ওরে আমারে ভাত দে, ভাত দে!” ফয়সাল মুখে খাবার তুলতে গিয়েও থেমে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে নেহার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমারে কতবার বলছি বুড়োটাকে আগে খাবার দিয়ে নিবা। কথা কি শুনতে পাও না নাকি? ” নেহাও সমান মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, “আমার কি কোনো কাজ নেই? সারাদিন কি তোমার বাবার খাবারের প্লেট নিয়ে বসে থাকি? এতই যদি দরদ তিনবেলা তুমি খাবার বেড়ে দিও!” ফয়সাল খাবারের প্লেটটা দূরে সরিয়ে বলে, “শোনো রোজ রোজ কাজ থেকে বাড়ি ফিরে এসব উৎপাত আমার ভালো লাগে না। যাও বাবাকে ভাত দিয়ে এসো।” নেহা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে যায়। অপরিস্কার একটা খাবারের প্লেট নিয়ে তাতে খাবার বাড়তে থাকে। ফয়সাল কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। জানে এখন কিছু বলতে গেলেই নেহা উল্টো ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দেবে। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করে। তাছাড়া কাউকে বলেও যখন কাজ হয় না, তখন কথা বলাটা নিছক কথা বাড়ানো বৈ আর কিছু নয়।
ফয়সালের বাবার নাম তমিজু্দ্দিন। বয়স ৭০ ছুঁইছুঁই। বছর দুয়েক হলো তিনি চোখে দেখেন না। প্রথমে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন। কেউই গুরুত্ব দিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। আস্তে আস্তে একসময় তিনি অন্ধ হয়ে যান। একটা অন্ধকার ছোট রুম বরাদ্দ হয়েছে তার জন্য। সে রুমে আলো-বাতাসের অনুঃপ্রবেশ ঘটে না। স্যাঁতসেঁতে দুর্গন্ধযুক্ত ঘরটায় প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসে না। যে ই আসে, নাকে কাপড় গুঁজে থাকে। ফয়সালের দুটো ছোট ছোট বাচ্চা সারাক্ষণ দাদু দাদু বলে অস্থির হয়ে গেলেও নেহা ওদেরকে তমিজু্দ্দিনের রুমের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয় না। এত দুর্গন্ধ ছোট ছোট বাচ্চারা কিভাবে সহ্য করবে! নেহা খাবারের প্লেট নিয়ে হনহন করে তমিজু্দ্দিনের রুমে প্রবেশ করেই সজোরে প্লেটটি তমিজু্দ্দিনের সামনে রেখে কর্কশ কন্ঠে বলে, “নিন, খেয়ে নিন। খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেন। ” নেহা নিজের জন্য খাবারের প্লেটে ভাত বেড়ে মুখে তুলতেই তমিজু্দ্দিন ডাক দেয়, “ও বউ, বউ। একটু তরকারি দিবা? তরকারি ছাড়া ভাত কি খাওন যায়?” বিরক্তিতে ফয়সালের কপাল কুঁচকে যায়। বিরক্তভরা চোখে নেহার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার কি তরকারিতে টান পড়ছে? একটু বেশি করে তরকারি দিতে পারো না?”
নেহা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে, “সবসময় আমাকেই দোষারোপ করো। তোমার বাবা চোখে দেখে না। ভাত ভেবে তরকারিগুলো আগে খেয়ে ফেলে। তারপর সাদা ভাত পড়ে থাকে। ” অন্ধ বাবার জন্য হঠাৎ ফয়সালের করুণা হয়। মুখে করুন ভাব ফুটিয়ে বলে, “খাক না। বুড়ো মানুষ আর কতদিন খাবে?” নেহা কথা না বাড়িয়ে একবাটি তরকারি নিয়ে উঠে যায়। নিজেকে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে। কোন কুক্ষণে যে ফয়সালের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল! এত জ্বালা আর ভালো লাগছে না। কবে যে বুড়োটা মরবে আর সে জ্বালামুক্ত হবে, কে জানে! খেয়ে-দেয়ে ফয়সাল বাহিরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই তমিজু্দ্দিন ডাক দেয়, “বাবা ফয়সাল, একটু শুনবা?” ফয়সাল রুমে না এসেই বাহিরে দাঁড়িয়ে বলে, “কিছু বলবেন?”
তমিজু্দ্দিন মিনমিনে কন্ঠে বলে, “বাবা, শ্বাসকষ্ট আবার বাড়ছে। যদি কয়টা ওষুধ নিয়ে আসতে ” ফয়সাল গলা চড়িয়ে বলে, “আপনি কি ওষুধ পানিতে গুলে শরবত বানিয়ে খান? পরশু ই তো একপাতা ওষুধ নিয়ে আসলাম। কি করছেন?” তমিজু্দ্দিন আমতা আমতা করে বলে, “ওষুধ খুলতে গিয়ে কোথায় যে পড়ে যায়, আর খুঁজে পাই না। ” মনে থাকলে আনব ” বলে ফয়সাল বেরিয়ে যায়। পান-সুপারিও ফুরিয়ে গেছে। ছেলের এই রাগত স্বর শুনে তমিজু্দ্দিন আর সে কথা বলার সাহস পেলেন না। সন্ধ্যায় ফয়সাল বাড়ি ফিরতেই নেহা হইহই করে ওঠে, “তোমার বাবা কি কান্ড করেছে জানো?” ফয়সাল ক্লান্ত কন্ঠে বলে, “বাবার কান্ডের কথা একটু পরে শুনি? আমি খুব ক্লান্ত!”
নেহা ফয়সালের ক্লান্তি উপেক্ষা করে চেঁচিয়ে ওঠে, “তোমার কি? সব জ্বালা তো আমাকে পোহাতে হয়। আমি কি তোমার বউ? আমি এ বাড়ির কাজের লোক! ” তমিজু্দ্দিন হাতরাতে হাতরাতে দরজার সামনে এসে মুখ নামিয়ে বলে, “বউ আর চেঁচিয়ো না। আমাকে পুকুর দেখিয়ে দাও, আমি নিজের কাপড়-চোপড় নিজেই ধুয়ে আনি!” নেহা ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে, “হ্যাঁ, আপনাকে এই সন্ধ্যায় পুকুরঘাটে পাঠিয়ে দিই আর পানিতে ডুবে মরলে সবাই দোষারোপ করবে আমাকে!” তমিজু্দ্দিন লজ্জ্বায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নাতি-নাতনীদের সামনে তার মাথা কাটা যাচ্ছে। কে জানে ওরা ততটুকু বোঝে। তমিজু্দ্দিন তো ওদেরকে দেখতে পান না, এমনকি একটু ছুঁয়ে দেখারও অনুমতি নেই তার! গন্ধে ফয়সালের গা গুলিয়ে ওঠে। দ্রুত নিজের রুমে ফিরে যায় সে।
খাবার মুখে তুলতে গিয়েই ফয়সাল থেমে যায়। নেহার দিকে তাকিয়ে বলে, “বাবাকে খাবার দিয়েছো?” নেহা তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠে বলে, “না “! ফয়সাল অবাক হয় যখন জানতে পারে সকাল থেকে দুপুর অব্দি বুড়ো মানুষটা না খেয়ে আছে। নেহার সহজ স্বীকারোক্তি, খাবার দিলেই তমিজু্দ্দিনের পেট খারাপ হয়, জামা-কাপড় নোংরা হয় আর সেগুলো নেহাকেই পরিস্কার করতে হয়। তাই খাবার না দেয়াই ভালো। ফয়সাল গন্ধ উপেক্ষা করে বাবার রুমে দৌঁড়ে আসে। মিনিটখানেক পরেই ফয়সালের আর্তচিৎকারে নেহা দৌঁড়ে আসে, পেছনে পেছনে বাচ্চা দুটোও। তমিজু্দ্দিন আর নেই। ক্ষুধা, পেট খারাপ, লজ্জ্বা – সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন তিনি।
ফয়সালের বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে মাথার উপর থেকে একটা শীতল ছায়া সরে গিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রচন্ড রৌদ্র তাপে! ফয়সাল বাচ্চা দুটোকে বুকে চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে। ঠিক এমনভাবে তমিজু্দ্দিনও তাকে বুকে আগলে রাখত। কি প্রতিদান দিয়েছে সে? মানুষটা শেষ পর্যন্ত একটু পেটভরে খেতেও পায়নি। তার বুকে জড়ানো সন্তানেরা তাকে কি প্রতিদান দেবে সহজেই অনুমান করতে পারছে সে। ফয়সাল নিজের ভবিষ্যতটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। ময়লা, নোংরা খাটটাতে তমিজু্দ্দিন শুয়ে নেই, শুয়ে আছে ফয়সাল।