হেমন্তের কোনো এক সকালে হালকা হালকা শীত ও ঠান্ডা বাতাসে জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে আগমন ঘটবে শীতের ছায়া। তাই চারিদিকে যেন কেমন মৃদু শুষ্কতার ছোয়া খেলা করছে। আমি ভার্সিটিতে যাবো বলে বের হয়েছি। কানে হেডফোন গুজে প্যান্টের বাঁ পকেটে হাত গুজে রিকশা স্ট্যান্ডে আসতেই দেখি একটা পুলিশের জীপ রাস্তার ও পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় হল একটি ভূড়ি মোটা হাবিলদার বা পুলিশ আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে।
ব্যাপারটা কেমন যেন উইয়ার্ড মনে হল। বেশি পাত্তা না দিয়ে রিকশাতে যেই না উঠতে যাবো। তখনি পুলিশটি আমার দিকে হাত ইশারা করে ডাকলো। আমাকেই ডাকছে কিনা সেটা সিওর হওয়ার জন্য আশে পাশে থাকালাম, কিন্তু যা মনে হল লোকটি আমাকেই ডাকছে। কান থেকে হেডফোনটা খুলে আসতে আসতে ওনার কাছে গেলাম..কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়ায় বললাম…
– আমাকেই কি ডাকছেন? (আমি)
– হুমম..তোমার নাম আবির না?
– জ্বি, কিন্তু আপনি কিভাবে জানেন?
– গাড়িমে ওঠো…
– মানে..? কেনো..?
– কোনো কথা না, চুপচাপ গাড়িতে উঠো। বেশি কথা বললে কেস দিয়ে দিবো। ওঠো…
– এহহ মগের মুলুক নাকি.? কিছুই করিনি অথচ আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন সেটা তো মানা যায় না।
– আরে চলোতো, বললাম না চুপচাপ যেতে, (ঝাড়ি দিয়ে)
আমি আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ জীপে উঠে বসলাম। কিন্তু মাথার মধ্যে টেনশনে মরে যায় অবস্থা। আমি কি করেছি, কিসের জন্য পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝলাম না। তবে ভুড়ি মোটা পুলিশ দেখলে আমার খুব হাসি পায়, কারন এদের ভূড়ি মোটা হয় সরকারের টাকা দিয়ে না, অন্যভাবে টাকা নিয়ে। একবার কি জিগাস করবো এটা..
– আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি..?
– হুমমম,,,তবে কেনো নিয়ে যাচ্ছি সেসব জিঙ্গাসা করবা না।
– আপনার ভুড়ি মোটা কেনো?
– কিহহহ.? এই ছেলে..তোমাকে তো এইবার সত্যিই কেস দিতে হবে।
আমি আর কিছু বললাম না। এইভাবে থানায় যেতে হবে কোনোদিন সেটা কখনই ভাবিনি। কিন্তু করেছিটা কি? আর এই পুলিশটাই বা আমার নাম জানলো কিভাবে? কত ভদ্র একটা ছেলে আমি, কই জামায় আদর করবে, তানা করে থানায় নিয়ে যাচ্ছে।
– এই নামো, চলে এসেছি, আর শোনো কোনো কথা না বলে সোজা অসি সাহেবের রুমে চলে যাবা।
গাড়ি থেকে নামতেই যখন থানার নামটা পড়লাম তখনি বুকের মধ্যে কেমন একটা ভয় কাজ করলো। কেমন যেন অচল মনে হচ্ছে নিজেকে। কোনো অপরাধ ছাড়ায় জেল এ থাকতে হবে? ধুরর কি যে করেছি? এসব ভাবতে ভাবতে থানার মধ্যে ঢুকলাম। যার সাথে এসেছি তিনি অসি সাহেবের রুমটা দেখিয়ে দিলেন। ভদ্র ছেলের মত আসতে আসতে রুমে প্রবেশ করতেই দেখি একজন আব্বুর বয়সি লোক সিভিল ড্রেস পরে পায়চারি করছে। তবে আসল ব্যাপারটা হল এনার ভুড়ি নেই। তাইলে কি ইনি পুলিশ না…সিওর হওয়ার জন্য যেই না জিঙ্গাসা করতে যাবো তখনি তিনি বলে উঠলেন..
– আবির তুমি এসেছো তাহলে..?
আড়চোখে ওনার টেবিলটার দিকে তাকালাম। নাম প্লেটটা দেখে নিলাম (সাফিক খান)। তবে ওনার কথা শুনে চমকে উঠলাম। কারন, যা বুঝলাম উনি আমারই জন্য অপেক্ষা করছিলেন অনেক্ষন ধরেই। তার মাসে কেস গন্ডোগোল, গুরুতর। অবাক হযে বললাম..
– হুমম এসেছি, কিন্তু আমাকে কেনো আনা হয়েছে? আর কেনই বা এভাবে কথা বলছেন?
– কোনো কথা বলার সময় নেই আবির, তাড়াতাড়ি চলো।
আমি আবারো বড় রকমের অবাক হলাম। আগে থানায় আনলো, আবার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ইনি? কি হচ্ছে কি আমার সাথে? আমি কি খুব বড়রকমের কিছু করেছি? কিন্তু চুল ভর্তি মাথায় তো সেরকম কিছুই মনে পড়ছে না যেটার ফলে আমাকে থানায় ধরে আনা হয়েছে।
– কোথায় যাবো…?
– কোনো কথা বলো না, দাড়াও পিস্তলটা সাথে নেই। এবার পুরোপুরি ভয় পেলাম। আমাকে কি অন্য কোথায় ডেকে নিয়ে কি ইনকাউন্টার করবে?
– স্যার আমি কি করেছি?
– চুপ,,বেশি কথা বলবা না। নাহলে কিন্তু তোমাকে টিজ করা মামলায় জেলে ঢুকিয়ে রাখবো।
– হায় হায় স্যার, আমি জীবনে কাউকেই টিজ করিনি।
– ঐ চুপ থাকো তো, চুপ করে চল
আমি আর কিছু বললাম না। তখনি মনে পড়লো এনার কেনো ভূড়ি নেই সেটা জিগাস করবো কিনা। কিন্তু হাতে থাকা পিস্তল টার দিকে তাকিয়ে কোনো কথাই বের হলো না। তবে কথা হল আমি কি করলাম..? আর আমাকেই বা কোথায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে? আমি কি আজ শেষ হয়ে যাবো? থানা থেকে সাফিক স্যারের পিছনে হেটে হেটে বের হচ্ছি, তখনি যেন সবাই আমার দিকে কেমন করে যেনো তাকাচ্ছে। থানা থেকে যখন বের হলাম তখন দেখলাম বাইরে কালো রং এর একটি গাড়ি দাড় করানো।
– কোনো কথা শুনতে চাই না, চুপচাপ গাড়িতে বসো। আমিও বাধ্য ছেলের মত গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে ওঠার পর বললো..
– জানো তোমাকে না আমার কি করতে মন চাচ্ছে?
– তাতো জানিনা
– তোমাকে না গুলি করতে মন চাচ্ছে।
– কেনেন স্যার?
উনি আর কোনো কথা বললেন না। আমিও আমার মত চুপকরে বসে থাকলাম। গাড়িটা যে কখন ছেড়ে দিয়েছে বুঝতে পারিনি। তবে নিজেকে বারবার জিঙ্গাসা করছি, “কি করেছি আমি”? আর আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি? থানা থেকে গাড়িটি চলে এসেছে অনেকদুর। নিরাবতা ভেঙ্গে সাফিক খান বললেন..
– নিতুকে কষ্ট দিয়ে তুমি ঠিক করোনি।
আমি কথাটা শোনা মাত্রই চমকে উঠে ওনার দিকে তাকালাম। তখনি দেখি উনি নরমাল ভাবে বসে হাতে একটি কাগজ নাড়াচাড়া করছে। আমি ওনার দিকে তাকাচ্ছি একবার আর হাতে থাকা কাগজটার দিকে তাকাচ্ছি। কাগজটা যে একটি চিঠি সেটা বুঝতে বাকি নেই। তবে ইনি নিতুর ব্যাপারে কথা বলছেন। তারমানে উনি কে??
– মানে..?(আমি)
– নিতুকে কতদিন ধরে চিনো মি. আবির?
আমি তখনও ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে কিন্চিৎ গম্ভীর করে কথাটি বললো।
– আপনার কথায় আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
– শোনো, আমার সাথে একদম ফাজলামি করবে না। ইচ্ছে করছে তোমাকে গুলি করি, কিন্তু সেটা পারছি না।
– আমি করেছিটা কি?
– ঐ কিছু করোনি? এখন ন্যাকামো করছো? নিতুকে কষ্ট দিছো এটাই তোমার অপরাধ।
তিনি আবারো নিতুর কথা বললেন। এই নামটার উপর আমি সবচাইতে দুর্বল। এমনি নিতুকে দেখলেই আরো দূর্বল হয়ে পড়ি। আর তিনি বারবার সেই নিতুর কথা বলছেন কেনো? একটু চুপ থেকে ওনাকে বললাম..
– আচ্ছা নিতুর কে হন আপনি?? (আমি)
– তোমার মত এমন একটি গাধা ছেলেকে আমার মেয়ে যে কি করে ভালোবাসলো বুঝিনা।
তার মানে এই লোকটি নিতুর বাবা? রহস্যের জাল তাহলে এখন খুললো। তবে এখনো জানিনা আমি কোথায় যাচ্ছি বা কেনো যাচ্ছি? সেই কখন থেকে গাড়িতে বসে আছি কিন্তু জানিনা কোথায় যাচ্ছি? আবারো নিরাবতা..তখনি তিনি বললেন..
– নামো, চলে এসেছি।
গাড়ি থেকে নামতেই আমি অবাক। কারন, যেখানে নেমেছি সেটা হল একটি হসপিটাল। তবে হসপিটালে কেনো আসছি? জিঙ্গাসা দৃষ্টি নিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন…
– চলো
– কোথায়?
– কোথায় মানে..? কোথায় আসছি আমরা?
– হসপিটালে..তবে এখানে কেনো আসছি?
– কারন, তোমার নিতু হসপিটালে আছে। আমি চমকে উঠে ওনার দিকে তাকালাম। কি হয়েছে নিতুর? ও কি করলো..?
– নিতুর কি হয়েছে?
– আবির, তুমি কি ন্যাকামি ছাড়া কিছুই পারো না?
– আংকেল প্লীজ বলুন না নিতুর কি হয়েছে? আর নিতু কত নাম্বার কেবিনে?
– তুমি কি কিছুই জানো না?
– মানে কি?? (কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার)
– আগে চলো ৭৭ নাম্বার কেবিনে নিতু আছে।
কোনো কথা না বলে এক প্রকার দৌড়ে হসপিটালের মধ্যে ঢুকছি। নিতুর আব্বু আছে আমার পিছনে। কোনো কিছুই আর মাথার মধ্যে আসছে না। নিতুকে দেখতেই হবে সে কেমন আছে। দৌড়ে তার কেবিনের সামনে যেয়ে আমি ঠাই দাড়িয়ে পড়লাম। নিতুর মুখে মাস্ক পরানো। তার মানে ব্যাপার যা হয়েছে সেটা গুরুতর। কিন্তু কেনো সে এমনটা করলো? কি করেছি আমি নিতুর কাছে? যার কারনে সে আমাকে না জানিয়েই এমন পাগলামি করলে?? এসব ভাবছি দরজার সামনে দাড়িয়ে। তখনি কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখি আংকেল দাড়িয়ে আছে। ততক্ষনে বুঝেছি নিতুর আব্বু আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেনি কেন? সব মেয়ের বাবা তো তার মেয়ের বয়ফ্রেন্ড কে তো সহ্যই করতে পারে না।
– জানো আবির, ওর যখন ১৩ বছর বয়স তখন ওর মা মারা যায়। কোনোদিন কষ্ট করতে দেয়নি ওরে। আর তুমি তাকে কিনা কষ্টে রেখেছো? কেনো করলে এমনটা?
– আংকেল আসলে…
কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাতে থাকা চিঠিটা আমাকে দিলেন। এরপরই তিনি তার মেয়ের কাছে চলে গেলেন। আমি হসটিটালের বেলকনিতে দাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে ভাবছি। কেনো করলো নিতু এমনটা? কি হয়েছে ওর?? ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। নিতুর আব্বু চলে গেছে আমাকে রেখে। কিন্তু নিতু কেনো করলো এমনটা? কি হয়েছে? নিতুর আব্বুর কাছ থেকে জানতে পারলাম। নিতু অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলেছে আর হাতে ব্লেড দিয়ে কেটেছে। কি সব পাগলামি করলো যা ভাবতেই পারছি না।
ডান হাতের দিকে চোখ পড়ল। দেখি নিতুর বাবার দেয়া সেই কাগজের চিঠি। আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি সেটা খুললাম। সেখানে যা লেখা তা দেখে কেমন যেন লাগতে লাগলো। সেখানে লেখা “আবির আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওমন না যেমন আমাকে সবাই এখন ভাবছে। তোমার সাথে কাটানো সময়টা আমাকে নতুন ভাবে ভালোলাগা শিখিয়েছে। কখন যে ঐ ভালোলাগার সম্মোহনে পড়ে তোমার প্রেমে পড়েছি জানিনা। তোমাকে আর লেখা নেই কিছু। কিন্তু এসব কি? আর লেখা নেই হয়ত সে পাগলামি করার পরেই কাগজটা লিখেছে। আর তারপরই নিতুর আব্বু এটা পায়। সেকারনে সবাই ভাবছে আমি দোষী। কিন্তু সেটা তো ভূল। আমি তো কিছুই করিনি। কেবল ভালোবাসি নিতুকে কিন্তু সেটাও তো বলা হয়নি।
আমি কেবিনের মধ্যে ঢুকলাম। নিতু তখনও ঘুমাচ্ছে। আমি পাশে থাকা চেয়ারটাতে যেয়ে বসলাম। মাস্ক পরা নিতুর শুকনো চেহারার দিকে তাকালাম। কেমন যেন মায়া লাগছে। কিন্তু নিতু এমনটা করলো কেনো? তাহলে পুরো ঘটনাটা খুলেই বলি নিতু ছিল ভার্সিটির সেরা সুন্দরী। সব ছেলেই যেন নিতু নাম শুনেই ক্রাশ খেত। আর আমি তো কোথাকার কোন ছা। ক্লাসের সবাই নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকতো সারা ক্লাস। নিতুর বয়ফ্রেন্ড থাকা সত্তেও সবাই যেন তার সাথে কথা বলার জন্যই ছুতো খুজতো। কেবল আমিই কথা বলিনি কোনোদিন ওর সাথে। কেবল তাকাতাম তবে সে ওটা বুঝতেই পারতো না। ভালো লাগতো নিতুকে। ওর রেশমী চুল। ওর চোখ, ওর দাঁত সেই দাঁতের হাসি সব মিলিয়ে নিতুকে ভালোবাসবেই যে কোনো ছেলে। কিন্তু কোথা থেকে যে ওর একটি বয়ফ্রেন্ড জুটলো। এসব ভাবছি ক্যামপাসের নিম গাছের নিচে বসে। তখনি আমাকে অবাক করে দিয়ে নিতু আসলো।
– এই ছেলে সবসময় দেখি তুমি একা থাকো। কথা কম বলো কারনটা কি হুম?
নিতুর এমন কথা শুনে কেমন যেন কেঁপে উঠলাম। কেঁপে উঠারই কথা। কারন একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে বা তার ক্রাশ হয়। আর যদি ঐ মেয়ে ছেলেটির সামনে এসে নিজে থেকেই যদি কথা বলে তাহলে সেই ছেলের প্রথম স্টেপ হয় কেমন যেন অসস্থি বোধ হওয়া। তারপর পা কাঁপা তারপর ঘামতে থাকা। আমারো ঠিক সেটাই হচ্ছে। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা আবার তুতলিয়ে যাচ্ছে। নিতু আবারো বললো…
– এই যে আবির সাহেব। কথা কেনো বলছো শুনি? নাকি আমি কথা বলতে এসেছি দেখে ভাব নিচ্ছো? আসলে তোমাকে অন্যরকম লাগে। সবাই আমার সাথে কথা বলতে চাইলেও তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা আমাকে দেখলে এড়িয়ে চলে যাও। কথা বলো না। কেনো বলোতো? কারনটা কি হুমম?
– আসলে তোমার সাথে তো সবাই কথা বলে। তাই আমি বলি না। আমার ব্যাপারটা আলাদা। সবাই যেটা চাই আমি তা চাইনা। সবাই যে গেটআপ পছন্দ করে আমি সেটা করি না। সবাই যে কালার চুজ করে কাপড় পরে আমি সেটাও করিনা। সবাই আপনার সাথে কথা বলে আমি বলি না। এর কারন সবাই যেটা পছন্দ করে সেটা পপুলার। সবাই চাই সেটা। সবার মাঝে বিদ্যমান সেটা বা আপনি মানে আপনি সবার কাছেই সাধারন। আমার কথা শুনে নিতু চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি কি বললাম নিজেও জানিনা। যা মনে এসেছে তাই বলে ফেলছি। নিতুর বিষ্ময়কর চাহনি আর অবাক করা মুখে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি এরুপ প্রতিরুপ দেঁখে মনে মনে হাসলাম।
– বেশ কথা বলো তো তুমি। তোমার মতই তো একটা বন্ধু দরকার। এই বন্ধু হবে আমার?
নিতু আমার সামনে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ওর হাতের দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার ওর দিকে তাকাচ্ছি। নিতু হাসি হাসি মুৃখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমিও হাতটা বাড়ালাম। কিন্তু হাত কাঁপছে। নিতু তা দেখে হাসতে হাসতে শেষ।
তারপর থেকে দুজনে ভালো বন্ধু। দুজনে রিকশাতে ঘোরা শুরু। কত জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। নিতুকে তুই করে বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু ওর একটাই কথা “কিছু কিছু সম্পর্ক ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব হলেও তুমি করে বলতে ভালোই লাগে। সবাই তুই করে বলে আমরা না হয় তুমি করেই বলি একে অপরকে” তারপর আর কোনোদিন তুই করে বলার কথা বলিনি নিতুকে। একসাথে দুইটা একটা বছর পার করলাম। এর মাঝে নিতুর বয়ফ্রেন্ড এর সাথে পরিচিত হয়েছি। আমাদের দুই বছরের সিনিয়র উনি। নিতু যখন সাকিব ভাইয়ের কথা বলতো খুব রাগ হতো। এমনিতেই একতরফা ভালোবাসি আমি তাকে তার উপর ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো মনে হত এদের প্রেমটা নষ্ট করে দিই। কিন্তু নিতু কষ্ট পাবে ভেবে আর করিনি। একদিন ক্যামপাসে বসে আছি নিতু মুখ ভার করে আমার পাশে এসে বসলো।
– কি হয়েছে নিতু?
– কিছু না।
– বলো আমাকে।
– সাকিব একটা বেয়াদপ আবির।
– কেনো?
– ওর কাছে আমার সব পিকচার আছে
– তো?
– হারামিটা পিকচারগুলো নেটে ছেড়ে দিয়েছে এডিট করে। তুমি ওগুলা দেখেছো তাই না? বিশ্বা করো আমি কিছু করিনি।
– ব্যাপারটা খুলে বলো কি হয়েছে।
– আমাকে সাকিব রুম ডেটের অফার করে আমি রাজি হয়না তাই সে পিকগুলো ওমন করেছে। আমার কি হবে? আমার আব্বু জানতে পারলে মেরেই ফেলবে।
নিতু আর কিছু বললো না। কান্না করতে করতে ভার্সিটি থেকে দৌড়ে চলে গেল। তারপর বিষয়টা সব জেনে অনেক খূশিই হয়েছিলাম। নিতুর আর সাকিব এর আর কোনো রিলেশন থাকবে না। তারপর থেকে নিতুকে অনেক বেশি সময় দিতে থাকি। সারাদিন দুজনে ঘোরাঘুরিতে মেতে থাকতাম। নিতুকে বেশি সাপোর্ট করতাম যাতে করে সেই সব ভূলে যেতে পারে। রোজ বিকেলে দুজনে ঘুরতাম খালি পায়ে হাটার ছলে। এভাবেই কাটে ১ মাস। নিতুকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলি তখন। কিন্তু এখন জানি নিতু আমাকে আর বিশ্বাস করবে না। নিতু আমাকে সব ছেলেদের মত ভাবতে থাকবে। কারন সাকিব নামের ছেলেটি তার মনে অবিশ্বাসের এক পাথর তুলে দিয়েছে। একদিন বিকেলে নিতু ডাকলো..
– আবির, তুমি কিন্তু আর আগের মত কথা বলো না কি হয়েছে? (নিতু)
হুমম আগের মত আর নিতুর সাথে কথা বলি না। কারন নিতুকে আমি এখন ভালোবাসি। কিন্তু নিতু সেটা মেনে নিবে না। হয়ত ভাববে আমি তার অসহায় বা বন্ধুত্বের সুযোগ নিচ্ছি। তাই তাকে এড়িয়ে চলছি। যাতে সে বুঝতে না পারে আমি তাকে ভালোবাসি।
– এই আবির কি হয়েছে তোমার? কথা বলছো না যে?
– কই বলছি তো। এই যে..
– তুমি কি কারো প্রেমে পড়েছো? নিতুর কথা শুনে চমকে উঠি। বলে কি মেয়েটা? তবে কি সে বুঝে ফেলেছে? কি জানি? আমি কাঁপা গলায় বললাম..
– নাহ তো…কারো না।
– আমি কিন্তু জানি। বলো কার প্রেমে পড়েছো?
– আরে এমনিতেই চুপ। কারো প্রেমে পড়িনি।
– না পড়লেই ভালো।
তারপর চলে আসি সেখান থেকে। বাড়িতে এসেই ফোন অফ করে দেয়। সোজা গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। এখানে এভাবেই কাটে ১০ দিন। এ দশ দিনে নিতুর সাথে কোনো কথা হয়নি,দেখা হয়নি। আমি তাকে ভূলতে চেয়েছি। তাই এ ব্যবস্থা। কিন্তু নাহ, পারলাম না তাকে ভুলতে। আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছি নিতুকে। তাই আর থাকতে না পেরে সব তাকে জানাবো বলে ঢাকাতে চলে আসি। ১২ দিন পর ভার্সিটিতে যাবো বলে বের হয়েছি তখনি তো পুলিশ এসে তুলে নিয়ে আসে আর আমি এখন এই হসপিটালে। নিতু চোখ খুলেছে। আমি ওর হাতটা তখনও ধরে আছি। আমাকে দেখা মাত্রই নিতু মুখ থেকে মাস্কটি খুললো। উঠতে যাবে তখনি আমি আবার ধরে শুয়ে দিলাম। নিতু তখনও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি ওর চোখের দিকে তাকলাম। চোখে চাপা কষ্ট আর রাগ জমে অভিমানেন অশ্রু ঝরছে। আমি বললাম…
– এসব পাগলামির কোনো মানে আছে?
– কোথায় ছিলে তুমি এতদিন?
– একটু গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
– আমাকে তো জানিয়ে যেতে পারতা?
– এমনি। এখন কেমন আছো?
নিতু চুপ করে চেয়ে আছে। আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। শুকনো মুখ, আর করুন চেহারাতে নিতুকে কেমন যেন লাগছে। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকে নিতু বললো..
– আবির আমাকে তুমি ভালোবাসো তাই না?
– কিহহ? আরে না না তোমাকে আমি কেনো ভালোবাসতে যাবো?
– ওহ, কিন্তু আমি বুঝে গেছি। আর ভালো না বাসলেও এখন তো বাসো। কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আর আমাকে কেনো ভালোবাসো?
– সত্যিই তুমি আমাকে ভালোবাসো না? তোমার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো আমাকে নতুনভাকে বাঁচান ম্বাদ জাগিয়েছে। তোমাকে তখন থেকেই ভালোবেসে ফেলি।
– সাকিবকেও তো ভালোবাসতা।
– ভালোবাসিনি, কেবল অভিনয় করেছিলাম।
আমি জানি ও কেমন ধরনের ছেলে ছিল। এর আগে অনেক মেয়েদের এমন করেছে। তাই তাকে শিক্ষা দিতে এসব করেছি। আর তুমি বিশ্বাস করো আমি সাকিবের সাথে এমনটা করিনি যেমনটা সবাই ভাবছে। আমাকে তুমি ভালোবাসো না কারন আমি খারাপ। ঠিক আছে যাও। চুপ করে ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। ও চোখ ঘুরিয়ে নিল। আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম। কি করে বলি একে যে আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
– কি হল যাচ্ছো না কেনো?
– এমনি। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
– কেনো?
– জানিনা।
– আমাকে কবে থেকে ভালোবাসো?
– জানিনা।
– তোমার ব্যবহার তোমার চুপ থাকা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তুমি আমাকে ভালোবাসতা। বলোনি কেনো তুমি?
– ভয়ে।
– ভয়? কিসের ভয়? আমাকে তো বলতে পারতা। আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলে। তাই তো এসব করেছি। আর যদি চলে যাও তো…
– থাক,আমি কি বলেছি যাবো?
– হুমম।
– এখন রেস্ট নাও। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
নিতু চোখ বুজলো। আমি ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মনে মনে বললাম..যাক তাহলে ভালোই হল, দুরে চলে যেয়ে যদি ভালোবাসা হয় তবে দুরে যেয়ে আবার ফিরে আসাই ভালো। সবার জন্য একটা টিপস না দিলেই নয়। “কাউকে ভালোবাসলে তাকে প্রথমে সবটা সময় দাও। তাকে এমনভাবে কনভেন্চ করতে হবে যে সে তোমাকে ছাড়া দিনের সবটা সময় অচল। এরপরও সে যদি তোমাকে না বুঝে তুমি একটু দুরে চলে যাও। দেখবে সে তোমাকে তোমার অনুপস্থিতিতে তোমাকে খুজবে। তোমাকে মিস করবে। তারপর সেই খুজে ফেরা,তোমাকে মিস করার অন্তরালে পড়ে তোমাকে ভালোবেসে ফেলবে।”
‘(সমাপ্ত)’