মাফিয়া

মাফিয়া

মেয়েটা দেখতে ঠিক তার মায়ের মতো হয়েছে আমার খেয়াল রাখার কোনো কমতি নেই যে বাবা তার কাছে তার পৃথিবী তার যে এক ভয়ংকর অতীত আছে সেটা তো আর রাইসা জানে না।

আমার এখন ও মনে আছে আমার বয়স যখন সাত আমার মা বাবা দুইজনকে একটা রোড এক্সিডেন্ট এ একসাথে হারাই।। সব হারিয়ে সেদিন পাথর হয়ে যাই আশ্রয় নেই চাচার বাসায়।কিন্তু সেখানে পেয়েছি অমানুষিক নির্যাতন। আর বদলে আমার চাচা হাতিয়ে নিয়েছিলো সব সম্পদ আমার বয়স যখন সতেরো আমাকে চাচার বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় সারাদিন রাস্তায় ঘুরেও এক দানা আহার জুটাতে পারি নি এভাবে ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ি রাস্তায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠি।।

একজন যুবক বয়স ২৪ কি ২৫ হবে আমাকে বললো – তোমাকে দেখে তো ভালো ঘরের মনে হয় কিন্তু রাস্তায় কেন আমি বললাম আমাকে আগে কিছু খেতে দিন তারপর না হয় সব বলবো। উনি বলল আমার বাড়িতে চলো। উনার বাড়িতে গিয়ে আমি অবাক বিশাল বড় বাড়ি। তারপর আমাকে খেতে দিল আমি খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিয়ে উনাকে সব বললাম তারপর উনি বললেন আমি চাইলে আমার ও বাড়ি গাড়ি সব হবে শুধু আমাকে উনার সাথে কাজ করতে আমি ও রাজি হয়ে গেলাম কি কাজ সেটা আর জানতে চাই নাই।

পরের দিন উনি আমাকে উনার সাথে নিয়ে গেলেন। উনার নাম সেলিম। সেলিম ভাই বলে ই ডাকলাম। সেলিম ভাইয়ের কর্মস্থলে যাওয়ার পর জানলাম আমার কাজ বেশি কিছুনা খুন খারাপি করা, মারামারি করা, আর ড্রাগ এর চালান দেওয়া আমার তো কেউ নেই কিছু হারানোর ভয় নেই চাচা চাচির অত্যাচার থেকে অনেক ভালো এই কাজ। আমি সেলিম ভাইয়ের সাথেই থাকা শুরু করলাম।। সেলিম ভাইকে এলাকার মানুষ এক নাম এ চিনতো আর যমের মতো ভয় পেতো বেশ কিছুদিনের মধ্যে আমিও সেলিম ভাইয়ের মতো হয়ে যাই। পাথর হৃদয়টা আরও বেশি পাথর হয়ে যায়

মারামারি খুন করার সময় বিন্দুমাত্র বুক কাপতো না।সবাই আমাকে ও একনামে চিনতো রাহাত ভাই নামে এভাবে কেটে যায় কয়েকটা বছর একদিন রাস্তায় বসে সিগারেট টানছিলাম রাস্তায় কয়েকজন মেয়ে যাচ্ছিলো এর মধ্যে একজন এর মধ্যে আমার চোখ আটকে যায়। যার চোখে মুখে ছিলো হাসির ছোঁয়া আর এতোটাই চঞ্চল যে সামনের রাস্তা ও দেখছেনা আর এতোটাই হাসছে তার হাসি গুলো এতোটা বছর পর ও এখনও আমার কানে ঝর্নার জলের মতো শব্দ করছে। আমার পাথর হৃদয়টায় সেদিন প্রথম ধাক্কা অনুভব করি হ্যা তার নাম ছিলো রাহিকা সেদিন খবর নিয়ে জানতে পারি কলেজে পড়ে। সেদিন থেকে তার কলেজের সামনে আমার শুরু হয় অপেক্ষা করা। সে অপেক্ষা ছিলো শুধু তার হাসিমাখা মুখটা দেখার কিন্তু কথা বলার সাহস খুঁজে পেতাম না। একদিন সাহস করে কথা বলতে যাই সে আমাকে দেখে দেয় দৌড়। কথা বলাতো দুরের কথা,,,,,

দেখতে খারাপ ছিলাম না।মানুষ হিসেবে অনেক খারাপ ছিলাম যখন সে বুঝতে পারে আমি তাকে ফলো করি এরপর থেকে সে আমাকে দেখলেই ভয়ে পালাতো বুঝতে পারলাম মেয়েটিকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি তাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। ভাবি নি এই পাথর হৃদয় এর মানুষ টি ও কাউকে ভালোবাসবে একদিন খবর আসে রাহিকার নাকি বিয়ে সেদিন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারি নি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে রাহিকা কে জোর করে তুলে আনি শুধু এতোটুকু ই নয় তার মা বাবাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাহিকাকে বিয়েও করে ফেলি।।

বিয়ে শেষে রাহিকাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি কিন্তু আমার বিবেকবোধ জেগে উঠলো এতো বছরে প্রথম,,,, যে আমি কাজটা ঠিক করি নাই রাহিকার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তাই লজ্জায় রাহিকার সামনে ও যেতে পারছি না রাহিকাকে একা রুমে রেখে আমি বারান্দায় বসে সিগারেট শেষ করছি একটার পর একটা। তখন রাত বারোটা অনুভব করছি পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে পিছন ফিরে দেখি রাহিকা

-আপনি এতো সিগারেট টানতেছেন কেন?? এই প্রথম রাহিকা আমার সাথে কথা বলল

– না মানে এমনেই,,,,আমি জানি রাহিকা আমি তোমার সাথে অনেক বেশি অন্যায় করে ফেলেছি,,,কিন্তু তোমার বিয়ের কথা শুনে আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারিনাই আমি তোমাকে অন্য কারোর হয়ে দেখতে পারবো না তাই,,,,,

-দেখুন বিয়েটা কিভাবে হলো না হলো এখন ভেবে লাভ নাই। আমার আপনার স্ত্রী এটাই বড় সত্যি। আর জন্ম মৃত্যু বিয়ে এগুলা একবারই,, বারান্দায় বসে না থেকে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পরেন না হয় অসুস্থ হয়ে যাবেন,,,,আমার ও ঘুম আসছে গুড নাইট কথা গুলো বলে সে শুয়ে পড়ল রাহিকার সাথে আমি এত বড় অন্যায় করলাম আর সে সব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলো,,, এসব ভাবতে ভাবতে রাহিকার পাশে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা চোখে মুখে পানির ছিটায় ঘুম ভাঙলো

– এতোবেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়?? এবার হতে তাড়াতাড়ি উঠবেন আর আমার কাজে সাহায্য করবেন। আমি বাধ্য ছেলের মতো বললাম আচ্ছা

-এই নিন আপনার চা নাস্তাটা ও রাহিকা ই বানিয়েছিলো নাস্তা খেয়ে বের হয়ে পরলাম ফিরলাম রাত ১১ টায়।সেদিন অনেকগুলা ডিল ছিলো বাসায় ফিরতেই রাহিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল আর বলতে লাগলো- এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?আমার একা একা অনেক ভয় লাগে কাজের লোকেরা সবাই সন্ধ্যায় ই যে যার বাড়িতে চলে গেছে এতক্ষন পর্যন্ত আমার ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে,,,প্লিজ আমাকে আর এভাবে একা রেখে যাবেন না যে মেয়ে আমাকে ভয় পেতো সে মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভয় দূর করছে এটাই হয়তো নিয়তি,,,,,,

এরপর থেকে প্রতিদিনই সন্ধ্যার আগে কাজ শেষ করে বাসায় চলে আসতাম আমাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রী এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও রাহিকা আমার খাওয়া দাওয়া থেকে সব কিছুর অনেক খেয়াল রাখতো।দিনে দিনে মেয়েটাকে আরো অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলি। সে যেনো আমাকে শিখিয়ে দিলো কিভাবে ভালোবাসতে হয়।রাহিকা কে ছাড়া আমার প্রত্যেকটা মুহুর্ত অচল হয়ে পড়ে তবে রাহিকা আমাকে ভালোবাসতো কিনা সেটা জানতাম না রাহিকাকে আমার জীবনে র প্রত্যেকটা কথা বলে দেই।।। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙার পরর দেখি রাহিকা আমার পাশে নেই বুকের ভেতর যেন কেমনটা করে উঠে খুজে দেখি বারান্দায় একা একা চাঁদ দেখছে

_একা একাই চাঁদ দেখছো??
_আপনি ঘুমাচ্ছেন তাই আর জাগাই নি আপনার ও চাঁদ পছন্দ??
_নিজের ঘরে চাঁদ থাকতে আকাশের চাঁদ দেখতে যাবো কেন কথা গুলো বলতে বলতে রাহিকার কাছে যাই রাহিকাকে আমার আরো কাছে এনে বলি আচ্ছা রাহিকা তুমি আমাকে ভালোবাসো তো??

কথা গুলো বলে ওর ঠোঁটের কাছে এগুতেই সে নিজেকে ছাড়িয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে ভাবলাম হয়তো রাগ করেছে সকাল বেলা নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরার দেখি রাহিকা খুব সুন্দর করে সেজে বসে আছে অনেকটা নতুন বৌ এর মতো লাল শাড়ি সাথে মিলিয়ে গহনা পরেছে এর আগে কখন ও এমন সাজতে দেখি ভাবলাম গত রাতের জন্য হয়তো আমাকে ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যাবে বললাম – আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো??

প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই তুমি চলে গেলে আমি অনেক একা হয়ে যাবো কথা গুলো শেষ করার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁট দুটি সে নিজের অধীনে নিয়ে নিল কয়েক মুহুর্ত পর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো আমিও যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।অনেক বেশি ভালোবাসি সেদিন আমার নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হলো। আমি ও রাহিকা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম আমি ও তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি বলে কপালে ভালোবাসা একে দেই কিন্তু ঠোঁটের দিকে যেতেই বললো আমার ঠোঁট স্পর্শ করার আগে সিগারেট ছাড়তে হবে সেদিন রাহিকাকে ওয়াদা করার পর আজৌ অবধি কখনো সিগারেটের দিকে ফিরে তাকাই নি তারপর ঠোঁট কেন রাহিকাকেই আমার করে নিলাম এভাবে একটু একটু করে রাহিকা আমাকে বদলে দিতে শুরু করে।

আমি নামাজ পড়া শুরু করে দেই মারামারি খুন বন্ধ করে দেই কিন্তু সেই সতেরো বছরে যে মাফিয়া র সাথে কাজ শুরু করি তা ছাড়তে পারিনি একদিন রাতে রাহিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলে আমি বাবা হতে যাচ্ছি আমি খুশিতে কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম শুধু রাহিকার কপালে চুমু দিয়ে বললাম আজ তুমি যা চাও তাই পাবা সেদিন রাহিকা বললো আমি নিজের জন্য কিছু চাইনা শুধু আমার সন্তান এর জন্য আদর্শ বাবা চাই আমি চাইনা আমার সন্তান জানুক তার বাবা মাফিয়া কলোনির কেউ।।।তুমি এসব ছেড়ে দাও।।। আমি চুপ ছিলাম কারন কাজটা এতো সহজ না দশ বছর যে মাফিয়ার যুক্ত তা একদিনে কিভাবে ছাড়বো পরের দিন সেলিম ভাইকে সব বলি কিন্তু আমাকে দিয়ে উনাদের অনেক লাভ হওয়ায় আমাকে কোনোভাবে ছাড়বেনা।

উনাকে ভাবে বুঝাই কিন্তু বুঝেই না বললো তোর দুইদিনের বউ এর জন্য তুই আমাদের ছাড়বি এমন মেয়ে রাস্তায় অনেক পাবি রাহিকাকে এটা বলার আর নিজের কন্ট্রোল এ ছিলাম উনার মাথায় চেয়ার ছুড়ে সব শেষ করে চলে আসি আর বাড়িতে এসে প্লেন করি রাহিকার ডেলিভারি শেষে এই শহর ছেড়ে চলে যাবো আমাদের সন্তানকে নিয়ে,, নয় মাস পর রাহিকার ডেলিভারি পেইন উঠলো আমাদের কোল জুড়ে আসলো একটি মেয়ে রাইসা রাহিকা সুস্থ হওয়ার পর আমরা শহর ছাড়ার উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হলাম কিন্তু গেইট এর সামনে দেখলাম সেলিম ভাই আর তার লোকজন সেলিম ভাই বলল – তুই এই মেয়ের জন্য আমাদের ছাড়লি?? তোর সামনে ই তোর বউকে শেষ করছি বলেই গুলি মারলো রাহিকার বুকে। রাইসা আমার কোলে ছিলো রাহিকা সেখানে ই ঢুলে পড়ে।।মনে হয়েছিল আমার ভিতর থেকে হৃদপিন্ড টা বুঝি কেউ বের করে নিলো রাহিকার শেষ কথা ছিলো আমার মেয়ের খেয়াল রেখো।।।

রাইসা কে নিচে রেখে একাই সবার সাথে লড়াই করে গেলাম সেলিম ভাইকে আমার নিজের হাতেই শেষ করলাম তারপর রাইসাকে নিয়ে সেখান থেকে অনেক দূরে চলে আসলাম হয়তো সেদিন সেলিম ভাই আমাকে শেষ না করতে পারলেও আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলতাম রাহিকার সাথে সাথে। কিন্তু আজ ও বেচে আছি রাইসার দিকে তাকিয়ে। রাইসাকে ডাক্তার বানিয়েছি একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়েও দিয়েছি আমি রাইসার সাথেই থাকি। কারন আমাকে তো দেখার কেউ নেই অনেক ইচ্ছে ছিলো রাহিকার হাতে হাত রেখে গল্প করতে করতে বৃদ্ধ বয়স টা কাটিয়ে দিবো কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না।।।এখন শুধু রাহিকার কাছে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি সে যে অনেক বছর ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে ন ফেরার দেশে।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত