– কি রে দোস্ত তোর চোখে পানি ?
– মনে অনেক দুঃখ তো, তাই কাঁদতেছি।
– দোস্ত পেয়াজের ঝাঁজ অনেক বেশি তাই না ?
– নিজেই কেটে দেখ, টের পেয়ে যাবি।
– যারে বলে বাংলার পিয়াজ। ঝাঁজ তো একটু বেশি হবেই।
– তোরে কে বলছিল টাকা বেশি দিয়া এই বাংলা পেয়াজ আনতে ? এমনই ছোট, কাটতে কাটতে সারা দিন যায়। ইন্ডিয়ান পিয়াজ আনলে অনেক আগেই কাটা শেষ হয়ে যেত।
– মজা পেলাম। থাকিস বাংলাদেশে ভরসা রাখিস ইন্ডিয়ায়। মুখ বন্ধ করে কাজ কর। তা না হলে মুখের ভিতরও পিয়াজের ঝাঁজ লাগবে। শহরে আসার পর এই মেসবাড়িই আমাদের সব। একগাদা ব্যাচেলর তিন তলার এই পুরনো ভবনটা জুরে আছে। এখানে সকাল দুপুর রাত বলে কিছু নাই। সবটা সময়ই চলে হৈচৈ। সিট ভাড়া নেবার আগে আমাদের বাড়িওয়ালা চাচার বেশ কিছু শর্ত মেনে তবেই সিট নিতে হয়।
– শোনও বাবা, সিট ভাড়া নিবা ভাল কথা। এই শহরে আরও অনেক মেসবাড়ি আছে। আমার এইখানে সিট ভাড়া নিতে হবে এমন কোন কথা নাই। আমার শর্তে যদি রাজি থাকো তাহলে সিট ভাড়া দিব তা না দিব না।
– চাচা শর্ত গুলা যদি বলতেন ?
– হুম। প্রথম শর্ত, বাড়ির থেকে বাপ ভাই টাকা পাঠিয়েছে কি পাঠায়নি সেটা বড় কথা না। বড় কথা হলো মাসের এক তারিখ থেকে দশ তারিখের মধ্যে সিট ভাড়া দিতে হবে।
– জী আচ্ছা।
– দ্বিতীয় শর্ত, বাড়ির ছাদে উঠতে পারবা না। তৃতীয় শর্ত হলো কোন প্রকার মেয়ে মানুষ মেসবাড়িতে নিয়া আসা যাবে না। আর প্রথম মাসের সিট ভাড়া অগ্রিম দিতে হবে। এখন রাজি আছো কি না বলো।
– জী চাচা, রাজি আছি।
– ও হ্যা আরো একটা শর্ত আছে। প্রতি ঘরে চারটা বিছানা। কোন বিছানা খালি থাকলে সেইখানে যেয়ে শুয়ে থাকবা
না। কারন ওই বিছানায় পেশাব পায়খানা করলে ওইটা নিশ্চয় আরেকজন পরিষ্কার করবে না। বাড়িওয়ালা চাচার শেষ শর্ত শুনে প্রচন্ড হাসি পেলেও সিট ভাড়া না পাওয়ার ভয়ে হাসিটা চেপে যেতে হয়েছিল। এই মেসবাড়ি আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক কাছে। হেঁটেই যাওয়া যায়। তাই মেসবাড়িটা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছিলাম না। ভালয় ভালয় মেসবাড়িতে উঠতে না উঠতেই একপাল বন্ধুবান্ধব জুটে গেলো। আসলে এক রুমে চারটা মানুষ আর পাশাপাশি রুম হওয়াতে সম্পর্কটা সবার সাথে এমনিতেই হয়ে যায়। সব কিছু ঠিক থাকলেও বিরাট বড় রকমের সমস্যা বাধে আরেক জায়গায়।
– আচ্ছা এই শহরে তুমি আর কোন মেসবাড়ি পেলে না ?
– কেন কি হয়েছে!
– কেন কি হয়েছে তুমি বুঝনা ? ওই মেসবাড়ি আমার বাপের। আব্বা যদি জানে তুমি আমাদের মেসবাড়িতে থাকো তাহলে জীবনে কোন দিন তোমার আমার সম্পর্ক মেনে নিবে না।
– ব্যাচেলর মানুষ, আমি মেসবাড়িতে থাকবো না তো কি ফ্যামেলি বাড়িতে থাকবো!
– শোনও আমি এতো কথা শুনতে চাই না। তুমি এই বাড়ি ছাড়ও।
– আজব তো আমি এখন মেসবাড়ি পাবো কোথায়! সব গুলারই তো সিট ভাড়া হয়ে গেছে।
– উফ! তুমি একটা যন্ত্রণা। যদি কোন ঝামেলা হয় দেখও তোমার খবর আছে।
সত্যি বলতে মেসবাড়িটা ছাড়ার ইচ্ছা আমার নেই। বিয়ের আগে হবু শ্বশুরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার মত এতো ভাল সুযোগ অন্য কোথাও থাকলে পাওয়া যাবে না। আর সব মিলিয়ে এই মেসবাড়ি আমার জন্য দারুন একটা জায়গা। এই বাড়ি ছাড়ার কোন কারন নাই।
– ভেবে ছিলাম তোমার কাছাকাছি কোন মেসবাড়িতে উঠলে রোজ না হলেও কয়েকদিন পরপর তোমার দেখা পাব। এখন তো দেখি উল্টো হয়ে গেলো।
– কি করবো বলো! যেখানে যাই সেখানেই পরিচিত মানুষ।
– তোমার দাদা নানারা মানুষ ছিলেন বটে। একপাল সন্তান জন্ম দিয়েছে। আর সেই সন্তানরা জন্ম দিয়েছে আরও কয়েক পাল। সারা এলাকাজুড়ে আত্মীয়স্বজন আর আত্মীয়স্বজন। তোমাকে নিয়ে যে কোথাও গিয়ে শান্তিমত একটু কথা বলবো সে উপায়টাও নেই।
– সবই কপাল। কি আর বলবো বলো!
– আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয় ?
– কি কাজ ?
– মেসবাড়িতে দেখা করলে কেমন হয় ?
– তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! আমি যাব মেসবাড়িতে ?
– হুম যাবে। আমার মনে হয় মেসবাড়ি দেখা করার জন্যই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। ওখানে তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ নাই। আর তাছাড়া দিনের বেলা তোমার আব্বা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। চুকিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে।
– এতো গুলা ছেলে মানুষের মাঝে আমি একটা মেয়ে কি করে যাই! তোমার আক্কেল দেখে আমি অবাক।
– আরে বোকা, ওরা সবাই জানে তুমি আমার প্রেমিকা। আর তাছাড়া কোন সমস্যা হলে ওরা তখন সাহায্য করবে। বোরকা পরে আসবে, বোরকা পরে চলে যাবে। ভেবে দেখও আমার কথাটা।
– ওসব পরে ভাববো। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। না জানি কে কোন দিক দিয়ে দেখে ফেলে কে জানে।
– ঠিক আছে তাহলে চলো যাওয়া যাক।
– এই শোন, তুমি আমার রিক্সার পিছন পিছন আসবে না। আমি যাওয়ার দশ মিনিট পরে রওনা হবে।
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।
মেসবাড়িতে ঢুকতেই চোখ কপালে উঠে গেলো। পাশের দুই সিট লোহার শিকল দিয়ে প্যাঁচানো। ঘটনা তো কিছুই মাথায় আসছে না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বেশ কয়েকটা রুমের সিট গুলাতে না কি বাড়িওয়ালা শিকল দিয়ে তালা মেরে দিয়েছে।
– এই ঘটনা কি রে!
– তেমন কিছু না। আজ মাসের বিশ তারিখ। সিট ভাড়া যারা এখনও দেয় নাই তাদের সিট প্যাঁচিয়ে তালা মেরে রেখে গেছে।
– বাহ! দরুন তো। সারাজীবন দেখেছি বাড়ি ভাড়া ঠিকমত না দিলে দরজায় তালা দিতে। এখানে এসে দেখি সিটে তালা মারা হয়। নাহ! বলতে হয় হবু শ্বশুর আব্বার মাথায় বুদ্ধি আছে।
– তোর যে একটা কপাল। শহরের এমন জায়গায় তিনতলা বাড়ির মালিকের মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম তার উপর হিটলার টাইপের শ্বশুর। একেবারে সোনায় সোহাগা।
– তা যা বলেছিস। যা এখন এই বাড়ির হবু জামাইের জন্য গরম গরম এক কাপ চা নিয়ে আয়।
– স্যারের আর কোন আবদার ?
– না রে দোস্ত, মজা করলাম। চল চায়ের দোকানে আড্ডা মেরে আসি।
– চল।
এখন আর লুকিয়ে লুকিয়ে বাহিরে দেখা করা লাগে না। প্রেমিকা আমার বোরকা পরে মেসবাড়িতে আসা যাওয়া করে। বন্ধুবান্ধব পাহারা দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত। বলা যায় না কোন সময় আমার হবু শ্বশুর আব্বা এসে হাজির হয়। লোকে বলে চোরের দশ দিন গৃহস্থের একদিন। দশ দিন পার না হতেই হবু শ্বশুর আব্বার কানে খবর চলে যায় কোন মেয়ে না কি বোরকা পরে মেসবাড়িতে আসা যাওয়া করে। আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে ধমক দিয়ে অনেক বার কথা বের করার চেষ্টা করলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমি এক কথাই বলে যাই “আমি কিছুই জানি না।” বেশ কিছু দিন আমার উপর কড়া নজর রাখার পর দিন বারতেই সব কিছু হালকা হয়ে গেলো। মেসবাড়িতে এসে হবু বউ রান্না করে আর আমি পেট ভরে খাই। বলতে গেলে কপাল একটা আমার। বিয়ে না করেই হবু বউ এর হাতে রান্না খাবার সৌভাগ্য কয়জনের হয়। কিন্তু এই কপাল যে পোড়া কপালে রুপ নিবে তা আমার ধারণার বাহিরে ছিল।
– এই দেখো কে যেন বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে!
– দরজা লাগিয়ে দিয়েছে ? কে দিয়েছে ?
– আমি জানি না। তুমি একটু দেখ তারাতারি। আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।
– আচ্ছা আমি দেখতেছি। এই কে ? বাহির থেকে দরজা লাগালো কে ?
– আর কেউ না আমি। আমি তোমার বাড়িওয়ালা চাচা।
– চাচা দরজা খোলেন, দরজা খোলেন চাচা!
– খুলবো, সময় হলেই খুলবো।
প্রেমিকা আমার নিজের বাপের গলার আওয়াজ শুনে ভয়ে মুখ চেপে কান্না করছে। বোরকার ফাঁক দিয়ে শুধু তার চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল। এখন সেটাও ঢেকে দেয়া হয়েছে। ভয়ে আমার নিজেরই হাত পা কাঁপছে। না জানি আজ কপালে কি আছে। হারামীটা পাহারা না দিয়ে না জানি কোথায় আছে। এতোক্ষন যাও মুখ চেপে কাঁদছিলো এখনতো দেখি প্রায় চিৎকার করে কাঁদার মত অবস্থা। মাথা চরকির মত ঘুরছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ।
– আসেন, আসেন ভিতরে আসেন।
– চাচা কি শুরু করলেন আপনি!
– আমি না তো। তুমি শুরু করছো আমি শেষ করবো। বেগানা মেয়ে মানুষ নিয়া আমার মেসবাড়িতে উঠবা আর আমি বসে থেকে তামশা দেখবো তা তো হতে পারে না। কাজী সাহেব আপনি বিয়ে পড়ান। বিয়ের পর তারা মন ভরে প্রেম পিরিতি করবে।
– চাচা এবারের মত মাফ করে দেন। আর কোন দিন এমন কাজ করবো না।
– কথা কম বলো। তোমারে বহু বার জিঙ্গেস করছি। আমার সাথে মিথা কথা বলছো।
বেয়াদব কোথাকার! কাজী সাহেব তারাতারি বিয়ে পড়ান। কাজী সাহেব বিসমিল্লাহ্ বলে লিখালিখি শুরু করলেন। হাত পা আমার ঠান্ডায় বরফ হয়ে গেছে। যে মেসবাড়িতে শান্তিমত ঘুমানো যেত না সেই মেসবাড়ি আজ একেবারেই শান্ত। বোরকায় হাত মুখ ঢাকা হবু বউ আমার মাথা নিচু করে আছে। বাপের সামনে মেয়ে চুপ মেরে বসে আছে অথচ হবু শ্বশুর আব্বা বেপারটা জানেনও না। বোরকা পরায় নিজের মেয়েকেই চিনতে পারছেন আজ।
– দাঁড়ান কাজী সাহেব, মেয়ের নাম কি বললেন ?
– মারিয়া রহমান।
– এ তো আমার মেয়ের নামে নাম। তাহলে এক কাজ করেন উকিলবাপ আমাকেই করে দেন।
– ভাই সাহেব, মেয়ের বাবা’র নামের সাথেও আপনার নামের মিল আছে।
– তাই না কি! হা হা হা তাহলে তো আর কথাই নাই।
লিখেন লিখেন উকিলবাপের জায়গায় আমার নাম লিখেন।
লিখেন ভাল করে লিখেন। কবুল বলা শেষ হলেই টের পাবেন মজা কারে বলে। এতো তারাতারি আপনার মেয়েকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না। আপনি যখন মানতে নারাজ তো আর কি করার! দিন আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিন। আজ না হলে কাল তো দিতেই হতো। কাজী সাহেবের কথায় আমার তিনবার কবুল বলা শেষ। এবার মারিয়ার পালা।
– বলো মা, এই বিয়েতে রাজি থাকলে কবুল বলো।
– কবুল।
– আবার বলো।
– কবুল।
– আরও একবার বলো।
– কবুল।
– দাঁড়ান কাজী সাহেব।
মেয়ের গলার আওয়াজ কেমন জানি পরিচিত লাগতেছে। এই মেয়ে তোমার বোরকার মুখ খুলো তো দেখি। আরে লজ্জার কিছু নাই। বিয়ে তো হয়েই গেছে। আমি তোমার উকিল বাপ। বাবা তার মেয়ের মুখ দেখতেই পারে। বেশ কয়েকবার বলা হলেও ভয়ে বোরকার মুখ খোলা তো দূরের কথা বউ আমার রীতিমত কাঁপাকাপি শুরু করে দিয়েছে। এদিকে শ্বশুর আব্বা আর কাজী সাহেব ওর মুখ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে হা করে তাকিয়ে আছে। মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আর মুখ লুকিয়ে লাভ নাই। অনেক সময় নিয়ে বউ আমার বোরকার মুখ খুলতেই শ্বশুর আব্বা চেয়ার ছেড়ে লাফ মেরে উঠলেন।
– তুই!
– আব্বা আমি মারিয়া।
মনে হলো নিজের মেয়ের মুখে আব্বা ডাক শুনে শ্বশুর আব্বার দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে ধাপাস করে মেঝেতে পরে গিয়ে অজ্ঞান। কাজী সাহেব দোয়া দুরুদ পড়ে ফু দিচ্ছেন। মেসবাড়িতে সবার ছুটাছুটি। কেউ পানি আনছে কেউবা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। আমি বিছানায় বসে পা দুলাছি আর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছি। মারিয়া শ্বশুর আব্বার হাত পায়ে তেল মালিশ করছে আর আব্বা আব্বা বলে কাঁদছে। অবশ্য কান্না করারই কথা। জলজন্তু একজন মানুষ তার নিজের মেয়েকে দেখে চিতপটাং হয়ে গেছে। বেপারটা খুব একটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। বেশ কিছুটা সময় মাথায় পানি ঢালার পর শ্বশুর আব্বার জ্ঞান ফিরলো। শোয়া থেকে উঠে বসলেও মনে হচ্ছে উনার মাথা এখনও ঘুরছে। ঘুরাটাই হয়তো স্বাভাবিক। কারন নিজের মেয়েকে এমন ভাবে বিয়ে দেয়ার ইতিহাস মনে হয় তিনিই প্রথম রচনা করলেন।
– মারিয়া বাড়িতে চল।
– জী আব্বা।
– এই তুমিও আসও।
যা হবার তা তো হয়েই গেছে। মেয়ের জামাইরে তো আর মেসবাড়িতে রাখতে পারি না।
মনে হলো বুকের ভিতর থেকে বড় একটা পাহাড় সরে গেলো। এতো সহজে উনি বেপারটা মেনে নিবেন আমার জানা ছিল না। মেসবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে আমরা নামছি আর পিছনে একপাল ফাজিল গুলা তিড়িং বিরিং করে নাচতেছে। মেসবাড়িতে আমার থাকা এখানেই শেষ হয়ে গেলো। তারপরও রোজ একবার করে হলেও এখানে আসতে হবে। এতো মধুর স্মৃতি আর ইতিহাস রচনাকারী এই মেসবাড়ি ছেড়ে কি থাকা যায়! যায় না।
ফাজিল গুলা এখনও নীরবে ভেংচি কাটছে আর নাচতেছে। ওরা পারেও বটে।