আমাকে চুপিসারে রুমে ঢুকতে দেখে তানহা বলে উঠলো,
-মাফ করবেন, এতদিন আমি চুপ করে সয়ে গেছি। গত তিনমাস যাবৎ আপনি এমনটি করে চলেছেন। প্রথম কদিন যাবার পর ভেবেছিলাম, হয়ত অভ্যাস পাল্টে যাবে। কিন্ত আমার ভাবনা ভুল ছিল। যত দিন যেতে লাগলো আপনি তত আরো এরকম করতে লাগলেন। ঘড়ির কাটা দেখেছেন এখন ক’টা বাজে? আমি ওকে এড়িয়ে যেতে চাইলাম। পা বাড়ালাম ওয়াশরুমের দিকে। কিন্তু পারলামনা আমি। ও আবার বলে উঠলো,
-কি হলো! আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই যে এভাবে চলে যাচ্ছেন! আগে জবাব দিন তারপর যান। আমি এবার ওর দিকে ফিরে তাকালাম। রুমের ভেতর আবছা আলো। পাশেই সুইচ ছিলো, অন করলাম। লাইট জ্বলে উঠলো। থ্রিপিস পড়ে আছে ও। মাথায় ওড়না দেয়া। ঘরের ভেতর সবসময় এই বেশেই থাকে। বুজতে পারলাম, উত্তর না দিয়ে আজ আর রেহাই পাওয়া যাবেনা। এবার আমি নিচু স্বরে বললাম,
-আগে ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর না হয় সব বলি! ও বললো,
-নাহ, এখনি বলুন! কথাটি বলতে বলতে ও টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটি নিয়ে এগিয়ে আসলো আমার দিকে। পানি পান করলাম। গ্লাসটি হাতে নিয়ে বললো,
-দেখুন, আমি আপনার স্ত্রী। আপনার সবকিছু জানার অধিকার আমার আছে। এতদিন ধরে আপনি এভাবে রাতে দেরি করে ফিরেন আমি কোনদিন টুঁশব্দটিও করিনি। কিন্ত আজ, আজ বাবা এসে দীর্ঘ চার ঘন্টা আপনার জন্য বসে অপেক্ষা করে গেছেন। কল দিয়েছি বেশ কয়েকবার অথচ একবারো ফোনটি রিসিভ করলেননা! বাসায় যদি কোন বিপদ হতো তখন কি হতো কোন ধারণা আছে কি আপনার? তানহার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ছ’মাস হতে চলেছে। এর আগে কোনদিন ও আমাকে এভাবে প্রশ্ন করেনি। আজ করছে। আর কেন করছে সেটা ইতোমধ্যে আমার সাথে সাথে আপনারাও জেনে গেছেন। এবার আমি বললাম,
-আমার ফোনটা আজ সন্ধায় চুরি হয়ে গেছে। আমিও আমার ফোনে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলাম তবে চোর বেচারা রিসিভ করেনি। জানিনা, চুরি করার পরও কেন ফোনটা সুইচ অফ করেনি! আর দেরি কেন হয়েছে সেটা আগে আমাকে ফ্রেশ হতে দাও তারপর সব বলছি। আমার ফোন চুরি হয়ে গেছে শুনে তানহার চেহারার রং এবার পাল্টে গেল। ও বললো,
-কি বলছেন এসব! ফোন চুরি হয়ে গেল কি করে? আমি এবার বললাম,
-দেখো, পেটে অনেক ক্ষিদে। পরে বলছি তো সব….
আমার কথার ধরণ আর চেহারা দেখে ও বুঝতে পেরে গেছে এবার আমি রেগে যাচ্ছি। ও সরে দাঁড়ালো এবার। আমি চলে গেলাম ওয়াশরুমে। গোসল করলাম। প্রচণ্ডরকম ঘেমে গেছি। প্রতিদিনই এরকম ঘামি আমি। চাকরী যেটা করি মাস শেষে তার বেতন পাই চৌদ্দ হাজার। তার থেকে বাসা ভাড়া বাবদ দিতে হয় ছয় হাজার টাকা। বাদবাকি অন্যান্য খরচ সামলে বাবা-মায়ের জন্য বাড়ি পাঠানোর মতো তেমন টাকা আর হাতে থাকেনা। আর কিছুদিন পরই শালিকার বিয়ে। তানহার একমাত্র বোন। আর আমিও তার একমাত্র দুলাভাই। সবকিছুর কথা ভেবেচিন্তেই আমাকে চাকরীর পাশাপাশি বিকল্প পথ বেছে নিতে হলো।
কিন্তু এসব বিষয়ে আমি তানহাকে কিছু বলিনি। জানি, আমার হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কথা ও শুনলে কিছুতেই সেটা সহ্য করতে পারবেনা। তবে আজ ওর কাছে সব না বলে আর কোন উপায়ন্তর দেখছিনা আমি। কিন্তু কি করে কি বলব সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। ফ্রেশ হয়ে রুমে আসলাম। ডাইনিংয়ে খাবার নিয়ে বসে আছে তানহা। আমাকে আসতে দেখে সবকিছু দেখে নিতে লাগলো দেয়া হয়েছে কিনা। আমি আসার পরই ও খায়, হাজার বলার পরও কোনদিন আমাকে ছাড়া রাতে খায়নি। তবুও প্রতিদিনকার মতো বললাম,
-এতো রাত পর্যন্ত জেগে না থেকে খেয়ে শুয়ে পড়লেই তো পারতে। যা করোনা তুমি। এবার ও বললো,
-আমি তো আর চাইলেও আপনার মতো এত কঠোর হতে পারবনা। আমি পারিনা ঐসব। নিন, খান এবার! দেশি মুরগীর তরকারি দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি ব্যাপার! গোশত কোত্থেকে? ও বললো,
-মা রান্না করে বাবার কাছে দিয়ে দিয়েছিলেন। আগে এটা খান পরে আরো আছে। কথাটি বেশ হাসিমুখেই বললো ও। আমিও অবাক হয়ে বললাম,
-আরো আছে মানে? তা, আর কি দিয়েছেন তোমার মা? ও বললো,
-আরেকটা তরকারি আমার শাশুড়ী মা দিয়েছেন সেটা পরে দিব। আমি বললাম,
-তোমার বাবা কি আজ বিশ্ব ভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন নাকি? কথাটি শুনে ও চোঁখগুলো বড়বড় করে দিয়ে বললো,
-দেখুন, না জেনে না বুঝে আমার বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলবেননা!
আমার শশুর আর শাশুড়ী কাল আমাদের বাড়ি গিয়েছেন। বাবা আজ আসবেন জেনে শাশুড়ী মা আপনার জন্য আলাদা রান্না করেছিলেন। মেয়েদেরকে যত বকাবকি আর যাই বলেননা কেন, কখনোই ওদের বাপের বাড়ি নিয়ে খারাপ কথা বলবেননা। এমন কোন কথা বলবেননা, যা শোনার মধ্যে এটা উপলব্ধি হয় যে, আপনি তাঁর বাবা-মাকে অথবা বাপের বাড়ির কাউকে ছোট করছেন। অথবা এমনকিছু মনে হয় যে, যার দ্বারা বুঝায়; আপনি তাঁদেরকে যথাযথ সম্মান দিচ্ছেননা। এতে করে মেয়েরা অনেক কষ্ট পায়। এমনকি, এসবের জন্য স্বামীর প্রতি স্ত্রীর মনে এক ধরণের স্পেসের তৈরি হয় যা কিনা সাংসারিক জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
এখানে যদিও আমি তানহার বাবাকে কোনরকম কটাক্ষ করিনি বা ছোট করিনি তবুও তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটি বলায় ওর কাছে খারাপ লেগেছে। এবার ভাবুন, যদি খারাপ কিছু বলি তখন কেমন লাগবে ওর! তানহা খুব বুদ্ধিমতী। ও দেখেছে, ছুটিতে বাড়ি গেলে সবসময় আমি মায়ের হাতের রান্না করা তরকারি দিয়েই পেটভরে খেয়ে ফেলি। আর সেটা থেকেই ও আগে থেকেই সতর্ক, জানে; আগে যদি আমার মায়ের হাতের রান্না করা তরকারি আমার পাতে দেয় তাহলে আর ওর মায়ের রান্না করা তরকারি আমি ছুঁয়েও দেখবনা। স্ত্রী তো, অর্ধাঙ্গিনি আমার, সবকিছু মনে রাখে। তবে, তার যত খারাপ লাগা এই বিষয়টা নিয়েই যে, কেন আমি এতদিন ধরে রাতে দেরি করে ফিরি আর সে বিষয়ে ওকে নিজে থেকেই কিছু বলিনা। এবার ও প্রশ্ন করলো,
-তা, আপনি তো বললেননা যে কেন এত দেরি করে আসেন আর কোথায় থাকেন! আমি ওর দিকে আমার অর্ধেক খাওয়া মুরগীর রানটি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-সেসব শুয়ে শুয়ে বলব, এবার এটি খাওতো! কোন কথা না বলে ও হা করে একটু সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-আপনি দিয়ে দিন মুখে!
আমি এমনি করি। খেতে বসে বউয়ের সাথে ভাগবাটোয়ারা করে খাই। স্বামী হয়েছি বলে যে, আমাকে একাই মুরগীর দুটো রানই খেয়ে ফেলতে হবে! গলা, ঠ্যাং সব আমাকেই যে খেতে হবে বিষয়টি তা নয়। মেয়েরা এমনই হয়, ওরা কম খেয়ে নিজের স্বামীকে ভালো ভালো খাওয়াতে ভালোবাসে। এতেই যেন ওদের তৃপ্তি! তবে, আমরা যদি অর্ধেক বা কিছু অংশ খেয়ে বাকিটা স্ত্রীর মুখে তুলে দিই তাহলে সেটা আর ফিরিয়ে দিতে পারবেনা। বরং, এতে করে সাংসারিক জীবনে শান্তির বারিশ বয়ে যাবে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে এবার বিছানায় গেলাম। বালিশ থাকলেও আমি শোবার পর তানহা আমার বুকেই ঘুমায়। আজো এর ব্যতিক্রম হলোনা। ভেবেছিলাম, রোমান্টিক কিছু কথা বলে সবকিছু গুলিয়ে ফেলব তবে, সেটা আর হয়ে ওঠেনি। বুকে মাথা রেখেই ও বলে উঠলো,
-এবার বলুন কেন এত দেরি হয় আপনার? আমিও এবার বলতে লাগলাম,
-আসলে, তুমি তো জানোই যে, আমি যে পরিমাণ টাকা মাস শেষে পাই তা দিয়ে সবকিছুর খরচ বাদে আর কিছু থাকেনা। তাই আরকি এসব কথাগুলো বলে আমি থেমে গেলাম। ও মাথা ভাসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-তাই কিসব? থামলেন কেন? আমি বলতে লাগলাম,
-তোমাকে আজ মিথ্যা বলার জন্য দুঃখিত। আমার ফোনটা চুরি হয়নি। ঐটা অফিসের এক কলিগের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। আর পঁচিশশো টাকা দিয়ে একটি বাটন সেট কিনেছি। এখানে থেকে খেয়ে সবকিছুর খরচ বাদে বাড়ি পাঠানোর মতো টাকা থাকতোনা বলে আমি একটি পার্টটাইম জব নিয়েছি। এটি বেকারির কাজ। অনেক বলেকয়ে এক বন্ধুর মাধ্যমে এটি নিয়েছি আমি। চার ঘন্টার কম কাজ করা যায়না। হয়ত চার ঘন্টা নয়ত আট ঘন্টা আর চাইলে বারো ঘন্টাও কাজ করা যায়। আমি এতদিন চারঘন্টা করেছি। আজকেই প্রথম আট ঘন্টা করলাম। এখানে ওরা প্রতিদিন টাকা দিয়ে দেয়। আাড়াইশো টাকা করে দিতো আমায় যা কিনা মাস শেষ দাঁড়াতো প্রায় সাড়ে সাত হাজারে। এর থেকে পাঁচ হাজার টাকা বাবাকে পাঠাতাম। একহাজার টাকা ব্যাংকে রাখতাম সঞ্চয় হিসেবে। আর বাকিটা আনুষাঙ্গিক খরচে চলে যেত। কদিন পরই তোমার বোনের বিয়ে। আর বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। আমার আর কি করার ছিল বলো! ও এতক্ষণ ধরে চুপচাপ শুয়ে ছিলো। হুট করেই এবার কেঁদে উঠলো ও! স্বজোড়ে আঁকড়ে ধরলো আমায়। আমি ওকে থামানোর চেষ্টা করে বললাম,
-আরে, আমার পাগলীটার আবার কি হয়ে গেলো! ও কান্নামাখা স্বরে বললো,
-আমাকে মাফ করে দিন আজ আপনার সাথে এভাবে কথা বলায়। আমি আসলেই বড় ভাগ্যবতী। তবে, যাই করেন আমাকে জানাইয়েন। চিন্তা হয় যে সেটাও কি বুঝেননা! আমি ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে এবার বললাম,
-আচ্ছা পাগলী, আর হবেনা এমন।