রাত ১২টা ছুঁইছুঁই।খাবার টেবিলে না খেয়ে বসে আছি রাহাতের অপেক্ষায়।আজকাল অনেক রাত করেই বাসার ফিরে রাহাত।বাসার সবাই ঘুমিয়েছে।কেবল আমি জেগে আছি।জামাই বলে কথা।জামাই না খাওয়ার আগে খাই কিভাবে।শরীরটা খুব ব্যথা লাগছে।গতকাল রাতেও মার খেয়েছি রাহাতের।প্যান্টের বেল্ট দিয়ে মেরেছে খুব।বাসায় দেরীতে কেনো আসলো সেটা জিজ্ঞেস করার অপরাধে।এটা নতুন নয়।এর আগেও কারণে অকারণে বিনাদোষে অনেক বার মার খেয়েছি।হাতের কাছে যা পেতো তা দিয়ে মারতো রাহাত।
আমি মিলা আহমেদ।মা বাবার একমাত্র মেয়ে।ছোটবেলা থেকে বাবা মা ডাকলেও উনারা আমার আপন বাবা মা না।সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানার বাড়ী বেড়াতে যাই।জাহেদা খালামনির সাথে পুতুল খেলা খেলছিলাম।খালামনি কাপড় দিয়ে সুন্দর সুন্দর পুতুল বানাতে পারে।পুতুলের আবার বাবা মা আছে।তাও কাপড় দিয়ে বানানো। দু’জনে পুতুল খেলা খেলতে খেলতে জাহেদা খালামনি আমাকে বললো,
– মিলা পুতুলেরও বাবা মা আছে।কিন্তু তুর বাবা মা নেই।তুই পালক মেয়ে।তুই যাদের বাবা মা ডাকিস ওরা তোর আসল বাবা মা না।
– কি বলো খালামনি?বাবা মা তো বাবা মা-ই।আসল আর নকল কি?
– দুলাভাই আর আপা তোর আসল বাবা মা না।তুই ওদের মেয়ে না।
– আমি কার মেয়ে তাহলে?কি সব আজগুবি কথা বলছো খালামনি।আমার সাথে মজা করিও না।সব বিষয় নিয়ে মজা করা ভালো লাগে না।
– তুই আপা দুলাভাইয়ের পালক মেয়ে।
– খালামনি চুপ করো।আমি এবার মাকে বলে দিবো।
– আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুই তোর বাবা মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। এক দৌঁড়ে ঘরে এসে মা বাবাকে খুঁজছি।
– বাবা মা,বাবা মা কোথায় তোমরা?
– কিরে মিলা কি হয়েছে?এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেনো?
– আমি কি তোমাদের মেয়ে?
– এটা কেমন কথা বলছিস মিলা?
– আমাকে আমার কথার উত্তর দাও।তোমরা কি আমার আপন বাবা মা?
– বাবা মা আবার পর হয় নাকি?কি হয়েছে তোর আজকে?এসব কথা বলছিস কেনো?
– তাহলে জাহেদা খালামনি কি মিথ্যা বলেছে?
– কি বলেছে?
– তোমরা আমার আসল বাবা মা না।আমি তোমাদের আপন মেয়ে না।তোমরা আমাকে পালক এনেছো।
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফ্লোরে বসেই কান্না শুরু করে দিয়ে ছিলাম। বাবার পায়ে ধরে বলছি,
– বাবা ও বাবা তুমি জাহেদা খালামনিকে ডেকে বলে দাও আমি তোমাদের মেয়ে।তোমরাই আমার আসল বাবা মা।বাবাও ফ্লোরে বসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন।সাথে মাও কাঁদছেন।
– তুই আমাদের মেয়ে।
আমরাই তোর বাবা মা।যে যা খুশি বলুক কানে নিস না মা। নানু জাহেদা খালামনিকে অনেক বকাবকি করেছিলো। জাহেদা খালামনি বললো,
– যা সত্যি তাই বলেছি।ঐ পালক মেয়ের জন্য তোমরা আমাকে কেনো বকা দিচ্ছো।
সেদিন নানার বাড়ী থেকে আমাদের বাসায় চলে আসি।সারাদিন শুধু জাহেদা খালামনির কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।তাহলে কি জাহেদা খালামনির কথা ঠিক।বাবা মা আমাকে মিথ্যা বলছে না তো।সারা রাত বিছানায় এদিক ওদিক ছটফট করেও ঘুম আসছিলো না। মনের ভিতর শুধু একটা প্রশ্ন- “আমার বাবা মা কে?তারা কোথায়?” রুমে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
– কিরে মা ঘুমাসনি এখনো?
-না বাবা ঘুম আসছে না।তুমি ঘুমাওনি কেন?তোমার শরীর খারাপ করবে।
– তুই ঘুমিয়ে যা মা।আমি তুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
– আচ্ছা বাবা একটা কথা বলবে?
– আমি জানি তুই কি বলবি।
– বাবা সত্যি করে বলো আমি কার মেয়ে? আমার পরিচয় কি?
– মারে তুই বড় হয়েছিস।তুই যখন জেনেই গেছিস তোর কাছে ব্যাপারটা লুকানো ঠিক হবে না। বাবার মুখে এই কথা শুনতেই আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম।
– বাবা তাহলে কি জাহেদা খালামনির কথায় ঠিক। আমি তোমাদের মেয়ে না।
– এভাবে বলিস না মা।তুই আমাদের মেয়ে।
তোর মাকে বিয়ে করার দশ বছর পরেও আমাদের কোন সন্তান হচ্ছিলো না।কতো ডাক্তার দেখিয়েছি।যে যা বলেছে তাই করেছি।তবুও কোন সন্তান হচ্ছিলো না।এদিকে তোর দাদার বাড়ীর আশেপাশের মানুষ তোর মাকে যা ইচ্ছা বলতে থাকে।কোন নাতি নাতনী না হওয়াতে তোর দাদী তোর মাকে সহ্য করতে পারতো না।তোর দাদী আমাকে আবার বিয়ে করতে বলে।আমার অমতে অনেক মেয়েও দেখে তোর দাদী।কিন্তু আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না।আমি তোর মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম।এক পর্যায়ে রাগারাগি করে তোর মাকে নিয়ে বাড়ী ছেড়ে শহরে চলে আসি।তোর মা মানুষের বাচ্চা দেখলে পাগলামি শুরু করে দিতো।আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের সাথে বাসার ছাদে গিয়ে খেলতো।আমাকে জোর করতো একটা বাচ্চা এনে দিতে।কখনো কখনো একা বসে বসে কান্না করতো।
এক সময় তোর মা অনেক অসুস্থ হয়ে পরে।ডাক্তার বলেছিলো তোর মাকে হাসি খুশিতে রাখতে।তোর মাকে খুশিতে রাখার জন্য আমি বিভিন্ন জায়গায় বাচ্চার খোঁজ করি।আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলাম একটা মেয়ে বাচ্চা পাওয়া গেছে।ঠিকানা নিয়ে সেখানে গেলাম।সেখান থেকে বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে আমার বাসায় এনে তুর মায়ের কোলে তুলে দিলাম।তুর মা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে চোখে,মুখে ও কপালে চুমু দিচ্ছিলো আর হাসছিলো।আমি তোর মায়ের হাসি দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি সেদিন।বিশ্বাস করবি না মা..বিয়ের দশ বছরে তোর মাকে এতোটা হাসতে দেখিনি,ছোট্ট বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেদিন যতোটা হেসে ছিলো।সেদিনের সেই ছোট্ট বাচ্চাটাই তুই মা। বুক ফেটে কান্না আসছিলো আমার।বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি।মাও এসে গেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে আর বলছে,
– মিলারে তোকে আমি নিজের পেটে ধরিনি ঠিক।কিন্তু তোকে কখনো পর ভাবিনি।আর দশটা মা যেভাবে বাচ্চা পালন করে,আমিও তোকে সেভাবে পালন করেছি।কোন দিন তোকে অন্য চোখে দেখিনি।তুই আমাদের ফেলে চলে যাস না মা।তুই ছাড়া এই দুনিয়ায় কেউ নাই আমাদের।তুই চলে গেলে আমরা কাকে নিয়ে বাঁচবো।
– আমি কোথাও যাবো না মা।তোমরাই আমার বাবা মা।
মা ঠিকি বলেছেন।বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখেছি বাবা মা আমাকে অনেক যত্নে বড় করেছেন।না চাওয়ার আগে সবকিছু এনে দিতেন।একবার অনেক জ্বর হয়েছিলো।মা সারারাত জেগে কপালে জলপটি দিয়েছেন আর বাবা দোয়া পড়ে আমাকে ফুঁ দিয়েছেন।আমার সামান্য অসুখ হলে মা কাঁদতো।যারা আমার জন্য এতো কষ্ট করলো তাদের আমি ছেড়ে যাই কিভাবে।আর কখনো এসব মাথায় আনিনি।বাবা মাও এই নিয়ে কোন কথা বলেনি।সব জানাজানি হওয়ার পর থেকে মা তার বাবার বাড়ী যাওয়া ছেড়ে দেয়।যদিও আবারো কোন সমস্যা হয় এই ভেবে।বাবা মার মাঝে সবসময় আমাকে হারানোর ভয় কাজ করতো। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়।আমাকে বিয়ের দেয়ার জন্য পাত্র ঠিক করা হয়। বিয়ের আগের দিন বাবাকে বলে ছিলাম,
– বাবা ও বাবা,তুমি আর মা আমাকে বলেছিলে তোমাদের ছেড়ে কোথাও না যেতে।আর আজ তোমরা আমাকে বাড়ী থেকে বিদায় করে দিচ্ছো।এতোটাই পর করে দিলে বাবা।আমি ওখানে তোমাদের ছাড়া কিভাবে থাকবো।
– পারলে তোকে রেখেই দিতাম মা।তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল।মেয়ে হয়ে আমার ঘরে এসেছিস।বিয়ে দিয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করতে হবে।একদিন তোকে দুই হাতে তুলে কোলে করে এই ঘরে এনেছিলাম।আর আজ নিজ হাতে অন্য কারও হাতে তুলে দিতে হচ্ছে।এটাই দুনিয়ার নিয়ম। বিয়ের দিন আমাকে গাড়ীতে তুলে দিলেন বাবা।গাড়ীর পিছনের গ্লাসে বাবা মাকে দেখেছিলাম।বাবা হাউমাউ করে কাঁদছে।ইচ্ছা করছিলো গাড়ী থেকে নেমে দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরি। একটা বিশাল বাড়ীর সামনে গাড়ী থামলো।আমি গাড়ীতে একা বসে আছি।আমার স্বামী গাড়ী থেকে নেমে ঘরের দরজার দিকে চলে গেলেন।
– এই রাহাত থাম থাম।নতুন বউকে একা রেখে কোথায় যাচ্ছিস?
কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন উনি। বুঝতে পারলাম মহিলাটা আমার শাশুড়ি।আর রাহাত নামের লোকটা আমার স্বামী।এরপরে শাশুড়ি আমাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে ঘরে ঢুকালেন।শ্বশুর বাড়ীতে আজ আমার প্রথম দিন।এই বাড়ীতে কে কে আছে,আমার স্বামী কি করে আমি কিছুই জানি না।রুবা আপা আমাকে একটা রুমে বসিয়ে গেলেন।রুবা আপা রাহাতের বড় বোন।দেয়ালে ছবি দেখে নিশ্চিত হলাম এটা রাহাতের রুম।আজ আমার বাসর রাত।খাটের উপর বউ সেজে বসে আছি।
গাড়ীতে থেকে নামার পর রাহাতকে আর ঘরে দেখিনি।রাত একটা বাজে।এখনো রাহাত আসছে না।আমি এখনো বসে আছি।খুব ক্লান্ত লাগছে।ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।প্রায় দুইটার দিকে রাহাত রুমে আসলো।আলমারি থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে খাটের একপাশে শুয়ে গেলো।আমার দিকে একবার তাকালো না।আমি মেয়েটা এতো রাত পর্যন্ত উনার জন্য জেগে ছিলাম তার কোন মূল্য নেই।আমিও ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো।নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হলাম।বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে।আমি রুমে চলে এলাম।বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।বাইরে হালকা হালকা আলো ফুটেছে।বাবা মার কথা মনে পড়ছিলো খুব।আস্তে আস্তে রুমে গেলাম।মোবাইলটা নিয়ে আবারো বারান্দায় এলাম। বাবাকে ফোন দিলাম।
– হ্যালো মিলা,মা কেমন আছিস?
– ভালো আছি বাবা।তুমি কেমন আছো? মা কেমন আছে?
– আমরাও ভালো আছি মা।তোর মা ঘুমাচ্ছে।সারা রাত ঘুমায়নি।তুর জন্য কেঁদেছে খুব। আমাদের কথা রাখ।তোর কথা বল। তোর শ্বশুর বাড়ির সব ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ বাবা সব ঠিক আছে।আচ্ছা বাবা রাখি। এই সাতসকালে কার সাথে ফোনে কথা বলছিস?তাও আবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে।প্রেমিক নাকি? পিছনে ফিরে দেখি রাহাত।
– আমি আমার বাবার সাথে আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রাহাত বললো,
– তোদের মতো মেয়েদের আমার ভালোই জানা আছে।
এটা বলে রাহাত চলে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিলো না। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম আমার শাশুড়ি নাস্তা বানাচ্ছেন।উনাকে নাস্তা বানাতে সাহায্য করলাম। আমার শাশুড়ি বললেন,
– বৌমা রাহাত সকালের নাস্তা রুমে খায়।তুমি ওর নাস্তা রুমে নিয়ে যাও।
– আচ্ছা মা।
রাহাতের জন্য রুমে নাস্তা এনে টেবিলে রাখলাম।আমাকে কিছু না বলে নাস্তা না খেয়েই বাইরে বের হয়ে গেলো।আমার সাথে কেনো এমন করছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শাশুড়িকে বলে দুপুরের রান্নাটা আমি করলাম। ডাইনিং টেবিলে সবাই ভাত খেতে বসলো।আমার শাশুড়ি বললেন,
-আজকের সব রান্না বউমা করেছে। আমার শ্বশুর বললেন,
– অনেকদিন ধরে ছেলের বউ এর হাতের রান্না খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো।আজ আমার আশা পূরণ হলো। রাহাত হাত দিয়ে ঠেলে ভাতের প্লেট ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বললো,
– মা তুমি জানো না তোমার হাতের রান্না ছাড়া আমি কারো হাতের রান্না খেতে পারি না? এটা বলে রাহাত টেবিল থেকে উঠে চলে গেলো।একের পর এক অপমান।আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে অবিরাম। শাশুড়ি বললেন,
– আমার ছেলেটা রাগী বেশি। তুমি কিছু মনে করো না। শ্বশুর বললেন,
– রাহাতের বদ মেজাজটা এখনো গেলো না।নতুন বউয়ের সাথে কেউ এতো খারাপ ব্যাবহার করে।
রাহাতের মা ছেলেকে মানুষ বানাতে পারলে না। বিকেলে বাসার ভিতর ভালো লাগছিলো না।তাই ছাদে উঠলাম।
– মিলা মিলা,এই মিলা।
আমার নাম শুনে সেদিকে তাকালাম।পাশের বিল্ডিং থেকে আমাকে ফরহাদ ডাকছে।ফরহাদ আমার ক্লাসমেট।ডিগ্রিতে পড়ার সময় একই সাথে পড়তাম আমরা।
– কিরে তুই এখানে কেনো মিলা?তোদের বাসা কি চেঞ্জ করেছে?
– নারে।এটা আমার শ্বশুর বাড়ী।
– কি বলিস?তোর বিয়ে হয়ে গেছে?তুই রাহাত ভাইয়ের ওয়াইফ?
– হুম।
-তোর বাবা সব খোঁজ খবর নিয়ে তোকে বিয়ে দেয়নি?
– কেনো বল তো।
– রাহাত ভাই মানুষ ভালো না।তোর মতো ভালো মেয়ে কিভাবে রাহাত ভাইয়ের বউ হতে পারে। সিঁড়িঘরে কারও পায়চারী শুনে সরে আসলাম।সিঁড়িতে উঁকি দিয়ে দেখলাম রাহাত।
– হারামজাদী,বেয়াদব দুই দিন হয় নাই বিয়ে হয়েছে এর মাঝে পাশের বাসার ছেলের সাথে লাইন মারা শুরু করেছিস।চল রুমে চল।
– আমার চুল ছাড়েন।ব্যথা লাগছে।আমাকে আপনি ভুল বুঝছেন।ঐ ছেলেটা আমার ক্লাসমেট।আর কোন কিছু না।
আমার কোন কথায় রাহাত কর্ণপাত করলো না। চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে আমাকে রুমে নিয়ে গিয়ে ইচ্ছামতো মারলো। রাহাতের হাত থেকে আমাকে বাঁচানো দূরের কথা,একটা বার দরজায় কেউ উঁকি দিয়ে দেখেনি।সেদিন আর খাওয়া দাওয়া করিনি।ব্যথায় কাতরাচ্ছি আর কান্না করছি।বাবা মার কথা খুব মনে পড়ছিলো।সেই ছোটবেলা থেকে আদর স্নেহ ছাড়া শাসন পাইনি কোনদিন।পালক মেয়ে হয়েও অবহেলা করেনি কখনো।খাটের একপাশে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সারারাত কেঁদেছি।অন্যপাশে রাহাতও আছে।একবারও জিজ্ঞেস করলো না আমি কাঁদছি কেনো।শেষ রাতের দিকে গায়ে কারও স্পর্শ অনুভব করি।
ভাবলাম আমি কাঁদছি বলে রাহাত মায়া দেখাবে।কিন্তু যা ভেবেছি তা হয়নি।নিজের শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য আমার উপর ঝাঁপিয়ে পরলো।ঘন্টা খানেক আগেও পশুর মতো আচরণ করেছিলো আমার সাথে।মেরে সারা শরীর দাগ বানিয়ে দিয়েছে।আর সে আমার উপর নিজের শারীরিক চাহিদা মেটাচ্ছে।খুব ঘৃণা লাগছিলো রাহাতের উপর।ইচ্ছা করছিলো দুই হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে আমার কাছ থেকে আলাদা করে দিতে।স্বামী বলে কথা,তার সম্পূর্ণ হক আছে।তাই নীরবে সহ্য করে গেলাম। ব্যবসার কাজে রাহাত ঢাকায় গেছে।নতুন নতুন বিয়ে হলে জামাই দূরে গেলে বৌ এর খারাপ লাগে।রাহাত ঢাকায় যাবে শুনে বরং আমার ভালো লাগছে।এই মানুষটা যতক্ষণ বাসায় থাকে আমি অাতংকে থাকি কোন সময় আমার গায়ে হাত উঠায়। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়েছি।রাইসা রুমে আসলো।রাইসা আমার ননদ।রাহাতের ছোট বোন।
– ভাবি একটা হেল্প করো প্লিজ।
– কি হেল্প?আমি পারলে অবশ্যই করবো।
– ভাবী কলেজের ফরম ফিলাপে চার হাজার টাকা লাগবে।ভাইয়া বাসায় নেই।বাবার কাছেও এতো টাকা নেই।ভাইয়া কোথাও টাকা রেখেছে কিনা তুমি দেখো প্লিজ।
– আচ্ছা দেখবো।আমি পেলেই তোমাকে দিবো।চিন্তা করো না।
অালমারির ভিতর ড্রয়ার খুললাম।চার হাজার টাকা নিলাম রাইসার জন্য।বিয়ে হয়েছে পর্যন্ত কোন দিন রাহাতের কোন জিনিসে হাত দেইনি।রাইসার জন্য আজ হাত দিতে হলো।মনে মনে ভাবছি রাহাত জানলে কি বলবে।আবার ভাবলাম আমি নিজের জন্য নেইনি।রাইসার জন্য টাকাটা নিয়েছি।রাহাত ঢাকা থেকে ফিরলে ওকে জানাবো ব্যাপারটা। বারান্দায় ফুল গাছে পানি দিচ্ছি।এই বাড়ীতে পা রাখার পর সব স্বাধীনতা হারিয়েছি।বাবা মায়ের কাছে কতোই ভালো ছিলাম।এসব ভাবতে ভাবতে কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলতে দেখি রাহাত এসেছে।
-আপনি আজ বাসায় আসবেন ফোন দেন নাই কেনো?
– আমি আমার বাসায় আসবো তোর অনুমতি নিতে হবে।বাসায় ঢুকতেই তুই ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিছিস।আমার সামনে থেকে সর। হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে রুমের দিকে চলে গেলো। আমার শাশুড়ি বললেন,
– আমার ছেলে বাহির থেকে আসছে।এতদূর পথ জার্নি করে আসছে আমার ছেলেটা।কথা গুলো তুমি পরেও জিজ্ঞেস করতে পারতে বউমা।বাহির থেকে আসলে পুরুষ মানুষের মেজাজ গরম থাকে সেটা জানো না?
– মা আমি খারাপ কিছু জিজ্ঞেস করিনি।বাসায় ফিরবে সেটা ফোন দিয়ে বলেনি কেন সেটা জিজ্ঞেস করেছি শুধু।
– মুখে মুখে তর্ক করোনা।বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা জানো না? চুপ হয়ে আছি।একের পর অন্যায়ভাবে দোষী হচ্ছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
– চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?আমার ছেলে বাহির থেকে আসছে।খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করো।
রান্নাঘরে চলে গেলাম।রাতের খাওয়া দাওয়া রেডী করে টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম।সবাই খাওয়া দাওয়া করে যে যার রুমে চলে গেলো।আমিও শুয়ে আছি।আজকেও রাহাত আমার উপর স্বামীর অধিকার খাটিয়েছে।রাতে বউকে নিজের প্রয়োজনে কাছে টেনে নেয়,আর দিনের বেলায় সবার সামনে দূর দূর করে। সকালে রাহাতের জন্য চা বানিয়ে রুমে এনে টেবিলে রাখলাম।চায়ের কাপে এক চুমুক দিতে থু মেরে কাপটা ফ্লোরে ফেলে দিলো।
– এগুলো কি চা বানিয়েছিস?বাসায় কি চিনির অকাল পরছে?তোর মা তুকে চা বানানো শেখায়নি?
– আমাকে যা ইচ্ছা বলেন।আমার মাকে নিয়ে কোন কথা বলবেন না প্লিজ।
– আজকাল তোর অনেক সাহস বেড়েছে।
মুখে মুখে কথা বলা শিখেছিস।তোর মা বাবাকে নিয়ে ১০০ বার বলবো।কি করবি তুই?আমাকে মারবি? এটা বলেই আমাকে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে ইচ্ছামতো মারলো।যতোক্ষণ গায়ে শক্তি ছিলো ততোক্ষণ। এরপরে রাহাত অফিসে চলে গেলো। ফোন বাজছে।বাবা ফোন দিয়েছে।
-হ্যালো বাবা..
– মারে কেমন আছিস?
– বাবা ও বাবা..এই কোন দোজখে আমাকে বিয়ে দিলে তুমি।আমি আর পারছি না বাবা।আমি তোমার নিজের মেয়ে না বলেই তুমি আমার সাথে এমন করতে পারলে।
-এসব কি বলছিস মা?ওখানে সব ঠিক আছে তো মা?জামাই কোথায়?
-কিছুই ঠিক নেই বাবা।আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।
বিকেলে বাবা আমার শ্বশুর বাড়ীতে আসলেন আমাকে নিয়ে যেতে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আর আসবো না এই বাড়ীতে।রাহাতের মতো অমানুষের সাথে সংসার করবো না।যে আমার বাবা মাকে নিয়ে বাজে কথা বলে তাকে ক্ষমা করা যাবে না। শাশুড়ি বাবাকে বললেন,
– বিয়াই দুই/তিন পর পাঠিয়ে দিয়েন বউমাকে।আমি একা মানুষ সংসার সামলাতে কষ্ট হয়।
বাবা কিছু বললেন না।নিজের বাড়ীতে আসছি।জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছি মনে হচ্ছিলো। রাহাতের মারের দাগ গুলো এখনো আছে শরীরে।ব্যথা করছে ভীষণ। আজকে রাতে বাবা মায়ের রুমে শুয়েছি।আমার গায়ে মা ব্যথার ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছে।
– বাবা আমি ও বাড়িতে আর যাবো না।রাহাত আমাকে কথায় কথায় মারে।তোমাদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলে।আমার এসব শুনতে ভালো লাগে না।
– মারে আমাদের ক্ষমা করে দিস।আমরা ওদের বাড়ী গাড়ী সব আছে দেখে তোকে বিয়ে দিয়েছি।যাতে তুই কোন অভাবে না থাকিস।কিন্তু জামাই এরকম হবে সেটা আমরা জানতাম নারে মা।আমাদের ভুল বুঝিস না।
– বাবা আমার বাড়ী গাড়ীর দরকার নাই বাবা।রোজ রোজ গালাগালি ও মার খেতে আর ভালো লাগে না বাবা। বাবাও কাঁদছে।চোখে পানি ছলছল করছে।আমার কাছ থেকে চোখের পানি লুকাতে অন্য রুমে চলে গেলো।বাবারা এমন হয়।বাবাদের ভালোবাসা কখনো প্রকাশ পাই না। পরের দিন মা বললো,
– মারে বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর ঘর হলো আসল ঘর।মেয়েরা বেশিদিন বাবার বাড়ী থাকলে সমাজের লোক খারাপ ভাবে।তুই শ্বশুর বাড়ীতে ফিরে যা আবার।
– আমি এতো বোজা হয়ে গেলাম তোমাদের কাছে।দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছো আমায়।আমাকে যখন এতোই বোজা মনে হচ্ছে মেরে ফেলো একেবারে।সবাই শান্তি হয়ে যাবে।তবুও ঐ বাড়ীতে যেতে বলো না।
– এভাবে কেন বলছিস?আল্লাহ নারাজ হবেন।
– আল্লাহ আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছে মা।একের পর এক কতো জ্বালা সইবো আমি।
– মারে তুই একটা বাচ্চা নিয়ে ফেল।অনেকে আছে বাচ্চা হলে ঠিক হয়ে যায়।
বউয়ের প্রতি ভালোবাসা আসে।তোর জামাই হয়তো বাচ্চাকাচ্চার মুখ দেখলে ঠিক হয়ে যাবে। তিন/চার দিন বাবার বাড়ী থাকার পর শ্বশুর বাড়ীতে চলে আসি।এই বাড়ীতে টাকা পয়সার কিছুর কমতি নেই।তবুও আমার ভালো লাগে না।যেখানে স্বামীর সামান্য ভালোবাসা পেলাম না,সেখানে টাকা পয়সা দিয়ে কি হবে। রাহাত অফিস থেকে এসে আলমারী থেকে কি জেনো খুঁজছে।পুরো আলমারীর কাপড় তছনছ করে ফেলেছে ড্রয়ারের কাগজপত্র সব ফ্লোরে অগোছালো করে ফেলে দিয়েছে। আমি বললাম,
– কিছু খুঁজছেন? কোন উত্তর দিলো না।আবারো বললাম,
– কিছু খুঁজছেন?আমাকে বলেন।আমি খুঁজে দিচ্ছি।
– আমার টাকা পাচ্ছি না।ব্যবসার কাজে ড্রয়ারে কিছু টাকা রেখে ছিলাম।সেখান থেকে চার হাজার টাকা পাচ্ছি না।
– টাকা গুলো আমি নিয়েছি কথা পুরোপুরি শেষ করতে না দিয়ে আমার কাছে এসেই চুলের মুঠি ধরে বললো,
– আমার টাকা কাকে দিয়েছিস হারামজাদী।আমার টাকা চুরি করে বাবার বাড়ী গেছিস।তোর বাবাকে দিছিস নাকি তোর কোন প্রেমিককে।তোর মা বাবা তোকে এই বাসায় পাঠিয়েছে আমার টাকা চুরি করে তাদের দিতে?
– আমার বাবা মাকে নিয়ে কোন বাজে কথা বলবেন না।দোহাই লাগে আপনার।
– আমার টাকা এনে দে।না জানি আলমারী থেকে আর কি কি চুরি করে বাবার বাড়ী নিয়ে গেছিস জোরে জোরে আমার গালে থাপ্পড় মারছিলো আর কথা গুলো বলে যাচ্ছিলো। রাহাতের মারধরের আওয়াজ শুনে রাইসা এসে বললো,
– ভাইয়া টাকা গুলো ভাবী চুরি করেনি।তুমি না জেনে ভাবীকে দোষ দিচ্ছো।আমার কলেজের ফরম ফিলাপের জন্য চার হাজার টাকা লাগছিলো।তুমি তখন ঢাকায় ছিলে।তাই আমি ভাবীকে বলেছিলাম টাকা দিতে।ভাবী তোমার ড্রয়ার থেকে চার হাজার টাকা নিয়ে আমাকে দিয়েছিলো।
– আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাবী।আমার কারনে ভাইয়ার বকা শুনতে হলো তোমার।ভাইটা জীবনে বদলাবে না। রাইসার মুখ থেকে টাকার কথা শুনে রাহাত কিছু না বলে বাইরে চলে গেলো। ওয়াশরুমে ঢুকে পানির কল ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছি।
– আল্লাহ আমাকে উঠিয়ে নে তুই।আমার মতো মেয়ের এই দুনিয়ায় বেঁচে থেকে লাভ নাই।আমার কারনে আমার বাবা মা চোর হয়ে গেলো।এই অমানুষ থেকে আমাকে উদ্ধার কর আল্লাহ।
দিনের বেলায় রাহাত বাসায় থাকলে বেশিরভাগ সময় আমি বারান্দায় কাটাই।এই লোকটার কাছ থেকে দূরে থাকায় আমার জন্য মঙ্গল।সামনে গেলেই কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে আমার গায়ে হাত তুলে।বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি বোরকা পরা এক মহিলা বারবার আমার শ্বশুর বাড়ীর আশেপাশে লুকিয়ে লুকিয়ে কাকে যেনো খুঁজে কয়েকদিন আগে বাবার বাসায় গিয়েছিলাম সেখানেও এসেছিলো।আমার বিয়ের আগেও বাবার বাসায় আসতো।আমার সাথে তেমন কথা বলতো না।শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। বারান্দা থেকে ডাক দিলাম উনাকে।
– এই যে শুনছেন?আপনি কে?কেনো আসেন এখানে?আপনার কেউ আছে এখানে?
মহিলা কিছু না বলে হনহন করে গেইটের বাইরে চলে গেলেন। দুই তিন ধরে শরীরে দুর্বল লাগছে।মাথাটা কেমন যেনো ঘুরাচ্ছে।শাশুড়িকে জানালাম।শাশুড়ি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।ডাক্তার বলেছে, “আমি মা হতে চলেছি।” শ্বশুর বাড়ীতে পা রাখার পর থেকে এই প্রথম আমি হেসেছি। সন্ধ্যায় রাহাত বাসায় আসার পর ওকে বললাম,
– আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো।
– এতো ঢং না করে কি বলবি জলদি বল।
– আজ মার সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ছিলাম।ডাক্তার বলেছে আমি মা হতে যাচ্ছি।
– কি বললি?বিয়ের এক বছর না যেতেই তোর বাচ্চা জনম দেয়ার শখ জাগছে?এই বাচ্চা আমার চাই না।
– কি বলছেন এসব?আল্লাহ নারাজ হবেন।বাচ্চা আল্লাহর হুকুমে হয়।
– বেশি জ্ঞান দিতে আসবি না।আমার কোন বাচ্চা লাগবে না।তুই এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেল।কালকেই আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবি।যতো তাড়াতাড়ি ঐ বাচ্চা মেরে ফেলবি তোর জন্য মঙ্গল।
– আমি কোথাও যাবো না।আমার বাচ্চা আমার কাছে থাকবে।
– বেশি বাড়াবাড়ি করবি না।যা বলছি তাই শুনবি।
– আমি বাচ্চা নষ্ট করবো না।
-খুব সাহস বেড়েছে তোর।
আরেক দফা মারা শুরু করলো আমাকে।ইচ্ছামতো মেরে রাহাত রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রাহাত অফিসে গেছে।আমার শ্বশুর শাশুড়ি রুবা আপার বাসায় যাচ্ছেন।রাইসাও কলেজে গেছে।সারা বাড়ীতে আমি একা। শাশুড়িকে বললাম,
– মা বাসায় যখন কেউ নেই আমি একা একা কি করবো।আমার বাবার মায়ের জন্য মন জ্বলছে।বাবা মাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।আপনারা রুবা আপার বাসায় যাওয়ার পথে আমাকে আমার বাবার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েন।
– কিন্তু রাহাত শুনলে কি বলবে?রাগারাগি করবে আবার।
– আমি আপনার ছেলেকে ফোনে বলে দিবো মা।
– আচ্ছা ঠিক আছে।আমরা আজ রুবার বাসায় থেকে যাবো।তুমি সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে আসিও।
রুমে এসে রাহাতকে ফোন দিলাম।রিসিভ করলো না।শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে বাবার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে বাসার কাছে আসতে দেখলাম দরজা খোলা।মায়ের দরজা খোলা রাখার অভ্যাসটা গেলো না।যেদিন বাসায় চোর ঢুকে বাসার জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যাবে সেদিন শিক্ষা হবে।মনে মনে এসব বলতে বলতে দরজার দিকে পা বাড়াতে দেখলাম,সেই বোরকা পরা মহিলাটি মায়ের সাথে ড্রইং রুমে কথা বলছে।আমি ভিতর না ঢুকে বাইরে দরজার অাড়ালে লুকিয়ে গেলাম। মা মহিলাকে বলছেন,
– দেখো ফাতেমা খালা মিলা তোমার নাতনী সেটা ঠিক আছে।কিন্তু ছোটকাল থেকে ওকে লালন পালন করে আমি বড় করেছি।তুমি মিলাকে দেখতে আমাদের বাসায় অাসতে।তোমাকে আমরা কখনো মানা করিনি।কারন তোমার মিলার উপর অধিকার আছে।।কিন্তু তুমি এখন মিলার শ্বশুর বাসায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছো।মিলা যদি জানতে পারে তুমি ওর নানী তখন ও ওর বাবা মায়ের পরিচয় জানতে চাইবে।ওর শ্বশুর বাসার কেউ জানতে পারলে মিলার আরও বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। তোমার কাছে হাত জোর করে বলছি,তুমি মিলার সামনে বার বার এসো না।দশটা বছর নিঃসন্তান ছিলাম।একটা বাচ্চার জন্য আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছি।মিলাকে পেটে না ধরলেও ওকে নিজের মেয়ের মতো আগলিয়ে রেখেছি।আমার কাছ থেকে আমার মেয়েটাকে কেড়ে নিও না।
– মিলারে না দেখে থাকতে পারি নারে মা।খুব মন জ্বলে।মিলা দেখতে একেবারে হের মায়ের মতন হয়ছে।ওরে দেখলে মনে হয় আমি আমার মাইয়াটারে দেখতাছি।
– খালাম্মা তোমার যদি টাকাপয়সা লাগে আমি দিবো।তবুও বারবার মিলার সামনে যেওনা।
– তুই ভাবিস নারে মা।আমি আর মিলার শ্বশুর বাড়ী যামু না।আমার নাতীন সুখে থাকলে আমি সুখী।
হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে মহিলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।বাসার দরজার দিকে আসতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম।এতোক্ষণ যা শুনলাম নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।আমার কি অপরাধ ছিলো যার কারনে জন্মের পর আমার মা আমাকে অন্যের হাতে তুলে দিলেন। আমার পিতৃ পরিচয় কি? আমার মা কে? বাবার বাসায় যাবো না আজ।মহিলার পিছু নিবো। উদ্দেশ্য একটাই- “এই মহিলা কোথায় থাকে,আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।” গেইটের বাইরে এসে মহিলাটা একটা রিকশায় উঠলেন।আমিও একটা রিকশা নিয়ে মহিলার পিছু নিলাম।প্রায় আধা ঘন্টা পর একটা বস্তির সামনে রিকশা থামালেন মহিলাটা।তারপর একটা ঘরে ঢুকে গেলেন।আমিও রিকশা থেকে নেমে মহিলাটার ঘরের দরজায় দাঁড়ালাম।আমাকে দেখে মহিলা অবাক হয়ে গেলো।
– তুই এহানে কিভাবে আইলি মিলা?তুরে কে অানছে এহানে?
– আমি আজ আপনার আর আমার মায়ের সব কথা শুনেছি।এরপরে আপনি আমাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পর আপনার পিছু নিয়ে এখানে এসেছি।
– আয় ভিতরে আয়।ভিতরে আইসা বস।
– আমি বসতে আসিনি।আমি জানতে এসেছি কেনো আপনার মেয়ে আমাকে জন্ম দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।আমাকে যখন পরের হাতে তুলে দিবেন,দুনিয়াতে আনলেন কেনো?
– তুই শান্ত হয়ে বস।আমি সব বলমু তোরে।
– আমি বসতে আসিনি।আমি যা জানতে চাচ্ছি আমাকে উত্তর দিন।
– তোর নানা মানে আমার স্বামীর অার্থিক অবস্থা তেমন ভালা ছিল না।
তোর মারে অল্প বয়সে বিয়া দিয়ে দেয়।তোর বাপরা মেলা টাকাওয়ালা ছিল।ধন দৌলত কিছুর অভাব ছিল না।কিন্তু তোর বাপ মানুষ ভালা ছিল না।রাতে মদ খাইয়া আইসা তোর মারে মারধর করতো।তোর দাদার বাসার কেউ তোর বাপরে কিছু কইতে পারতো না।কারন তোর বাপের বহুত রাগী ছিল।তোর মা অত্যাচার সহ্য কইরা কইরা অসুস্থ হইয়া পরে।তোর নানা একদিন তোর দাদার বাসায় গিয়া দেখে তোর মারে তোর বাপ মারতাছে।তোর নানা রাইগা গিয়া তোর বাবারে গালাগালি দিয়া মাইয়ারে সাথে কইরা নিয়া আসে।তোর নানা তোর মারে বেশি ভালোবাসতো।তোর মায়ের লাইগা দুশ্চিন্তা কইরা কইরা তোর নানা মারা যায়।তোর নানা মারা যাওনের পর আমরা অভাবে পইরা যাই।কারন হেতে ছাড়া আয় রোজগার করবার কেউই ছিল না।এর মাঝে তুই তোর মায়ের পেটে চলে আসিস।
তোরে জন্ম দেয়ার সময় তোর মাও মারা যায়।বাপ মেয়ে একই বছরে আল্লাহর কাছে চইলা গেল।তুই পেটের ক্ষুধায় কান্না করতি।তোরে কিছু খাওন দিতে পারতাম না।টাকার অভাবে আমি নিজেই দুই বেলা খাওন ঠিকভাবে খাইতে পারতাম না।তোর লাইগা দুধ কিনুম কি দিয়া।এর মাঝে খবর পাই এক লোক বাচ্চা খুঁজতাছে।হেগো বাচ্চা হয়তাছেনা তাই বাহির থেইকা বাচ্চা পালক লইতে চায়।আমি সব খবর নিয়া তোরে ঐ লোকটার হাতে তুইলা দেই।যাতে তুই ভালা থাকিস।যাতে অভাব অনটনের সংসারে না খাইয়া কষ্ট না পাস।বিশ্বাস কর আমি যা করছি তোর ভালার লাইগা করছি।আমারে ক্ষমা করে দিস মিলা।আমার মাইয়াটারেও ক্ষমা করে দিস।আমার মাইয়ার কোন দোষ নাই।ঐ ধনীর দুলাল আমার মাইয়ার জীবন নষ্ট কইরা দিছে।
– আমি সুখে নেই নানী।আমার মায়ের মতো আমিও প্রতিদিন অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছি।আমার স্বামী আমাকে বিনাদোষে মারধর করে। জানো নানী আমার পেটেও এখন বাচ্চা।ঐ লোকটার নাকি বাচ্চা লাগবে না।আমাকে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে বলছে আমি কি করবো তুমি বলো।আল্লাহ মায়ের মতো আমার ভাগ্য কেনো এরকম লিখে দিলো।
– কান্দিস নারে মিলা।উপর আল্লাহ যা করে বান্দার ভালার লাইগা করে।
– নানী আমি উঠি।সন্ধ্যা হয়ে গেছে।রাহাত অফিস থেকে আসার আগেই বাসায় পৌঁছতে হবে। বাসায় কলিং বেল চাপতেই রাহাত দরজা খুলে দিলো।
– কোথায় গিয়েছিলি হারামজাদী।বাসায় কেউ নাই দেখে কার সাথে দেখা করতে গেছিস?
– কিসব আজেবাজে কথা বলছেন।আমি বাবা মাকে বলেই আমার বাবার বাসায় গিয়েছিলাম।আপনাকে ফোন দিয়ে ছিলাম।আপনি রিসিভ করেননি।
– কাল ডাক্তারের কাছে যাবি আমার সাথে।
– ডাক্তারের কাছে কেনো?
– কেনো ভুলে গেছিস।তুর পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করতে যাবি।
– আমি বাচ্চা নষ্ট করবো না।আমার বাচ্চা আমার কাছেই থাকবে।
– তোর যখন বাচ্চা পালার শখ হয়েছে তুই বাচ্চা নিয়ে থাক।আমি তালাক দিবো তোকে।
তালাকের কথা শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো।বোবার মতো রাহাতের মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম শুধু।মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিলো না। পরের দিন সবাই ঘুমে থাকতে আমি বাবার বাসায় চলে আসি।আমার সাথে যা হয়েছে তা আমার সন্তানের সাথে হতে দিবো না।আমি নিজ হাতে আমার সন্তানকে মানুষ করবো। চেকআপ শেষে রিসিপশনে বসে আছি ছেলের অপেক্ষায়।এক সাথে বাসায় যাবো। চেম্বারের ভেতর থেকে এক মাঝ বয়সী লোক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– তুমি মিলা না?
– জ্বী,আমি মিলা।
– অনেক বছর পর দেখলাম তোমাকে।ডাক্তার দেখাতে এসেছো?
– হুম।ডাক্তার দেখানো শেষ।ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি।একটু আগে চেম্বারে যে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ছিলেন সে আমার ছেলে।
– আমাদের ছেলে ডাক্তার হয়েছে?
– মিশকাত শুধু আমার ছেলে।ওর বাবা মা দু’টোই আমি।ওকে আমি আমার পরিচয়ে মানুষ করেছি।মিশকাত জানে ওর বাবা মৃত।
– আমাকে ছেলের কাছে মৃত বানিয়ে দিতে পারলে মিলা?আমিও তো ওর বাবা।
– আপনি ওর বাবা নন।ওকে জন্ম দেয়ার আগে আপনি খুন করতে চেয়েছিলেন।খুনি কখনো কারও বাবা হতে পারে না।
– আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি মিলা।তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি আবারও বিয়ে করি।এতো বছরে আজও কোন সন্তানের মুখ দেখিনি।বাবা ডাকটা শুনতে পারিনি।আল্লাহ আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিয়ে দিয়েছেন।আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। মা চলো তোমাকে অনেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।আমার ছেলেকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।