“বাবা, আইজকা কিন্যা দিবা, ঠিক না, বাবা?” রতন বাড়ির দরজাতেই দাঁড়িয়ে তার বাবার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল। কুদ্দুস মিয়া সাইকেল থেকে নামার আগেই সে অনেক আশা নিয়ে প্রশ্নটা করল। তার দু’চোখ ঝিকমিক করছে।
“হ, বাবা, আইজ কিন্যা দেওনের লাইগ্যাই তো ইস্কুল থেইক্যা আগে আগে চইল্যা আইছি।‘ সাইকেলটা বাড়ির সামনের বেড়ার সাথে সাবধানে হেলান দিয়ে রাখতে রাখতে কুদ্দুস মিয়া হেসে বলল। বাবার উত্তরটা শুনেই রতন একটা আনন্দের চিৎকার দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল, “মা… মা…, বাবা আইজকাই আমারে নিয়া জুতা কিনতে যাইবো।“ তার চিৎকার রান্নাঘরে থেকেই হোসনা পরিষ্কার শুনতে পেল। তার মুখেও একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।
“বাবা, কোন সময় যাইবা? অখনই? আমি রেডি হই?” রতনের আর তর সইছে না। বাবার সাইকেলে চড়ে এখন সে চান্দিনা বাজারে যাবে। ওখানে রহমত সওদাগরের দোকানে তার অনেক আরাদ্ধ সেই বাত্তিওয়ালা জুতা পাওয়া যায়, সে জানে। তার কিছু বন্ধু ওখান থেকে কিনেছে। আজ বিকালে বা আরো ভালো হয় সন্ধ্যায় সেই বাত্তির জুতা পরে সে তার বন্ধুদের সাথে খেলবে। বন্ধুদেরকে যে করেই হোক সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলার মাঠে ধরে রাখতেই হবে, না হলে জুতার আলোগুলো ভালো করে দেখা যাবে না। উত্তেজনায় সে এক মুহূর্ত এক জায়গায় বসে থাকতে পারছে না।
কুদ্দুস মিয়া হাসিমুখে হলেও মনে অনেক ব্যাথা নিয়ে তার অনেক আদরের ছেলেটির উচ্ছাস দেখছে। কী আর এমন একটা আবদার, অথচ সেটাই পূরণ করতে তাকে তিনমাস অপেক্ষা করতে হলো! আসলে এতো স্বল্প বেতনে যেখানে সংসারের বোঝা বহন করাই অনেক কষ্টের, সেখানে চারশ টাকা দিয়ে এমন কিছু কেনাটা তাদের মত পরিবারের জন্য বিলাসিতার পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু ছোট্ট মানুষ, একটা শখ করেছে, ছেলের এই আবদারটা পুরণ করাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবশ্য এই ধরণের অন্য জুতার দাম দুই আড়াইশোর মধ্যেই তবে এটার তলায় কী না কী এক ধরণের লাইট লাগিয়ে দিয়েছে, পায়ের চাপ পড়লেই জ্বলে ওঠে, এতেই দাম হয়ে গেছে চারশ টাকা! খামোখাই বাচ্চাদের মাথা নষ্ট করার একটা ফন্দি, কুদ্দুস মিয়া অসহায়ভাবে ভাবে।
রতন পাঁচ মিনিটেই কাপড় পরে প্রস্তুত। কাপড়ও এমন কিছু না। আছেইতো কেবল দুইটা শার্ট। একটা স্কুলের আরেকটা বাসায় পরার। সে স্কুলের ভালো শার্টটাই পরেছে, আজ বিশেষ একটা উপলক্ষ! রতনের বয়স মাত্র সাড়ে চার বছর, কুদ্দুস মিয়ার একমাত্র সন্তান। আরেকটি সন্তান আসছে। তার স্ত্রী হোসনার এ অবস্থায় বাড়ির কাজ করতে বেশ কষ্ট হয়।
কুদ্দুস মিয়া নিজ গ্রামের বাড়িতে থেকেই চান্দিনা সরকারি হাই স্কুলে দপ্তরি হিসাবে চাকুরি করে। চান্দিনা উপজেলা সদরের পাশেই তাদের গ্রাম, সাইকেলে যেতে দশ মিনিটের মত লাগে। তবে পদে দপ্তরি হলেও তাকে স্কুলের নানা কাজ, স্যারদের নানা ফুট-ফরমায়েশ খাটতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো হেডস্যারের শখের বাগান করা। স্কুল ভবনটির সামনে একটা ছোট চত্তর আছে, তার পরেই বড় একটা খেলার মাঠ। তাদের স্কুলের হেডমাস্টার স্যার, আশরাফ আহমেদ খুবই ভালো মানুষ। কুদ্দুসকে বেশ স্নেহ করেন। তাঁর বাগানের খুব শখ।
“বুঝলা কুদ্দুস, এই বাগানে যখন সবগুলি ফুল ফুটবে, সেগুলির দিকে দেইখা তোমার নিজেরই গর্ব হবে। আল্লাহ আমাদের জন্য কী সুন্দর সুন্দর নানা রঙের ফুল বানাইয়া দিছেন। আর আমরাই যদি সেই ফুলগাছ না লাগাই, ফুল কেমনে ফুটবে, স্কুলটা দেখতে কেমনে সুন্দর হবে, তুমি বল?”
হেডস্যারের কথাগুলি তার খুব ভালো লাগে। সে দপ্তরি হলেও মালীর কাজগুলো সে অনেক বছর ধরে করায় বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। উপজেলা পর্যায়ের একটা স্কুলে মালী হিসাবে একটা আলাদা পদ দেয়া হয় না। তাই নিজের দপ্তরি পদটাই যেন আবার না হারায়, সে প্রাণপণে মালীসহ অন্যান্য সব কাজই করে যায়। তবে সে জানে এই হেডস্যার যতদিন আছেন, তার কোনো চিন্তা নাই। সে অতি আগ্রহের সাথে বাগান ছাড়াও সারা বছরই নানা জাতের ফুল বা অন্যান্য গাছ লাগায়, স্কুলের চারিদিক ও মাঠের ঘাসগুলোকে কেটে সুন্দর করে রাখা ছাড়াও কত রকমের কাজ যে করে!
সামনে শীতকাল আসছে। তাই বাগান পরিচর্যার কাজ সে আগে ভাগেই শুরু করে দিয়েছে। স্কুলে মালীর কাজ সে শুধু একাই করতে পারে। তবে বাগানের কেয়ারী তৈরির সময় হেডস্যার বাইরে থেকে তার জন্য একজন সহযোগী নিয়ে দেন, এতে কঠিন কাজগুলি দুইজনে মিলে করতে তেমন আর কষ্ট হয় না। এরপরে বাগানে চারা লাগানো, সেগুলির পরিচর্যা করা, নিয়মিত পানি দেয়া, নিড়ানো, এসব করার জন্য কুদ্দুস একাই যথেষ্ট।
আজ তাদের বেতন হয়েছে। তাই ছেলের শখ মেটানোর জন্য হেডস্যারকে বলে সে স্কুল ছুটির ঘন্টাখানেক আগেই চলে এসেছে। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতে হবে, কারণ তাদের বাড়ি থেকে বাজারে যেতে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েটার উপর দিয়ে কিছুক্ষণ যেতে হয়। সন্ধ্যার পরে ওখান দিয়ে সাইকেল চালানো নিরাপদ না। তাই দিনে দিনেই ছেলের শখটা মিটিয়ে সে বাড়ি ফিরে যেতে চায়।
তবে একটা সমস্যা রয়ে গেছে। তাদের স্কুলের শরীরচর্চা বা পিটি স্যার কুদ্দুসকে বলেছিলেন মাঠের ভেতরের সব ঘাস কেটে সমান করে ফেলতে। কোনো সময়সীমা যদিও দেননি, তবে পরের সপ্তাহে স্কুলের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা হবে। কুদ্দুস ভেবেছে, আজ না হলেও কাল খুব ভোরে উঠে পুর্নোদ্যমে কাজ শুরু করলে দুইদিনেই সব ঘাস কাটা হয়ে যাবে। তাই পিটি স্যার থেকে অনুমতি না নিয়েই সে হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। এখন যদি পিটি স্যার কিছু বলেন? তবে দেখা হলেও কিছু বলবেন না বলেই কুদ্দুসের ধারণা, কারণ সবাই জানে কুদ্দুস তার কাজে খুবই আন্তরিক, সময়মত তার সব কাজই সে করে ফেলে। অবশ্য পিটি স্যারের মেজাজ খুবই গরম। ছাত্র-ছাত্রিদের তো বটেই তিনি অনেক সময়ই নিন্মশ্রেণির কর্মচারিদের বকাঝকা, গালাগালি এমনকি কখনোবা গায়েও হাত তোলেন! তাই কুদ্দুস কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় আছে, কারণ বাজারে যেতে হলে তাকে স্কুলের উপর দিয়ে যেতে হবে।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে সাইকেলটা বেশ ধীর গতিতেই এগিয়ে চলেছে। সামনের রডটির উপরে ছোট একটি বালিশের মত কিছু রেখে রতন সেটাতে খুব আরাম করে বসেছে। কিন্তু সে খুবই উত্তেজনায় আছে। তার কেনো যেন মনে হচ্ছে চান্দিনা বাজারটা আজ হঠাৎ করেই অনেক দূরে চলে গেছে, পথ যেন শেষই হচ্ছে না! সে একেরপর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে, তার বাবাও হাসিমূখে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কুদ্দুস তার ছেলেটিকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।
“আইচ্ছা বাবা, যদি গিয়া দেহি, সব জুতা শেষ, তাইলে?” রতন বিশ্বাস করতে চায় না এটা সত্যি হবে, তবুও তার মনের শঙ্কাটা দূর করতে প্রশ্নটা করেই ফেলে। তার কাছে তার বাবা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী, ক্ষমতাশালী ও সাহসী মানুষ। এমন কিছু নেই যেটার উত্তর তার জানা নেই, কিংবা এমন কেউ নেই, যে তার বাবার সামনে কিছু বলতে সাহস করবে। তিনি একজন সুপারম্যান – পাশের বাড়ির রমজান চাচাদের বাড়ির টিভিতে দেখা সেই সুপারম্যান কার্টুন ছবির মানুষটির মত!
“শেষ হইবো না বাবা,” কুদ্দুস তাকে শান্তনা দেয়, “আর যুদি হয়ও, আমি তাইলে কুমিল্লা শহর থেইক্যা তোমার লাইগ্যা জুতাগুলি কিন্যা আনমু!” মুখে একটু স্মিত হেসে কুদ্দুস বলে।
কথাটা শুনে রতনের বুকে ধবক করে ওঠে, বাবা যেহেতু বলেছে পাওনা নাও যেতে পারে, তাহলে আসলেই না পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে! তাছাড়া কুমিল্লা থেকে আনতে গেলে তার যাওয়া হবে না এবং সেটা আবার কয়দিন পিছিয়ে যায় কে জানে! সে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করতে থাকে, যেন ওই দোকানে অবশ্যই জুতাগুলি পাওয়া যায়।
তারা হাইওয়ে পেরিয়ে তাদের স্কুলের সামনের গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে। পেছনের গেট দিয়ে বেরুলেই চান্দিনা বাজার শুরু। ছেলের মনের ভাব বুঝতে পেরে কুদ্দুস আরো যোগ করে, “আমরার যেমুন কিনার ইচ্ছা, দোকানদারগরওতো বেচনের ইচ্ছা থাকব, বল, ঠিক না? হের লাইগ্যা, পাওয়া যাইব, তুমি চিন্তা কইর না।“ বলে সে হাসল। রতনের মনের শঙ্কাটাও সাথে সাথে দূর হয়ে গেল। তবে সামনের দৃশ্যটি দেখে কুদ্দুসের মুখের হাসিটি মুহূর্তেই মুছে গেল। সামনেই একতলা মূল স্কুল ভবনটির সামনের পথটির পাশে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পিটি স্যার। তার মুখটি থমথমে। কুদ্দুস দ্রুত সাইকেল থেকে নেমে ছেলেকে বসিয়ে রেখেই সাইকেলটা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে গেল।
“কই গেছিলা, কুদ্দুস মিয়া?” কিছুটা দূরে থাকতেই পিটি স্যার প্রশ্ন করলেন। কুদ্দুস একেবারে তার সামনে এসে সাইকেলের দুই হ্যান্ডেলে দুইহাতে ধরে রেখে সালাম দিল, “আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। ভালো আছেন?”
“তোমারে আমি জিগাইছি, স্কুল ছুটির আগে তুমি কই গেছিলা? মনে হয় বাড়িতে গেছিলা?”
“জ্বি, স্যার। একটু কাজ আছিল। পোলাটারে লইয়া…”
“পোলাটারে লইয়া মানি কী?” হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন পিটি স্যার। “আমার কামের কী করছ?”
কুদ্দুস কোনো কথা না বলে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল আর পিটি স্যার প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে তাকে বকাঝকা এমনকি কিছু বাজে গালিও দিতে থাকলেন। রতন অবাক হয়ে একবার তার বাবার নত মুখটির দিকে আরেকবার পিটি স্যারের ভয়ঙ্কর রাগান্বিত মুখটির দিকে তাকাচ্ছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না, কী হচ্ছে!
বাইরে চেঁচামেচি শুনে হেডমাস্টার সাহেব কৌতুহলী হয়ে তার জানালার পর্দাগুলি একটু সরিয়ে বাইরে তাকালেন। এখান থেকে সব কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না, তবে জাহাঙ্গীর মানে শরীরচর্চা শিক্ষকের কথা তিনি শুনতে পাচ্ছেন। এমন অকথ্য ভাষায় কেউ কথা বলে কী করে, তিনি ভাবলেন। এর আগেও তিনি জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে একাধিক অভিযোগ পেয়েছিলেন, ভেবেছিলেন, তাকে একদিন ডেকে একটু শাসন করে দেবেন। তিনি তার কথা শুনে বেশ হতভম্ব হয়ে পড়লেন।
হঠাৎ করেই কুদ্দুস মুখটা নিচু করেই খুবই নিচু স্বরে কিছু একটা বলতেই পিটি স্যার সজোরে তার গালে একটা চড় মেরে দিলেন! হেডমাস্টার সাহেব চমকে উঠলেন, তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, তিনি এই দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন! তিনি তার স্কুলের সকল শিক্ষককে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন যে, এই স্কুলে কোনো ছাত্র-ছাত্রীর গায়ে কেউ হাত তুলতে পারবে না। অথচ জাহাঙ্গীর একজন কর্মচারীর গায়ে হাত তুলেছে! তিনি দ্রুত বাইরে গিয়ে পরিস্থিতিটাকে সামাল দেয়ার কথা ভেবে ঘুরতে যাচ্ছিলেন, তখন তার অন্য একটা দিকে চোখ পড়ল।
তিনি অবাক হয়ে দেখছেন, কুদ্দুসের শিশু ছেলেটা সামনে দুইহাতে সাইকেলের হাতলে ধরে বসে থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে মাথাটা কিছুটা উঁচু করে এক দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহাঙ্গীর যে চিৎকার করে তার বাবাকে বকাঝকা, গালাগালি করছে, সেসব যেন সে শুনতেই পাচ্ছে না, সে একটিবারের জন্যও পিটি স্যারের দিকে ফিরে তাকায়নি। সে এক নিষ্পলক চোখে, এক অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, যে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর তার দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু ঝরে পড়ছে। আশরাফ আহমেদ সাহেব তার জীবনেও এত অমানবিক, এমন হৃদয়বিদারক কোনো দৃশ্য নিজের চোখে দেখেননি! তার দুটো চোখ ভিজে গেল।
তিনি কুদ্দুসের কষ্টটা দেখছেন না। তিনি নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেই চার/পাঁচ বছরের শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি যেন তার মনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলি, তার অবাক দৃষ্টির ভেতরের কান্নাগুলি যেন তিনি অনূভব করতে পারছেন। তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে শিশুটা?
জন্মের পর থেকে সে তার বাবাকে দেখে এসেছে একজন ভালোবাসার মানুষ হিসাবে, তার যে কোনো ইচ্ছে পুরণের মানুষ হিসাবে। তার কাছে তার বাবা একজন মহান মানুষই শুধু নন, তার ক্ষমতা অপরিসীম। তাকে কীভাবে কেউ গালাগালি করতে পারে? কীভাবে কেউ তার গায়ে হাত তুলতে পারে? আর তার বাবাই বা কী ধরণের মানুষ! বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে মাথা নিচু করে নীরবে কেঁদে চলেছেন? কেন? আজ ছোট্ট এই শিশুটির সামনের জগতটা যেন হঠাৎ করেই পাল্টে গেল। টিভিতে দেখা সুপারম্যানের মতো তার বাবাকে সে একজন সুপার হিরো হিসাবেই জেনে এসেছে। তার বাবার এই পরাজিত রূপ দেখে সে বিশ্বাস করতে পারছে না! তার ছোট্ট চিন্তার জগতটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে! চোখ দুটি মুছে হেডমাস্টার সাহেব তার রুম থেকে ত্রস্তপায়ে বেরিয়ে এলেন। কুদ্দুস সাইকেলটি চালিয়ে যাচ্ছে, রতন সামনের লোহার রডে বসে অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। দুজন মানুষ, কেউই কোনো কথা বলছে না। নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে সাইকেলটি।
এতকিছুর পরও কুদ্দুস ঠিকই তার ছেলের জুতা কেনার জন্য বাজারের দিকে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু কে জানে কেন, রতন জুতা কিনতে যেতে রাজিই হল না! কুদ্দুস অবাক হয়ে ভাবছে, এতটুকু ছোট একটা বাচ্চাও তার বাবার কষ্টটা বুঝতে পেরেছে? সে-ও আর দ্বিতীয়বার কিছু না বলে সাইকেলটা ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরল। একাকী কোথাও গিয়ে তার প্রাণভরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে ভাবছে, পিটি স্যার এই কাজটা যদি কাল সকালে করতেন! যদি তার আদরের সন্তানটির সামনে এটা আজ না করে কাল সকালে তাকে আরো বেশি মারধরও করতেন! তার ছেলে কীভাবে জানবে যে, তাদের জীবনটা এভাবেই চলে। ছোটলোকদের কষ্ট, ব্যাথা, শিক্ষিত ওই মানুষগুলো বুঝতে চেষ্টা করে না, তাই বাকি জীবনটাও তার এভাবেই চলবে! তার দু’চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
রতন ভাবছে, তার জন্যই আজ তার বাবা এমন পরিণতির শিকার হলেন। সে তার জীবনেও কখনো আর বাত্তির জুতা চাইবে না। তাকে কিনে এনে দিলেও সে সেই জুতাজোড়া পরবে না। কারণ এই বাত্তির জুতাই তো সকল কিছুর জন্য দায়ি! সে তার অসহায় বাবার দিকে আরেকবার ফিরে তাকানোর সাহস করল না। নিঃশব্দে তার দু’গাল বেয়ে একটা উষ্ণ ধারা অবিরামভাবে গড়িয়ে পড়তে থাকল।
চারিদিকে সাঁঝের আঁধার নামছে, বেশ দ্রুতই চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেল বলে মনে হলো। প্রকৃতি যেন অভাগা সেই পিতার কষ্টটাকে তাড়াতাড়ি অন্ধকারে ঢেকে ফেলতে চাইছে, সন্তানের সামনে তাকে আর অপমানিত করতে চাইছে না। শিশুটিও সেটি আর দেখতে চায় না!