আমার বয়স তখন ছয়। ফ্রক পরি। আমার মামার ছিল অন্দরমহলে অবাধ যাতায়াত। সেই তিনি একদিন আমাকে জাপটে ধরে একটা কুৎসিত কাজ করলেন। আমার শরীরে একটু ব্যথা লেগেছিল। তবে জানো, মনে কষ্ট খুব একটা লাগে নি। সবচেয়ে বেশি লেগেছিল অবাক। কাউকে বলতে পারি নি। আজ বলবো, কাল বলবো, রেখেঢেকে বলবো, বুঝেশুনে বলবো – এই করতে করতে বড় হয়ে গেছি। সব মেয়েই বড় হয়। অন্দরমহল কিংবা রাস্তার দু-একটা এমন ব্যাপার মনে রেখে বড় হয়। কাউকে বলতে না পেরে বড় হয়। আমার একটা ডায়েরি আছে। তাতে লেখা আছে, চেনা-অচেনা মানুষ মিলে কতজন সুযোগ পেলেই আমার গায়ে হাত দিয়েছে। একেবারে পরিসংখ্যানের ট্যালি কাটার মত আমি হিসেব রেখেছি।
ইন টোটাল হবেঃ সাতাশি বার। সাতাশি একটা সুন্দর সংখ্যা। তিন দিয়ে বিভাজ্য। একশোর কাছাকাছি। আমার বয়স বাইশ, অন এভারেজ মানুষ আমার গায়ে হাত দিয়েছে আচ্ছা থাক। আমি সেঞ্চুরির অপেক্ষা করছি। খুব দ্রুত হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
যা যা ঘটে, তাতে প্রতিদিন আমার মাথা নিচু করে বেরুনোর কথা। কিন্তু কেমন করে যেন আমি নিজেকে বুঝ দিই।
টেনেটুনে পাশ করা স্টুডেন্ট যেমন ফেল করা স্টুডেন্টকে দেখে নিজেকে বুঝ দেয়। আমি তো সেই মেয়েটার থেকে ভালো আছি, যাকে রেইপ করে বস্তায় ভরে ফেলার সময় বয়স ছিল দুই। আমি তো সেই মেয়েটার থেকে ভালো আছি, রেললাইনের ওপর যাকে ফেলে গিয়েছিল ওরা। ট্রেন চলে যাবার পর দেখা গিয়েছিল মাথা একদিকে, আর শরীর আরেকদিকে। আমি তো সেই মেয়েটার থেকে ভালো আছি, রেইপড হবার পর যে মেয়েটা পানি চেয়েছিল। আর ওরা হাসতে হাসতে ওর মুখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিল।
মেয়েগুলো নিশ্চয়ই খুব একটা কষ্ট পায় নি। নিশ্চয়ই অবাক হয়েছে মানুষগুলোর কাণ্ড দেখে। ভেবেছে, আমার বয়স দুই, কেমন করে আমাকে দেখে তোমাদের লোভ লাগে? কিংবা ভেবেছে, মেরে ফেলেছ ভালো কথা, আমাকে এতগুলো টুকরো করার কী দরকার ছিল? কিংবা ভেবেছে, পানি চেয়েছিলাম, না দিলেও হত, কিন্তু অ্যাসিড দেখেছ, আমি কিন্তু একবারও “অমানুষ”, “বর্বর” কিংবা “পিশাচ” জাতীয় শব্দ ব্যবহার করছি না। সবাই তো মানুষ। যে মানুষটা আজ রাতে কাজের মেয়েটার মুখ চেপে ধরবে রান্নাঘরে, তারপর নিশ্চিন্তে বেডরুমে ফিরে এসে ঘুমিয়ে যাবে স্ত্রীর পাশে, সে-ও মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। বাবা, স্বামী কিংবা ভাই। কাজের মেয়েটা কোনোদিন কিছু বলতে পারবে না, কারণ ঢাকা শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার চাইতে রোজ রাতে একটু সহ্য করা বেশি নিরাপদ। আর স্ত্রীও কোনদিন কিছু বলতে পারবে না। কারণ আচ্ছা ছাড়ি। তার চেয়ে সাতচল্লিশ বছর আগের একটা ছোট্ট গল্প শোনাই।
জায়গাটা ছিল একটা হাসপাতালের মত। আহত, নির্যাতিত মেয়েদের সেবা দেয়া হচ্ছে। এক ডক্টর এলেন একটা মেয়ের চিকিৎসা করতে। সে বীরাঙ্গনা। মিলিটারি ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। জামাকাপড় ছেঁড়া, শরীরে আঁচড়-কামড়ের দাগ। জ্ঞান নেই বোধহয়। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে বিছানায়। ডক্টর দেখলেন, ছোট্ট রুমটার একমাত্র জানালা বন্ধ। পাশে দাঁড়ানো নার্সকে উর্দুতে বললেন, “খোল দো।” পরমুহূর্তেই অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, শুয়ে থাকা প্রায় সংজ্ঞাহীন মেয়েটার হাত চলে যাচ্ছে নিজের পাজামার ফিতের কাছে। সে গত কয়েক মাস ধরে এতবার এই হুকুম তামিল করেছে, সে জানেও না এখন কে বলছে “খোল দো”, মিলিটারিরা নাকি অন্য কেউ। সে শুধু জানে হুকুম তামিল করতে হবে।
সাতচল্লিশ বছর এমন কিছু সময় না। খুব বেশি কিছু এই সময়ে বদলানো যায় না। এই যেমন ধরো, আমরা এখনো কাঁদতে পারি, লুকোতে পারি আর অর্থহীন আস্ফালন করতে পারি। আমি খুব ভীতু স্বভাবের মেয়ে। যে যা-ই করুক, মাথা নিচু করে চলে আসি। বাসের ভেতর সেদিন এক মেয়ে তুমুল ঝগড়া করলো কেউ একজন গায়ে হাত দিয়েছে বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাকি কাউকে দলে না পেয়ে নিজেই কাঁদতে কাঁদতে নেমে গেলো।
মেয়েটা আমাকেও দলে পায় নি। আমি মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিলাম। ভাবছিলাম, আমি তো সেই মেয়েটার থেকে ভালো আছি, যাকে রেইপ করে বস্তায় ভরে ফেলার সময় বয়স ছিল দুই আমার আসলে ভাবতে ইচ্ছে করে না কাউকে রেইপ করার পর হাত-পা-মুখ বেঁধে বস্তায় ভরে ফেলার সময় তার খুব কষ্ট হয়। ভাবার চেষ্টা করি, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়, মেয়েটা নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি মরে যায়। এই যাহ, এতদিন ওদের সবার থেকে এগিয়ে ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ আমি বস্তার ভেতর কেন?
আমার শরীরের বাকি অর্ধেক মিস করছি। এই বস্তাটার ভেতর আছে শুধু আমার মাথা আর হাত দুটো। বাকিগুলো আলাদা আলাদা করে আরও দু-তিনটা বস্তায় ভরে ফেলা হয়েছে। একেকটা ফেলা হবে একেক জায়গায়, যাতে সব এক করতে কালোঘাম ছুটে যায়। মানুষ আজকাল খুব বুদ্ধিমান বস্তায় বসে বসেই খুব বিদঘুটে একটা জোক মনে পড়ে যায়। পুলিশের জোক। একটা স্টিল ফোটোতে দেখা যায় লাশ পড়ে আছে। ছিন্নভিন্ন লাশ। ক্রাইম সিন। এক পুলিশ আরেক পুলিশকে জিজ্ঞেস করছে, বলো দেখি, এই ছবিটাতে মোট ক’টা বডি পড়ে আছে? বন্ধু উত্তর দিতে পারলো না, মাথা চুলকোলো শুধু। প্রথম পুলিশ হাসতে হাসতে বলল, জানতাম তুমি পারবে না। কারণ সঠিক উত্তর হচ্ছে একটা ভগ্নাংশ।
হ্যাঁ, ভগ্নাংশ। ঠিক যেমন সম্ভ্রমের একটা ভগ্নাংশ নিয়ে প্রতিটা মেয়ে বড় হয়। স্বাধীনতা দিবসে সেজেগুজে বেরুবো। সবুজ শাড়ি আর লাল ব্লাউজ পরে। চুলে ফুল জড়াবো, হাত ভর্তি থাকবে কাঁচের চুড়িতে। বান্ধবীদের সাথে ঘুরবো, ছবি তুলবো। কোন এক সুযোগে নিশ্চয়ই তোমরা আজকেও আমার গায়ে হাত দেবে। তাই না, মানুষ?