বিছানায় একপাশে সন্ধ্যা আলুথালু হয়ে ঘুমুচ্ছে। বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল সরে গেছে, সেদিকে চোখ আটকে যেতে চাইলেও জোর করে সরিয়ে নিলাম। অনেকদিন হলো লেখালিখি করি না। ঘুম আসছেনা, এপাশ ওপাশ করে মনস্থির করে উঠেই পড়লাম। হাতড়ে হাতড়ে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ অন করে দিলাম। এখন শুধু লেখালেখির নেশায় বুঁদ হয়ে যেতে চাই, আর কোনকিছুর নয়। টেবিল ল্যাম্পের হলদে আলোয় দেওয়ালে আমার ছায়ার নড়নচড়নে নিজেই একটু কেঁপে উঠলাম। এমন ভয় সবসময় লাগে না।
সন্ধ্যা বড্ড ভিতু ধরণের। তার ধারণা রাতে ঘুমোনোর আগে জানালা আটকে পর্দা টেনে না দিলে জানালার লাগোয়া ওপাশে যে পেয়ারাগাছটা ডালপালা মেলে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে, তার সেই ডালপালা বেয়ে কোন মাথাবিহীন মানুষ ওর সঙ্গে মোলাকাত করতে আসবে। পাগল আর কাকে বলে? মায়া মায়া চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও পারি না, রাতে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, বাতাস চলাচলের রাস্তা থাকতে হবে তো!
ঘড়ি দেখলাম, রাত তিনটের ঘর ছুঁইছুঁই কাঁটা। আমি জানি আমি আমার গল্পের খাতাটা টেনে নিলেই কাল্পনিক চরিত্রগুলো বাস্তবে উপদ্রব শুরু করে দেবে। তবুও আজ কোত্থেকে যেন অনেকখানি সাহস ভর করেছে বুকে। আমি বিছানা হতে নেমে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছিমাত্র, এর মধ্যেই কুদ্দুস আর তার মৃত পরিবার রান্নাঘরে উপদ্রব শুরু করে দিয়েছে। ট্যাপ ছেড়ে হাত ধোওয়ার শব্দ, আবার ট্যাপ বন্ধের শব্দ,। তরকারির পাতিলের ঢাকনা বসানোর শব্দ, কত কি! প্রায় মাস দশেক আগে একখানা উপন্যাস ছেপেছিলাম। মোটামুটি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল বটে। কিন্তু উপন্যাসের মূল চরিত্র কুদ্দুস মিয়াকে কেন আমি উপন্যাসে পানিতে ডুবিয়ে না মেরে ট্রাকচাপায় মারলাম তা নিয়ে রোজ রাতে আমার বিছানার পাশে এসে সে যখন ঘ্যানঘ্যান করা শুরু করতো আমি প্রথম প্রথম বেশ ভয়ই পেতাম। তার এককথা, পানিতে ডুবিয়ে মারলে নাকি সে শহীদের দরজা পেত! ডানপাশে আওয়াজ পেয়ে কিছুটা চমকে উঠলাম। কুদ্দুস মিয়ার মৃতা মা কি রান্নাঘরের উপদ্রবে কাজ না হওয়ায় আমার পাশেই হাজির হলেন?
নাহ, সন্ধ্যা। পাশ ফিরেছে। পিঠের নিচে ব্লাউজের ফিতা চাপমুক্ত হয়ে পিঠের ওপর থেকে সামান্য সরে গিয়েছে। সেখানে চামড়ার ওপর একটানা অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার লালচে দাগ। পাশ ফেরার খচরমচরে এমন চমকে উঠার কী হলো? ভূতেরাই যখন তাদের কাল্পনিক মৃত্যু আরো ভালো করে দেইনি বলে আক্ষেপ আফসোস করে একশেষ, তখন আর ভয় পাওয়ার কি কিছু থাকে?
কপাল ভালো বলতে হবে, কুদ্দুস মিয়া ও তার মৃত পরিবার কিংবা কাল্পনিক সময় ভ্রমণকারী সিয়ামের আমার সাথে সাক্ষাতের বিষয়টা সন্ধ্যা টের পায় না। পেলে আর দেখতে হতো না। আমাকে এই বাসাটা ছাড়তে বাধ্য করতো। বাসাটা আমার ভালোই লাগে, নিজের বাসা বলে কথা! বাবা প্লট কিনে দিয়ে গেছেন। তাঁর ছিল এক কথা-
‘ঢাকা শহরে বাবার কাছ থেকে একচিলতে জমি পেয়েছো, লাখো শুকরিয়া আদায় করো, নিজের হিম্মৎ থাকলে এখানে বড় বিশতলা এপার্টমেন্ট তুলবা নয়ত ছনের ঘর বানায়ে থাকবা।’
বাবা ট্রাক এক্সিডেন্টে আমার চোখের সামনে স্পট ডেড হন প্রায় বছর চারেক আগে। মা? আধপাগল হয়ে যান। কেবলই বাবার কোন স্মৃতি মনে করে ক্রমাগত কাঁদেন। এমতাবস্থায় অনেক ডাক্তার দেখিয়েও লাভ না হওয়ায় গ্রামে রেখে এসেছি। না, আমি কুপুত্র নই, সামর্থ্যেরও ব্যাপার আছে। আমার লেখালেখির যৎসামান্য আয়ে কোনরকমে সংসার তো চলে যায়। আর ফুডপান্ডা কিংবা উবার ইটসে পার্টটাইম খাটুনি। মাকে ঠিকমতো দেখে রাখা, ভালোমন্দ খাওয়ানো, সময় দেওয়া, এগুলো একেবারেই সম্ভব না। তিনি বরং ওখানেই ভালো আছেন। দু হপ্তায় একবার দেখতে যাই মাকে। আমাকে দেখলেই বলবেন, “আজকে তোর বাবা বলল আমার কাচকি মাছে নাকি লবণ কম হয়েছে। এটা কি ঠিক খোকা বল দেখি? তুই খেয়ে দেখ্ তো, আয়” আমি সাবধানে অশ্রু আড়াল করি।
“সাহেব”
“কুদ্দুস মিয়া এসেছো?”
“না আমি কবির। উনার ছাওয়াল”
“ওহ কবির, তা কি খবর? আজকে কী মনে করে এলি?”
“সাহেব আপনে কতোদিন লেখেন না কন দেখি? আপনে লেখতে বইলে আমরা আপনের লগে একটু দেখাসাক্ষাৎ করি, ভাই বেরাদর মানুষ আপনে। আপনিও লেখেন না, কথাও কইতে পারি না, আমগো সকলের মন টন বিষ হইয়া থাকে” “আহারে হ্যাঁ, তোমাদের কথা মনে পড়লো বলে লিখতে বসলাম। কিন্তু কী লিখব তা-ই তো ভাবলাম না” “সাহেব, আপনার লিখতে পেরা নেওন লাগে? বিসমিল্লা বইলা একটা লাইন দিয়া শুরু করেন।”
আমি কিছু বলার আগেই বেডরুমের দরজার পর্দাটা কেঁপে উঠল। হিমশীতল কিন্তু ত্বরিত একটা বাতাসের ঝটকা পর্দাটাকে নাড়িয়ে দিল আর নতুন কণ্ঠ কানে এলো। “কবিরইয়া! তুই বেশি পডর পডর করোস। দাদা আপনে লেখেন। কী লেখবেন? গল্প না কবিতা? গল্প লেখেন, গল্প আপনার হাতে ভালো আসে। শরীল ভালা?” “হুমম কুদ্দুস তোমাদের কী খবর?” “চলে দাদা। আম্মমাজানের বাতের ব্যথা বাড়সে। বটগাছের ডাইলে ঘুমায়। আজকে এতোদিন পর আপনে লেখতে বইলেন, আম্মমাজান আইতে পারতেসে না। আম্মাজান আপনেরে খুব ভালো পায়। কথা কইতে মন চায় আপনার লগে। আপনে লেখেন না ক্যান?” “এমনি অলস লাগে আরকি।”
“দাদা আইলসামি খুবই খারাপ। আপনেই তো গল্পে আমারে আইলসা বানাইছিলেন। একবার ডাকাতিতে বড় দাঁও মাইরা আমি মদ, জুয়া নিয়া আর বেশ্যাপাড়ায় পইড়া থাকতাম টাকা শেষ হওনের আগ পর্যন্ত। আবার ডাকাতি করাইতেন। হুদাই আমারে ধরা খাওয়াইয়া ফাঁসি খাওয়াইলেন গল্পে। তাও আপনেরে দোষ দিয়াম না। লেখকদের মর্যাদা আলাদা। আমি আপনের সৃষ্টি হইয়া কেমনে আপনেরে দোষারোপ করি কন।” “হুমম। আচ্ছা আজকে কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছে। কী নিয়ে লিখবো বলো দেখি?”, বলতে বলতে আমার চোখ পড়লো সন্ধ্যার দিকে। ওর পেটিকোট হাঁটুর ওপর উঠে আছে আর এদিকে রুমভর্তি মানুষ(?) কিন্তু এখন ওকে পেটিকোট ঠিক করতে বললেই বরং এরা ওর দিকে বেশি নজর দেবে। এখন তো মনোযোগ আমার দিকে। তাই চুপ করে গেলাম।
“কবিতা? যাই কন দাদা আজাইরা কবিতা লেইখেন না। আইজকাল কীসব কবিতা দেখি কুনো ছন্দ নাই কিসু নাই। হুদাই ভ্যারভ্যার কইরা একটু ভং কইরা বাক্য আওড়াইয়া যায় বলদ কবিগুলা। আপনে ওরকম লেইখেন না”
“সত্যি বলতে কুদ্দুস, আমারও অমন ভালো লাগে না। আমি ছন্দ মিলিয়েই লেখার চেষ্টা করবো। তুমি বলো কী নিয়ে লিখব?” “আপনের বিবিরে নিয়া লেখেন” “সন্ধ্যাকে নিয়ে? আচ্ছা দাঁড়াও ভাবি” আমি খাতায় লিখলাম- ‘সাঁঝের আলোআঁধারির মায়ায় তুমি দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা..’ তারপরের লাইন কী দেওয়া যায়? সন্ধ্যার সাথে মেলে এমন শব্দ কী দেওয়া যায়? অন্ধ, বন্ধ্যা, মন্দা, স্কন্ধ কোনটা দিয়েই বাক্য আসছে না মাথায়।
“দাদা, আটকাইলেন যে?”
“কী লিখব ভাবছি”
“তুমি আমার স্ত্রী হয়েছো বন্ধ্যা- এইডা লেখেন দাদা”
আমি কিছুটা রাগ নিয়ে তাকালাম। কুদ্দুস চুপসে গেল। দিল গাধাটা আমার মনটা খারাপ করে। হ্যাঁ, আমার স্ত্রী বন্ধ্যা বটে। কিন্তু আমায় ভালোবাসতে কোন কমতি রাখে নি। স্রষ্টা কাউকে একেবারে নিঃস্ব করে দেন না। আমাকে যেমন পিতৃহারা, মাতৃহারা, বাবা হতে অসমর্থ করেও স্ত্রীর ভালোবাসায় টইটম্বুর করে দিয়েছেন। “দাদা রাগ করলেন?” আমি চুপ করে রইলাম। কবিতা লেখার জেদ চেপে গেছে। খাতায় আগের লাইনটা কেটে লিখলাম- সন্ধ্যার আলোছায়ায় আমার জীবনের গল্প ভালোবাসা নাহি সেথা কোনখানি অল্প পাখিরা নীড়ে ফেরে তোমার আগমনে তোমাতে ফিরিয়ে নাও মোরে একান্ত যতনে বুকে সেঁটে কিছু কথা বলি সংগোপনে প্রিয়- আপন করে রেখো তব চিরপথচলাতে রাখব ধরে হাতখানি পদাঙ্ক মেলাতে।
এক নাগাড়ে লিখে কলম নামিয়ে রাখলাম। ঘেমে গিয়েছি। অক্টোবর মাসের শেষ। হাল্কা হাল্কা শীত সারারাতজুড়ে বেড়ে বেড়ে ভোররাতে ভালোই শীত করে। ঘামগুলো নিমেষেই ঠাণ্ডা হিম হয়ে গায়ে সাথে জামা লেপ্টে দিতে লাগলো বারবার। “কুদ্দুস” সাড়াশব্দ পেলাম না। আজানের শব্দ শোনার চেষ্টা করলাম কান পেতে। নাহ, আজানও তো দিচ্ছে না। গেল কোথায় সব? “তুমি এখনো ঘুমাও নি, রুদ্র?” সন্ধ্যার কণ্ঠে আমি চমকে উঠে বুকে ফুঁ দিলাম। “বাপরে এভাবে হঠাৎ করে কেউ বলে? আরেকটু হলে তো ভয়ে চেয়ার থেকে পড়েই যেতাম” মুচকি হাসলো সন্ধ্যা। হাসিটা ধরে রেখেই বলল, “এসো শুতে এসো। শীত করে না তোমার? আমার তো শীতেই ঘুম ভেঙে গেল, কাঁথা গায়ে দিবো, আসো তুমিও আসো।”
আমি বাধ্য ছেলের মতো উঠলাম। খাতাটা ইচ্ছে করেই বন্ধ করলাম না, সন্ধ্যা সকালে উঠে দেখবে। হয়ত একচিলতে হাসি উঁকি দেবে ওর ঠোঁটের কোণে। সামান্য একটু হাসির কারণ হতে পারাও কি কম? সত্যি বলতে মানুষকে কাঁদানোর চেয়ে হাসানো ঢের শক্ত কাজ। সন্ধ্যা আমার মুখের ওপর পর্যন্ত কাঁথা টেনে দিতে গেলে আমি না করলাম। দম বন্ধ লাগে আমার। ও আমার ওপর দিয়ে ঝুঁকে টেবিল ল্যাম্প বন্ধ করতে গেল আর আমি দরজার দিকে তাকালাম। কুদ্দুস আর তার পরিবার দাঁড়িয়ে। বিদায় সম্ভাষণ নাকি? কুদ্দুসের বৃদ্ধা মা-ও আছেন। বাতের ব্যথা বোধহয় কমেছে মহিলার। দেরি না করে একনজর দেখতে চলে এসেছেন আমাকে। আমি বুঝে উঠতে পারি না কেন এরা আমার কাছে পড়ে রয়েছে? অবশ্য জীবনের সব ‘কেন’র উত্তর হয় না।