রোদেলা আজ ভীষণ খুশি। আশিকের মাথায় আজ এক বোতল পানি ঢালতে পেরেছে। সকাল থেকেই আশিকটা জ্বালিয়ে মারছিলো। ফুচকা খেতে গিয়ে ওর ভাগের ৩টা শেষ করে রোদেলার ভাগের শেষ ফুচকাটাও মেরে দিয়েছিল। রোদেলা কিছু বলার আগেই তার হারপিক দিয়ে মেজে ঝকঝকে তকেতকে পরিষ্কার করা ১৬ দন্ত জোড়া দিয়ে এক ভুবন জুড়ানো হাসি দিয়ে দিয়েছিলো। হাসিটা দেখে রোদেলার মাথা আরো বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল ওর অতি শখের চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলে।
অবিশেষে সুযোগ পেয়েই পুরো এক বোতল পানি ঢেলে দিয়েছে ওর মাথায়। শার্ট প্যান্ট ভিজে একাকার হয়ে গেছে আশিকের। রাগে রোদেলাকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ওর মিষ্টি হাসিতে আটকে গেল আশিকের চোখ। এই হাসিটার জন্য ও সব কিছু করতে পারে। যে কারো সাথে লড়তে পারবে সে। দুপুর ২টা। ক্লাস শেষে কলেজের ক্যাম্পাসে সবুজ ঘাসে বসে বসে গল্প করছে রোদেলার আর ওর বন্ধুরা। কিছুক্ষণ পর ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপাতে লাগলো আশিক। আরিফ বললো,
– কি রে কি হয়েছে?
– রোদেলা ক্রাশ লিস্টটা বের কর। আমার ৪৭ নাম্বার ক্রাশ খেলাম।
– ওয়াও গ্রেট। বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো অর্পণ।
– তাহলে তো দুপুরের লাঞ্চ আজ আশিকের ট্রিট।
সুপ্তি একথা বলতেই সবাই তাতে সুর মেলালো। আর রোদেলা ওর ব্যাগ থেকে হলুদ ডায়েরিটা বের করলো। আর তাতে নাম্বার ৪৭ দিয়ে লিখতে শুরু করলো। আশিককে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
– নাম?
– মর্জিনা। না শুনেই সবার হাসাহাসি শুরু হয়ে গেল।
– পেশা?
– ছাত্রী।
– কোন ক্লাস?
– একাদশ। উন্মুক্ত’র স্টুডেন্ট। অট্টহাসি শুরু হয়ে গেল এবার।
– বয়স?
– একটু বেশি। সম্ভবত ৩০।
– কথা বলার চেষ্টা করার পর প্রতিক্রিয়া?
– চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছে।
– প্রথম বলা কথা?
– শালারপুত যাইবে এইনতে? বেশি ত্যাঁদড়ামি করলে দিবাম একটা।
এবার রোদেলাও আর হাসি চাপিয়ে রাখতে পারলো না। ক্রাশ রিভিউ রেখে জোরে জোরে হাসতে লাগলো বাকি সবার সাথে তাল মিলিয়ে। রোদেলার এই হলুদ ডায়েরিটাতে আশিক যখনই ক্রাশ খায় তখনই তার রিভিউ লিখে রাখে রোদেলা। আশিকের প্রতিটা ক্রাশ এতোটাই বিচিত্র। যে শেষ পর্যন্ত রোদেলা থেকে শুরু করে যারা ওর আশেপাশে থাকে সবারই পেটে ব্যাথা শুরু হয় যায় হাসতে হাসতে।
কিন্তু রোদেলা জানে না যে আশিকের এই ক্রাশের গল্পগুলো আসলে পুরোটাই কাল্পনিক। প্রতিদিন কলেজে আসার পথেই আশিক রিকশায় বসে বসে এসব গল্প বানায় আর রোদেলাকে এসে বলে ক্রাশ খাওয়ার কথা। বিচিত্র ক্রাশের বিচিত্র কাণ্ডকারখানার কথা শুনে যখন রোদেলা হাসতে হাসতে আত্মহারা হয়ে যায় সেটা দেখতেই প্রতিদিন আশিক এই ক্রাশের গল্প ফাঁদে। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে সে রোদেলাকে কিন্তু কখনোই বলা হয়ে উঠে নি।
এরই মাঝে দেখতে দেখতে পরীক্ষা ঘনিয়ে এল। পরীক্ষার পর আশিকের সাথে রোদেলার দেখা সাক্ষাৎ একেবারেই কমে গেল। আর তখন অফুরন্ত অবসরে রোদেলা যখনই একা থাকতো তখনই তার বার বার আশিকের কথাই মনে হতো। তখন রোদেলা হলুদ ডায়েরিটা বের করে ক্রাশ কাহিনী গুলো পড়তো। প্রথম প্রথম মজা নিয়ে পড়লেও আস্তে রোদেলার ওই ক্রাশ লিস্ট দেখলেই রাগ উঠে যেত। কি বেহায়া ছেলে! সারাক্ষণ শুধু মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকা!
রেজাল্ট হয়ে গেল। কিন্তু রোদেলা আশিকের আর খোঁজ পেল না। রেজাল্টের দিন সবাই কলেজে এলেও আশিক এলো না। ওর ফোন নাম্বারও বন্ধ পাওয়া গেল। এমনকি ও যে মেসে থাকতো সেখানেও অর্পণ আরিফ খোঁজ নিতে গিয়েও ওকে পেল না। যেন একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেল আশিক। আর তখন রোদেলার কেমন জানি লাগতে লাগলো। প্রচন্ড রকমভাবে মিস করতে লাগলো আশিককে। বুঝতে পারলো মনের অজান্তেই হয়তো ভালোবেসে ফেলেছিল আশিককে।কিন্তু আশিক এখন হারিয়ে গেছে ওর দৃষ্টিসীমার আড়ালে।
জীবন কখনো থেমে থাকে না। রোদেলারও থেমে থাকে নি। একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়ে গেল রোদেলার। এরই মধ্যে রোদেলার বাবা তার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করলো রোদেলার। ছেলে একটা বড় কোম্পানির ম্যানেজার। ভীষণ ব্যস্ত। দুই পরিবার সব কথাবার্তা ঠিক করার পর ছেলে আর ছেলের পরিবার এল রোদেলাকে দেখতে। ড্রয়িং রুমে রোদেলার বাবা আর ওর ভাইয়ের সাথে কথা বলছে ছেলে আর ছেলের পরিবার। কিছুক্ষণ পর রোদেলাকে নিয়ে এল ওর মা। রোদেলা একবার মাথা উঠিয়ে ছেলেকে দেখেই চিৎকার করে উঠলো,
– বাবা আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবো না। এই ছেলে উঠতে বসতে ক্রাশ খায়। বাছ – বিচার নেই। রাস্তায় যাকে দেখে তার উপরই ক্রাশ খায়। এই পর্যন্ত ৫১ টা ক্রাশ খেয়েছে পুরো লিস্ট আছে আমার কাছে। রোদেলার এই কথা শুনেই রোদেলার বাবা ছেলের বাবা দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেল। বলে কি এই মেয়ে! রোদেলার বাবা আর ছেলের বাবা একসাথে বলে উঠলো,
– ক্রাশ কি? এতক্ষণে মুখ খুললো ছেলে মানে আশিক।
– ক্রাশ মানে বাঁশ। রোদেলার বাবা আর আশিকের বাবা দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। আশিক এবার কোনো রকম ভণিতা না করেই বললো,
– আমি রোদেলার সাথে একা একটু কথা বলতে চাই। রোদেলার ভাই আশিক আর রোদেলাকে ওর রুমে নিয়ে গেল।রোদেলার ভাই চলে আসতেই বলতে শুরু করলো আশিক,
– ৫২ নাম্বার ক্রাশ টা খেয়ে ফেলেছি। নাম রোদেলা। পেশা চাকরিজীবী। প্রথম অভিব্যক্তি চিল্লানি দিয়া উঠা। প্রথম কথা বাবা আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবো না। এই ছেলে উঠতে বসতে ক্রাশ খায়। বাছ – বিচার নেই। রাস্তায় যাকে দেখে তার উপরই ক্রাশ খায়। এই পর্যন্ত ৫১ টা ক্রাশ খেয়েছে পুরো লিস্ট আছে আমার কাছে। আর তাকেই আমি বিয়ে করবো।
– জীবনেও না। তোর বিয়ে তোর ৩৯ নাম্বার ক্রাশ ওই তিন বাচ্চার মা সখিনা বানুর সাথেই দেব।
– নাউজুবিল্লাহ। বিশ্বাস কর। আমার লাইফে ক্রাশ শুধু একজনই আর সেটা তুই। তোর ওই হাসিমুখ দেখার জন্যই ওইসব ক্রাশের গল্প ফাঁদতাম। আমি শুধু তোকে ভালোবাসি। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল রোদেলা। আর কিছু বলতে পারলো না। রিসিপশনের স্টেজে বসে আছে রোদেলা আর আশিক।
– ওই রোদেলা তাড়াতাড়ি ডায়েরি বের কর। ৫৩ থেকে ৬০ নাম্বার ক্রাশ একসাথে পেয়ে গিয়েছি।
– কি বললি হারামজাদা চিৎকার করে উঠলো রোদেলা। সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল স্টেজের দিকে। মিটিমিটি হাসতে লাগলো আশিক তার হারপিক দ্বারা মাজা ১৬ জোড়া দন্ত কেলিয়ে।