সারপ্রাইজ টেস্ট

সারপ্রাইজ টেস্ট

আজকে রাফি স্যারের মেজাজ টা খুব খারাপ।স্কুলে আসার আগে বউয়ের সাথে তার কথোপকথন :

-বাজারে কি লবণ ফ্রি দিতাসে??
-ওমা!ফ্রি কেন দিবো???দোকানদার কি আমার দাদাশ্বশুর লাগে??
-ওই খবরদার আমারে দাদারে নিয়া কথা তুলবা না।তরকারী তে এত লবণ দিসো কেন??মনে হইতাসে পারলে আজকে ভাতের মধ্যেও লবণ দিয়া দাও।
-যেটা দিছি মুখ বন্ধ কইরা খাইয়া ফালান।
-যতসব মূর্খ মেয়ে ছাওয়াল নিয়া বসবাস।মুখ বন্ধ করলে খাবো কিভাবে??ধুর ভাল্লাগে না।

সকালে উঠে ভাত খাওয়া টা তার অভ্যাস হয়ে গেছে।তাই তার স্ত্রীকেও সকাল সকাল যেতে হয় ভাত রান্না করতে।ঘুমের ঘোরে তরকারীতে ভুল করে তিন বার লবণ দিয়ে দিয়েছে।প্রায়ই এমন হয়।তাই রাফি স্যর ঠিক করলেন সকাল থেকে আর ভাত ই খাবেন না।প্রয়োজনে সকালে না খেয়ে থাকবেন।তাও ওইসব অখাদ্য কুখাদ্য মুখে তুলবেন না।

ক্লাসে ঢুকেই কুইনাইন খাওয়ারর সময় মুখ যেমন হয় তেমন ভাব করলেন।আজকালকার পোলাপান দের কোন ভদ্রতা জ্ঞান নেই।স্যার ক্লাসরুমে ঢুকলে যে দাঁড়াতে হয় সেটাও অনেকে শিখে নি।যারা ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিল তারা ঠিকই দাঁড়ায়। কিন্তু শেষের বেঞ্চ গুলিতে যারা বসে তাদের ধারণা টা এমন ‘স্যার তো আমাকে দেখবেই না।হুদাই দাঁড়ানোর দরকার নেই।’ কারোর কারোর ভাবখানা এমন স্কুলে পড়তে আসেনি ঘুমাতে এসেছে।স্যার আসলো নাকি প্রেসিডেন্ট আসলো এটা নিয়ে তাদেরা মাথা ঘামানোর দরকার নাই। আর কাউকে তার পাশের বন্ধু তুলে দাঁড় করাচ্ছে। ‘ওই ওঠ।স্যার আসছে।’ স্যার ক্লাসে ঢুকেই পুরো ক্লাস টার দিকে একবার তাকালেন।এরপর গিয়ে যেখানে চেয়ার আর টেবিলটা রাখা সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন,বসলেন না।মৌ রিদির কানে কানে বলল

-কিরে স্যারের পিছনে কি ফোঁড়া উঠছে নি।বসতাসে না ক্যান??
-ধুর।স্যার বসুক বা না বসুক আমাদের বসতে বলতাসে না ক্যান?পা তো ব্যথা করতাসে। প্রায় পাঁচ মিনিট হয়ে গেল স্যার বসার কথা বলছেন না।মুখের লবণাক্ত স্বাদ টা এখনো যায় নি।কথা বলতেও কেমন যেন ইচ্ছা করছে না।

-স্যার
-কি হলো কি??
-আপনি বসেন স্যার।
-বেয়াদপ মেয়ে।

কোথায় আমি তোমাদের বসার পারমিশন দিবো উল্টো তুমি আমাকে বসতে বলতাসো।তোমাকে টিসি দিয়ে দিবো। ‘টিসি দিয়ে দিবো’ এটা তার রোজকার ডায়লগ।কিন্তু আজ পর্যন্ত একজন কেও টিসি দেয়ার রেকর্ড গড়তে পারেন নি। রিদি মুখ টা কাঁচুমাচু করে বসতে নিয়েছিল।এরপরেই আবার তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেল।

-এই তোমরা বসো। যাক অবশেষে স্যার বসার পারমিশন দিলেন।
-আজ তোমাদের সারপ্রাইজ টেস্ট। একমাত্র সারপ্রাইজ টেস্ট এমন একটা সারপ্রাইজ যেই সারপ্রাইজ টা পেলে সবার মুখ টা বাংলার পাঁচের মত হয়ে যায়।

-দুনিয়াতে এত সুন্দর সুন্দর জিনিশ থাকতে স্যাররা কি সারপ্রাইজ দেয়ার মত আর জিনিশ খুঁজে পায় না।(মনির)
-কবে যে পড়ালেখা ছেড়ে সন্নাস গ্রহণ করবো তার ঠিক নাই।(আলিফ) পুরো ক্লাস জুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে।যেন টেস্টের কথা বলা হয় নি কারোর ফাঁশির আদেশ দেয়া হয়েছে।

-ওই সবাই চুপ।আর যদি একটা বাড়তি কথা কেউ বলো মুখ সেলাই করে রেখে দিব। যদিও সেলাই কাজ টা তিনি জানেন না আর পঞ্চাশ টা ছেলে মেয়ের মুখ সেলাই করা টা কোন মুখের কথা না,বিশাল খাটনি তাও এই কথাটা বলেন।

-আজকে খাতা কলমে পরীক্ষা হবে না।আমি মুখে প্রশ্ন করবো আর তোমরা উত্তর দিবে।

এটা শুনে সবার মুখ আরেকবার ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কেননা খাতায় লিখলে তাও দেখাদেখি করার সুযোগ আছে।মুখে প্রশ্ন ধরলে তো কিছুই পারবে না। ক্লাসের যেগুলি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টস তাদের কাছে পরীক্ষা মানে তো ঈদ।কেননা এই সময়েই তারা তাদের প্রতিভা দেখানোর সুবর্ণ সুযোগ পায়।ইশফিয়া ক্লাসের সবচাইতে মেধাবী ছাত্রী।হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে।তাকে দেখে এখন মনে হচ্ছে সেই হলো পৃথিবীর সবচাইতে সুখী ব্যাক্তি।এমনিতে তাকে কেউ খুব একটা পাত্তা দেয় না।একমাত্র এক্সামের সময়ই ওর কদর।এক্সামে এর ওর ডাকাডাকির জ্বালায় ঠিক মত লিখতেও পারে না। স্যার প্রশ্ন করা শুরু করছে।

-এই অমি তুই দাঁড়া। অমি তাকেই দাঁড়াতে বলেছে কিনা এটা নিয়ে কনফিউজড। ইতস্তত করতে করতে দাঁড়ালো।
-স্কুলে আসার সময় চুল আঁচড়ে এসেছিলি?? এই প্রশ্ন শুনে সে দন্ত বিকশিত হাসি দিল।
-স্যার এত্ত সোজা প্রশ্ন!!না স্যার।চুল আঁচড়ে আসিনি। এই বলে ধপ করে বেঞ্চে বসে পরলো। স্যারের রাগ আস্তে আস্তে বাড়ছে।
-ওই তোরে বসতে বলছি???দাঁড়া।
-জ্বি স্যার।
-বল ঢাকার পূর্ব নাম কি ছিল??

প্রশ্ন শুনে অমি এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।যদি কেউ পাশ থেকে বলে দেয়। একজন ফিসফিস করে বলল ‘মোহাম্মদপুর’ আরেকজন বলল ‘ইসলামাবাদ’ একজন বলল ‘জাহাঙ্গীরনগর’ এমনিতেই বেচারা সবসময় একটা কনফিউশনে থাকে।স্কুল ৯ টায় শুরু হয় নাকি ৯.৩০ টায় এটাও সে নিশ্চিত করে বলতে পারে না।তাই ইচ্ছে করেই তিন জন তিন রকম উত্তর দিলো। দেরি হচ্ছে দেখে স্যার দিলেন হুংকার।

-কিরে বলতে এতক্ষণ লাগে???জলদি বল।
-মোহাম্মাদপুর,ইসলাবাদ, জাহাঙ্গীরনগর। এক নাগারে তিনটা নাম ই বলে দিলো। হাতের বেত টা দিয়ে টেবিলে জোরে বারি দিলেন।

-ওই তোকে এইসব শিখাইছি???ঢাকার কি তিনটা নাম ছিল আগে???
-স্যার,তিনজনে তো তিনটা বলল।কোনটা সঠিক কনফিউজড ছিলাম তাই তিনটাই বলে দিছি।একটা না একটা সঠিক তো হবেই।
-তুই বোস।আর ওকে যে তিনজন বলে দিয়েছে সেই ব্লিলিয়ান্ট গুলি দাঁড়াও। অমির পাশের তিনজন মুখভার করে দাঁড়িয়ে রইলো।ঘন্টা না পরা পর্যন্ত আর বসার সুযোগ নেই এটা ভেবে।

-এই মৃদুলা তুই দাঁড়া।
-ইয়েসসসসস স্যার।।

এই মেয়ের আবার মিলিটারিতে যাওয়ার শখ।তাই এখন থেকেই সেটার প্র‍্যাক্টিস শুরু করে দিয়েছে। বুকে হাত দিয়ে ধড়ফড় করে উঠলেন স্যার।

-আস্তে আস্তে এত জোরে ইয়েস স্যার বললে তো হার্ট এ্যাটাক করবো।
-স্যারি স্যার।
-তুই বল মমতাজ মহল সম্রাট শাহ জাহানের কত তম বিবি ছিলেন??
-ছি ছি স্যার।ওই লুইচ্চা ব্যাটা কে নিয়ে আমাকে কোন প্রশ্ন করবেন না স্যার।আমি কোন প্রশ্নের জবাব দিবো না।
কিছুক্ষণ নির্বাক নয়নে তাকিয়ে থাকলেন স্যার।এরপর ভাষা ফিরে পেয়ে বললেন

-তোমার সাহস তো কম না।সম্রাট শাহ জাহান কে তুমি লুইচ্চা ব্যাটা বলো!!!আর এসব কি ল্যাংগুয়েজ!!!
-স্যার যেই ব্যাটা দশ বিশ টা কইরা বিয়া করে তারে তো এই টাই বলা উচিত।আর আমাদের সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে।কি বলো মেয়েরা?????

-হ্যা হ্যা ঠিক।প্রতিবাদ প্রতিবাদ মেয়েদের সমস্বরে উত্তর।
-একদম চুপ।তুই ব্যাঞ্চের উপর দাঁড়া।
-স্যার আমি তো এমনিতেই লম্বা।বেঞ্চের উপর দাঁড়ানোর দরকার কি???
-একদম চুপ।
-অভিক তুই দাঁড়া
-জ্বি স্যার।
-পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ নিয়ে কিছু বলো।
-ওইযে স্যার অন্নেক কাল আগে পানি নিয়া রাজাগো মধ্যে যেই যুদ্ধ হইছিলো সেটাকেই পানিপথের যুদ্ধ বলে।

এই যুদ্ধ টা পথের মধ্যে হইছিলো তো তাই এই নামকরণ করা হয়েছে। আর কিছু বলার আগেই রাগে ডাস্টার টা ছুড়ে মারলেন।অভিক সেটা ক্যাচ ধরে ফেলল।

-হিহি।স্যার আপনার গোল হয় নাই। এই ছেলে স্কুলের ফুটবল টিমের গোলকিপার।কিন্তু এইখানে গোল আটকানোর শাস্তি স্বরুপ বিশ বার কান ধরে উঠবোস করতে হলো।

-মিতালি তুই দাঁড়া।
-ইয়েস স্যার
-১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তোমার মতামত ব্যক্ত করো।
-হিহিহাহা।
-ওই হাসছো কেন???আমি কি কোন জোকস বলেছি??
-স্যার এত বড় যুদ্ধ নিয়া আমি আর কি মতামত দিবো???যেটা হওয়ার সেটা তো হয়েই গেছে।
-ক্লাসের বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো।

-স্যার বাইরে বেরুতে বেরুতে একটা মুখ ভেংচি দিলো মিতালি।তবে স্যারের অগোচরে।
-এই ইমরান তুই দাঁড়া।
-ওই ইমরান হাশমি তোরে দাঁড়াইতে কইছে দাঁড়া। পাশের জন ঠেলে ঠুলে দাঁড় করালো।
-ভাষা আন্দোলনে শহিদ হয়েছিল তাদের কয়েক জনের নাম বলো।
-একজন আমার আব্বু,একজন আমার চাচা একজন আমার নানা সবাই হা…করে ওর দিকে তাকিয়ে রইছে।
-ওওইই এসব কি বলিস??
-স্যার আমার বাবার নাম সালাম,চাচার নাম বরকত আর নানার নাম রফিক উদ্দিন।

দাঁত কিড়মিড় করে কিছু বলতে যাবে অমনি ঘণ্টা পরে গেল।সবার মনের মধ্যে যেন শান্তির সুবাতাস বয়ে গেল।এদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে স্কুল লাইফের কোন বিষয় টা সবচাইতে আনন্দের ছিল??তখন এক বাক্যে সবাই উত্তর দিবে ‘ঘণ্টা পরার বিষয় টা সবচাইতে আনন্দের।’ এদের ভবিষ্যৎ যে কি হবে এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন রাফি স্যার। কয়েক দিন পর হৈচৈ এর শব্দ শুনে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন রাফি।বাইরে বেড়িয়ে দেখেন ক্লাসের প্রায় সব ছাত্র ছাত্রী হাজির।

-তোরা এখানে??কিছু হয়েছে??? উত্তর দেয়ার আগেই অমিত কোলে করে স্যারের ছেলেকে নিয়ে পিছন থেকে সামনে আসলো।
-একি!!!মিরানের কি হয়েছে???
-স্যার,ওকে কয়েকটা বাচ্চা মিলে মারছিলো।

আমরা নিয়ে এসেছি।আর আপনি আজ স্কুলেও যাননি।আপনি সুস্থ আছেন তো??? কিছু বলার ভাষা পেলেন না তিনি।তার ছেলেটা অটিজমে আক্রান্ত।এজন্য অনেকেরই হাসি ঠাট্টার খোরাক হতে হয় তাকে।কিন্তু এই বাচ্চাগুলি তার ছেলেকে নিয়ে কখনোই হাসি ঠাট্টা করে নি।বরং সবসময় তার ছেলের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে।বন্ধুর মত মিশেছে। চোখ দিয়ে পানি পরছে তার। আর বলছে

-তোরা ভবিশ্যতে অনেক টাকা পয়সা উপার্জন করতে পারবি কিনা জানিনা,তবে তোরা সবার আগে মানুষের মত মানুষ হ।মানুষের দুর্বলতা গুলো যেন তোদের হাসির কারণ না হয়। বিড়বিড় করে বলছেন তিনি। স্যার বিড়বিড় করে কি বলছে কেউ শুনেনি।ক্লাসের লেকচারের মত এই কথা গুলিও তারা মনোযোগ দিয়ে শুনেনি।তারা ব্যস্ত হয়ে পরলো মিরান কে নিয়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত