ভর্তা খেয়ে পাবনার রাস্তা ধরলো । শুধু মুখ বোচা করে আর এক বদনা রহস্য নিয়ে সেও সীমান্তর সাথে রওনা হল পাবনা ।
পাবনায় পৌছে সীমান্তর পিছে পিছে একবার অটোতে,একবার রিক্সায় চড়ে,তারপর কিছুদূর পায়ে হেঁটে সে পাবনা মানসিক হাসপাতালে হাজির হল । ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে সে পারমিশন নিয়ে গেল । কেউ ঘুমিয়ে আছে? বিছানার সাথে তার হাড্ডিসার দেহ মিশে গিয়েছে । সাদা শাড়ি,সাদা চাদর সব একাকার হয়ে গায়ের হাড্ডির সাথে মিশে আছে । মাথায় হাতে গোনা কয়েকটা পাকা চুলও আছে । তারমানে বিছানায় হাড্ডিসার কঙ্কালটা কোন মহিলার । মাছি ভনভন করছে মহিলার মুখে । মুখ হা হয়ে আছে । লালা পড়ছে গড়িয়ে গড়িয়ে আর মাছি সেখানেই উড়ে উড়ে ঘুড়ে;ফিরে পড়ছে । সীমান্ত এখন তার মুখোমুখি ।
– মা…. মা… … মা…
– কে?
– মা, আমি তোমার ছেলে ।
– আমার ছেলে ? সে তো মরে গেছে ।
– কে বলেছে মা?
– ওরা বলেছে যারা আমার দেখা শোনা করে ।
আমার তো মাথায় একটু সমস্যা ছিল । তারপর ভালো করার জন্য আমার ছেলে,স্বামী এখানে রেখে গেল । বললো যে সুস্থ হলে নিয়ে যাবে । সুস্থ হওয়ার পর এরা খোজ নিতে গিয়েছিল আমার বাড়ির ঠিকানায় । যেয়ে নাকি শুনেছে সবাই মরে গিয়েছে ,তাই আর আমার বাড়ি যাওয়া হয়নি ।কিন্তু তোমার কী হয়েছে?তুমিও কী আমার মত একা? তুমিও মা হারা?
– হ্যা মা, আমি তুমি থেকেও মা হারা । সীমান্ত গোধূলির আলোতে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো । সে অবশেষে বুঝতে পেরেছে ,মা তার পাগল হলেও মা ছিল ।