পুইঁশাক চিংড়িমাছ এবং একটি চার্যার লাইটের গল্প

পুইঁশাক চিংড়িমাছ এবং একটি চার্যার লাইটের গল্প

বাজারের ব্যাগটা খুলে জাহানারা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ব্যাগের এক কোনায় পরে আছে ফিনফিনে পাতলা সাদা পলিথিনে কিছু গুড়া মাছ আর একটা পলিথিনে জলপাই আর কাঁচামরিচ।

জলপাই দিয়ে ছোটমাছের চচ্চরি করতে হবে বোঝাই যাচ্ছে। জাহানারা বেগমের রান্নার হাত মাশআল্লাহ ভালো। কিন্তু পাঁচজনের পরিবারে এই একপদের তরকারি কি দুবেলা যাবে, মুখ কালো করে বটিটা নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে যায় জাহানারা। পুকুরপাড়ে ঘাটের পাশ দিয়ে সে কয়েকটা পুঁইশাকের ডাটা পুতে দিয়েছিলো, ভেজা মাটিতে তরতর করে পুঁইশাক বেড়ে উঠেছে। জাহানারা তিন চারটা ডাটা কেটে নিলো। পুকুরের ঘাটটা বাঁশ দিয়ে বানানো হয়েছে। চার পাঁচটা বাশ একসাথে করে দুপাশে তক্তা পেরেক মেরে পুকুর ঘাট তার স্বামী আর ছেলে মিলে গতবছর বানিয়ে দিয়েছিলো।

এই পুকুর তাদের নয়, পুকুরের ওপারে থাকে তাদের বাড়িওয়ালা, শফিক চেয়ারম্যান। পুকুর তারই, ঘরটাও তার, জাহানারা বেগমের স্বামী সালেক মাস্টার স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক। তারা এখানে ভাড়াটে। দু’টো বারান্দা নিয়ে একটা কাঠের ঘরে পাচজনের সংসার। জাহানারা বেগম পুকুরপাড় পেরিয়ে পেছনের ব্যাড়ের দিকে আগায়। এই ব্যাড় দিয়ে পুকুরে জোয়ার ভাটার পানি ঢোকে, ব্যাড়ে জাহানারা একটা চাই পেতে রাখে। মাঝে মাঝে টেনে তুললে সাত আটটা চিংড়ি মাছ লাফাতে থাকে, কপাল ভালো হলে দু একটা ট্যাংরা বা টাকি মাছও উঠে পরে। আজ যেমন চিংড়ি মাছ পাওয়া গেল বারোটা আর দুটো ট্যাংরা মাছ। হাতের ঝাপিতে মাছ গুলো নিয়ে চাইটা আবার ব্যাড়ে ঢুবিয়ে দেয় ইট দিয়ে। তারপর হেঁটে হেঁটে রান্নাঘর এর দিকে আসে।

তার তিন সন্তান। বড় ছেলে কলেজে ডিগ্রি পড়ে, মোটামুটি ছাত্র, মেঝ মেয়েটা ক্লাশ টেনে, রোল চার। ক্লাশ এইটে সাধারণ কোঠায় বৃত্তিও পেয়েছিলো। কোন প্রাইভেট পড়াতে পারে না, একা একা পড়ে এত ভালো করে মেয়েটা। অথচ বাড়িওয়ালার মেয়েটার দুটো মাস্টার বাসায় এসে পড়ায় তাও রোল চব্বিশ। জাহানারার মেয়েটার চেহারা ভারী মিষ্টি, ডাগর ডোগর হয়ে উঠেছে ইদানীং। মেয়ের বাবা চাইছে মেয়ে সুন্দরী আর কমবয়েসী থাকা অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দিতে। গত সপ্তাহে পাত্রপক্ষ এসে দেখে গেলো। পাত্র ভালোই, প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার।

তার বাপ মা বোনের কত প্রশ্ন মেয়েটাকে, রাঁধতে পারে কিনা, সুরা কয়টা জানে, চুল কত লম্বা আরো কত কি!
মেয়েটা খুব কাঁদছিলো, এখনি বিয়ে করতে চায়না সে। তার খুব ইচ্ছে বড় চাকরি করবে, ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করবে। কিন্তু টানাটানির সংসারে এই কথা বলতে সাহস পায়নি জাহানারা। তার স্বামী স্কুলের পরেও তিনটা টিউশনি করে। গ্রামের বাড়িতে শ্বশুর শাশুড়ীকে দেখতে হয় তাদেরই। এই অবস্থায় মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়া ভালো। ছোট মেয়েটা ফোরে পড়ে। এই মেয়েটা আদরের বলে একটু সৌখিন। কয়েকদিন ধরে আবদার করছে একটা চার্যার লাইট কিনতে হবে। রাতে প্রায় দু ঘন্টা কারেন্ট থাকেনা। বাড়িওয়ালার বাড়িতে সাদা রঙের চার্যার লাইট জ্বলে। আর জাহানারা বিকেলে হ্যারিকেনের চিমনি মুছে কেরোসিন ভরে রাখে। একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ওদের পড়ার টেবিলে দিয়ে দেয়।

জাহানারা রাঁধলো পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি মাছ। দুটো ট্যাংড়া মাছ ভেজে আলু দিয়ে রাঁধলো স্বামী আর ছেলেকে দেবে। আর ছোট মাছের চচ্চড়ি জলপাই দিয়ে। রাতে কারেন্ট চলে গিয়েছিলো খাওয়ার সময়। ছেলেমেয়েদের আগেই খাইয়ে দিয়েছে জাহানারা। স্বামী ফিরলেন রাত দশটার দিকে। ছোট্ট মফস্বল শহরে অনেক রাত। পুই শাকের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, শাক কই পাইলা, বাজারে যে আগুন দাম তরিতরকারির, কিচ্ছু কিনতে পারি নাই।

জাহানারা উত্তর দিলো, পুকুর পাড়ে লাগাইছিলাম, চাইরটা ডাটা। ওগুলা বড় হইছে। আর চিংড়ি মাছ চাইয়ে উঠছে।
খেতে খেতে সালেক সাহেব বললেন, ছেলেপক্ষের অনেক দাবী, ত্রিশ হাজার টাকা নগদ, গয়না তিন ভরি আরো মটর সাইকেল দিতে হবে। এত কিছু কিভাবে আয়োজন করবে বুঝতে পারছে না। তবে সরকারি চাকরি করা ছেলে, দুই বোনের এক ভাই এমন ছেলে পাওয়া যাবে না সহজে। খাওয়া শেষ করে পান মুখে দিয়ে বসলেন সালেক সাহেব। জাহানারা পাখা দিয়ে হাওয়া দিচ্ছিলো। মেজ মেয়েটা এসে দাঁড়ালো, বাবার হাতে আটশ টাকা দিয়ে বললো, আব্বা বৃত্তির টাকা দিছে আজকে পাঁচশ , আর গত সপ্তাহে উপবৃত্তি দিছিলো তিনশ টাকা। ছাত্রীরা উপবৃত্তি পায় স্কুল থেকে পরিমানে সামান্য হলেও বছরে দুবার।

-মোট আটশ টাকা জমছে, পুতুলের জন্য একটা চার্যার লাইট কেনেন আব্বা।

সালেক সাহেব টাকাটা হাতে নিলেন। জাহানারা বাতাস করছিলো। আজ এখনো কারেন্ট আসছে না। রাত বাড়ছে। আজ কারেন্ট আসে নি। সালেক সাহেবের ঘুম আসছে না গরমে৷ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলেন। জাহানারা, ঘুমাইছো নাকি? না, কিছু বলবেন? পানি দিবো? জাহানারা উত্তর দিলো। বুঝলা, মেয়েটার বিয়া দিবো না এখন, কালকে পাত্র পক্ষকে না কইরা দিবো। ও পড়তে চায় পড়ুক। কি আর এমন খরচ হয়, তুমি তো পুইশাক আর চিংড়ি মাছের জোগাড় করতেই পারবা বলো! জাহানারা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। তার চোখের কোণায় চিকচিক করছে অশ্রু। তাতে মিশে আছে কষ্ট নাকি আনন্দ, সে জানে না হয়তো

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত