মেয়েটাকে ভালো লেগেছিলো। চোখের গভীরতায় প্রশান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। ঠোঁটের আহ্লাদে ভিজে যাচ্ছিলাম। তবুও বড়দের দেখে দেখে ভেতরে পৌরুষ্য জাগলো। কনে দেখার আলোয় তাঁকে অস্তিত্বে জ্বলতে দেখেছিলাম। হঠাৎ প্রশ্ন করে ফেললাম– এইচ এস সি তে ইংলিশে কতো মার্কস্ ছিলো?? মেয়েটা মাথা নাড়লো। আস্তে করে বললো-“মনে নাই।” তার চোখে মুখে বিরক্তি দেখিনাই। তবুও পরদিন সকালে দুঃসংবাদটা শুনলাম। মেয়ের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি বলে ও মেয়ে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁর মাবাবাকে বলে দিয়েছে –“যদি পারেন, নদীতে ভাসান, ঐ লোকটার গলায় ঝুলাবেন না আমাকে।”
বুঝলাম মেয়েটা এমন একজনকে চায় যে কিনা প্রশ্নবিদ্ধ করে তাঁর যোগ্যতার বিচার করবেনা, প্রাণে বিদ্ধ করে তাঁর যোগ্যতাকে সম্মান করবে। আর এটাও বুঝলাম বড়লোক বাবার অত সুন্দরী মেয়ের বয়স ২৭ হওয়া সত্ত্বেও এখনো বিয়ে হচ্ছেনা কেন। মেয়েটা তাঁর উপযুক্তকে খুঁজছে, পাচ্ছেনা। ভেতরে দহন হতে থাকলো। মেয়ের বাবা মস্ত ধনী। শহরে বাড়ী গাড়ী করার ক্ষমতা আছে। তবুও বাপদাদার ভিটা আঁকড়ে গ্রামে পড়ে আছেন। আমি পরিকল্পনা করতে লাগলাম কি করে মেয়েটাকে জয় করা যায়। একবার ভাবলাম ওদের উঠোনের লেবু গাছের নিচে বসে আমরণ অনশন করবো ওকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু কল্পনাটা বাস্তবের বাইরে ছিলো। ভাগ্যবশত মনে পড়লো যে ওর ফোন নম্বর এনেছিলাম। অনেক ভেবে একটা কল দিলাম। ও প্রান্ত থেকে মধুর স্বর এলো–“বলুন?” আমি সোজা বললাম–“স্যরি!” তারপর বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। মেয়েটা খালি হুঁ, হুম, আর জ্বী বলতো। মেজাজটা খারাপ হতো কিন্তু চুপ করে সয়ে নিতাম। পরে আবার যদি প্রত্যাখ্যান করে আমায়?! এভাবে বেশ কিছুদিন কথা বলার পর একদিন প্রশ্ন করলাম–
–“আমাকে প্রত্যাখ্যান করার কারণ কি ছিলো?”
–“কিছুনা।”
–“ঐ প্রশ্নটা?”
–“ফোন রাখবো।”
কি কাঠালো জবাব!! মেজাজটা গরম হতো। তাও পাবার আশায় চুপ থাকতাম। ওর বাড়িতে পুনঃরায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবার আগের দিন ফোনে ওর সাথে আবার কথা হলো। কুশল বিনিময় শেষে বললাম-” আমি কি আবার আপনার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারি?”
–“আর কেন? যা গেছে,তা গেছেই।”
–“ইয়ে মানে দেখুন–
আমি ডিম ভাজার সাথে শুকনো মরিচ ভাজা খাই, অনেক ঝাল করে শুটকী মাছের তরকারি খাই। আপনি খালি মরিচটা ভেজে রাইখেন, কিংবা শুটকীতে মরিচ একেবারে কম দিয়েন তাও চলবে। স্বাধীনতা চান? সবটুকু নেন, চাকরি করবেন? করুন। খুব দরকার না পড়লে সেবা করাও লাগবেনা, তরকারিতে লবণ দিতে ভুলে গেলেও সমস্যা নাই আমি বলে শেষ করতে পারলাম না। ও পার থেকে আচানক সুন্দর শব্দের হাসি এলো! আমি তো পুরোই অবাক! এ মেয়ে এতো সুন্দর করে হাসতেও পারে??
হাসি থামিয়ে বললো-“এতো সুবিধে?? কেনো?” আমি একটু ভেবে বললাম–“ভালোবাসি তাই আর কোন শব্দ হলোনা। অনেকক্ষণ সে কিছুই বললো না, ফোনটাও রাখলোনা। অন্যসময় তার নিরবতা অসহ্য লাগতো,বিরক্ত লাগতো। কিন্তু তাঁর তখনকার নিরবতায় আমি অনুরক্ত হয়ে রইলাম; ভালো লাগায় ছেঁয়ে গেলো আকাশটা। পরদিনই প্রস্তাব পাঠানোর সাহস পেলাম। আমাদের বিয়ে হলো। প্রথম রাতে সে একটা প্রশ্ন করেছিলো–“কেমন আছেন?” “ভালো।” বলে আমি এ পাশে কাঁত হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। ঘুমাইনি,ঘুমের ভান করেছিলাম। সে ভানটাকে বাস্তব ভেবে সত্যই ঘুমিয়ে গেছিলো।
সে কি আমার ভান করাটা ধরতে পারেনি? নাকি তাঁর এই ঘুমিয়ে যাওয়াটাও তাঁর আত্মঅহংকারের অংশ ছিলো তা আমি জানিনা। কোনদিন আর জানা হয়নি। বিয়ের সপ্তম রাতটা তাঁর বাপের বাড়িতে বৌভাতে ছিলাম। ঐ দিন সকালে সে আমায় ঘুম থেকে ডাকতে এসছিলো। আমি অনেক বেলা করে ঘুমের ভান ধরে থাকতাম। ভাবতাম– সে আমার ঘুমন্ত চোখে হাত বুলাবে, কপালে হাত রেখে আস্তে করে ডাকবে আমায়! অবশেষে ঐদিন সকালে ডাকতে এসছিলো। –“এই যে! উঠেন।”
“সকাল বেলার নাশতা না করে আমি জাগি না।” এটা বলতেই সে আমার কপালে হাত রেখে বলেছিলো–“উঠেন! এগারোটা বাজে। খেতে হবেনা?” ঐদিন চোখ খুলে তাঁর হাসি মুখটা প্রথমবারের মতো দেখেছিলাম। আমি তাকাতেই হাসির শব্দ বাড়ছিলো। কি অবুঝ রকমের মিষ্টতায় ভরা হাসি!!!
অতঃপর, চারটি বছর কেটে গ্যাছে একসাথে। সে কদাচিৎ আমার মনের কথা বুঝতো। বেশিরভাগ সময়ই বুঝতো না। রাগ হতো আমার। সে স্বেচ্ছায় কখনো আমার রাগও ভাঙাতে আসতো না। আমার রাগ বেড়ে যেত আরো। পরে আবার কমিয়ে নিতাম। এভাবে হাসি,আনন্দ,কষ্ট, রাগ, অভিমান, ঝগড়ায় দিন কেটে গেছে বেশ। তবে সে রাগ করে কখনো তাঁর বাপের বাড়ী যেতনা। এটাও তাঁর আত্মঅহংকারেরই একটা অংশ। রাগ বা অভিমান বেশি হলে সে বেলকনির চেয়ারে বসে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাখতো।
ওটা দেখেই বুঝতাম তাঁর রাগ বা অভিমানটা সিরিয়াস অবস্থায় আছে। আমি অনেক চেষ্টা করে তাঁর রাগ ভাঙাতাম। খুব অপমানিত লাগতো আমার। উনার রাগ ভাঙাতে আমাকে কেন নত হতে হবে? এই ভেবে পৌরুষ্য জেগে উঠতো। কিন্তু থেমে যেতাম। ভাবতাম–” ইট পাথরের নষ্ট পৃথিবীটার সামনে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নোংরামির সাথে পৌরুষ্য দেখাই; ঘরের অবলা নারীর সাথে কেন? তাঁর আত্ম অহংকার আমায় গর্বিত করতো। মনে হতো আমার সম্মান যার কাছে বাঁধা, তাঁর নিশ্চয় আত্মসম্মানবোধ থাকা উচিৎ। সে আমার মন বুঝতো না, মান ভাঙাতো না, ঠিক। তবে তাঁর মান ভাঙানোর পর সে যে সরল হাসিটা আমায় উপহার দিতো তাঁর কাছে সমস্ত পৌরুষ, সমস্ত প্রভুত্ব জলাঞ্জলি দেয়া যায়।
আজ সন্ধ্যা বেলায় রুমে এসেও দেখি সে বেলকনির চেয়ারে। গতকাল রাতে তাঁর সার্টিফিকেট দেখতে চেয়েছিলাম ভুলবশত। সে দেখাইনি। সে ওটা আমাকে দেখাবে না। তাঁর যোগ্যতা আমার অন্তরে গেঁথে রাখবে সে, কাগজ দেখিয়ে নয়। বেলকনিতে গেলাম। অন্যদিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম–” সবসময় খালি আমাকেই আসতে হবে!! হুঁ, আমি আসবো। কাল রাতে তো ওটা আমি এমনিতেই বলেছিলাম। স্যরি!” তারপর অনেক সময় গেলো চুপচাপ। হঠাৎ সে আমার হাতটা চেপে ধরলো। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে, তাঁর মৃদু সরল হাসিটার দিকে তাকিয়ে আবারো আমার পৌরুষ্যকে মাটি চাপা দিলাম। এটা কি পুরুষের দুর্বলতা? নাহ্! এটা দুর্বলতা নয়। দুর্বলের উপর বল খাটানোটাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা!
দূর দিগন্তে সন্ধ্যা শেষে রাত নামতে লাগলো। আমি বললাম–“আলো চলে যাচ্ছে যে! আরেকটু হাসি হবে?”
মেয়েটা হাসলো। আমার হাতের উপর সেঁটে থাকা তাঁর হাতগুলো হাসেনি। হাসির আড়ালের সবটুকু গাম্ভীর্যভরে আঁকড়ে রেখেছে আমায়!!! ওহ্! বলা হয়নি। মেয়েটা আমায় এখন মাঝেমাঝে ‘তুমি’ করে বলে। আর হ্যাঁ, মেয়েটার নাম অনামিকা। অনামিকা না হয়ে অহমিকা হলে ভালো হতো। আমার অহমিকা! আমার অহংকার!