প্রতিশোধ

প্রতিশোধ

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। মা রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল-প্লাবন বাসায় হলুদগুঁড়ো নেই। বাজারে গিয়ে নিয়ে আয়’না বাবা।

–বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে কিভাবে জাব ?
-তাহলে এক কাজ কর,দোতলার ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে নিয়ে আয় ।

এমনিতেই দোতালার ভাড়াটিয়ার মেয়ে সোনালী সবসময় আমার সাথে লেগে থাকে। মনে হয়-যেন আমি টম আর ও জেরি। তাই ইদানিং দোতালায় এবং ছাদে আমার যেতে ইচ্ছে করেনা-তবু মায়ের জন্য বাধ্য হয়েই যেতে হয়। দোতালায় দরজার কলিংবেল চাপতেই সোনালী দরজা খুলে কোমরে দুহাত রেখে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় আমার আসার আগেই জ্বীন পরি ওকে খবর দিয়ে রেখেছে। আমাকে তাচ্ছিল্য করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলছে-কি চাই এখানে ?

–ইয়ে মানে-মা রান্না করতে গিয়ে দেখে হলুদগুঁড়ো নেই,বাইরেও প্রচুর বৃষ্টি-তাই আম্মু আমাকে এখানে পাঠালো। তোমাদের কাছে হলুদগুঁড়ো আছে ?
-হে আছে,আপনি এখানেই দাঁড়ান-আমি নিয়ে আসছি ।

রাগে আমার পুরো গা জ্বলে যাচ্ছে,আমি বাড়িওয়ালার ছেলে-আর আমাকেই দরজার বাইরে দার করিয়ে রাখল !! এটা মেয়ে নাকি ডাইনী।নূন্যতম সম্মানটুকু দিলনা !! কি অভদ্র মেয়েরে বাবা !! দোয়া করি ওর কপালে যেন দজ্জাল মার্কা শাশুড়ি জুটে।

-এইজে মিষ্টার নিচে তাকিয়ে জুতা গুনে লাভ নেই,আমাদের বাসা থেকে কিছু চুরি করা এত সহজনা। এই নিন হলুদ। এই বলে আমার মুখের ওপর ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিল !! রাগে অপমানে আমার ভেতরে চরম প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল,এই অপমানের শোধ আমাকে নিতেই হবে। মায়ের হাতে হলুদের বাটি ধরিয়ে দিয়ে,আমি আমার রুমে চলে গেলাম।

-হঠাৎ মা চিৎকার করে উঠল-গলার আওয়াজ শুনে মনে হল মা অনেক রেগে চিৎকার করছে। দৌড়ে সামনে গেলাম।
–কি হয়েছে মা ?
-দোতালা থেকে তোকে কি আনতে বলেছিলাম ?
–কেন হলুদেরগুঁড়ো !!
-তাহলে মরিচেরগুঁড়ো কেন এনেছিস ?

–মা আমিতো হলুদের গুঁড়ো’ই চেয়েছি !! হিন্দি সিরিয়ালের ভিলেনের মত-ঘটনাস্থলে চলে এলো সোনালী ।
-কি হয়েছে আন্টি-এত রাগারাগি করছো কেন ?
–দেখতো মা-প্লাবনকে তোমাদের বাসায় পাঠিয়েছি হলুদগুঁড়ো আনার জন্য,কিন্তূ তোমরা ভুল করে মরিচের গুঁড়ো দিয়েছ।
-না আন্টি ভুল করে কেন হবে-ওনিতো আমার কাছে মরিচের গুঁড়ো’ই চাইল ।
-ঠিক আছে আন্টি আমি এখনই হলুদের গুঁড়ো নিয়ে আসছি।

হিন্দি সিরিয়ালের মতো আমাকে বোকা বানিয়ে মুচকি হেসে দৌড়ে চলে গেল সোনালী। আর আমি গলায় ছুরি রাখা বলদের মত নিরুপায় হয়ে হা করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে মা বলতে লাগলো। এমন ছেলে দিয়ে আমি কি করব-যে ছেলে নীচতলা থেকে ওপরে যেতেই হলুদের কথা ভুলে যায় ।

–মা বিশ্বাস কর-আমি ওর কাছে হলুদগুঁড়ো চেয়েছি ।
-চুপথাক-মেয়েটি কি তোর নামে মিথ্যা বলবে নাকি ।

রাগে আমার মনের ভেতর প্রতিশোধের আগুন তীব্র থেকে তীব্র আকার ধারন করেছে। যে করেই হোক প্রতিশোধ নিতেই হবে,শূধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি আমি। বিকেলে সোনালীকে দেখলাম বাইরে কোথায় যেন গেল। অনেকদিন হয় ছাদে খোলা হাওয়ায় গলা ছেড়ে গান গাওয়া হয়না। আজ গান গাইতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে,তাই গিটার নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। এক বন্ধুর সাথে মোবাইলে প্রায় আধাঘন্টা কথা বললাম। তারপর গিটারের ছন্দে গান গাইতে লাগলাম। যদি আমি নীল আকাশ হয়ে যাই তুমি মেঘ হয়ে থেকো। যদি আমি রাত হয়ে যাই তুমি তারা হতে থেকো। আমি ভালোবাসি তোমাকে তুমি শুধুই মনে রেখো । বিকেলের কাঁচা রোদের পরন্ত সূর্যটা যখন জানায় বিদায়, ভেবে নিও তুমি ভাবছি আমি তোমাকেই বসে নিরালায় । যদি নাইবা থাকি পাশে তবু আমার কথা ভেবো ।

-ওই হুস হুস ওই কাক যাহ হুস হুস। নাহ আজো আর মন খুলে গান গাওয়া হলোনা।
–ওই মেয়ে আপনার সমস্যা কি-এমন হুস হুস করছেন কেন !?
-কোন সমস্যা নেই-কাকের কা কা আওয়াজ কারো কি ভাল লাগে বলেন। তাই কাক তাড়াতে এলাম।

মনে মনে বললাম-আল্লাহ ওপর থেকে একটা দড়ি ফালাও,আমি ওপরে চলে যাই। এই মাইয়ার জ্বালায়তো আমি কয়লার মতো পুইড়া যাইতাছি । –প্লাবন ভাই কাক’টা গেল কই ?

-কিসের কাক-এখানেতো আমি ছাড়া আর কেউ ছিলনা !!
–কাকের মত কা কা শুনলাম-ভুল শোনালাম নাকি ?
-আজব এখানে আমি একা বসে গান করছিলাম,কাক আসবে কোথা থেকে !!
–ও এই কথা-আমিতো ভেবেছি কাক বোধয় বেসুরা গলায় কা কা করছিল-হিহিহিহিহিহি ।
সোনালী হাসতে হাসতে চলে গেল।

অপমানে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্বহত্যা করতে মন চাইছে,কিন্তূ দোতলার ওপর থেকে নিচে পরে মরার সম্ভাবনা খুবই কম। বড়জোর কয়েকটা হাড্ডি ভেঙে পংগু হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। বিছানায় পরে থাকলে প্রতিশোধ নিব কিভাবে !! তাই আর লাফ না দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলাম। সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম আমি। এক সপ্তাহ পর। সোনালী ওর মামা বাড়ি বেড়াতে গেল,একদিন পরে আসবে। ব্যাস-আমিও আমার কাজে লেগে গেলাম। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। আমার প্রথম টার্গেট ওর আম্মুর মোবাইলের ম্যামোরী-এই ম্যামোরীতে সোনালীর সব বাছাই করা পছন্দের গান আর কবিতা আছে। কলিংবেল চাপতেই আন্টি দরজা খুলে ভেতরে ডাকলেন।

–আন্টি সোনালী কোথায় ?
-সোনালী ওর মামা বাড়ি গেছে, কালকে চলে আসবে। কেন বাবা কোন দরকার ?
–না মানে আন্টি-সোনালী আমার একটা বই এনেছিল,বইটা এখন আমার একটু দরকার ।
-কি বই নাম বল-আমি এনে দিচ্ছি । আন্দাজে একটা নাম বলে দিলাম,যাতে আন্টির বই খোঁজ করতে সময় বেশি লাগে।
-ঠিক আছে তুমি বসো বাবা-আমি এনে দিচ্ছি। আন্টি তার মোবাইল আমার সামনে রেখেই চলে গেল। এযেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি । আমি আস্তে করে ম্যামোরীটা খুলে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। আন্টি বই না পেয়ে চলে এসেছে।

-কই বাবা পেলাম না,তুমি ওর রুমে গিয়ে খুঁজে দেখ।
–ঠিক আছে আন্টি।

আমি সোনালীর রুমে চলে গেলাম। রুমে ঢুকতেই মন করা সুগন্ধি’তে মাতাল হয়ে গেলাম। সোনালীর ঘরের ভেতরই কয়েকটি ফুলের টপে গোলাপ গাছ,অনেকগুলো ফুল ফুটেছে গাছে । ওর রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। এ ছাড়া ওর রুমে তেমন বিশেষ কিছু পেলাম না। হঠাৎ খাটের এক কোনায় একটা শ্যাম্পুর বোতল চোখে পরল। ব্যাস-এটাই কাজে লাগবে। আমি দেরি না করে বেরিয়ে এলাম।

-কি বাবা বই পেয়েছ ?
–না আন্টি,একটা জরুরী ফোন এসেছে-এখনই যেতে হবে। আমি বিকেলে আবার আসব।
-ঠিক আছে বাবা ।

মার্কেটে গিয়ে গাঢ় সবুজ রং কিনে নিলাম। রংটা পাথরের ধুলোর মত-পানি আর ঘষা না খেলে রং ছড়ায় না। আর ওর ম্যামোরীর সব গান কবিতা ডিলিট করে দিয়ে,স্যার মাহফুজুর রাহমান আর চাইনিজ হু চ্যাং পু হ্যাং চি গান ভরে দিলাম । আমার গলা নাকি কাকের মত !! নে এবার জম্মের গান শুনামু । বিকেলে আবার ওর রুমে গিয়ে,শ্যাম্পুর বোতলে ধীরে ধীরে কিছু রং ঢুকিয়ে দিলাম। স্বযত্নে বোতলটি ওয়াশরুমে রেখে এলাম,যাতে অন্য কারো হাতে ঝাঁকি না লাগে। কাজ শেষে চোখে একটু লজ্জা নিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম।যাতে আন্টি কিছু বুঝতে না পারে ।

-কি বাবা বই পেয়েছ ?
–ইয়ে আন্টি-সোনালী বইটা আমাকে আগেই দিয়েছে। বইটি আমার আরেক বন্ধুকে দিয়েছি,কিন্তূ আমার খেয়াল ছিলনা। কিছু মনে করবেননা আন্টি-আমি এখ যাই ।
–ওহ আন্টি-এই ম্যামোরীটা ওর রুমে পরে ছিল ।
-এটাতো সোনালীর ম্যামোরী। আমিতো এগুলো বুঝিনা একটু কষ্ট করে ভরে দিয়ে জাও বাবা।

ম্যামোরী ভরে দিয়ে বাসায় এসে একটা ঘুম দিলাম। অপেক্ষা শূধু আগামী কালকের মজা দেখার। সোনালী সকালেই দেখলাম চলে এসেছে,আমি মজা দেখবো বলে অধীর অপেক্ষায় বসে আছি ।

দুপুর প্রায় একটা। হঠাৎ সোনালীর চিৎকার,সাথে ওর মায়ের চিল্লাচিল্লি শুনে বুঝে গেছি কাজ হয়ে গেছে।খুশিতে আমি বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি, আর একা একাই বলছি । আহাহাহাহাহা সোনালী-তুমি আমাকে অপমান করেছিলে। আর আজ রং তোমাকে বলাৎকার করে দিয়েছে। আব তেরা কেয়া হোগা সোনালী। আহাহাহাহাহাহা কাটা ঘায়ে লবন দিতে আর মজাটা লাইভ দেখার স্বাদ দেখার ইচ্ছে হলো,তাই ওপরে ওদের বাসায় গেলাম।

–হায় হায়-একি সোনালী আপনার চোঁখ,নাক,মুখ পুরো শরীরে এত রং কেন !! আপনাকেতো চেনাই যাচ্ছেনা-পুরো ভূতের মতো লাগছে আপনাকে । কি বিচ্ছিরি লাগছে আপনাকে ।

আল্লাহ-আপনার চোঁখ আর দাঁত ছাড়া আর কিছুইতো বোঝা যাচ্ছেনা। এখন আপনি বাইরে যাবেন কিভাবে । সোনালী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগলো । আর আমি পৌশাচীক হাসি দিয়ে বেরিয়ে এলাম ।
মু হাহাহাহা মু হাহাহাহা কুচকুচে কালো মানুষ দাঁত বের করলে বা কথা বললেন যেমন দেখায়। সোনালীকে দেখতে এখন ঠিক তেমন লাগছে। অপমান করেছিলে আমাকে-এখন দেখ তার শোধ কেমন লাগে। এমন কাজ করে দিছি-এখন বারবার আয়না দেখবা। আর দুঃখে স্যার মাহফুজুর রহমানের গান শুনবা হিহিহিহিহিহি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত