দেখুন আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমার উপর কোন অধিকার খাটাতে আসবেন না?
–কিন্তু আমিতো তোমাকে বিয়ে করেছি।
-তো কি হয়েছে? আপনার কথায় আমাকে উঠতে, বসতে হবে?
–আমি সেটা বলিনি….
-তাহলে কি বলতে চাচ্ছেন?
–তোমার নামে অনেকেই অনেক কথা বলে। রাস্তা, ঘাটে একটু ভালো করে চলাফেরা করলেই পারো। মানুষ কি বলবে? এখন তোমার বিয়ে হয়েছে। আর এখন যদি তুমি রাস্তা-ঘাটে আগের মত পোশাক পরিধান পরে চলাফেরা করো তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখা যায় না?
-আপনি জানেন কার সাথে কথা বলছেন?
–আমার বিয় করা বউয়ের সাথে…
-আমি আপনাকে মানিনা।
–তাহলে বিয়ে করতে রাজি হলেন কেনো?
-আমি বাবাকে কষ্ট দিতে চাইনি। তাই বাবার কথা মত বিয়ে করেছি।
–আপনার ইচ্ছেতেই সব কিছু হবে?
-হ্যা হবে….কারণ আপনি আমার বাবার অফিসে চাকরি করেন, একজন কর্মচারী। তো একজন কর্মচারী হয়ে বসের মেয়ের আদেশ মানা আপনার দায়িত্ব।
–আমি বসের অফিসে চাকরি করি, আপনারনা।
কথাটা বলেই অফিসের দিকে হনহন করে চলে গেলো রুবেল। এতক্ষণ যারসাথে কথা বলল সে হলো আরিশা। আরিশা আর রুবেলের বিয়ে হয়েছে প্রায় একমাস। রুবেল ছেলে ভালো, ভদ্র, নম্র, বিনয়ী। অফিসের অন্যান্য সবার চেয়ে দক্ষ। এককথায় পার্ফেক্ট ছেলে যাকে বলে। তাইতো আশরাফ চৌধুরী তার একমাত্র মেয়ে আরিশাকে রুবেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। যাতে মেয়ে সুখে থাকে। কিন্তু আরিশা রুবেলকে এখনও মেনে নেয়নি। আসলে তার যে বয়ফ্রেন্ড আছে তাওনা। সে মেন্টালি প্রিপ্রায়েড ছিলনা। কিন্তু বাবার কথা অনুযায়ী রুবেলকে বিয়ে করেছে। রুবেল ওকে অনেক ভালোবাসে, আকারে ইঙ্গিতে অনেক বুঝিয়েছে। তবুও আরিশা রুবেলকে সহ্য করতে পারেনা। কেমন জানি বিরক্ত লাগে।
আরিশা আর রুবেল যে ফ্লাটে থাকে তার ঠিক সামনের ফ্লাটে উঠেছে আঁখিউল। ফ্লাটের ছাদে ছোট একটা রুমে থাকে সে। আখিঁউল এ শহুরে নতুন। চাকরির খোঁজে শহুরে এসেছে। গ্রামে ছোট একটা ঘর। মামা বাবা আর এক বোন নিয়ে ছোট একটা সংসার আখিঁউলের। ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ, পরিবারের খরচ সব মিলিয়ে কোন রকম দিনকাল যাচ্ছে তাদের। তাইতো চাকরির খোঁজে আসা। আখিঁউল ভালো গীটার বাঁজাতে পারে। সময় পেলেই সে ছাদে গিটারের সুর তুলে। আর সেই গিটারের সুর লুকিয়ে লুকিয়ে শোনে জেসিফা। জেসিফাও এই ফ্লাটেই তার মা-বাবার সাথে থাকে। আখিঁউলের গিটারের সুর জেসিফার ভীষণ ভালো লাগে। একটা মানুষ এত সুন্দর করে গীটার বাজায় সেটা আখিঁউলকে না দেখলে বুঝতেই পারতনা জেসিফা। জেসিফা অনেকবার যেচে আখিঁউলের সাথে কথা বলতে গিয়েছে। কিন্তু সামনে গেলেই সব গুলিয়ে ফেলে। তার আর কথা বলা হয়ে ওঠেনা।
আখিঁউল ছাদে বসে আছে। গীটার বাজাঁচ্ছেনা। আজকে ইন্টার্ভিউ দিয়েছে কিন্তু চাকরিটা হলোনা। তার আগে নাকি অনেকেই দিয়েছে। আসলে টাকা নাইতো তাই। এ নিয়ে প্রায় সাত, আটটা ইন্টার্ভিউ দিলো সে। কিন্তু একটাও হলোনা। তার খুব খারাপ লাগছে। আর কতদিন এভাবে চলবে। জেসিফা রাগে লাল হয়ে আছে। কারণ আজকে আখিঁউল এখনও গীটার বাঁজাচ্ছে না। কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছে সে। জেসিফার ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে আখিঁউলকে বলতে..”এই যে মিঃ এত ভাব কিসের। গীটার বাজাননা কেনো? বাজাঁন তাড়াতাড়ি যত্তসব।” আখিঁউল আগের মতই মন খারাপ করে বসে আছে। জেসিফা এবার রাগকে কন্ট্রোল করতে পারলনা। সরাসরি আখিঁউলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কোমড়ে হাত দিয়ে বলল….
–এই যে হাবা, কি সমস্যা আপনার হু? কতক্ষণ ধরে লুকিয়ে আছি গীটার বাঁজানোর নাম নেই। আজকে কি ছেকা খাইছেন নাকি? নাকি কেউ পাকা ধাণে মই দিছে। আপনি জানেননা আমি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম। যত্তসব…তাত্তাড়ি গীটার বাঁজান, আমি শুনবো।
আচমকা এভাবে অপরিচিত একটা মেয়ের কথা শুনে ভরকে যায় আখিঁউল। পরক্ষণেই সে আমতা আমতা করে বলে….
–লুকিয়ে লুকিয়ে শু..শু…শুনতেন মানে?
-আপনার সামনে আসার সাহস নাই। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে গীটারের সুর শুনি। আজকে বাঁজাচ্ছেননা দেখে মেজাজ খারাপ হলো তাই বললাম।
–আজকে এত সাহস পেলেন কোথায়?
-আব..মা..মানে..আস..সলে হ….
হুট করে জেসিফার এমন আমতা আমতা করতে দেখে হেসে দেয় আখিঁউল। নিজের এরূপ কর্মকাণ্ডে লজ্জায় লাল হয়ে যায় জেসিফা। মাথা নিচু করে ফেলে সে। এদিকে আখিঁউল হেসেই চলছে। নিজের গালে নিজেরই থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে হচ্ছে জেসিফার। না জানি লোকটা কি ভাববে। ছিঃ…আখিঁউল বলল….
–কি হলো, হঠাৎ বেলুনের মত চুপসে গেলেন যে?
-………
–কোথায় গেলো আপনার মেজাজ হা হা হা হ….?
-আমি সরি।
–এভাবে মাথা নিচু করে আছেন কেনো? লজ্জা পাচ্ছেন নাকি?
-আসলে আমি….
–হয়েছে হয়েছে থাক আর বলতে হবেনা।
-কিছু মনে করেননিতো আবার? (মাথা কিঞ্চিত উপরে তুলে)
–আরে না..তবে অবাক হয়েছি।
-কেনো?
–আপনার কর্মকাণ্ডে হা হা হা।
-ঐ খবরদার হাসবেনা পেঁচা, হনুমান জানি কোথাকার।
–বাব্বাহ মেডামের তো হেব্বি রাগ।
-রাগের দেখছেন কি হু….
–আচ্ছা আর রাগ করতে হবেনা। আমি সরি….
কারো মুখে কোন কথা নেই। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। জেসিফা মাথা নিচু করে আছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে আখিঁউলকে দেখছে। আখিঁউল মুচকি মুচকি হাসছে। তার আর মন খারাপ নেই। জেসিফা আস্তে করে বলল….
-গীটার বাজাবেন না?
–শোনার খুব ইচ্ছে?
-আচ্ছা থাক লাগবেনা বাঁজানো, আমি চলি।
–আরে আরে শুনুন?
হনহন করে চলে গেলো জেসিফা। পিছন থেকে আখিঁউল অনেক বার ডাকলো কিন্তু শুনলোনা জেসিফা। মুচকি হেসে গীটার হাতে নেয় আখিঁউল। তার খুব ভালোলাগছে। মন খারাপ নেই। চোখের সামনে জেসিফার লজ্জা মাখা মুখের ছবি ভাসছে।
রাত ১০ টা। রুবেল এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। আরিশা রুবেলের অপেক্ষায় বসে আছে। তার একটু চিন্তা হচ্ছে। কারণ রুবেল প্রতিদিন ৮ টার আগেই বাসায় আসে আজকে আসলোনা যে। কিছু হলোনা নাতো আবার? হোক তাতে আমার কি? উনি কি হন আমার? মনে মনে বলল আরিশা। কোন চিন্তা ভাবনাই ছাড়া বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। কিন্তু অদ্ভুত ঘুম আসছেনা। আরিশা ভাবছে..”আচ্ছা আমি লোকটার প্রেমে পরে গেলামনা তো আবার। তাহলে তার জন্য চিন্তা হচ্ছে কেনো? ধ্যাত….কি ভাবছি আমি।” বিছানায় ছটফট করছে আরিশা। বারবার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে। রাত ১২ টা বাজে এখনও আসছে না কেনো? সাতপাঁচ না ভেবেই এই প্রথম রুবেলের নাম্বারে ফোন দেয় আরিশা। আবার রিং হওয়ার আগেই কেটে দেয়। আবার কল দেয়। কিন্তু এবার বন্ধ দেখাচ্ছে। আরিশার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তার অস্থির অস্থির লাগছে। বুকের বাম পাশটায় চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো। আচ্ছা এই ব্যাথার নাম কি? এই অস্থিরতার নাম কি? ভালোবাসা? কই এর আগেতো এমন হয়নি। হঠাৎ কলিংবেলের টুং শব্দে ঘোর কেঁটে যায় আরিশার। তড়িঘড়ি করে দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েই একগাধা প্রশ্ন শুরু করে…..
–আজকে এত রাত হলো কেনো? কই ছিলেন এতরাতে। নাকি কোন মেয়ের ফ্লাটে গিয়েছিলেন। জানেন আমি কত টেনশনে ছিলাম? কি হলো কথা বলছেন না কেনো? জবাব দিন?
আরিশার এমন আচরণে অবাক হয়ে যায় রুবেল। বলে….
–আগে ভিতরে ঢুকতে দাও…
-তারর আগে বলুন কোথায় ছিলেন?
–আরে আসার সময় এক ফ্রেন্ডেরর সাথে দেখা। ওর বাসায় গেলাম। ভাবির সাথে কথা বললাম, সবার সাথে কথা বলতে বলতেই রাত হয়ে গেলো।
-আমাকে একটিবার ফোন করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?
–আসলে ফোনে চার্জ ছিলনা তাই। সরি….
মন খারাপ করে ঘরের ভিতরে চলে যায় আরিশা। আরিশার এমন আচরণে অনেকটাই বিস্ময় হয় রুবেল। মেয়েটি তার খোজ রাখে। তার জন্যে এতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিলো? ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে উঠে তার। ফ্রেস হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রুবেল। আরিশা ভ্রু-কুঁচকে বলে….
–খাবেননা?
-খেয়ে এসেছি।
–তাহলে আমার কি হবে?
-আপনিতো প্রতিদিন আমার আগেই হন। ভাবলাম খেয়েছেন তাই আমিও খেয়ে এসেছি।
–ওহ…
মন খারাপ হয়ে যায় আরিশার। লোকটার জন্য এতক্ষণ ধরে অপেক্ষায় ছিলো। অথচ সে খেয়ে এসেছে। আসলে দোষটা আমারই। চেয়ারে বসে প্লেটে ভাত নেয় আরিশা। তার খেতে ইচ্ছে করছেনা। গলা খাকাড়ি দিয়ে আরিশার পাশে চেয়ার টেনে বসে রুবেল। তারপর বিরিয়ানির প্যাকেটটা দিয়ে বলে….
–এটা তোমার জন্য। আসলে ভাবি বলল…বাসায় তুমি একা তাই তোমার জন্যও পাঠিয়ে দিলো।
-আমার খিদে নেই। আপনার ভাবি দিয়েছে আপনি খান।
–আমিও কিন্তু খাইনি?
-মানে..?
–সিম্পল, খাইনি।
-কেনো?
–ভাবি বললো বউয়ের সাথে এক প্লেটে বিরিয়ানি খেলে নাকি ভালোবাসা বারে।
‘ভালোবাসা বারে’ কথাটা শুনে আরিশার বুকটা ধুক করে উঠলো। মনে হচ্ছে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। রুবেল বলল….
-আচ্ছা আমি কি আপনাকে খাইয়ে দিব?
–লাগবেনা, আমি একাই খেতে পারি। আমার জন্য কারো দরদ দেখাতে হবেনা। (অভিমানের সুরে)
তারপর নিজে একাই খাওয়া শুরু করে আরিশা। কিছুক্ষণ পর মনে হয় ইসসস লোকটার হাতে খেলেই বুঝি ভালো হতো। লোকটা ভালোবেসে খাইয়ে দিবে আর আমি না করলাম। ধ্যাতত…ভাল্লাগেনা।
খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয় রুবেল। তারপর ছাদে উদ্দেশ্যে চলে যাওয়া শুরু করে। আরিশা বলে….
-কোথায় যাচ্ছেন?
–ছাদে।
-এতরাতে?
–যাই.. কিছুক্ষণ বসে থাকি।
-আমারর রুমে একাএকা ভয় করে।
–তাহলে আমার সাথে ছাদে চলুন।
অমনি বিছানা থেকে চাদর টান দিয়ে নিয়ে আরিশা বলল….
-চলুন।
–চাদর কেনো?
-ঠাণ্ডা লাগে যদি।
তারপর রুবেল আর আরিশা ছাদে চলে যায়। আকাশে তারা গুলো চকচক করছে। ছাদে বসে আছে রুবেল। তার থেকে একটু দূরে বসে আছে আরিশা। আরিশার ইচ্ছে হচ্ছে রুবেলের পাশে গিয়ে বসতে। ওর হাতে হাত রেখে, কাধে মাথা রাখতে। আরিশা গলা খাকরি দেয়। রুবেল বলে….
-ভয় পাচ্ছ?
–হুমমম।
-কাছে আসো।
আরিশা রুবেলের কাছাকাছি চলে আসে। রুবেল বলে আরো কাছে আসো। দুজনে একবারে গা ঘেষে বসে। আরিশার নার্ভাস লাগছে। বুকটা ধুটধুট করছে। শরীরে লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। অজানা এক অনুভূতিতে মনটা ছটফট করছে।
–আরিশা?
-হুমমম বলুন…
–ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর কারো কাছে ভালোবাসা পায়নি। ভাবছিলাম বিয়ে করে বউয়ের ভালোবাসা পাব। আচ্ছা তুমি আমাকে একটু ভালোবাসা ভিক্ষে দিতে পারবে? বিনিময়ে তুমি যা চাবে তাই দিব।
রুবেলের চোখে পানি ছলছল করছে। আরিশা তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে । নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে তার। একটা মানুষ তাকে এত ভালোবাসে অথচ তার গুরুত্ব সে দেয়নি। আরিশা নিজের হাত দিয়ে রুবেলের চোখের জল মুছে দিলো। কপালে আলতো করে চুমো দিয়ে বল….
–বিনিময়ে তোমাকে চাই। তোমার ভালোবাসা চাই। আর কিচ্ছু চাইনা।
-সত্যি….?
কোন কথা বললনা আরিশা। নিজের মাথাটা রুবেলের কাধে রাখলো সে। রুবেল চাদর দিয়ে আরিশাকে নিজের বাহুডোরে জরিয়ে নিলো।
পাশের ছাদে গীটার বাজাচ্ছে আখিঁউল। এতরাতে তবুও জেসিফা লুকিয়ে লুকিয়ে আখিঁউলের গীটারের সুর শুনছে। আখিঁউল জানে জেসিফা, যখন সে গীটার বাজাবে তখনই আসবে। মেয়েটাকে আখিঁউল ভালোবেসে ফেলেছে। এখন শুধু বলার অপেক্ষা।
আর সেই গীটারের শব্দ শুনে গুনগুন করে গান গাচ্ছে আরিশা। আর সেই গান মন্ত্রমুগ্ধের শুনছে রুবেল। ভালোবাসা এক অদ্ভুত জিনিস।