অন্ধ মশাল

অন্ধ মশাল

জয়তীর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন চারপাশে বেশ ভীড় জমেছে। কড়ই গাছের তলায় প্রায় এক গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে। মাথা তুলতে গিয়েই সমস্ত শরীর অসহ্য যন্ত্রণায় শিউরে উঠল জয়তীর। রক্ত রঞ্জিত বাম হাতখানা সামান্য তুলে নিজেকে স্পর্শ করতে গিয়েই চমকে উঠল সে। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র দেহের উপর এক প্রস্থ কাপড় কোনোমতে ঢেকে দেয়া। যন্ত্রণায় ডুকরে উঠল জয়তী, গত রাতের সব দুঃসহ স্মৃতি এক এক করে মনে পড়ছে তার।

হাজার চেষ্টা করে ওসব শকুনদের কাছ থেকে নিজের সদ্য প্রস্ফুটিত কুমারিত্বের গন্ধ আড়ালে রাখতে পারেনি সে। চারপাশে জমা লোকের ঢল ক্রমশ ঘন হচ্ছে, এদিক ওদিক থেকে শোনা যাচ্ছে ফিসফাস আর ছি ছি রব। ম্রিয়মাণ ভীড়ে হটাত সামান্য চঞ্চলতার আভাস দেখা গেলো। ভীড় ঠেলে ফিরোজ আর আহসান মাস্টার দৌড়ে এলেন। ফিরোজ দ্রুত গিয়ে জয়তীকে কোলে তুলে নিলো, আহসান মাস্টার স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, নিজের মেয়ের এ বিধ্বস্ত রূপ তিনি চিনতে পারেননি। কড়ই গাছতলার ভীড় ফিকে হয়ে যাচ্ছে, শুধু গাছতলার নিচে কালচে হয়ে যাওয়া রক্তের ছোপ এক কালিময় কলংকের জানান দিচ্ছে। ফিরোজ দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছেন আহসান মাস্টার, তার দুগাল বেয়ে বইছে বাঁধভাঙা জল।

কটেজটা ঝাটঝুট দিয়ে পরিষ্কার করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি রনকের, ঝামেলা বেধেছে অফিসটা সাফ করতে গিয়ে। বছর দুয়েক হল এ থানায় ইনচার্জ কেউ ছিলো না। আজ সকালে রনক জয়েন করেছে। মোতালেব কনস্টেবল কটেজটা অনেকখানি ঝেড়ে মুছে রেখেছিলো বটে, কিন্তু থানার রুমটা মাকড়শা আর আরশোলার আড্ডা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। মোতালেব কোথা থেকে ২ জন ডেকে এনেছে, তারাই ঝাটঝুট দিচ্ছে, পাশে মুখে গামছা বেঁধে রনক দাঁড়িয়ে আছে। এলাকাটা একেবারেই অনুন্নত, খড়িগঞ্জ পার হওয়ার সময় শেষবারের মতো মোবাইলে নেটওয়ার্ক পেয়েছিল, এখানে নেটওয়ার্ক একবারে শুণ্য। ক্যারিয়ারের প্রথম পোস্টিং এতোটা খারাপ জায়গাতে হবে এটা রনক কল্পনাও করেনি।

আশুগঞ্জের নাম শুনে তার কলিগেরা কেনো মুচকি হেসেছিলো এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। দুপুরের খাবারটা সেরে নিতে কটেজের দিকে রউনা হবে ঠিক তখনই ছোট দলটাকে এগিয়ে আসতে দেখলো রনক। কয়েকজন যুবকের মাঝে একজন ভদ্রলোক গোছের মধ্যবয়স্ক হন্তদন্ত করে ছুটে আসছেন থানার দিকে। কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই মধ্যবয়স্ক বিধ্বস্ত লোকটা এসে মোতালেবের হাত ধরে কেঁদে ফেলল। কান্না জড়ানো কণ্ঠে একটা কথাই অস্পষ্টভাবে শোনা গেলো, “ আমার মেয়েটাকে বাঁচা মোতালেব।”

থানার জিপটা মেঠো রাস্তায় প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। রনক জিপের পেছন দিকে আহসান মাস্টারের পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আহসান মাস্টার, এ গায়ে বছর বিশেক আছেন। একটাই মেয়ে তার, নাম জয়তী। ক্লাস টেনে উঠেছে এবার, বেশ মেধাবি। পুরো ইউনিয়নে যে দুজন বৃত্তি পেয়েছে তার মধ্যে জয়তী একজন।

গতকাল সন্ধ্যায় রেণু খালার বাড়ি কাঁঠাল দিতে গিয়েছিলো জয়তী, আর ফেরেনি। সারা রাত আহসান মাস্টার সাথে তার এক ছাত্র ফিরোজকে নিয়ে পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে, জয়তীকে পাওয়া যায়নি। সেই জয়তীকে আজ সকালে গায়ের দক্ষিণ পার্শ্বের কড়ই গাছের তলায় পাওয়া গেলো, ধর্ষিত, রক্তাক্ত, বিবস্ত্র অবস্থায়। আহসান মাষ্টার দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন, ফিরোজ মাঝে মাঝে অবাক হয়ে পিছনে ফিরে তাকে দেখছে। এই মানুষটাকে কখনো সে কখনো গম্ভীর মুখ ছাড়া দেখেনি, আজ সে মুখে কান্না বড্ড বেমানান! জয়তীকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল ফিরোজ, জয়তীর তখনও পুরোদমে ব্লিডিং হচ্ছে। ইমারজেঞ্চি ইউনিটে ডাক্তার ছিলো বটে, কিন্তু তারা মুখের উপর না বলে দিলো প্রথমেই। তাদের ভাষ্যমতে এটা পুলিশ কেস, পুলিশ অনুমতি না দিলে কিছুই করার সামর্থ্য তাদের নাই। ডুবন্ত মানুষ বাঁচার চেষ্টায় খড়খুটো পর্যন্ত আকড়ে ধরে। আহসান মাষ্টার হাতে পায়ে ধরেও যখন মেয়ের চিকিৎসার কোনো ব্যাবস্থা করতে পারলেন না তখন রুদ্ধশ্বাসে থানার দিকে দৌড় দিলেন।

জেনারেল ওয়ার্ডের মেঝেতে তেলচিটে ময়লা একটা চাদর পেতে জয়ীতাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, কেবিনে জায়গা পাওয়া যায়নি। জয়ীতাকে দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিল রনক। সারা মুখে হিংস্র নখের আচড়ে ক্ষতবিক্ষত। চাদরের আড়ালে কাঁধের যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেখানে অসংখ্য ক্ষত। কে যেন মাংস উঠিয়ে নরভোজের আসর বসিয়েছিল! একবার দেখেই চট করে চোখ সরিয়ে নিলো রনক, মেয়েটাকে দেখেই হটাত করেই নীরার কথা মনে পড়ছে। রানার ছোট বোন নীরা, এবার কলেজে উঠেছে মাত্র।

নীরার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইছে রনক। জয়ীতার দিকে আড় চোখে আরেকবার তাকালো সে,পরমুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিলো। এরকম বীভৎস দৃশ্যে সে অভ্যস্ত নয়।
জয়ীতা আধো ঘুমে আধ জাগরণে সময় কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে সামান্য জ্ঞান ফিরলে তার ঠোঁট তিরতির করে দ্রুত কেঁপে উঠছে। তারপরই যন্ত্রণার তীব্রতায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে ঠোঁট-মুখ। মৃদু আর্তনাদ করেই ফের জ্ঞান হারাচ্ছে সে। তরুন এক ডাক্তার জয়ীতার পাশে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও তার মুখে কোনো ভাবাবেগ নেই। রনকের উপর তিনি খানিকটা বিরক্ত, আবার সামান্য ভয়ও পাচ্ছেন। হাসপাতালে ঢুকেই তার কলার চেপে ধরেছিল রনক। কলারে আরেকবার হাত দিয়ে কলারটা সোজা করে নিলেন তরুন ডাক্তার, নার্সকে নির্দেশ দিলেন দুই নাম্বার ব্যাগের ব্লাড অ্যাটাচ করে দিতে, ব্লিডিং থামছে না।

হাসপাতালের এককোণে চুপ করে বসে আছে রনক। এই মুহূর্তে কোথা থেকে ইনভেস্টিগেশন শুরু করবে তার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছেনা সে। অথচ মাত্র কদিন আগে ইনভেস্টিগেশন সেক্টরের ট্রেনিং এ তার র্যাং ক ছিল সবার উপরে। হোঁৎকামুখো এক ট্রেইনার, আনারুল শেখ তো তার কাঁধে হাত দিয়ে বলেই ফেলেছিলেন, “ তুমি খাঁটি একতাল সোনা হে! তোমায় যেমন ইচ্ছা গড়ে নেয়া যাবে”। আজ রনকের হটাত সেসব প্রশংসা মিথ্যা মনে হচ্ছে। বাস্তবতা আর কল্পনার ফারাকটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো রনক। এভাবে অথর্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুরই সুরাহা হবে না।

মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিষ্ঠুরভাবে বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে, এবং অবশ্যই গ্যাংরেপ। একজনের পক্ষে এরকম করা সম্ভব নয়। বাম গালে জ্বলন্ত সিগারেটের পোড়া দাগটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এ কাজ গ্রামেরই কারো, নতুবা গ্রামের ভিতরেই মেয়েটাকে পাওয়া যেতো না। ফিরোজকে ইশারায় ডেকে বাইরে নিয়ে গেলো রনক। আহসান মাস্টার তখনো দু হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন, একরাতের অভিজ্ঞতায় তিনি একেবারে বুড়িয়ে গেছেন। হাসপাতালের সামনেই বিরাট বড় বটগাছ। তারই নিচে ঝুপড়ির মতো টঙের দোকান। দোকানেই ভীড় প্রায় । ফিরোজের হাতে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল রনক, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ডান হাতে চায়ের কাপ নিল সে।

“ ফিরোজ?” রনকের ডাকে প্রচ্ছন্ন একটা সতর্কতা ছিলো, সেটা টের পেয়ে চমকে মুখ তুলল ফিরোজ। “ তোমাদের গায়ে কি উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণীর লোকজন আছে?” প্রশ্নটা করেই রনকের আফসোস হল, এভাবে সে আগাতে চায়নি। প্রশ্ন শুনে ফিরোজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রনকের কেনো জানি মনে হল ফিরোজ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। রনক ফিরোজের দিকে একটু এগিয়ে বসল। তারপর প্রত্যেকটা শব্দ বাছাই করে বলল, “তুমি কি জানো কে একাজ করেছে?”

ফিরোজ সামান্য মাথা কাত করল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “ এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে স্যার।”
বেঞ্চ ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রনক, এ ছেলে বলে কি! দ্রুত ফিরোজকে জিজ্ঞাসা করলো, “ কি বললে! আগেও!!”
ফিরোজ হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতের মাথা নাড়লো।“ জয়নাল ভাইয়ের বউ স্যার। নতুন বিয়ে করেছিলো জয়নাল ভাই, ভাবী ভূজংপুর গ্রামের মেয়ে। খুব ভালো মানুষ। বিয়ের কদিন পর জয়নাল ভাই বাজারে দোকানের গদিতে ছিল, ভাবি বাড়ি ছিল একলা। তখনই…” ফিরোজের কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। রনক চুপ করে আছে, ঘটনার যবনিকা তখনো আসেনি। বাষ্পীভূত কণ্ঠে ফিরোজ বলল,“ মাজেদা ভাবী পরের দিন বাটাম গাছে গলায় ফাঁস দিয়েছিল।” রনক আগের মতোই চুপ করে রইল, ফিরোজও হটাত চুপ করে গেছে। অবশেষে আচমকা নীরবতা ভেঙে নির্লিপ্ত কণ্ঠে রনক জিজ্ঞাসা করল,” কে ফিরোজ? শুয়োরের বাচ্চাটার নাম কি?” “ সুমন, চেয়ারম্যানের ছেলে সুমন।” দাঁতে দাঁত পিষে নামটা উচ্চারণ করল ফিরোজ।

কুদ্দুস মৃধার কাছে খবর পৌছেছে বেশ আগেই। খবর শুনে তার মুখে উত্তেজনার চিহ্ন দেখা না গেলেও ভিতরে ভিতরে বেশ বিরক্ত চেয়ারম্যান। গতরাতে ছেলেকে উত্তরপাড়ার জালাল ব্যাপারীর ছেলের সাথে মাতাল হয়ে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি ঢুকতে দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল বটে, কিন্তু এতোবড় ঘটনা ঘটিয়ে তার ছেলে বাড়ি ফিরেছে তা তিনি ভাবেননি। সেবার তো এই নিয়ে গায়ে বেশ তোলপাড় হয়েছিল, কিন্তু করিম মৃধার মুখের উপর কথা বলতে পারেনি কেউ। মেহেদিরাঙা লম্বা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে করিম মৃধার মুখে ঈষৎ হাসির রেখা খেলে গেল। আহসান মাস্টার খুব বাড় বেড়েছিল। সেবার মাজেদা গলায় ফাঁস দেয়ার পর গ্রামের ভিতরে গোপনে গোপনে আহসান মাস্টার তাকে নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে এমন খবরও তার কানে এসেছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে ব্যাটার!

রনক ঠিক বুঝতে পারছেনা কাজটা ঠিক হচ্ছে কিনা, কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার উপায়ও তার নেই। জয়তীর জন্য আনা বেডটার কোণায় গিয়ে জড়সড় হয়ে বসলো সে। জয়তীর জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। টানা ২ দিন পর এই প্রথম জ্ঞান ফিরল তার। মেয়েটা বোবার মতো নির্লিপ্ত চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্লিপ্ততা! একজন নারীর সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সতীত্ব। জয়তী কি বুঝতে পারছে সে তার সবচেয়ে বড় সম্পদটা হারিয়েছে? মৃদু গলা খাকারি দিলো রনক, আহসান মাষ্টার রনকের দিকে তাকালেন। তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে, গালের ভেজা ভাবটা যদিও এখনও বেশ বোঝা যাচ্ছে, চোখ উৎকট লাল। রনক আহসান মাষ্টারকে সামান্য ইশারা করল, আহসান মাষ্টারের মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সাড়া না পেয়ে রনক ইতস্তত করে জয়তীর কাছে এগিয়ে গেলো, জয়তী তখনো অপলক নির্লিপ্ততায় সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আছে।

পকেটের ভিতরে হাত দিয়ে টেপ রেকর্ডারটা অন করল রনক, তারপর ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে শুরু করল “ জয়তী? এখন কেমন লাগছে তোমার?” প্রশ্নটা করে নিজের কাছে নিজেকে বোকা বোকা লাগল রনকের, প্রশ্নটা এ পরিস্থিতিতে বেমানানই নয়, নিষ্ঠুরও। শেষ পর্যন্ত ইতস্তত করে একদমে প্রশ্নটা করেই ফেলল সে, “জয়তী? কারা ছিলো ওরা?” রনকের ঘোর ভাঙল জয়তীর কান্নায়, বুকভাঙ্গা কান্নায়। মেয়েটা আহসান মাষ্টারকে জড়িয়ে ধরে নিজের কান্না লুকাতে চাচ্ছে। রনক দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। এভাবে কাজ আগানো অসম্ভব। হাসপাতালের লম্বা সাপের মতো দুর্গন্ধযুক্ত করিডর দিয়ে রনক হেঁটে যাচ্ছে, তার হাতের টেপরেকর্ডারে বাজছে অসহায় এক মেয়ের করুন আর্তনাদ।

করিম মৃধা পুলিশ স্টেশনে বসে বেশ তৃপ্তি করে চা খাচ্ছেন। চায়ের দোকানটা থানা থেকে বেশ দূরে, চা আনতে আনতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। করিম মৃধা তবু আপত্তি করছেন না, বেশ হাসিমুখে ঠাণ্ডা চা’ই খাচ্ছেন। রনক বেশ কিছুক্ষণ নিরবে চেয়ারম্যান মৃধার সামনে বসে আছে, চেয়ারম্যান খেয়াল করছেন না। অবশেষে রনক তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, “ আপনার ছেলে সুমন কোথায়?”

করিম মৃধা চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে শান্ত চোখে রনকের দিকে তাকালেন। তার হাটুর বয়সী একটা পুঁচকে ছোকড়া তার মুখের উপর এভাবে কথা বলে উঠবে, এটা তিনি ভাবতে পারেননি। গলার স্বর শান্ত রেখে কথা বলার চেস্তা করলেন করিম মৃধা,“সুমন তো গত সপ্তাহে ওর চাচাবাড়ি বেড়াইতে গেছে।” রনক মাথা নিচু করে মৃদু হাসল, তারপর শান্তকণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল, “ তাহলে কাল সকালে সাকো বাড়ির আড্ডায় সে কি করছিলো?” করিম মৃধা মুখে চায়ের কাপ তুলেছিলেন মাত্র, প্রশ্ন শুনে তার চায়ের কাপের চা ছলকে সাদা পাঞ্জাবির উপরে পড়ল। নতুন এসেই রনক সাকো বাড়ির তাসের আড্ডার খবর পেয়ে যাবে এটা তিনি ভাবতে পারেননি। সাঁকো বাড়ির সৃষ্টি করিম মৃধার হাতেই। দিনের বেলা ভিতরে চলে তাসখেলা ,গোপনে গোপনে চলে লালপানির ব্যাবসা। রাতের বেলা সাঁকো বাড়ির বাইরের ঝাঁপি ফেলে দেয়া হয়, ভিতরে শুরু হয় নিষিদ্ধ চলচিত্রের রমরমা ব্যবসা। আশেপাশের বহু গ্রামের কুরুচিপূর্ণ মানুষ পতঙ্গের মতো ছুটে আসে এসব দেখতে।

বাজারের একমাথায় সাধারণ আর কটা দোকানের মতো দেখতে এই সাঁকো বাড়ি, বাইরের কেউ এসে হটাত খোঁজ পাওয়ার কথা না, যদিনা ভিতরের কেউ খবর দিয়ে থাকে। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন চেয়ারম্যান। গায়ের লোকেরা তার পিছনে লেগেছে একথা রইস কয়েকবার তার কানে তুললেও মাছি নাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়েছেন মৃধা। এখন মনে হচ্ছে কথাটা একেবারে মিথ্যা না। “কি হল? কথা বলছেন না কেন?” ভ্রু কুঁচকে ঝাঁঝালো স্বরে আবার চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করল রনক, মুখে একটু আগে লেগে থাকা হাসির লেশমাত্র নেই। রনকের কথা শুনে এবার ক্ষেপে উঠলেন করিম মৃধা। এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, চেয়ারটা পিছন দিকে উলটে পড়ল।

“ বেতমিজ! মুরুব্বীদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানা নেই? গত ১৫ বচ্ছর ধরে আমি এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। গায়ের সব বিচার সালিশ আমার হাতে হয়। ব্যাদাইম্যা কোন মাইয়া, আচার শিক্ষা নাই, কার লগে ফষ্টিনষ্টি করার টাইমে ধরা পড়ছে আর তাই লয়ে আমার ছাওয়ালের লগে মস্করা! দেহি কি করবার পারেন!” মোটামুটি একটা হুমকি দিয়েই ক্যারাভাসের ছাতাটা হাতে নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলেন করিম মৃধা, বুক তার ধড়পড় করছে, রইস এসে দ্রুত তার মাথার উপর ছাতা মেলল। থানায় আসা নতুন এ ছোকরা যে ঘাবড়াবার বস্তু নয় তা দেখেই বুঝেছিলেন। এতোগুলো কথা বলে এলেন, রনকের চোখের পাতা পর্যন্ত কাপেনি। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আনমনে হেসে উঠলেন করিম মৃধা। তার ক্ষমতা সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা এ ছোকরার নেই, রনককে সরাতে তার সময় লাগবেনা। সেই সাথে আরেকটা চিন্তা হুট চেয়ারম্যানের মাথায় আসল, চিন্তার ফলাফলে করিম মৃধা এতো খুশি হলেন যে বারদুয়েক নিজের মাথায় নিজেই চাপড় মারলেন, বুড়ো মাথার সব বুদ্ধিই পাকা।

থানায় যে একটা টেলিগ্রাম করার আদিকালের যন্ত্র আছে তা রনকের চোখে পড়েছে গতকাল। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ওটাই। টেলিগ্রাম থাকলে টেলিফোন কেনো আনা যাবেনা এ প্রশ্ন এক রনক কনস্টেবলকে করেছিল। তার মাথা চুলকানোর ভঙ্গী দেখেই বোঝা গেলো এ কথা তার মাথায় কখনো আসেনি। ঘটনাটা ঘটলো বিকেলের একটু আগে। রনক থানা থেকে বের হবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই যান্ত্রিক শব্দে টেলিগ্রামে একটা ম্যাসেজ আসলো। রনক অবাক হলো বটে, এমন অসময়ে কোনো টেলিগ্রাম করার কথা না, যদিনা রুপা করে থাকে। হাসিমুখে ছাপানো কাগজখানা হাতে নিয়ে মূর্তির মতো জমে গেলো রনক, তার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে, নেক্সট জয়েনিং ডেট আগামিকাল! তখনই উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে ফিরোজ থানায় ঢুকল, করিম মৃধা তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।

উঠোনটা খুব বেশি বড় না, মাঝখানে একটা বেশ লম্বা লেবুগাছ। পুরো উঠান লোকে লোকারণ্য। করিম মৃধা পঞ্চায়েত ডেকেছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে সামনের দিকে তাকালো রনক। মাঝখানে চেয়ারে বসে হাসিমুখে দাড়িতে হাত বোলাচ্ছেন চেয়ারম্যান করিম মৃধা, তার পাশের চেয়ারে বসে থাকা জনকে দেখে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না রনকের, সুমন। সুমনের পিছনে জালাল ব্যাপারির বড়ছেলে। আহসান মাষ্টার মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন, তার চোখে শুন্য দৃষ্টি। ঘরের চোকাঠে বসে আছে জয়তী। বসে আছে বলা যায় না, বসার মতো অবস্থায় সে নেই। পাশের এক বয়োবৃদ্ধ মহিলার কোলে হেলান দিয়ে আছে।

করিম মৃধা সামান্য গলা খাকারি দিয়ে কথা শুরু করলেন।“ ভাইসব, ঘটনা আপনারা সবই জানেন। আহসান মাষ্টার এ গায়ে আইছে বহু বচ্ছর। হেই নাকি মানুষ গড়ার কারিগর! নিজের মেয়েরেই সে মানুষ করবার পারে নাই, অন্যজনের ছেলেপিলে মানুষ করবে ক্যামনে?” আহসান মাষ্টার হটাত সটান সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, দৌড়ে গিয়ে টুটি চেপে ধরলেন করিম মৃধার। সুমন এসে এক ঝটকায় আহসান মাষ্টারকে লাথি মেরে আলাদা করল। ফিরোজ গিয়ে পেছন থেকে টেনে ধরলো মাষ্টারকে। কিন্তু আহসান মাস্টারের গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। গলায় হাত বুলাতে বুলাতে চেয়ারম্যান উপস্থিত ভিড়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ দেখলেন? কত্ত বড় বে-লেহাজ! ব্যাদাইম্যা মাইয়ার বাপ হইয়া তেজ দেহায়! এদের গ্রাম থেকে তাড়ানো হোক! কি বলেন? সবাই একমত?” উপস্থিত লোকেদের মধ্যে কোনো সাড়া দেখা গেলো না, শুধু প্রথম সারির কজন উচ্ছৃঙ্খল হা হা করে চেচিয়ে উঠলো। পকেটের ভিতরে দলা করা ট্রান্সফার অর্ডারটা মুঠো করে ধরে রইলো রনক, তারপর ধীরে ধীরে পিছনে সরে আসলো। তার স্বপ্নে দেখা আদর্শে খাদের মাত্রা সে বেশ বুঝে গেছে।

রাত বেশ হয়েছে, স্যুটকেসটা রনক প্রায় গুছিয়ে এনেছে। রনকের নতুন পোস্টিং একেবারে শহরতলীতে, কিন্তু কেনো জানি রনক খুশি হতে পারছেনা। নিজের কাছে বারবার ছোট লাগছে নিজেকে। মোতালেব খবর নিয়ে এসেছে, গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে আহসান মাষ্টার। খবরটা শুনে নিজেকে বারবার ধিক্কার দিলো রনক, এই ছিলো তার সফলতা!
কটেজের দরজাটায় সশব্দে কে কড়া নাড়ল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রনক, গাড়ির সময় হয়ে গেছে, মোতালেবের চলে আসার কথা। দরজাটা খুলে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলো রনক। কটেজের সামনে ফাকা জায়গায় বেশ একটা জটলা, জটলার মাঝে একটা মশাল।

মশালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জয়তী, ধীর স্থির, জড়তাহীনভাবে। আগুনের শিখাতেও তার চোখ কাপছেনা, হাতে ধরা একটা লাঠি। তখনই বিষয়টা চোখে পড়ল রনকের, ভিড়ের প্রত্যেকের কাছেই ছোটবড় কিছু না কিছু আছে। বুড়ি রহমতের মা পর্যন্ত হাতের লাঠি উচিয়ে রেখেছে, তার চোখের ঝাপসা ভাবটা আর নেই। এ এক অপ্রতিরোধ্য আহ্বান, এ আহবান ফিরিয়ে দেবার সামর্থ্য রনকের নেই। ধীর পায়ে ঘরের ভিতরে ঢুকল সে। কাউকে পাক-কাদা থেকে টেনে তুলে আনতে গেলে মাঝে মাঝে নিজের এক পাও কাদায় ডুবাতে হয়, নিয়মকে ঠিক রাখার জন্য মাঝে মাঝে নিয়মের বাইরে যাবার প্রয়োজন পড়ে। রিভালবারটাতে কার্তুজ ভরে নিলো রনক, মানুষের মাঝে অমানুষের বেচে থাকার অধিকার নেই।

ঘোর অমাবস্যা। গ্রামের সরু পথটা দিয়ে হেটে যাচ্ছে কয়েকজন, মশালের নিভু নিভু আলোয় তাদের কাউকে চেনা যাচ্ছে না আলাদা করে। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে তারা সবাই মানুষ, হ্যাঁ মানুষ! এমন সব মানুষ যাদের বিবেক আজও জীবিত। পদশব্দে তাদের ভীরুতা নেই, নেই সামান্যতম লুকোচুপি। তাদের চোখের অঙ্গারের কাছে ঘোর অমাবস্যাও তুচ্ছ। অমানুষের বিরুদ্ধে মানুষের এ যুদ্ধ আদি ও অনন্তকালের।

ভোর হতে বেশ খানিক দেরি। আশুগঞ্জের ডোবার পাশে পড়ে আছে বীভৎস দুটো লাশ। কিন্তু তাতে সদ্য ফোঁটা ভোরের আলো এতটুকু ম্লান হয়নি। কুকুর বেড়াল দূরের কথা, আকাশের ত্রিসীমানায় কোনো শকুনেরও দেখা নেই। হাজার হোক, শকুনের মাংস শকুনে খায় না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত