বখাটে প্লেবয়

বখাটে প্লেবয়

আমি চুপচাপ শুনছি, কফিশপে আমার মুখোমুখি বসে একটা বখাটে টাইপের ছেলে পটানো মূলক সব বাক্য গুলো আমার সামনে মুখস্ত উপস্থাপন করছে। ফেবুতে মেয়ে পাটানোর যতো টিপস দেখেছে সব গুলোই মুখস্ত করেছে বলে মনে হচ্ছে। একটাও বাদ নেই সব প্রয়োগ করছে। মনে মনে খুব হাসি পাচ্ছে। আধা ঘন্টা ধরে হাসি চেপে রেখে এখন কেনো জানি রাগ হতে শুরু করেছে। আর সেই রাগ ক্রমাগত এক ডীগ্রি করে করে বেড়েই চলেছে। এত মিথ্যা আর নিতে পারছি না। তারপর পোষাকের ছিরি দেখে দৌড়ে অবাক বনে হারিয়ে যেতে মনে চাইছে।

এই বখাটের কিংভুত কিমাকার সাজসজ্জা দেখে আমার ভিম্রী খাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোঁকড়ানো চুল গুলো এলোমেলো, এক কানে রিং পরা, মেয়েরাই শুধু দুল পরে না সেটাও আজ জানলাম। গলায় একটা সিলভার কালারের চেইন, বাম হাতেও চেন পেচানো, ডান হাতে একটা বালা, শার্টের বুক হাক্কা উদাম, ভেতরে একটা টিশার্ট পরা, টিশার্টে লেখা “I LOVE YOU” জিন্সটার দুই হাটুতে এক খাবলা কাপড় নেই, দেখে মনে হচ্ছে বাঘ খামচি দিয়ে হাটুর জিন্স টুকু খেয়ে নিয়েছে। এত্তো সুন্দর লুক নিয়ে এই ছেলে এসেছে আমার সাথে দেখা করতে। ছেলেটার সাহস দেখেও আমি ভিম্রী খাচ্ছি। তবে পোষাকের সাথে নবাব নামটা কতটা ম্যাচিং হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না বলে বেশ টেনশনে আছি। মুভিতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কানে দুল দেখে ছিলাম তাই এই নবাবটাও বোধ হয় কানে দুল পরেছে কিন্তু সিরাজ সাহেবের হাতে চুড়ি ছিল কিনা সেটা মনে পড়ছে না, এই সব ভেবে মনে মনে হাসি পেলো।

এই অসাধারণ বখাটে ছেলেটার সাথে কফি শপে বসে আছি বলে আমার বেশ শরম শরম অনুভব হচ্ছে। লোকে ভাববে যে এই বিশ্ব প্রেমিক প্লেবয়ের সাথে আমি কেনো বসে আছি? কিন্তু এই বসে থাকাটারও অসাধারণ একটা কারণ আছে। গতকাল এই ছেলেটা আমার জন্য হাত কেটে আমার নাম লিখেছে। তারপর পিক উঠিয়ে আমার ইনবক্সে দিয়েছে। সেটা দেখার পর আজ তার সাথে দেখা না করে পারলাম না। ভার্সিটিতে পড়া ছেলে হাইস্কুলে পড়া কিশোরদের মত হাত কেটেছে সেটা জানার পর আমার ফিলিংস উতলে উতলে পড়ে যাচ্ছিল তাই দৌড়ে এসেছি দেখা করতে। আমি আর চুপচাপ বসে থাকতে পারছি না তাই বললাম-“দেখি কতটা কেটেছো?” আমার কথা শুনে সে এমন ভাবে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে গেলো যে মনে হচ্ছে আমি পাবলিক প্লেসে ওর প্যান্ট খুলতে বলেছি বোধ হয়। সে এক রকম চিৎকার করেই বলে উঠলো

–“এই না…..”

আমি ওকে বসতে বলে একটু গদো গদো ভাবে তাকিয়ে কিছু রোমান্টিক উক্তি ভাষণ হিসেবে ছেড়ে দিলাম। সেও আমার কথা শুনে বেশ গদো গদো হলো। মনে মনে ভাবলাম মেয়ে পটানো লাভগুরু তো দেখছি টানার আগেই নিচে নেমে যাচ্ছে, ভেরী ফাইন। আমি ওর ব্যান্ডেজের জায়গায় চরম মমতা অর্পন করে বললাম-

–“আহারে! বাবু খুব কষ্ট হচ্ছে?”

সে তো ফুল গদোগদো হয়ে চুপচাপ আছে। তারপর আমি একটানে ওর ব্যান্ডেজ খুলে দিলাম। তারপর এক টাস্কিতে আমরা দু’জনই দাড়িয়ে গেছি। ওর হাতের কোথাও কাটা নেই। কত বড় ধোকাবাজ ছেলে সে! সে আর লেট না করে উরাধুরা দৌড় দিল। আমি একাই দাড়িয়ে হাসলাম। একশ মেয়েকে নাকানী চুবানী খাওয়ানো ছেলেটাকে আজ নাকানী চুবানী খাওয়াতে পেরে বেশ আনন্দ ফীল হচ্ছে।

এবার বলি ঐ বিশ্ব প্রেমিক মার্কা লুইচ খানের পরিচয়। ওর নাম নবাব, হাহা কি দারুণ নাম, মন ঝলসে যায়। মূলত ওর আসল নাম সজীব কিন্তু সে নিজেকে নবাব ভাবে। আমরা একই ভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টে, সে আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমার ভার্সিটি লাইফের শুরু থেকেই এই বখাটে ছেলেটা আমার পেছনে পড়ে আছে। এই ছেলেটার স্বভাব হলো মেয়েদের সাথে প্রেম প্রেম গেমস খেলা। নতুন ভর্তি হওয়া মেয়েদেরকে সে সহজেই পটিয়ে নেয়। চেহারাটা ভালো হবার সুবাদে একাক দিন একাক মেয়ে তার gf এর রোল করে। এক সাথে তার ছয় সাতটা gf, এক সপ্তাহ পর পর সে gf চেইঞ্জ করে।

আমার সাড়ে তিনটা বান্ধবী ওর প্রদত্ত ছ্যাকা খেয়ে হজম করতে না পেরে ব্যাকা হয়ে আছে। তিনজন ফুল ছ্যাকা আর এক জন হাফ ছ্যাকা খেয়েছে। এখন তার টার্গেট আমি। পুরো দুটো মাস মাস ধরে সে আমার পেছনে পড়ে আছে, বাট আমি পটছি না। গত পরশু সে আমাকে প্রোপজ করে ছিল জবা ফুল দিয়ে। হাহা পৃথিবীতে সে-ই মনে হয় প্রথম পুরুষ যে জবা ফুল দিয়ে প্রোপজ করেছে। হাটু গেড়ে যখন সে আমাকে I love u বললো, তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি ইমশোনাল হয়ে গেছিলাম, কারণ ওটাই ছিল আমার জীবণের প্রথম প্রোপজ। কিন্তু চোখের সামনে জবা ফুল দেখে মুখ দিয়ে I love u too না বের হয়ে বের হলো-

–“এক থাবড়ায় সব কয়টা দাঁত ফেলে দিয়ে প্রেমের ভুত নামাবো বখাটে”

আমার বিশ্বাস এই প্রোপজ করাটা ছিল ঐ বখাটে নবাবের জীবণের প্রথম ইতিহাস। এই ঘটনার পরের দিনই সে হাত কেটে আমার নাম লিখে আমার ইনবক্সে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের জীবণের দ্বিতীয় ইতিহাস ঘটালো।

সেদিন কফিশপ থেকে দৌড়ে পালানোর পর এক মাস ধরে আমি নবাবকে দেখিনী। আমার ক্লাশের কিছু মেয়ে আছে যারা জানে যে, নবাব একটা লেডী কিলার প্লেবয় তবুও নবাবকে না দেখলে ওদের যেনো খাদ্য হজম হয় না। নবাবকে না দেখতে পেয়ে আমার আহত ক্লাশমেটদের হসপিটালে ভর্তির উপক্রম হয়েছে। ওদের হাল দেখে মনে হচ্ছিল এ লুইচ মন্ত্রীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে ওদের হাতে অর্পন করে দেশ সেবায় যুক্ত হই। ঐ রকম একটা লুচ ক্যারেক্টরের ছেলে এত্তো মেয়ের ক্রাশ কি করে হয় সেটা ভেবেই আমার রাত দিন একাকার হয়ে গেছে। তবে আমার পেছনে ঐ ছ্যাচড়া ছেলেটা লাগছে না বলে আমি ফুল রিল্যাক্সে আছি। এর পর থেকে আমি নবাবকে দূর থেকে দেখলেও আমার আশে পাশে কোথাও দেখিনী। হয়ত সে এখন অন্য কোথাও গিয়ে প্রেম প্রেম গেমস খেলে।

স্টুডেন্ট লাইফটা শেষ করলাম, বাসায় বিয়ের জন্য বেশ চাপাচাপি চলছে। চার বছর আগে আম্মুর কোন্ বান্ধবীর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। চার বছর আগে হবু শ্বাশুড়ী একটা আংটিও পরিয়ে গেছে। যদিও আজ পর্যন্ত হবু বরের মুখটা দেখিনী। সে নাকি বিদেশে লেখা পড়া করতো। যারা বিদেশে থাকে তারা কখনোই দেশে আসতে চায় না। এই ছেলে নাকি লেখা পড়া শেষ করে দেশে ফিরেছে তাই বিয়ে নিয়েও একটু চাপের মধ্যে আছি। কিন্তু নিজের পায়ে না দাড়িয়ে আমি বিয়ে করবো না এটাই আমার ফ্যামিলীর কাছে আমার এক মাত্র প্রত্যাশা।

জীবণের প্রথম চাকরীতে জয়েন করে ফুরফুরে ইমেজে আছি। বস একটা সিনিয়র অফিসারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য উনার রুমে নিয়ে গেলেন। ঢুকেই আমি এক মণ খানেক টাস্কী খাইলাম। ঐ লুইচ খান ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। ওকে দেখেই আমার চোখে অতীত স্মৃতি ভেসে উঠলো আর সেই সাথে মেজাজটাও হট হয়ে গেলো। কিন্তু ওর সাজ সজ্জার আমল পরিবর্তন দেখে ডাউট হলো এটা আসলেই নবাব কি না। এমন জ্যান্টালম্যানের সাজে তাকে দেখতে বেশ লাগছে। আমি না চেনার ভান করলাম। আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ বস চলে গেলেন। তখন নবাব একটা ফিক করে হাসি দিয়ে বললো-

–“কি .. সেই আমার পিছু পিছু এলে তো? মাঝ খানে শুধু শুধু অনেক সময় লস করলে কেনো সোনা?”

ওর কথা শুনে ডাউট উড়ে গেলো আর মেজাজটাও খারাপ হয়ে গেলো। আমি ভুলেই গেলাম যে এই ছেলেটার আন্ডারেই আমাকে কাজ করতে হবে। সোনা ডাক শুনেই মাথা আউলায় গেলো। আমি রেগে গিয়ে বললাম-

–“সোনা? মানে??”
–“সোনা মানে সোনালী, সোনালীর শটকাট সোনা”
–“এর পর যদি আমারে আর একবার সোনা বলে ডাকছোস তাইলে ঘুঁষি মেরে তোর নাকের বদনা ফাটামু”
–“তুই করে বলছো!! এক লাফে তুই এ নামলা কেনো সোনা?”
–“এখন থেকে তোকে তুই করেই বলবো”
–“কলিগরা শুনলে কি ভাববে?”
–“ওদের বলবি আমি তোর বাল্যকালের ফ্রেন্ড”
–“না সোনা মানে সোনালী এটা তুমি করো না প্লীজ, আমি তো তোমাকে তুই করে বলতে পারবো না”
–“কেনো?”
–“ভালবাসি তাই”
–“ভালবাসি’ এই কথাটা বলে ভালবাসা নামক বস্তুটাকে আর অপমান করো না প্লীজ!”
–“ঠিক আছে আর বলবো না”

আমি কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। মনে মনে খুব রাগ হলো ঐ অসহ্য লুচুপুচু ছেলের আন্ডারে আমাকে কাজ করতে হবে বলে। ইচ্ছে করছে চাকরীটা ছেড়ে দিতে। মনে মনে বললাম হে আল্লাহ আমার কপালে এই ছিল?

দু’মাস অফিস করার পর বুঝলাম নবাব আর আগের মত প্লেবয় নেই। অফিসের মহিলা কলিগদের সাথে সে বেশ ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ করে। তবে আমার সাথে মাঝে মাঝে ফাজলামী করে আমাকে রাগায়। আজকাল ছেলেটাকে একটু একটু ভাললাগে কিন্তু ওর অতীত ভাবতে গেলে ঘুষি মেরে ওর নাকের বদনা ফাটাতে ইচ্ছে করে।
ওর প্রতি ঐ একটু একটু ভাললাগাটাকে খুব যত্নে ঢেকে রেখেছি।

একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে একটাও রিকশা পেলাম না বিধায় হেটেই রওনা দিলাম। আকাশ মেঘলা ছিল তাই বৃষ্টিও শুরু হলো। আমি উদাসীন হেটেই চলেছি সাথে ভিজেও চলেছি। বেশ ভাল লাগছিল ভিজতে তাই শহরের রিকশা ওয়ালাদের মনে মনে থ্যাংকস দিলাম। ওরা আজ নেই বলেই এমন অসাধারণ একটা মুহূর্ত জীবণে এলো। হঠাৎ মাথায় একটা ছাতা বৃষ্টি প্রতিহত করলো। পাশ ফিরে তাকিয়েই দেখি নবাব। আমি কিছু না বলেই হেটে যাচ্ছি, সেও আমার মাথায় ছাতা ধরে হাটছে। মনে মনে ভালো লাগলেও মুখে অসহ্য লাগছে এমন একটা প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলে বললাম-

–“মেয়েদের পিছু নেয়ার স্বভাবটা এখনো আছেই দেখছি” আমার কথা শুনে সে ছাতাটা বন্ধ করে বললো-
–“এখনো কি মনে করো যে আমি টলি ওলি মলিদের পেছনে ছুটি?”
–“ছুটো না বুঝি?”
–“ছুটছি তো বটেই তবে টলি ওলি মলিদের পেছনে নয়; ছুটছি সোনালীর পেছনে”
–“কি লাভ ছুটে?”
–“লাভ একটাই হলো love আর কিছু নয়”
–“এক দুই করে বয়স তো কম হলো না এবার ছেড়ে দাও এসব আর ভালো হয়ে যাও।”
–“একটা মেয়েকে ভালবেসে নিজেকে বদলে ফেলেছি আর বাকী যা কিছু আছে সেটা ছাড়লে আমি অস্তিত্বহীন হবো”

ওর কথা শুনে অবাক হলাম। কতটা বখাটে প্লেবয় হলে এমন কথা বলতে পারে। পাঁচ বছর আগে কফিশপ থেকে বের হবার পর আর কখনোই সে আমার সামনে আসেনী অথচ আজ বলছে সে একটা মেয়েকে ভালবেসে নিজেকে বদলে ফেলেছে। সে যে অনেক বদলে গেছে সেটা আমি নিজেও জানি কিন্তু সেই বদলে যাওয়াটা কি শুধুই আমার জন্য?? আর সেই বদলে যাবার মধ্যে কি ভালবাসা সত্যিই আছে?

সেদিন দু’জনই নিশ্চুপ ভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ছিলাম। তারপর বাসায় পৌছে হাচি শুরু হলো আর রাতের বেলায় কাঁপুনী দিয়ে জ্বর এলো। একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকি। ঢাকাতে আমার তেমন আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। জ্বরে রান্না করার শক্তি হারালাম। সারা রাতটা খুব কষ্টে কেটেছে। সকাল থেকে শুধু পানি দিয়ে প্যারাসিটামল খেয়ে বিকেল গড়ালাম। মুখটা অসম্ভব রকমের তেতো হয়ে আছে। শরীরটা ভীষণ দূর্বল, চেতনায় আছি কিন্তু শক্তি নেই।

সন্ধ্যার দিকে ডোর বেল বেজেই চলেছে। দশ মিনিট ধরে বাজছে। আমার শক্তি নেই দরজা খোলার। মনে খুব জোর সঞ্চয় করে উঠে দরজা খুলে দিলাম। তাকিয়েই দেখি সজীব, আমার আর দাড়িয়ে থাকার সামর্থ্য নেই তাই ঢলে পড়ে যেতেই সজীব আমাকে ধরে ফেললো। সে আমাকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর আমার কপালে হাত রেখে আমার জ্বরের তাপমাত্রা দেখলো। সে কিচেন থেকে এক বাটি পানি নিয়ে এলো, কোনো ন্যাকড়া খুঁজে না পেয়ে ওর রুমালটা বের করে আমার কপালে জল পট্টি দিল। তারপর টাওয়েল ভিজিয়ে মাথায় রাখলো। আমি চেতনায় আছি কিন্তু কথা বলার শক্তি নেই।মনে মনে ভাবছি বখাটে প্লেবয় ছেলেটা এসবও পারে!

কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম তা নিজেও জানি না। ভোর বেলায় ঘুম ভাঙতেই দেখি সজীব আমার বিছানাতেই ঘুমিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ওকে। ওকে দেখে কে বলবে যে কোনো এক সময় সে মেয়েদের সাথে টাইম পাস করতো! অনেক রাত ধরে সে আমার সেবা করেছে এটা ভাবতেই কেমন যেনো লাগছে। মনে মনে একটা ভাললাগা অনুভব করছি কিন্তু একটা পুরুষ সারা রাত আমার বিছানায় এটা খুব লজ্জা জনক ঘটনা। হঠাৎ নবাবের ঘুম ভেঙে গেলে, তড়িঘড়ি করে বিছানে থেকে নেমে বললো-

–“এখন কেমন বোধ করছো সোনা?” আমি -“বেটার”
–“ভেরী গুড, আমি তোমার জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়ে আনছি”
–“তুমি রান্না করতে পারো?”
–“চেষ্টা তো করতেই পারি”

পনেরো মিনিট পর সে স্যুপ বানিয়ে আনলো। তারপর আমাকে বসিয়ে নিজে হাতে খাইয়ে দিল। খেতে খুব বেশী টেস্ট না হলেও আমার প্রতি ওর কেয়ারটা স্যুপটাকে অসাধারণ টেস্টি করে দিল। মনে মনে বললাম এমন একটা পুরুষকেই নারীরা বোধ হয় চায়। আর এ কারণেই মেয়েরা ওর স্বভাব জানা শর্তেও ক্রাশ খেতো। এখনো অনেকের ক্রাশ সজীব। আমাদের অফিস স্টাপ রমা তো সজীব বলতেই পাগল; নেহায়েত সজীব ওকে পাত্তা দেয়না বলেই হয়ত কোনো ড্রামাকর ঘটনা ঘটেনী। কিন্তু সজীব যে আমাকে ভালবাসে সেটা অফিসের পিয়নটাও বুঝে ফেলেছে। আর সে কারণেই রমা আমার প্রতি জেলাস ফীল করে। আমাকে দেখলেই যেনো ওর শরীর পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালানোর মত জ্বলে। খাওয়া শেষে আমিই কথা শুরু করলাম

–“একটা মেয়ের রুমে সারা রাত কাটালে, সেটা ভেবেছো এক বার?”
–“জীবণের থেকে সম্মান বড় নয় সোনা”
–“আমার কাছে সম্মানটাই আগে কারণ আমি তোমার মত লুইচ খান না”

আমার কথা শুনে সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। এই রে কষ্ট পেয়েছে মনে হয়। বদলে যাওয়া মানুষটার অতীত খোঁচানো ঠিক হয়নী। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-

–“এখনো আমাকে লুইচ খানই মনে হয়? সত্যিটা বলবে কিন্তু”

আমি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ওকে যে মনে মনে একটু একটু ভাললাগে এই ব্যপারটা ওকে বুঝতে দিলে চলবে না। তাছাড়াও আমার তো বিয়ে ঠিক হয়েই আছে, তাই অন্য কাউকে নিয়ে ভাবাটা আমার অনুচিত। আমি কথা ঘুরালাম

–“আমি কি ভাবি না ভাবি সেটা বড় কথা নয়, এখন আমার সম্মানের প্রশ্ন”
–“তুমি আমাকে বিয়ে করবে সোনালী?”
–“মানে?”
–“যদিও তোমার পাশে শুয়েছি মাত্র তবুও যদি তোমার সম্মানহানি হয় তাই বলছি”
–“এটা তুমি আমি জানলেও প্রতিবেশীরা কেউ বিশ্বাস করবে না”
–“চলো আজকেই বিয়ে করবো”
আমি-“না”
–“কেনো?”
–“কখনো কাউকে ভালবেসেছো সজীব?”
–“তোমার প্রেমে পড়ে ছিলাম প্রোপজ করা আর হাত কাটার নাটক করার পর।

যেদিন আমার বখাটে মনটা বুঝলো যে সোনালী আমার টাইম পাস নয় বরং সে আমার শ্বাস নেয়ার উপাদান। যেদিন থেকে বুঝলাম যে তুমি আমার জীবণ জুড়ে বয়ে যাওয়া সুখের একটা ধারাপাত, সেদিন থেকেই দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখেছি। খুব ইচ্ছে করতো তোমার সামনে দাড়িয়ে বলি, সোনালী আমি তোমার জন্য বদলে গেছি। ইচ্ছে করতো তোমাকে ঘিরে যে অনুভূতি গুলো দিন রাত আমাকে লুটপাট করে সে গুলো সব তোমার সামনে দাড়িয়ে ফাঁস করি। জানো সোনালী, দূর থেকেও কাউকে খুব করে ভালবাসা যায়। ”

ওর কথা শুনে কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। চারবছর আগে বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আমাকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে তারপর তাদের পছন্দকে মেনে নেয়াতে পেরে ছিল। তাছাড়াও আমার সেই সময় কারো সাথে কোনো রিলেশনও ছিল না। সেই ছেলেটা নাকি বিদেশে লেখা পড়া করে, তাকে দেখার একটু সুপ্ত ইচ্ছে থাকলেও লজ্জায় বাবা মাকে বলতে পারিনী। আমি বাবা মায়ের কাছে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। কি করে আমি সজীবকে বিয়ে করতে চাইতে পারি? ওকে মিথ্যে আশ্বাস না দিয়ে সত্যিটা বলাই বেটার মনে হলো।

–“সরি সজীব আমার বিয়ে চার বছর আগেই ঠিক হয়ে আছে। আমি বাবা মায়ের পছন্দেই বিয়ে করবো সেটাই প্রোমিজ করেছি।”

ঐ ঘটনার এক সপ্তাহ পর বাড়ি থেকে ফোন আসে আমার এঙ্গেইজমেন্ট এর জন্য। আমি বাড়ি যাচ্ছি সেই উদ্দেশ্য কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই বিগত এক সপ্তাহ সজীব প্রয়োজনের বাহিরে আমার সাথে একটাও কথা বলেনী। এই দু তিন মাসে আমি কি এতই দূর্বল হয়েছি যে, সে কথা না বললে আমার এত কষ্ট হবে? ওকে আমার একটু একটু ভাল লাগতো কিন্তু ঐ জ্বরের রাতটার পর থেকে সেই ভাললাগাটা আমার অজান্তেই ভালবাসা হয়ে গেছে। কেনো জানি না মনে হচ্ছে বাবা মায়ের কাছে করা প্রমিজটা ভেঙে ফেলি।

কিন্তু বাড়ি ফিরে সেটা আর পারলাম না তাই নিয়তিকে মেনে নিলাম। কিন্তু সজীবের কথা খুব মনে পড়ছিল। এঙ্গেইজমেন্ট এর দিন দশ পনেরো জন্য এলো। এর মধ্যে বেশ হ্যান্ডসাম যুবক বয়সী চার পাঁচ জন। কার সাথে যে এঙ্গেইজমেন্ট হবে বুঝতেই পারছি না। এত গুলো হ্যান্ডসাম ছেলের সামনে বসে থেকেও আমার চোখে সজীবের মুখটা ভেসে উঠে কাঁন্না পাচ্ছে। আজকাল আমার যে কি হয়েছে ঐ নবাবকে ছাড়া কাউকেই না চোখে ধরে, না মনে ধরে। আজকাল আমার চোখেরও বোধ হয় প্রবলেম শুরু হয়েছে মনে হয় সে-ই পৃথিবীর সেরা সুন্দর। আর সেই মানুষটাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চলেছি, কি করে যে তাকে ভুলে যাবো সেটা ভেবেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কেনো যে আব্বু আম্মুর কাছে প্রোমিজ করে ছিলাম!

এঙ্গেইজমেন্ট এর অনুষ্ঠানে হুট করে আগমন হলো সজীবের। ওকে দেখে আমি তো অবাক এবং ভয়ও পাচ্ছি।
সে এখানে কি ভাবে এলো? আর কেনোই বা এলো? ওকে দেখে আমি কেমন যেনো হয়ে গেলাম। মনে হলো আমি খুব দামী একটা কিছু হারাতে বসেছি। আজ সজীবের সামনে অন্য ছেলের থেকে আংটি পরতে হয়ত আমার দশ গুণ বেশী কষ্ট হবে। এর চেয়ে সজীব না এলেই ভালো হতো। আমি সজীবের মুখের দিকে তাকাতেই আমার দু চোখ জলে ছলছল হয়ে গেলো। এত বড় একটা জীবণের অর্ধেক কেটে গেছে প্রেম বিরাগী হয়ে আর বাকী জীবণটা কাটবে অচেনা একটা মানুষকে চিনে নিতে, বুঝে নিতে, মানিয়ে নিতে এবং কিছু স্মৃতি ভুলে যেতেও। সেই জ্বরের রাতে নবাবের সাথে একরাত্রির স্মৃতি ভুলে যেতে হয়ত আমার জীবণের সমস্ত আয়ুষ্কাল শেষ হবে তবু পারবো কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

আচমকা সজীব পকেট থেকে একটা আংটি বের করে আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সে আমার হাতটা টেনে নিয়ে আংটিটা পরিয়ে দিলো। এত বড় ঘটনা অথচ কেউ অবাক হলো না দেখে আমি রীতিমত বিরাট রকমের অবাক হলাম। তবে মনে মনে যে পরিমাণ খুশি হলাম তা বর্ণনার সামর্থ্য আমার নেই। মনে মনে আরো বড় ধরনের অবাক হলাম এই ভেবে যে, একটা বখাটে প্লেবয়ের বউ হবো ভেবে আমি এত খুশি কেনো হচ্ছি?

মনে নানান রকমের প্রশ্ন চিমটি কাটতে লাগলো। তাহলে চার বছর আগে আমার বিয়ে কার সাথে ঠিক হয়ে ছিল? শুনে ছিলাম ছেলেটা বিদেশে লেখা পড়া করে তাহলে সজীবের সাথে কেনো এঙ্গেইজমেন্ট হলো? এই গোলক ধাঁধার রহস্য জানতে রুম থেকে আম্মুর হাত ধরে টেনে অন্য রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে, এসবের মানে কি? আম্মুর থেকে শুনলাম চার বছর আগে সজীবের সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল। সজীব ওর আম্মুর কাছে ওর জীবণের এক মাত্র সেরা গিফট চেয়ে ছিল। আর সেই গিফটের নাম সোনালী। সজীবের আম্মু চার বছর আগে আমাদের বাসায় এসে আমার আব্বু আম্মুকে বুঝিয়ে এই বিয়েটা পাকা করে রেখেছিল এবং এই ব্যাপারটা আমাকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করে ছিল। ওটা ছিল আমার জীবণের সেরা সারপ্রাইজ। আমি আমার রুমে জানালার ধারে দাড়িয়ে আছি। সজীব অর্থাৎ নবাব আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বললো-

–“বাহ্ বাবা মায়ের ইচ্ছেতে তো ভালোই লাফাতে লাফাতে বিয়ে করতে এসেছো!”
–“আগেই তো সেটা বলে ছিলাম”
–“অন্য কাউকে বিয়ে করে ঠকানোর মতলবও তো ভালোই কষে ছিলে”
–“মানে?”
–“আমার সাথে এক রাত্রি কাটিয়ে অন্যের বউ হতে এসেছো, তাকে কখনো বলতে সেই রাত্রের কথা?”
–“ঐ রাতে আমি অসুস্থ ছিলাম, এটা নিয়ে খোটা দিচ্ছো কেনো? আমি কি তোমাকে ডেকে ছিলাম নাকি? নাকি তোমার সাথে আমার প্রেম ছিল হ্য?”
–“আমার প্রেমে পড়ে ছিলে না বুঝি?”

–“এমা কখন তোমার প্রেমে পড়লাম? এই শোনো আমি কিন্তু এই সব পড়ি না”
–“তাই?”
–“আমি তো বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই আমার হবু বরকে মনে মনে ভালবেসেছি, তাই তোমার প্রেমে পড়ার প্রশ্নই আসে না”
–“ওহ তাই তো! তো আপনার হবু বরটা কে ছিল ম্যাম?”

এই রে ফেঁসে গেছি। ঘুরে ফিরে তো ফলাফল সেই একই হলো। আমার হবু বর তো এই লুইচটাই আর আমি তো এই লুইচকেই ভালবেসেছি। এখন কি বলবো?

–“জানি না, যদি জানতাম তোমার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তবে কিছুতেই রাজী হতাম না বুঝলে লুইচ খান?”

–“মিসেস লুইচ খান হতে চলেছো তুমি”
–“আমার বর লুইচ না”
–“তাহলে কি তোমার বর?”
–“লুইচ পদ থেকে সে পদত্যাগ করেছে, এখন থেকে সে আমার স্বপ্ন ঘেরা প্রেম আর আমার গোটা জীবনের ভবিষ্যৎ”

নবাব আমার দিকে অপলক চেয়ে আছে, দৃষ্টিটা ঠিক প্লেবয়দের মতই। ওর দৃষ্টি দেখে আমার ওকে ঘুষি মেরে ওর নাকের বদনা ফাটাতে ইচ্ছে করছে। বুঝলাম আমাদের দু’ জনার চোখেই গন্ডগোল আছে কারণ সে যে ভাবেই তাকায় আমার কাছে গন্ডগোল লাগে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত