“দবির শয়তানটা কথা শুনেনা একদম। সন্ধ্যের আগে ঘরে আসতে বলি, সে লাটসাহেব রাতের আঁধার হলেই বেড়া ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে চোরের মতোন। ঘরে ঢুকবেনা ভয়ে।
এতোই যদি ভয় পাস, তবে প্রতিদিন রুটিন করে দেরি করিস কেনো বেয়াদব?
ঘরের এতোগুলো কাজ করবে কে শুনি! কল থেকে পানি আনা, পুকুর থেকে বালতি ভরে বাথরুমে রাখা। রাতে খাবার পর প্লেট ধোবার জন্যও পানি আনতে হবে। রাতে তো আর পুকুর গিয়ে ডেকচি পাতিল, প্লেট ধোয়া যায়না।
কারেন্ট চলে গেলে যদি দেখি কেরোসিন নাই, তবে আনবেটা কে শুনি?
অন্ধকারে বসে থেকে থেকে মশার কামড় খাও….আরে, মশার কয়েলও তো শেষ মনে হয়! মশারি পেতে বসে থাকবো নাকি শয়তান ছেলে!
তোর ফুটবল খেলা আমি ছুটাবো, আজ আয় তুই ঘরে!
তোর সুন্দর মুখ দেখার জন্যই কি তোকে ঘরে জায়গা দিয়েছি?
দুইবেলা পেটপুরে ভাত, দুইবেলা নাস্তা খেতে ভুল হয়না তোমার। ,
খেলতে গেলে কাজের কথা ভুলে যাও!
গেলো তো এইবার কারেন্ট!”
এতোক্ষণ এইসব কথা চুলায় লাকড়ি দিতে দিতে নিজে নিজে প্যানপ্যান করছিলেন বিরক্ত জমিলা।
কাজের ছেলে দবির যে কোনো কাজের নয়, তাতে সে ভীষণ রকম বিরক্ত।
-ভাবী, কেরোসিন আনার টাকা দেন, নিয়ে আসি।
জমিলা’র পেছন থেকে দবির বলে উঠে।
-আপনি কোত্থেকে উদয় হলেন দবির সাহেব? ঘর যে একটা আছে তা কি পেটে টান না পড়লে আপনার মনে পড়েনা? আপনি আজ বাইরেই থাকেন, কেরোসিন আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।
-আপনি কিভাবে যাবেন, আপনি তো মেয়ে মানুষ!
-অ হ্যাঁ, আমি তো মেয়ে মানুষ! তা আপনি পুরুষ মানুষ বলেই বাইরে থাকেন?
চুপ থাকে কিছুক্ষণ সে।
-সবাই আসতে দিচ্ছিলো না, আমি চলে এলে গোল কিভাবে হতো?
-জ্বি খেলোয়াড় সাহেব, আপনি তো বিরাট খেলোয়াড়! তা কয়টা গোল দিলেন?
-তিন ম্যাচে আমি একলা দিয়েছি পাঁচটা।
-খুব ভালো করেছিস।
যা, আগে বালতি নিয়ে পুকুর থেকে পানি তুলে আন, মুখ হাতও ধুয়ে আসিস। সাথে ল্যাম্প নিয়ে যা। অন্ধকারে পড়ে যাবি।
-ল্যাম্প লাগবেনা।
-কেনো, বিড়াল হয়ে গেছিস, অন্ধকারে সব দেখিস? আছাড় খেয়ে পা কোমর ভাঙলে বুঝবি, তখন আর খেলতে পারবিনা সারাজীবন। আর শোন,
আর কোনোদিন দেরি করবি তো ঘরের দরজা তোর জন্য বন্ধ, মনে থাকে যেন।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। কাল থেকে দেরি করবোনা।
আগে দোকানে যেতে হবেনা ভাবী?
-না, কাল সকালে গেলে হবে। যা আছে তাতে রাত পার হবে।
-আচ্ছা।
দবির কলসি বালতি সব ভরে রাখে।
-ভাবী খিদে লাগছে, ভাত দিবেন?
-খিদে তো লাগবে, অনেক মিন্নত(কষ্ট) করে আসছেন যে। ফুটবল খেলছেন চারঘন্টা! তা ওরা খাবার দেয়নি?
সে চুপ।
-ভাত খাবি কেমনে? তরকারি হয়েছে, গরম ভাত তো এখনো হয়নি।
-দুপুরের টা নাই?
-আছে, তক্তা নিয়ে বয়।
-ভাবী, তরকারি গরম, ভাত গরম করা লাগবেনা।
-খিদেয় তর সইছেনা তোর, তাই বল।
তা বিকেলের নাস্তা করতে আসিসনি কেনো? আটকাবো, তাই না?
-হুম।
-তাইলে আমার কি! তুই কষ্ট পাচ্ছিস।
তোর কাছে তো সবার উপরে খেলা। বলবো নাকি আবার তোর ভাইজানকে?
-না ভাবী, কাল থেকে আর দেরি হবেনা।
-আচ্ছা, বলবো না, মনে থাকে যেন।
জমিলা এমনিতেই ভয় দেখায়, সে আর কখনোই বলবেনা।
একবার স্বামী ফরিদকে দবিরের কাজ চুরি আর খেলা পাগলের কথা বলায়, খুব মার মেরেছিল সেই বার।
দবিরের তাতে শিক্ষা না হলেও জমিলার খুব শিক্ষা হয়েছে।
মারের ছোটে সারারাত জ্বরে ভুলবাল বকেছিলো দবির।
জমিলা, ফরিদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে, অর্ধরাতে উঠে দবিরের মাথায় পানি ঢেলে দেয়। দুধ পাউরুটি, ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তারপর সে ঘুমুতে যায়।
মাত্র পনের বছর বয়সী কিশোর সে, খেলা পাগল তো হবেই।
অনেক চেষ্টা করেও জমিলা তাকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি। স্কুলের নাম করে বাগিচায় বসে থেকেছে, পলিথিন প্যাঁচিয়ে বল বানিয়ে খেলেছে। ধরা খাওয়ার পর, ফরিদ আর স্কুলে যেতে না করে দিয়েছেন।
“ওর মা স্কুলে পাঠাতে পারেনি নাকি কোনোদিন, তোমার অতো দরদ কেনো? ”
জমিলাকে বলেন সে।
ছয় বছর আগে জমিলা এই ঘরে ফরিদের বউ হয়ে আসে। আর পাঁচ বছর আগে দবিরের বাপ মরলে, তার মা পাঁচ ছেলে মেয়ের বড় সংসার একা সামলাতে না পেরে, দশ বছরের দবিরকে টুকটাক কাজ করতে ওদের ঘরে দিয়ে যায়।
দবিরের মাকে মাসে মাসে কিছু টাকাও দেয় ফরিদ।
দবির তখনো স্কুল যেতে পছন্দ করতোনা।
এখানে জমিলাও কম চেষ্টা করেনি।
এই ছয় বছরে জমিলার কোলে পাঁঁচবছরের একটা মেয়ে মিনুই এসেছে শুধু।
একটা ছেলের জন্য কতো চেষ্টা করছে জমিলা আর ফরিদ। কিন্তু জমিলার পেটে আর বাচ্চা নাই মনে হয়। নইলে পাঁঁচবছর কি কম সময়?
শ্বাশুড়ি, পাড়ার মানুষ তো জমিলাকে এখন কাক বন্ধ্যা বলেই ডাকে। জমিলাও চায়, একটা ছেলে আসুক। তার বদনাম ঘুচোক। সে তো আর বন্ধ্যা নয়!
তাই এতো বকা দিলে, চিল্লালেও দবিরের জন্য খুব মায়া জমিলার। দবিরকে দিয়েই তার ছেলের স্বাদ মিটায়। দুধের স্বাদ ঘুলে মিটানোর মতো।
-আরেকটু ভাত নিবি?
-না, পেট ভরে গেছে।
-আচ্ছা, তুই তো বড় হয়ে যাচ্ছিস। কি করবি বড় হয়ে?
-খেলোয়াড় হবো ভাবি।
-মূর্খ খেলোয়াড়?
-খেলোয়াড় হলে কেউ আর মূর্খ বলবেনা।
-তাই নাকি! বিদেশ নিয়ে গেলে তুই ইংরেজিতে কথা বলতে পারবি?
আচ্ছা, বিদেশ বাদ। শহরে গেলেও তো তুই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারবিনা, লজ্জা লাগবেনা তোর?
-ভাবী, আপনি শুদ্ধ ভাষা আর ইংরেজি পারেন?
-কিছু কিছু পারি।
-আমায় শিখিয়ে দেবেন, তাহলেই হলো।
-ধুর পাগল, আমার থেকে শিখে কাজ হবেনা। তোর স্কুল থেকে শিখতে হবে। সার্টিফিকেট পাবি, তবেই তোর পড়া শক্ত হবে, নাম হবে।
-কিন্তু আমি তো বড় হয়ে গেছি। পড়ালেখা আর করবো কিভাবে?
-পড়ালেখায় বয়স কোনো ব্যাপার না।
-তুই তো ত্রি পর্যন্ত পড়েছিস। তোর ভাইকে বলে ফাইভে নাম লিখিয়ে দেবো কিনা বল, এখনো সময় আছে।
-কিন্তু আমি তো অনেক কিছু ভুলে গেছি।
-আমি তোকে ঘরে পড়াবো, স্কুলে তো মাস্টার আছেই। কি বলিস?
-ভাবী, লজ্জা করে, ক্লাসে আমি সবার বড় হবো!
-ঠিক আছে, তবে তোর আর খেলোয়াড় হওয়া লাগবেনা। দুই তিনবছর পর তুই বড় হয়ে যাবি। তখন, তোকে তোদের ঘর পাঠিয়ে দিবে তোর ভাই। আর তোর মা তোকে কোনো গ্যারেজে বা চায়ের দোকানে কাজ করতে ঢুকিয়ে দিবে। তখন তুই কি করবি?
এখন কিছু না হয় পড়ালেখা কর। স্কুলে যা, খেলে মাস্টারদের চোখে পড়, তারপর ভালো খেল্লে কারো চোখে পড়লে তুই কোনো সুযোগ পেতেও পারিস। সবাই তো বলে, তুই অনেক ভালো খেলিস।
-আমি স্কুল গেলে ঘরের কাজ কে করবে?
-তুই কিছু স্কুল যাবার আগে করলি, কিছু এসে করলি। কাজও হলো, স্কুলও, আবার বিকেলে খেলতেও পারবি।
-কালই আমাকে স্কুল ভর্তি করিয়ে দিন ভাবী।
-ঠিক আছে, আমি তোর ভাইকে বলবো। তবে এবারো বাগিচায় বসে থাকলে তোর সাথে সাথে আমিও অনেক বকা খাবোরে, মনে রাখিস।
-না ভাবী, এবার মন দিয়ে পড়বো, আমাকে খেলোয়াড় হতেই হবে। আর এখন বড় হয়েছি না!
-আচ্ছা তাহলে বড় হয়েছিস!? তবে আমার এতো বকা খাস, লজ্জা করেনা কেনো তোর?
-আপনার বকা খেতে ভালো লাগে।
-তাই নাকি বান্দর?
-হুম, আপনি বকা দিলেও তো অনেক ভালোবাসেন।
-যা যা অনেক হয়েছে, এবার দেখ তোর ভাই ঘরে এলো কিনা। এলে ভাত বাড়বো কিনা জিজ্ঞেস কর।
-আচ্ছা।
-মিনু আর তার দাদি কি করে দেখ। আওয়াজ শব্দ শোনা যায় না। ঘুমিয়ে পড়লো নাকি মিনু? মশা তো এতোক্ষণে তার রক্ত খেয়ে নেয়ে উঠেছেরে।
তাড়াতাড়ি যা, একটু হলেও ভাত খাইয়ে দিতে পারি কিনা দেখি।
-ভাবী, কারেন্ট এসেছে! খুশিতে চিল্লানি দেয় দবির।
-এতো খুশি হবার কি আছেরে? ঘণ্টায় ঘণ্টায় তো যাচ্ছে আসছে। ঘরের সব ল্যাম্পের আলো কমিয়ে দে, একেবারে নিভিয়ে দিসনা।
-মিনু ঘুম। জ্যাঠাইমা ভাত বাড়তে বলছে। ভাই তো এখনো আসে নাই।
-ঠিক আছে। তোর জ্যাঠাইমা কে খেতে আসতে বল।
মানুষটা এতো দেরি করছে কেনো! চিন্তিত হয় জমিলা।
রাতে শুতে গিয়ে জমিলা ফরিদকে, দবিরের কথা বলে,
-শুনছেন, হেড মাস্টার কে বলে, দবিরকে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করে দেন না।
-কেনো?
-সে এখন পড়তে চায়।
-পড়বে না ছাই, কাজ কাম না করে, আরো বেশিক্ষণ খেলার ধান্দা।
-না, না সত্যিই পড়বে। কাজ সময়মত করে নেবে।
-তোমাকে বলেছে! এখন পড়ালেখা নাই, তাও যতো তালবাহানা করে। আর ছয়ঘণ্টা স্কুল করে, কাজ করবে সে! আমাকে শিখাচ্ছো?
-আমিই ওকে রাজি করিয়েছি, করে দেননা ভর্তি।
-ওর স্কুলে পড়ার কথা ভুলে যাও। একবার করিয়েছিলাম তো, বাগিচায় বসে থেকে ফুটবল আর মার্বেল খেলা খেলছে। ওর রক্তে পড়ালেখা নাই। অন্যের ছেলে নিয়ে অতো মাথা ঘামিয়ো নাতো জমিলা।
পারলে নিজের একটা আনো। তাকে ইচ্ছেমত পড়িয়ো। এবার আসো দেখি কাছে।
জমিলা অনিচ্ছায় ফরিদের বুকের ভেতর ঢুকে। তার মাথায় একটাই চিন্তা, কাল সকালে দবিরকে কি জবাব দিবে!