দুধের কৌটা

দুধের কৌটা

শীতের সকালে গায়ে লেপ জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মাহিম। শুক্রবার হওয়াতে বিশাল সুবিধা ; হুজুরের কাছে যেতে হবে না। সকাল সকাল হাফিজ উল্যা মুন্সির কাছে পড়তে যাওয়া বিশাল দিগদারী। পড়া না পারলে পালা চেঙ্গি কিংবা কুম্ভা চেঙ্গি নিশ্চিত। অবশ্য কান ধরে উঠবস করা ও মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মাহিমের পেটে সামান্য মোচড় দিয়েছে; তার খিদে পেয়েছে। আরো একটা সমস্যা হলো তার শুশু পেয়েছে। তলপেট ভারী হয়ে আছে কিন্তু শীতের ভয়ে উঠতে পারছে না। সব চিন্তা বাদ দিতে হলো। তার মা এসে তাগাদা দিতে লাগল, ‘ মাইন্না উঠ, দাঁত মাজি ল, নাইক্কল, মুরি আর মিডাই দিছি। তুই আর আসমা বসি বসি খাইছ। বাইরে যাইছ না, যেই শীত হইডছে ঠান্ডা লাগি যাইবো’। মাহিম লেপ সরিয়ে উঠে বসল। আড়মোড়া ভেঙ্গে হাতে ছাই নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বাড়ির দরজার পুকুরে চলে গেল।

দুই ভাই বোন মনের আনন্দে নারকেল দিয়ে মুরি আর গুঁড় মাখিয়ে মুঠো মুঠো করে খেতে লাগল। শীতের দিনে মুরির সাথে গুঁড় আর নারকেল অতি সুস্বাদু খাবার। তাদের মা সাংসারিক কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাহিমরা দুই ভাই এক বোন। সবার বড় নুরিম আজ বাড়িতে নেই। নানার বাড়ি বেড়াতে গেছে। অবশ্য মাহিম বরাবরই বলে আসছে, ‘মাইক হড়া হাঁকি দিতো নানাগো বাড়িত গ্যাছে’।

কি এক বিচিত্র কারনে মাহিম তার বড় ভাই নুরিমকে কখনো মাইক কখনো খইল্লা বলে গালাগালি দেয়। এ নিয়ে নুরিমের কিঞ্চিৎ মন খারাপ। ছোট ভাই বড্ড বজ্জাতি করে। যার তার সামনে ইজ্জতের ফালুদা করে দিচ্ছে। তো আজ বড় ভাইকে ছাড়া ছোট দুই ভাই বোন আপন মনে মুরি খাচ্ছিল। মাহিমের বয়স আটের কাছাকাছি আর আসমা সবে দুই বছরে পড়েছে। মাহিমের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। মুরি রাখা ছিল মোটামুটি বড় সাইজের ডানো দুধের কৌটায়। মাহিম মুরি বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে কৌটা খালি করে ফেলল। এবার করল কি কৌটাটি আসমার মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিল। আবার বের করে আনল। আসমা খিল খিল করে হেসে দিল। দুজনেই বেশ মজা পেল।

মাহিম বলতে লাগল, ‘ আয় আন্ডা দুনুগা পলাপলি খেলি’। আসমা ভাইয়ের কথায় সায় দিল, ‘ আইচ্ছা ছুট্টি ভাই’। মাহিম ছড়া আওরাতে লাগল, ‘ আমি যা দেখি তুমি তা দেখো নি’? আসমা জবাব দিল, দেখি। মাহিম বলতে লাগল, ‘ তুমি কি দেখ’? আসমা দুই হাত শূন্যে তুলে খলবলিয়ে হেসে উঠল। আর ঠিক ঠিক বলে দিল সে মুরগা দেখেছে। এভাবে তাদের পলাপলি খেলা চলতে লাগল। প্রতিবারই মাহিম দুধের কৌটা দিয়ে আসমার মুখ ঢেকে দেয় আর এক একটা জিনিসের নাম জিজ্ঞেস করে। দুজনের পলাপলি খেলার মাঝখানে মাহিম আবিষ্কার করে কোন এক বিচিত্র কারনে কৌটাটি আসমার মাথা থেকে খুলছে না। মাহিম বেশ কয়েকবার টানাটানি করেও খুলতে পারল না। আসমা ভয় পেয়ে গেছে, ‘ ছুট্টি ভাই দুক্কাই’ বলে চেঁচাতে লাগল। মাহিম নিজেও বেশ ঘাবড়ে গেছে।

সারা ঘর ভর্তি লোক, সবাই চেষ্টা করেও কৌটা আর বের করতে পারলো না। জোর করে টান দিতে পারছে না তাতে মেয়েটির থুতনিতে লেগে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রচন্ড ভয়ে সে কুঁকড়ে আছে। মাহিম ভয়ে তফুরীর মায়ের কোলে উঠে বসে আছে আর সমানে কাঁদছে। কান্নার দমকে তার বুক বারবার উঠানামা করছে। কান্নার এক পর্যায়ে সে তফুরীর মায়ের কোল থেকে নেমে দৌঁড় দিল। দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে ছেনি নিয়ে আসলো। সবাই হকচকিয়ে গেল। কি করতে যাচ্ছে মাহিম। কিন্তু না, সে আবার তফুরীর মায়ের কাছে ফিরে আসল।

ছেনি তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আকুল হয়ে সে বলতে লাগল, ‘ ভাজিগো আন্নে অ্যাঁরে কাডি হালান, আব্বা অ্যাঁরে মারি হালাইবো’। তফুরীর মা তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল, ‘ আল্লা আল্লা কর ভাই, আল্লা আল্লা কর’। মাহিমের বাপ সকালে চরে গিয়েছে এখনো ফিরে আসে নি। তার মা কোন কথা বলতে পারল না, বিলাপ করতে লাগল। শানুর জামাই সাইকেল ছুটিয়ে খলিফার বাড়ীর দিকে ছুটল, বড় কাঁচি আনার জন্য। তার মাথায় ঢুকেছে কাঁচি দিয়ে এক পাশ কেটে ফেললে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হবে, পরে আস্তে আস্তে পুরোটা কাটা যাবে। বিভিন্ন লোক বিভিন্ন মন্তব্য করতে লাগল। কেউ বলল দা দিয়ে কেটে ফেলতে, কেউ আবার হাতুড়ি বাটালের কথা ও বলল। কিন্তু আসলে ছোট একটি মেয়ের মাথায় আঘাত লাগতে পারে এই ভয়ে কেউই কোন কিছুই করলো না।

সময় গড়িয়ে যায়, লোকজনের ভিড় আরো বাড়তে থাকে। মেয়েটি আস্তে আস্তে নেতিয়ে যেতে থাকে। কাছাকাছি আত্মীয় স্বজন যারা ছিল খবর পেয়ে সবাই আসতে লাগল। নুরিম তার নানা বাড়ী সোনাপুর থেকে ফিরে এসেছে। সাথে তার নানা নানী আর মামীও এসেছে। তার বাবাকে চর থেকে হাফিজ গিয়ে ডেকে এনেছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল কিন্তু কেউই কৌটা আর খুলতে পারলো না। ছোট মেয়েটি হাত পা ছড়িয়ে দিল। খোকনের মায়ের কোলে মেয়েটি কৌটা সমেত শুয়ে পড়ল। সবাইকে শানুর জামাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। কাঁচি দিয়ে কাটা হবে এই আশা নিয়ে তারা বসে আছে। খোকনের বাপ মাইজদি নেয়ার প্রস্তাব করল। আসল কথা হলো এই কাঁচি দিয়ে এটা কাটা আদৌ সম্ভব নয়। আসমা ক্রমস আরো নেতিয়ে যেতে লাগল। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় সে পুরোপুরি কাহিল হয়ে পড়েছে।

আসমাকে মাইজদি নেয়ার জন্য রিকশা ডাকা হয়েছে। উত্তর বাড়ী থেকে রিকশা এসে ঘরের দরজায় দাঁড়াল। সবাই হায় হায় করে উঠল, ‘এই মাইয়া বুঝি আর বাঁচবো’ বলে কেউ কেউ হাহাকার করে উঠল। এত ভিড় আর লোকজনের শোরগোল শুনে উত্তর বাড়ীর মনোয়ারার জামাই এগিয়ে আসল। তিনি আজই শ্বশুর বাড়ী এসেছে। তিনি ভিড় ঠেলে রিকশার সামনে আসলেন। এক নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কোন কথা না বলে কৌটাটি দুই হাতের তালু দিয়ে কোনাকুনি চাপ দিলেন।

পেটানো শক্ত হাতের চাপে কৌটাটি একটু বেঁকে গেল। আস্তে করে টান দিতেই মাথা থেকে কৌটাটি বেরিয়ে আসল। একগুচ্ছ কোঁকড়ানো ছোট চুল বেরিয়ে আসল। আসমা পিটপিট করে তাকাতে লাগল। এই প্রথম সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সবাই আশ্চর্য হয়ে মনোয়ারার জামাইকে দেখতে লাগল। কিভাবে এই দুধের কৌটা মাথা থেকে বের করে আনল তা লোকজনের মাথায় ঢুকছে না। লোকজনের আরেক দফা আশ্চর্য হবার পালা তখনো অপেক্ষা করছে। ছোট্ট আসমা থপথপ করে দৌঁড়ে মাহিমের দিকে ছুটে গেল। ছুটে গিয়ে মাহিমকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, ‘ ছুট্টি ভাই, আমি যা দেকি তুমি তা দেকো নি’?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত