অরুকে যখন বিয়ে করি তখন অরুর বয়স তেরো, সার্বজনীন এই আনলাকি সংখ্যাটার ওপর ভয় কিংবা অনাস্থা বরাবরই ছিল। আমার বয়স যখন তেরো তখন বাবা গত হলেন, ভিটেমাটি বিক্রি করে মা ঋণের বোঝা কমালেন আমার সেই তেরো বছর বয়সেই। তবে অরুকে বিয়ে করার মাসখানেক পর এই আনলাকি সংখ্যাটির ওপর থেকে ভয় কিংবা অনাস্থা কর্পূর হয়ে উড়ে গেল।মাস তিনেক পেরোতেই আড়াই হাজার টাকা বেতনের এক হুলুস্থুল ধরনের চাকরিও জুটে গেল। মা এ ঘর ও ঘর ঘুরে ঘুরে সবাইকে রসগোল্লা বিলিয়ে বেড়ালেন, পাড়ার সবার মুখে মুখে আমার বন্দনায় বেকারদের কান পঁচে যাবার উপক্রম হলো তবুও বন্দনা থামলো না, পরে অবশ্য থেমেছিল তবে অন্য এক কদর্য কারণে। সে গল্প পরে বলছি।
মা ছিলেন একবারেই অন্যরকম। অন্য আট-দশটা ঘরের শাশুড়িরা বউদের ওপর যেভাবে ছড়ি ঘোরায়, তাদের বানানো হাজারটা নিয়মের বেড়াজালে আটকে রাখতে চায় আমার মা তেমন ছিলেন না। মা একদিন দুপুরে আলমারিতে তুলে রাখা জলপাই রঙা পাঞ্জাবিখানা হাতে ধরিয়ে বললেন, কেরানীগঞ্জ যেতে হবে, ঘন্টা দুয়েকের পথ তাড়াতাড়ি পরে নে। কোন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে নি কেননা মা যে যখন তখন দুম করে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেবেন সে আগে থেকেই ঠিক ছিল। বারবার মাকে বলেছিলাম, এই তেরোশ টাকার বেতনে বউ, সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়বে। মা চোখ রাঙিয়ে বলেছিলেন, বউয়ের জন্য রোজরোজ পাঠা বলি দিবি নাকি? তেরোশ টাকায় তিনজনের বেশ চলে যাবে সাথে কিছু সঞ্চয়ও দেদারসে হয়ে যাবে। সাথের বন্ধুদের দেখতাম বিয়ে করার জন্য মাসি,পিসিকে বাবা মায়ের কাছে পাঠাতে অথচ আমার বেলায় হয়েছিল উলটো। মা নিজেই ছেলের জন্য মেয়ে দেখলেন, বিয়েও ঠিক করলেন, দিলেনও। যখন জানতে পেরেছিলাম মেয়ের বয়স তেরো তখন মাকে ফিসফিসিয়ে বলেছিলাম, ষোল কিংবা চৌদ্দ বছরের মেয়েকে বিয়ে করব।
মা চোখ কটমট করে বলেছিলেন, শিক্ষিত, সচেতন মানুষ সংখ্যাতে লাকি, আনলাকি খোঁজে না। আমি ওমন কাটা জবাবে আর একটি টু শব্দও করার সাহস করিনি। অরু বেলা করে ঘুম থেকে উঠতো, কী রাঁধতে গিয়ে কী রেঁধে বসতো সেই প্রশ্ন অরুকেও করলে ঠিকঠাক জবাব আসবে সে আশা মা কখনো করেননি। নিশিথদের শ্যাওলা জমা পুকুরে রোজ ভোরে সাঁতার কাটা শিখিয়ে আমি অরুর জল ভীতি দূর করেছিলাম। ঋতুস্রাবের ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া অরুর পেটে গরম কাপড়ের ছ্যাঁকা দিতেই অরু গুটিশুটি হয়ে আমার কাছে নিজেকে সঁপে দিত, মা দরজার আড়াল থেকে কেবল মিটিমিটি হাসতেন, মায়ের সাথে তখনও অরুর চিকন একটু দূরত্ব রয়ে গিয়েছিল, সেটা কেবল লজ্জার নয় কিছুটা সম্মানেরও।
আমার ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার পাশে ধীরেধীরে অরুর রবী ঠাকুর জায়গা করে নিল, প্রথম দিককার শিমুল তুলোর কোলবালিশটাও সময় গড়াতে উধাও হয়ে গেল। ছোলাবুট, হাওয়াই মিঠাইয়ে পার করা বিকেল গুলো ভাড়া বাড়ির ছাদে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। হুট করেই এর মাঝে জয়েনিং লেটার এলো, পোস্টিং পাবনা। শর্ত ছিল প্রথম চার মাসে ছুটি চাওয়া যাবে না। বেতনের অঙ্ক আর ভাড়া বাড়ির দায় এড়াতে আমার রাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
পাবনা যাবার আগের রাতে সারা রাত অরুর সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। অরু সে রাতে ঝাপসা আয়নাটা আমার সামনে ধরে বলেছিল, আয়নাটা বড্ড ঝাপসা, টিপ ঠিকঠাক পরবো কেমন করে? আপনি তো থাকবেন না। আমি উত্তরে বলেছিলাম, কাল ই মা একখানা ঝকঝকে আয়না এনে দেবে, আমি বলে যাব। ব্যাগ গোছাতে যখন ব্যস্ত ছিলাম অরু তখন পকেটের কোণে পড়ে থাকা ছোলাবুটটা সামনে ধরে বলেছিল, বিকেল হলে ছোলা বুটও কি মা এনে দেবে? আমি প্রত্যুত্তরে কেবল মাথা ঝাকিয়েছিলাম। ইনিয়েবিনিয়ে নানা প্রশ্ন শেষে যখন কোনভাবেই আমায় আটকানো যাচ্ছিল না তখন অরু বলল, বাড়ির জন্য মন কাঁদলে যখন আপনি কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেন, সেটা কে এনে দেবে আপনি চলে গেলে? আমি তখন উত্তরে কিছুই বলতে পারিনি কেবল কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিলাম।
পাবনা থেকে ফেরার সময় অরুর রবী ঠাকুরের কোন কোন বই আনতে হবে তার একখানা লিস্ট অরু রাতেই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, জয়ী কোম্পানির আলতার কৌটো, বেলী ফুলের তেল সহ আরো অনেক কিছুর লম্বা একখানা আলাদা লিস্ট করে আমার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলেছিল, বড়ো মাইনের চাকরিতে বড়ো খরচ, বুঝলেন তো?
আমি সেদিন তিন মাসেই কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেয়া এক বুদ্ধিদীপ্ত রমণীকে দেখেছিলাম যে জানতো কিভাবে মায়া লুকাতে হয়, কিভাবে চোখের জল হাসতে হাসতে তাড়িয়ে দিতে হয়। ভোর সকালে মাকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম অরুকে ঘুমে রেখেই।সেদিন বুকের ভেতর ঠিক আজকের মতোই খচখচ করছিল।
পাবনায় প্রথম চার মাস থাকতে হবে এমন শর্তে আসার পর শুনি মাসটা চার নয় ছয় হবে। নতুন কোম্পানি একটু ডেডিকেশন দেয়াই লাগবে।অনেক কিছু ভেবে আমি দাঁতে দাঁত চেপে থেকেছিলাম। মায়ের রাঁধা সজনেডাঁটা, কুমড়ো বড়ি দিয়ে বেগুন ঘন্ট আর মায়ের মুখখানাকে যতবার মনে পড়তো তার চেয়ে বেশি মনে পড়তো অরুকে। সারাক্ষণ মনে হতো এই বুঝি অরু ঋতুস্রাবে কুঁকড়ে যেয়ে কেঁদে চলেছে, এই বুঝি অরু তার মাকে দেখতে না পারার জন্য চুপিসারে চোখ মুছে চলেছে, মনে হতো এই বুঝি অরু পুকুর ঘাটে যেয়ে একলা বসে আছে। ছমাস পর যখন ছুটি পেলাম তখন যত্নে তুলে রাখা অরুর আবদারের জিনিসের লিস্ট দুটোর সব জিনিস কিনেছিলাম, মায়ের জন্য একগাদা শাড়ি নিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম।
আমার ঘরের টেবিল খানা, আম কাঠের আলনা, দেয়ালঘড়ি থেকে প্রতিটা জিনিসই বাড়ি ফেরার পর সেই আগের মতো মনে হয়েছিল যা একটুও বদলায়নি কেবল অরু বাদে । বিদেশি কোম্পানির বায়ারদের সাথে আমি যেমন কৃত্রিম আন্তরিকতা, মেকি সৌজন্যতা দেখিয়ে কথা বলতাম কেবল প্রোডাক্ট সেলের জন্য অরুও আমার সাথে তেমনি ব্যবহার করতে শুরু করল, কেবল উদ্দেশ্যটায় ধরতে পারিনি সেবার। ছুটিতে থাকা সাতটা দিনে অরুর সমস্ত শরীরটাকে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম কেবল ওর মনটা বাদে। আমি হন্যে হয়ে ঐ সাতটা দিনে অরুর মনকে খুঁজে বেড়িয়েছি আর অরু খুঁজেছিল শান্তিতে দম নেবার একটুখানি জায়গা। দিন সাতেক পর আমি আবার ফিরে গেলাম পাবনায়, সেবার আর ফেরার পথে অরু কোন বইয়ের লিস্ট করে হাতে ধরিয়ে দেয়নি, ঝাপসা আয়নার অজুহাত দিয়ে আমায় আটকে রাখতে চায়নি কেননা ঘরের আয়নাখানা তখন বেশ ঝকঝকে। অরুর ঋতুস্রাবের ব্যথাতে নাকি তখন আর কান্না আসে নি,সয়ে নিতে শিখেছে নাকি।
কাজের চাপ, অরুর ওপর জমতে থাকা খানিকটা অভিমানে যখন মাস দুয়েক পেরিয়ে যাবার পরেও বাড়ির দিকে গেলাম না আরো একটা মাস কাটিয়ে যাবার আশায় তখন এক সন্ধেয় মা আমার পাবনার কোয়াটারে এসে হাজির। মাকে পাবনায় দেখতে পেয়ে যতোটা না অবাক হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম নিশিথের সাথে অরুর লাপাত্তা হবার কথা শুনে। অরুর বাড়ির লোক, থানা পুলিশ নিয়েও মা অরুকে খুঁজে পায়নি। মাকে সঙ্গে করে যখন ফিরে এসেছিলাম তখন পাড়ার লোকের মুখে মুখে মুখরোচক নানা গল্প ঘুরছিল। সবাই আমার দিকে তাকিয়েছিল এক অবজ্ঞা ভরা দৃষ্টিতে।
সপ্তাহ দুয়েক খোঁজাখুঁজি শেষে মাকে সঙ্গে নিয়ে পাবনায় ফিরে এসেছিলাম।ভেবেছিলাম অরু মাস কয়েক পর আপনা-আপনি ফিরে আসবে।না, আসেনি। বছর দুয়েক পর আজ অরুর চিঠি পেলাম প্রিয় অশোক কৈশোরে কিংবা উঠতি যৌবনের ভুলগুলো যে কতটা ভোগায় তা আজ টের পাচ্ছি। তোমার অনুপস্থিতি যখন আমায় খুব করে পোড়াচ্ছিল, মস্ত পুকুরে যখন একলা সাঁতার কাটতে হচ্ছিল তখন নিশিথ এসে বলল, একলা সাঁতার কাটলে ডুবে মরবে। সেই ভয়ে আমি বন্ধু পাতালাম, অন্তত ডুবে যেন না মরি। মা আমার লাগাম ছেড়ে দিয়েছিলেন বিস্তর বিশ্বাস নিয়ে, সেই বিশ্বাসকে গলা টিপে মেরে শ্যাওলা জমা পুকুরের ভোরের স্নানে বেপরোয়া হয়ে নিশিথে ছুঁয়ে দেয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম, ডুবে যেন না মরি সেই ভয়ে পাতা বন্ধুত্বে ঠিকই আমি ডুবে মরেছি। অমাবস্যায় যেমনি ব্যথাতে বুড়োদের শরীর একটুখানি উষ্ণতা খোঁজে আমারও তাই হয়েছিল, প্রতিটা দিন অমবস্যার ব্যথা নিয়ে ভোরবেলা শ্যাওলা জমা পুকুরটায় ছুঁটে যেতাম। কী নির্লজ্জের মতো তোমায় সমস্তটা বলে দিলাম, তাই না?
তোমার অনুপস্থিতিতে নিশিথ ধীরেধীরে আমার সবকিছুতেই মিশে গেল, আমি জানি যখন প্রতিটা দিনে তুমি আমায় খুঁজতে আর তখন আমি খুঁজতাম নিশিথকে। তুমি ছুটিতে বাড়ি এলে যখন আমায় ছুঁয়ে দিয়েছিল বিশ্বাস করো আমার তখন মনে হয়েছিল আমি একসাথে দুটো মানুষকে ঠকাচ্ছি।অনেক ভেবেচিন্তে শেষ অবধি আমি নিশিথকেই বেছে নিয়েছিলাম। সেই নিশিথই আজ তিনমাস হলো আমায় রেখে ইন্ডিয়াতে চলে গেছে,শুনেছি ও নাকি আর ফিরবে না। আমি এটা জানি আমি তোমাকে ঠকিয়েছি আবার এটাও জানি আমি তোমাকে আর ঠকাতে চাইনি বলেই এভাবে সরে এসেছি। পারলে আমায় ক্ষমা করো,করবে তো? অপরাধবোধে আমি রোজ জ্বলেপুড়ে মরে যাচ্ছি যে। কাল বাবার বাড়ি যাব, তুমি একটাবার আসবে?আসবে তো?
ইতি
অরু
১৩/০৫/১৯৬৮
চিঠিখানা বুক পকেটে নিয়ে সিনিয়র অফিসারকে একখানা চিরকুট লিখে পাঠালাম অফিস সহকারী বিমল দাদাকে দিয়ে। আর কোথায়? ডায়েরির বাকি পাতাগুলো ফাঁকা কেন? প্রকাশক ইলিয়াস ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ডায়েরিটা একজন নীলক্ষেত থেকে কিনেছিল। আমাকে গতকালই দিয়ে গেছে গল্পটা পড়ে। আমাদের প্রকাশনী চাচ্ছে এই অসমাপ্ত গল্পটাকে আপনি সমাপ্ত করুন।
আমি খানিকক্ষণ সময় নিয়ে ভেবে দেখলাম, যে মানুষটা নিজেই তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে গল্পটা সমাপ্ত করেনি সেখানে আমি তার হয়ে সমাপ্ত করাটা বড়ো অন্যায় হয়ে যাবে। সে হয়তো অরুকে ক্ষমা করেছিল কিংবা করেনি, উপন্যাসে আমার যেকোন একটাকে বেছে নিতেই হবে যেটা আমি কোন ভাবেই চাচ্ছি না। সিগারেটের ফিল্টারটা আ্যশট্রেতে রেখে ইলিয়াস ভাইকে বললাম, এই গল্পটা সমাপ্ত করবেন না প্লিজ, গল্পের অভাব হলে আমাকে জানিয়েন আমি পাণ্ডুলিপির একটা ব্যবস্থা করে দেব।
ইলিয়াস ভাই ক্যালেন্ডারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,আচ্ছা তবে তাই হোক। খেয়াল করে দেখলাম ক্যালেন্ডারের পাতার তেরো সংখ্যাটা আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে, দিনটাও আজ তেরো তারিখ।বাইরে প্রচণ্ড রোদ উঠেছে, রিক্সার ক্রিং ক্রিং শব্দ, ডাস্টবিনের বুড়ো কাক, ট্রাফিক পুলিশের বাঁশি একস্বরে বলে চলেছে “আজ তেরো তারিখ”।