ডিভোর্স লেটারের সাথে হলুদ খামে করে একটা চিঠি পাঠিয়েছে রিয়া। অনিমেষ, প্রিয় এবং অপ্রিয়ের মাঝামাঝিতে যে মানুষ থাকে , চিঠির শুরুতে তাকে ঠিক কি বলে সম্বোধন করতে হয়, আমি শিখিনি কোথাও। এতক্ষনে নিশ্চয়ই ডিভোর্স লেটারটা তোমার হাতে পৌঁছে গেছে। হুট করে ডিভোর্স লেটার পেলে, যেকেউই একটু ধাক্কা খাবে। তুমি ঠিক কতটুকু ধাক্কা খেয়েছো, আমি অনুমান করতে পারছিনা। অথবা তোমার কোন ধাক্কাই লাগেনি হয়তো। শোন আমাদের সম্পর্কের আজ ৪ বছর পূর্ণ হলো। এইদিনে ডিভোর্স লেটারের জায়গায় হয়তো প্রেম পত্র থাকার কথা ছিল। অথচ, পৃথিবী সব সময় তার কথা রাখতে পারে না। যেমন কথা রাখতে পারোনি তুমি।
আমরা ৪ বছর একসাথে ছিলাম! একই ছাদের নিচে! পাশাপাশি বালিশে! একই ঘরে! একটাই শরীর মোছার তোয়ালে ব্যবহার করেছি! পাশাপাশি চেয়ারে বসে খেয়েছি প্রতিদিন! অথচ, আমরা কখনো কাছে আসতে পারিনি। আমাদের ভেতরে একটা দূরত্ব ছিল গোপনে। আমি তোমার কাছের মানুষ হয়েছি শুধু সঙ্গমে! সঙ্গম এবং সঙ্গমের বাইরে তুমি এক অন্যমানুষ! আমি তোমার কাছের মানুষ ছিলাম, যতক্ষন না তোমার বীর্যপাত সম্পন্ন হয়েছে। বীর্যস্ফলনের পর তোমাকে অপরিচিত লাগে। এই মানুষটা তখন আর একটু আগের মানুষ থাকেনা। আমার নিজেকে খুব যৌন যন্ত্র মনে হয়, অনিমেষ। অথচ, বিছানার বাইরেও আমার একটা ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন হয়! যত্নের অভাববোধ হয়! মুগ্ধতায় ভরা এক জোড়া চোখের চাহনি প্রয়োজন হয়!
তুমি রোজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে ঘরে ফিরবে বলে আমি চোখে কাজল দিয়ে বসে থাকি। কপালে তোমার প্রিয় রংয়ের টিপ পরি। তুমি ঘরে ফেরার আগে, আমি বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখি। তুমি ঘরে ফেরার পর প্রথম যে কথাটা বলবো, সেটা অন্তত ১০০ বার ট্রায়াল দেই। কথা বলার সময় আমার মুখের এক্সপ্রেশনটা দেখি। তোমার চোখে কেমন লাগবে, এই ভয়টা কাজ করে সবসময়। তারপর তুমি ঘরে ফিরো, আমি দরজা খুলে জিজ্ঞেস করি, ” খুব ক্লান্ত হয়ে গেছো, তাই না?” তুমি তাকাও না কখনো। আমার কান্না পায়! আমি প্রত্যাশা করি, সারাদিন মানুষটা কাজ করে ঘরে ফিরে আমাকে একটু দেখুক। আমি প্রত্যাশা করি, কেউ ঘরে ফিরে একবার জিজ্ঞেস করুক, “সারাদিন খুব একা একা লেগেছে?”সেরকমটা হয়না কখনো। তুমি ফ্রেস হও, আমি প্লেটে খাবার তুলে দেই।
তুমি কখনো বলোনি, ” তোমার হাতের মালাইকারিটা খুব অসাধারন হয়, রিয়া!” কারন তুমি জানোই না, রান্নার কাজটা ভালোবেসে করতে হয়। ঠিক কত’টা যত্ন নিয়ে তরকারিতে লবন ঠিক আছে কিনা দেখতে হয়, তোমার ভালো লাগবে কিনা ভাবতে হয়, তুমি টের পাবেনা। এরপর রোজ রাতে নিয়ম করে আমরা বিছানায় যাই। আমার কপালের টিপ খুলে আয়নায় লাগিয়ে রাখি। আমার চোখের কাজল মুছে ফেলি। শরীর মুছে সামনে আসি। তুমি তাকাও। তোমার চোখে মুগ্ধতা অথবা যৌনতার লিপ্সা দেখে আমি হতবম্ভ হই। এই মানুষটাই কি একটু আগের মানুষ? যে এতক্ষন তাকায়নি আমার দিকে। তুমি বোধয় খুব নগ্নতা প্রিয় স্বামী, অনিমেষ! তাই না?
জানো অনিমেষ, স্বামী হওয়ার আগে একজন প্রেমিক হতে হয়! এমন প্রেমিক, যার কাছে বিছানা এবং বিছানার বাইরে সব জায়গাতেই স্ত্রীর গুরুত্ব সমান। আমারও তোমার মতো, শারীরিক চাহিদা আছে। তবে যার তার সাথে আমি শরীর বিনিময় করিনা। তোমাকে আজকাল রাস্তার মানুষ মনে হয়। যে ভালোবাসতেই জানে না। ভালোবাসাহীন শরীরের বিনিময়ে নিজেকে বেশ্যা লাগে। অথচ, আমি প্রেমিকা হতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, মানুষটা দূরে গেলে আমার শূন্যতা অনুভব করুক। কাছে আসলে ভালোবাসার দৃষ্টিতে একবার অন্তত তাকিয়ে থাকুক। এটা তোমার হয়নি কখনো।
আমি চলে যাচ্ছি। যে ঘরে ভালোবাসা, প্রেম, যত্নের অভাব থাকে, সেখানে দমবন্ধ লাগে খুব। তোমার খুব একটা সমস্যা হবেনা। তোমার ফোনের টেক্সট পড়েছি আমি, তার নাম অনুরিমা। খুব সম্ভবত তোমার কলিগ। তুমি লিখেছিলে, নীল শাড়িতে তোমাকে আজ ভীষন সুন্দর দেখিয়েছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, তোমার চোখেও প্রেম আছে, তবে সেটা আমার জন্য না। যে মানুষ ঘরের বাইরে আমার না, সে আমার পুরুষ হতে পারেনা।
ব্যক্তিগত পুরুষ হতে হলে, এক কোটি মাইল দূরে বসে থাকলেও সে আমার। অতটুকু নির্ভরশীলতা যার প্রতি আসেনা, তাকে আমি আমার বলি না! যে প্রেমিক ঘর থেকে বের হলেই অন্য মানুষ, সে ব্যক্তিগত হয়না কখনো। যার তার সাথে আমি শুধু মাত্র শরীর বিনিময়ে অংশ নিতে পারবোনা। আমার প্রেম এবং শরীর দুটোই চাই। আমার একটা ব্যক্তিগত মানুষ চাই, যে মানুষ একান্তই আমার। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে থাকার দূরত্বেও সে আমার। তুমি ভালো থেকো! মাইগ্রেনের ঔষুধের পাতাটা ডান দিক থেকে আলামারির তৃতীয় ড্রয়ারে রাখা আছে!
নিজের খেয়াল রেখো!
ইতি,
রিয়া।