– ‘আপনি কি ঠিক করেই নিয়েছেন যে, প্রতিদিনই আমাকে বিরক্ত করবেন? আমি তো জানিয়েই দিয়েছি এই মুহুর্তে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভম নয়, কারণ এখনও চাকরি পাইনি। পরিবার থেকে বলা হয়েছে চাকরি না পেলে বিয়ে করে বউয়ের ভরণ-পোষণ কীভাবে চালাবো। তাদের কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে, এখন মেয়েদের যে চাহিদা! ভালো চাকরি করা ছাড়া পূরণ করা কঠিন। আমি তো নিজের খরচও ঠিকমত নিজে ইনকাম করতে পারি না। তাহলে বিয়ের পর স্ত্রীর, আমার খরচ কীভাবে চালিয়ে নিবো? আমি যতটুকু জানি, মেয়েদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো, মেয়েও শিক্ষিতা। সুতরাং ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়ে দিতে বলুন।’
– ‘সে যদি অন্য জায়গায় বিয়ে করতে রাজি হয়; তবেই তো বিয়ে দিবে? কিন্তু সে বলেছে, জানা-শোনা ধার্মীক ছেলে ছাড়া বিয়ে করবে না। সে তোমাকে নাকি অনেক আগে থেকেই চেনে, কলেজে অনেকদিন ধরে তোমার উপর চোখ রেখে চলেছে। তোমার মধ্যে কখনও কোন খারাপ অভ্যাস সে দেখেনি। তাছাড়া মেয়ের বাবাও তোমার পরিবার সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জানেন। তোমাদের আর্থিক অবস্থা একটু দুর্বল, বাকী সব ঠিক আছে। তাই তিনিও চাচ্ছেন মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে।’
– ‘দেখুন চাচা, মেয়েটি অনেকদিন ধরে আমাকে ফলো করেন আমি জানি সেটি। কয়েকদিন কথা বলার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু যখন জানলাম প্রেম করতে চায়, তখন থেকে তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আপনি মেয়ে ও তার পরিবারকে আমার সমস্যার কথা বুঝানোর চেষ্টা করুন। আর যদি বুঝাতে সক্ষম না হন তো আমি না হয় একদিন মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করবো। আপনার কথা রাখতে পারছি না, এজন্য দুঃখিত।’
এতক্ষণ কথা হচ্ছিলো রফিক ও কফিল উদ্দীনের মধ্যে। রফিক সবে মাত্র মাস্টার্স শেষ করে চাকরির জন্য ছুটাছুটি করছে। আর কফিল উদ্দীন ঘটকালি করে বেড়ান। তবে তার একটি ভালো বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি অন্যদের মত মিথ্যা তথ্য দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করেন না। যা বলবেন তার সব তথ্যই সঠিক। তাকে রফিকের কাছে পাঠিয়েছেন, গ্রামের জামাল সাহেব তার একমাত্র কন্যা লিমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। জামাল সাহেব গ্রামের পরোপকারি, সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে বেশ পরিচিত। কফিল উদ্দীন মন খারাপ করে ফিরে গেলেন জামাল সাহেবের কাছে। ছেলের সমস্যার কথা তাকে বললেন। জামাল সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর কফিল উদ্দীনকে বললেন- ‘ছেলেটি তো মন্দ কথা বলে নি। চাকরি না পেলে স্ত্রীর উপর তার দায়িত্ব সে কীভাবে পালন করবে। বুঝাই যাচ্ছে- ছেলেটি বেশ সচেতন। যাইহোক, বেকার ছেলের হাতে তো আর মেয়েকে তুলে দেয়া যায় না। তুমি এখন যাও, আমি দেখি মেয়েকে বুঝাতে পারি কিনা।’
বিষয়টি নিয়ে জামাল সাহেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি মেয়েকে ছেলের সমস্যার কথা সব খুলে বললেন। এটিও বললেন যে- ‘দেশে চাকরির যে অবস্থা, তাতে দু’পাঁচ বছরের মধ্যে সে চাকরি পাবে বলে মনে হয় না। তোমারও বয়স বেড়ে যাচ্ছে, এতদিন অপেক্ষা করাও তো সম্ভব নয়। তাই আমি চাই, তুমি অন্য ছেলের সাথে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও। ভালো চাকরিজীবী ছেলের সাথে তোমাকে বিয়ে দিবো।’
বাবার কথা শুনে লিমার বুকের ভিতরটা ধুক করে কেঁপে উঠলো, এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। কেননা রফিককে সে গত তিন বছর ধরে জেনেছে, চোখে চোখে রেখেছে। সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দিতে না পারলেও সে মনে মনে তাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে কল্পনার জগতে সাজিয়ে রেখেছে। তাই তো সে অন্য কোন ছেলেকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারে না। নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে থাকলো। রুমে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। লিমা কী উত্তর দিবে ভাবতে থাকলো, কিন্তু এই মুহুর্তে কোন উত্তরই তার মাথায় আসছে না। কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে বাবাকে এ ব্যাপারে পরে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলো।
পরদিনই লিমা কফিল চাচার সাথে দেখা করলো, একই পাড়ায় বাড়ী হওয়ায় কফিল উদ্দীন লিমাকে মেয়ের মত স্নেহ করেন। তাই তো তিনি রফিককে বার লিমার জন্য বিয়ে প্রস্তাব দিয়ে বিরক্ত করেন। কথার এক পর্যায়ে কফিল উদ্দীন বললেন- ‘ছেলের সাথে কয়েক দিন কথা বলে যতটুকু বুঝলাম- সে খুব ভালো একটি ছেলে। বর্তমান সময়ে এমন ছেলে পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার, এমন ছেলেকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেলে জীবন ধন্য হবে তোমার। সুখে-শান্তিতে থাকবে সেটি নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। যেহেতু ছেলেটি তোমার সাথে কথা বলতে রাজি আছে, সেহেতু তুমি তার সাথে দেখা করে পরার্মশ করতে পারো। আশা করি, সে তোমাকে খুব ভালো পরার্মশ দিবে।’ কফিল চাচার কথাগুলো লিমা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো, ভাবলো- রফিকের সাথে দেখা করার বিকল্প পথ নেই। তার সাথে কথা বললে হয়তো কোন পথ বাতলে যাবে।
এর পরদিনই রফিকের সাথে দেখা করার জন্য লিমা কলেজ ক্যাম্পাসে গেলো। সকাল ১১ টার ১৫ মিনিট আগেই লিমা কলেজ লাইব্রেরিতে এসে রফিকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। রফিক ১১ টার ঠিক ২ মিনিট আগে লিমার সামনে এসে সালাম দিলো। রফিকের কণ্ঠে সালাম শুনতে পেয়ে লজ্জায় লিমার মুখ লাল হয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে সালামের জবাব দিলো। কুশল বিনিময়ের পর দু’জনই কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো, কী বলে যে শুরু করবে বুঝতেই পারছে না। অবশেষে রফিক মুখ খুলল, বলল সে- ‘দেখুন, আপনি তো জানেন আমি সবে মাত্র মাস্টার্স পাশ করলাম।
দেশে চাকরির যে অবস্থা তাতে কবে চাকরি পাবো তা বলা মুশকিল। আর আমাদের দেশে বেকার ছেলের হাতে কোন বাবাই মেয়ে তুলে দেন না, কোন মেয়েই বেকার ছেলেকে পছন্দ করেন না বা বিয়ে করতে রাজি হন না। মেয়ে বা মেয়ের মা-বাবা শুধু এটি দেখেন যে, ছেলে কত টাকা আয় করে, কতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। তারা একবারও জানতে চান না- ছেলে কতটা ধার্মীক, তার আচার-আচরণ, চরিত্র কেমন? তাদের কাছে ছেলের আয়টা বড় ব্যাপার, চরিত্র নয়। আমাদের সমাজে এখন ধার্মীকতার কোন মূল্য দেয়া হয় না। যার কারণে দিনদিন মানুষ ধর্মকে ছেড়ে দুনিয়ার অর্থের পেছনে দৌঁড়াচ্ছেন। যাইহোক, যতদিন আমি চাকরি পাচ্ছি না, ততদিন বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আশা করি, আপনি আপনার বাবার পছন্দ করা উচ্চ বেতনের চাকরি করা ছেলেকে বিয়ে করে নিবেন।’
লিমা এতক্ষণ মাথা নিচু করে রফিকের কথা শুনছিলো। সেও ভাবলো- রফিকের কথাই তো ঠিক, আমাদের সমাজে কোন মেয়ে শিক্ষিত বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে চায় না, যদিও সে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়। কারণ তার টাকা থাকে না। কোন অভিভাবকও বেকার ছেলের সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি নন, যদিও ছেলে ধার্মীক হয়। অথচ দেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার ছেলে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর লিমা মুখ তুলল, তার চেহারায় দুর্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সে মুখ বলল- ‘দেখুন, আমি একটি ধার্মীক ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। আজ আপনার চাকরি নেই, তাই বলে কোনদিনও চাকরি হবে না ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয়। এখন না হয় একটু কষ্ট করে দিন কাটাবো, নিজেকে মানিয়ে নিবো।
আর আমার পিছনে খরচ নিয়ে ভাবছেন? সেটি আপনার ভাবতে হবে না। আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলবো, যতদিন আপনি চাকরি পাচ্ছেন না, ততদিন আমার জন্য একটি টাকাও খরচ করতে হবে না। আমি যদি আরও দু’বছর পরে বিয়ে করি তাহলে তো আমার আব্বুকে আমার সব খরচ বহন করবেন। তাহলে আপনি চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত আমার খরচ চালাতে তাঁর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আশা করি, এরপর আর বিয়ে করতে আপনার আপত্তি থাকবে না।’ লিমা একটানা কথাগুলো বলে আবারও মুখ নিচু করে ভাবতে থাকলো- নিজের বিয়ের কথা নিজেই কিভাবে ছেলের সাথে আলোচনা করছে সে, তার সাহস মনে হয় বেশ বেড়ে গেছে!
রফিক লিমার কথাগুলো শুনে বেশ অবাক হলো! এমন কথা কোন মেয়ের মুখ থেকে শুনবে এমনটি সে আশাই করেনি। এমন কি- যে মেয়ে বেকার ছেলেকে বিয়ে করবেন এবং চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত তার খরচের টাকাও নিবেন না বলে আশস্ত করবেন, তেমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে এমনটি সে ভাবিই নি! নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন। তার মনে হচ্ছে- স্বপ্নের মধ্যে কেউ তাকে এসব কথা শুনাচ্ছে। রফিককে গভীর ভাবনার মধ্যে ডুব থাকতে দেখে লিমা জিজ্ঞাসা করলো- ‘এত গভীর ভাবে কী ভাবছেন? চিন্তা করা লাগবে না, আমি বাবাকে ম্যানেজ করবো। আপনি আপনার পরিবারকে বুজিয়ে বলুন।’ রফিক এবার মুখ খুলল, বলল- ‘বিয়ের পরে আপনি বাবার খরচে চলবেন! ব্যাপারটি কেমন দেখাবে? মানুষ কী বলবেন? সমাজের মানুষ বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে নিবেন?’ লিমা যেন একটু বিরক্ত হলো, বিরক্তি ভাব নিয়েই বলল- ‘সত্যিই তাই, আমাদের সমাজের মানুষ বিষয়টি সহজে মেনে নিবেন না। আসলে সবাই ভালো কাজ সহজে মেনে নিতে পারেন না।
অথচ আমরা যদি প্রেম করতাম, তাহলে সমাজের মানুষ সেটি খুব সহজেই মেনে নিতেন, উপভোগ করতেন! আচ্ছা, একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই, আমাদের সমাজে বিয়ের আগে প্রেমর নামে অবৈধ্য মেলমেশাকে এখন প্রায় বৈধতা দেয়া হয়েছে, তাই না? যুবক-যুবতি প্রেমের এক পর্যায়ে অবৈধ্য শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে মেয়েটি প্রেগনেন্ট হয়, এক সময় ছেলে বাচ্চাকে অস্বীকার করে। তারপর মেয়েটি নিরুপায় হয়ে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অথবা নিজের গর্ভের সন্তানকে হত্যার মত জঘণ্য কাজটি করে বসে, কী ভয়ঙ্কর অপরাধ! অথচ এ সমাজ সেই অবৈধ প্রেমকে উৎসাহিত করে আর বৈধ বিয়েকে নানা রকম শর্তে বেধে কঠিন থেকে কঠিনতর করে ফেলেছে। যার কারণে সমাজে দিনদিন ধর্ষণ, পরকিয়া, খুনের মত জঘণ্য অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা তো সেই রকম অপরাধ করা থেকে বিরত থাকছি, বৈধ ভাবে বিয়ে করে সংসার শুরু করতে চাচ্ছি। এতে যদি সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের মাথা ব্যথা হয়, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। দেখবেন আমাদের দেখাদেখি হাজারও ছেলে মেয়ে এমন শর্তে বিয়ে করতে উৎসাহিত হবে।’ লিমার ব্যাখ্যাটি রফিক মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলো, তার যৌক্তিক কথাগুলো বেশ ভালোই লাগলো, তাই সে ভাবলো- এমন উদার মেয়েকে নিশ্চিন্তে বিয়ে করা যায়। এ সব ভেবে সে লিমার কথায় রাজি হলো। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে উভয় সালাম বিনিময় করে বিদায় নিলো। লিমা বাসায় যাওয়ার সময় কফিল চাচাকে রাতে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য বলে গেলো।
প্রায় পনের মিনিট হলো কফিল চাচা এসেছেন। লিমা তিন কাপ চা ও বিস্কুট এনে সোফায় বসলো। সামনেই আব্বু ও চাচা বসা। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল আর ভাবছিলো- কীভাবে শুরু করা যায়। লিমাকে গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে কফিল চাচা বললেন- ‘লিমা মা, তুমি মনে হয় কিছু বলতে চাচ্ছিলে?’ লিমা যেন সম্বিত ফিরে পেলো, সে বলা শুরু করলো- ‘আব্বু, আমি যদি আরও এক বছর পরে বিয়ে করি, তাহলে আপনি কী আমাকে খেতে দিবেন না? পোশাক কিনে দিতে পারবেন না? কলেজে যাওয়া-আসার জন্য খরচ যোগাতে কষ্ট হয়ে যাবে?’ মেয়ের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে জামাল সাহেব কিছুটা অবাক হলেন, কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বললেন- ‘এসব কী বলছিস মা! তুই আমার একমাত্র মেয়ে, তোর খরচের টাকা আমি কেন দিবো না? তোর প্রয়োজনীয় কিছু দিতে কখনও কি কৃপণতা করেছি?’
– ‘না, আমাকে কখনও অভাব বুঝতে দেননি।’ লিমা গম্ভীর মনোভাব নিয়ে বলা শুরু করলো, ‘আচ্ছা আব্বু, আপনি কি জানেন, আমাদের দেশে কী পরিমাণ অর্নাস-মাস্টার্স পাশ করা ছেলে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে একটি চাকরির আশায় ফাইল বন্ধী সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? এই এত এত বেকার শিক্ষার্থীর সবাইকে কি সরকার চাকরি দিতে পারবেন? না পারবেন না। তাহলে এই সব যুবকরা কি বিয়ে করতে পারবে না? সব মা-বাবা যদি চাকরিজীবী খোঁজ করেন তাদের মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য, তাহলে এসব ছেলেদের কপালে তো মেয়ে জুটবে না!’
– ‘ঠিক বলেছিস মা, যখন দেখি শিক্ষিত ছেলেরা চাকরির অভাবে সমাজে সম্মান নিয়ে ঘুরতে পারছে না, তখন খুবই খারাপ লাগে। কিন্তু এসব কথা আমাকে বলছিস কেন? আমি কি এই লাখ লাখ ছেলেদের চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবো? তাদের বিয়ের সম্বন্ধ খুঁজে দিতে পারবো? সে ক্ষমতা তো আমার নেই।’
– ‘আমি জানি লাখ লাখ শিক্ষার্থীর চাকরি দেয়ার ক্ষমতা আপনার কেন, সরকারেরও নেই। তবে আপনি চাইলে তো আপনার মেয়েকে একটি ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারেন, হোক সে বেকার। তাতে কী আসে যায়? শিক্ষিত ছেলে, চাকরি না পেলেও কোন ব্যবসা করে সংসার চালিয়ে নিতে পারবেন। হয়তো একটু সময় লাগবে, সে সুযোগটা তো দেয়া উচিৎ?’
– ‘এসব তুই কী বলছিস? তুই আমার একমাত্র মেয়ে, তোকে বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিলে সমাজের লোক কী বলবে?’
– ‘আব্বু, প্রেমের নামে যখন যুবক-যুবতীরা নষ্ট প্রেমে জড়িয়ে পড়ে, নিষ্পাপ শিশু ধরণীর আলো দেখার আগেই যখন হত্যা করে তখন এই সমাজে নামধারী মানবাধিকার কর্মীরা কী বলেন? তখন কিন্তু ঠিকই চুপ থাকেন। অথচ বৈধ বিয়েতে যত বাধা এদের পক্ষ থেকেই আসে।’
লিমার মুখে এমন কথা শুনে কফিল উদ্দীন মিটমিট করে হাসতে লাগলেন, যদিও লিমা যে এমন কথা বলতে পারবে তা তিনি ভাবেন নি। জামাল সাহেব তো অবাক! এ যেন তার শান্ত পুচ্কু মেয়ে লিমা নয়। সে আজ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে যেন! মেয়ে যে বড় হয়েছে, সমাজ, সংসার নিয়ে সে যে ভালো-মন্দ ভাবতে পারে তা এতদিনে বুঝলেন। তিনি মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলেন, একটু পরে মাথা তুলে বললেন- ‘তুই খুব ভালো কথা বলেছিস মা, আসলে বেকার যুবকদের কথা যদি সবাই এভাবে ভাবতো তাহলে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা নিশ্চয়ই কমে যেতো। এখন তাহলে কী করা উচিৎ? আরও এক বছর পরে বিয়ে করবি?’ এতক্ষণে কফিল উদ্দীন যেন কথা বলার সুযোগ পেলেন, তিনি বললেন- ‘এক বছর পরে বিয়ে করবে কেন? লিমা মা তো খুব সুন্দর কথা বলেছে, আপনি চাইলে এ মাসেই বিয়ে হতে পারে।’
– ‘তা কিভাবে সম্ভব? লিমা তো ঐ ছেলেকে ছাড়া বিয়ে করতে চাচ্ছে না।’
– ‘ঠিকই তো, ঐ ছেলের সাথেই বিয়ে হবে। আপনি কি লিমার কথা বুঝতে পারেন নি? ছেলে বেকার তাতে কি হয়েছে, সে যতদিন চাকরী না পাবে ততদিন আপনি লিমার খরচ দিবেন। তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’
জামাল সাহেব এবার মিটমিট করে হাসতে লাগলেন, তিনি এতক্ষণে বুঝতে পারলেন মেয়ে কেন বেকারদের পক্ষ নিয়ে এত কথা বলছিলো। বাবার এমন হাসি দেখে লিমা বেশ লজ্জা পেলো। রফিক সাহেব মিষ্টি হেসে বললেন- ‘ঠিক আছে কফিল, আগামী কালই রফিকদের বাসায় গিয়ে তার বাবা-মায়ের সাথে ওদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো। যে করেই হোক, তাদের রাজি করাবো। এবার খুশি তো মা?’ খুশিতে লিমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, কিছুটা লজ্জাও পেলো। সাথে সাথে দৌড়ে অন্য রুমে চলে গেলো।
উভয় পরিবারের সম্মতিতে পনের দিন পর রফিক ও লিমার বিবাহ সম্পন্ন হলো। দেনমোহর করা হলো মাত্র বিশ হাজার টাকা, যা রফিক বাসর রাতেই লিমাকে পরিশোধ করে দিলো। এর ছ’মাস পরে দেশের নাম করা একটি কোম্পানিতে রফিকের চাকরি হয়ে গেলো। এখন রফিক ও লিমার সংসার খুব ভালো ভাবেই চলছে। ধার্মীক ছেলে পেয়ে লিমা যেমন খুশি, লিমার মত ভালো, নম্র -ভদ্র মেয়েকে পেয়ে রফিকের পরিবারের সদস্যরাও খুবই আনন্দিত।