“গোল গলা দুইশ পিস, ভি গলা দুইশ পিস আর কলার ওয়ালা গেঞ্জি একশ পঞ্চাশ পিস। কত অয় হিসাব কইরা ক।”
মতিন মিয়ার দেয়া হিসাব অনুযায়ী ক্যালকুলেটর টিপছে তার পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ুয়া ছেলে চাঁন মিয়া। দূর্দান্ত মেধাবী চাঁন। গত বছর চতুর্থ শ্রেনীতে প্রথম হয়ে ক্যালকুলেটর টা পুরষ্কার পেয়েছিল।
রমজান তেইশটা শেষ হয়ে গেছে। এখন গেঞ্জির ব্যবসা করবে মতিন মিয়া। ধারদেনা করে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুঁজি সংগ্রহ করেছে মতিন। এমনটাই বলেছে ছেলে চাঁনমিয়াকে। বউটা সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ অসুখ হয়ে মরেছে। কল্যাণপুর বস্তির এই টিনের ঘরটায় ভাড়া নিয়েছে মতিন মিয়া। মাথা গোঁজার জন্য মাসে বারো’শ টাকা গুণতে হয়। এখন সংসার বলতে চাঁন আর সে। কিন্তু বউ মরতেই এতগুলো টাকা একটা চালচুলাহীন নেশাখোর লোককে কেউ কেন লোন দিলো, ভেবে পায়না চাঁন।
চাঁন ক্যালকুলেটর টিপতে টিপতে নিজের সাথেই আউড়াচ্ছে, “গোল গলা, দুইশ পিস আশি টাকা কইরা হইলে ষোল হাজার। ভি গলা, দুইশ পিস ষাইট টাকা কইরা হইলে বারো হাজার। আর কলার আলা গেঞ্জি দেড়’শ পিস একশ পাঁচ টাকা কইরা হইলে পনের হাজার সাত’শ পঞ্চাশ। তাইলে সব মিলাইয়া অয়, তেতাল্লিশ হাজার সাত’শ পঞ্চাশ।” গুণে শেষ করে ক্যালকুলেটর টা রেখে বাবার মুখের দিকে তাকায় চাঁন। তারপর বলল, “আব্বা, তেতাল্লিশ হাজার সাত’শ পঞ্চাশ টাকা।” মতিন মিয়া আকিজ বিড়ি ফুঁকছিলো। হরহর করে একদলা ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, “ওহ। তাইলে আর থাকবো, ছয় হাজার দুইশ পঞ্চাশ টাকা। কাসেম মিয়ার পুরাণ ভ্যানডা চার হাজার কইছিলো। ইকটু পরে গিয়া দেহি, আর কয়ডা টাকা কমানো যায় নি !”
“আব্বা, তাইলে তো আরো দুই হাজার টাকা বাকি থাকবো। ঐডা দিয়া আমারে ঈদের মার্কেট কইরা দিবা ?” মনভর্তি উচ্ছাস নিয়ে বলল চাঁন। তবে তা শুনেই যেন আগুন হয়ে গেল মতিন মিয়া। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলল, “প্যাডে নাই ভাত, অয় মার্কেট পো**য়। অই তোর মায়রে খাইয়া শান্তি অয় নাই ? অহন কি আমারেও খাইতে চাস ? ঈদ কি তোর লাইগা ? ফকিন্নির পোলার শখ কত !” বলেই উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মতিন। ছলছল করে উঠলো চাঁন মিয়ার চোখদুটো। বাবা কখনোই ওর পছন্দের মানুষ ছিলেন না। রোজ রাতেই নেশা করে ঘরে ফিরেই বেধরক পিটাতেন চাঁনের মাকে। তাই চাঁন বরাবরই ঘৃণা করে তাকে। বাধ্য হয়েই এখন মানুষটাকে সহ্য করতে হয় ওর। এখনও রোজ রাতে নেশা করে ঘরে ফিরে মতিন। চাঁন ঘুমের ভান ধরে চুপচাপ পড়ে থাকে।
টাকা রোজগার করতে হবে। এমন মনোভাব নিয়ে বস্তি থেকে বেরিয়ে গেল বারো বছর বয়সী চাঁন মিয়া। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগছে খুব। দুবার দুটো খাবার হোটেলে ঢুকে পানি খেয়েছে। ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণায় অচল হয়ে আসছে পা দুটো। তবুও। আর সাতদিন বাকি। কাজ করে টাকা দিয়ে মার্কেট করতে হবে। মা থাকতে প্রতি বছর ঈদে ওকে মার্কেট করে দিতেন। তা যেভাবেই হোক। এখন তো আর মা নেই। আর চাঁন মিয়া ভালো করেই জানে, ওর মায়ের অভাব ওর বাপ কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না। তাই মায়ের অভাবটা এবার নিজেরই পূরণ করতে হবে। ঈদের পোশাক কিনতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে চাঁন মিয়া চলে এসেছে মিরপুর ১ নম্বরের বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্স এর সামনে। মিরপুর ১ বরাবরই লোকজন, ভীর-বাট্টায় পরিপূর্ণ ঘিঞ্জি একটা বাণিজ্যিক এলাকা। আর ঈদের এই আগ মুহুর্তে তো এখানে হেঁটে পথ চলারও প্রয়োজন হয় না। লোকজনের ধাক্কাতেই এগিয়ে যাওয়া যায় বহুদূর।
বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্স এর আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটে ঢুকলো চাঁন। এ দোকান, ও দোকান। কত রকম রঙ-বেরঙের বাহারি পোষাক। চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠে চাঁনের। দূর থেকেই চাঁন ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে পোষাকগুলো। কারণ ও জানে, ওসব ছুঁয়ে দেখার অধিকার ওর নেই। হঠাৎ একটা টকটকে লাল শাড়ির দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ায় চাঁন। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে শাড়িটার দিকে। মনে পড়ে গেছে গত বছর রোজার ঈদের তিন দিন আগের কথা। (ফ্ল্যাশব্যাক) চাঁনের জন্য কিনে আনা ঈদের পোশাকগুলো একে একে ব্যাগ থেকে বের করছে মা। যদিও পণ্যগুলো ফুটপাতের, তবে সাধ্যের মধ্যেই সবটুকু সুখ বলে একটা কথা আছে। তার ফলশ্রুতিতেই চাঁন আনন্দে আটখানা হয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে সেগুলো। দুটো গেঞ্জি, একটা জিন্সের প্যান্ট, একটা শার্ট আর একজোড়া জুতো।
“পছন্দ অইলো বাজান ?” জিজ্ঞেস করলেন মা।
“হ মা। অনেক পছন্দ অইছে। এগুলান কি অনেক দামী ?”
“হ বাজান। জিনিসপাতির যেই দাম, হাত দেওন যায় না। তোর সবগুলান মার্কেট করতেই লাগছে বারো’শ টাকা।”
“মা, আমারে কইলাম ঈদের দিন একশ টাকা বকশিশ দিবা। আমি আমার বন্ধুবান্ধবগো লগে ঘুরতে যামু।” মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল মায়ের। তবুও মমতার স্পর্শে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললেন,
“হেইডা আমার মাথায় আছে বাজান। পনেরো’শ টাকা লইয়া গেছিলাম। তোর মার্কেট করার পরে তিন’শ টাকা আছিলো। দুই’শ টাকা দিয়া তোর বাপের লাইগা একটা লুঙ্গি আনছি। আর একশ টাকা রাইখা দিছি তোর লাইগা।” মৃদু হেসে বললেন মা।
“কিন্তু তুমার লাইগা কিছু আনলানা যে মা ?” চাঁন মিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে মায়ের মুখের দিকে।
“আমার কিছু লাগবো না রে বাজান। তুই খুশিতে থাকলেই আমার খুঁশি।”
“কিন্তু তুমার শাড়িখান তো ময়লা হইয়া গেছে। ছিড়াও গেছে কয়খান দিয়া।”
“এইডি কিছু না। তুই বড় হইয়া যহন বড় অপিসার হবি, তহন আমার লাইগা টুকটুইক্কা লাল একখান শাড়ি আনিস। আমি পান চাবাইতে চাবাইতে সারা মহল্লার মাইনষেরে কমু, দেহো তোমরা, আমার চাঁন আমার লাইগা কত সুন্দর একখান শাড়ি আনছে।” বলেই ছলছলে চোখে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন মা। ঘটনাটা মনে পড়তেই চাঁন মিয়ার চোখে পানি চলে এলো। চোখের পানি দু হাতে মুছে লাল শাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল চাঁন। দোকানে ঢুকেই শাড়িটায় হাত দিবে, এমন সময় দোকানদার তেড়ে এলো ওর দিকে।
“ঐ, ঐ, ঐ পোলা, করস কি ?” চাঁন বেশ ভরকে গেল। ঢোক গিলল নিজের অজান্তেই। তারপর মৃদুস্বরে বলল,
“এই শাড়িখান অনেক সুন্দর। এইডার দাম কত ?”
“এ্যা, তুই এই শাড়ি কিনবি ? জীবনে এই শাড়ি ধইরা দেখছস ? যা এইখান থিকা।” বিদ্রুপের সুরে বলল তাগড়া দোকানদার।
“কন না ভাই, দাম কত এইডার ?”
“এইডার দাম পাঁচ হাজার। একলগে দেখছস এত টাকা ? যা ভাগ।”
“ভাই, চাঁনরাইত পর্যন্ত শাড়িখান বেইচেন না। আমি এইডা লমু।”
“এ্যা ? কয় কি ! ঐ কার লাইগা কিনবি এই শাড়ি ?”
“আমার মায়ের লাইগা। আপনে চাঁনরাইত পর্যন্ত শাড়িখান রাইখেন।”
“আইচ্ছা। টাকা লইয়া আহিস, থাকলে তো পাবিই, অহন যা।”
দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো চাঁন। মনে মনে ভাবতে লাগলো, নিজের জন্য না। এবারের ঈদটা হবে মায়ের জন্য। শাড়িটা কিনে নিয়ে ঈদের দিন মায়ের কবরটা ঢেকে দিয়ে আসবে সে। এলাকায় আসতেই চাঁনকে ডাক দিলো এলাকার একমাত্র ফার্মেসী ব্যবসায়ী রতন। রতনকে এমনিতে বেশ পছন্দ করে চাঁন। পঁচিশ বছর বয়সী রতন মাঝে মাঝেই ওকে এটা ওটা খেতে দেয়। বিনিময়ে রতনও যখন দুপুরে খেতে বাসায় বা অন্য কোনো কাজে কোথাও যায়, তখন ফার্মেসীতে বসে চাঁন মিয়া। চাঁন এগিয়ে ফার্মেসীর কাছে এলে রতন ওকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে চাঁন, মুখটা শুকনা ক্যান ? খাস নাই কিছু ?”
“খাইতে মন চাইতাছে না রতন ভাই।”
“তোর বাপ কই ?”
“কইতে পারিনা। গেছে মনে অয় নেশা করতে। জুয়া আর নেশা ছাড়া হের জীবনে আর কিছু আছে নি ?”
“থাক। বাপরে লইয়া এমনে কয় না। কলা খাবি ?”
“না রতন ভাই। ক্ষিদা নাই। আইচ্ছা রতন ভাই !”
“ক।”
“কি কাম করলে সাতদিনে পাঁচ হাজার টাকা পামু ?” চাঁনের সরল প্রশ্ন শুনে হোঁ হোঁ করে হেসে রতন বলল,
“ক্যান রে, পাঁচ হাজার টাকা দিয়া কি করবি ?”
“কাম আছে। ঈদের আগেই পাঁচ হাজার টাকা লাগবো আমার।”
“আমারে ক। তারপর দেখতাছি।”
“মায়ের লাইগা একখান শাড়ি পছন্দ হইছে। টুকটুইক্কা লাল। ঐডা কিনুম।”
“কি কস ? তোর মায় তো !” অবাক হয়ে বলল রতন।
“জানি রতন ভাই। আমার মা নাই। মইরা গেছে। কিন্তু মায়ের কবরখান তো আছে। শাড়িখান দিয়া মায়ের কবরখান ঢাইকা দিমু।” ছলছল করে উঠলো চাঁনের চোখজোড়া।
“পাগল হইছস ? এইডা কইরা কি হইবো ?” “মায় কইছিলো, যেদিন আমি বড় অফিসার হমু, ঐদিন মায়রে একখান লাল শাড়ি কিন্না দিতে। মায় নিজে ছিড়া শাড়ি পইরা, আমারে ঈদের মার্কেট কইরা দিতো। এই ঈদে আমি মায়রে মার্কেট কইরা দিমু।” বলেই কেঁদে ফেলল চাঁন। মুহুর্তেই রতনের চেহারায় পৈশাচিক একটা ছাপ পড়লো। মনে মনে অংক কষে নিল রতন। চাঁনের এই অবুঝ মনের সরলতার সুযোগটাই নিতে হবে তাকে। সান্ত্বনার সুরে রতন বলল, “শোন, আমার কাছে একটা উপায় আছে। আরে কান্দিস না। শোন।” চাঁন চোখের পানি মুছে বলল,
“কও।”
“একটা উপায় আছে। তোর কোনো কাম করতে হইবো না। তাও তুই অনেক টাকা পাবি।”
“কও কি রতন ভাই, কাম না কইরা টাকা ? কিন্তু ক্যামনে ?” অবাক চোখে চাঁন তাকিয়ে রতনের মুখের দিকে।
“শোন চাঁন। আমি এহন তোরে যেইডা কমু, এইডা তুই আমি ছাড়া আর কাউরে কইতে পারবি না। যদি রাজি থাকোস, তাইলে উপায়ডা কমু তোরে।”
“আমি কাউরে কমু না রতন ভাই। তুমি কও।”
“না। এমনে না। তুই তোর মরা মায়ের কসম খাইয়া ক, কাউরে কবি না ! তাইলে কমু। নাইলে না।” উপায় না থাকায় সাতপাঁচ না ভেবেই চাঁন রাজি হয়ে বলল,
“আমি আমার মরা মায়ের কসম খাইয়া কইতাছি, তুমি এহন আমারে যা কইবা, এইডা আমি আর কাউরে কমু না।”
“তাইলে শোন। তোর একটা কিডনি বেঁইচা ফালা।”
“কি কও রতন ভাই ? কিডনি বেঁচলে আমি বাঁচুম ক্যামনে ?” হাঁ হয়ে তাকিয়ে বলল চাঁন।
“আরে ধুরো বলদ। আল্লাহ মানুষরে দুইডা কিডনি দিছে ক্যান জানস ?”
“ক্যান ?”
“যেন বিপদে পড়লে একটা কিডনি বেঁইচা দিতে পারে। মানুষের বাঁইচা থাকনের লাইগা একটা কিডনিই যথেষ্ট।”
“কিন্তু !”
“আবার কিন্তু ! আইচ্ছা তুই আমারে ক। দুইডা কিডনি দিয়া তুই কি করবি ? একটা দিয়াই তো চলতে পারবি।”
“তুমি এতো কিছু ক্যামনে জানলা রতন ভাই ?”
“আরে,
ফার্মেসীর ব্যবসা করতাছি ৬ বছর হইলো। আমার তো দোকানের লাইগা ঔষধ আনতে বহুত জাগায় যাইতে হয়। বহুত মাইনষের লগে পয়-পরিচয় হয়। তেমনি কিডনি হাসপাতালের একটা ডাক্তারের লগে আমার আলাপ হইছে। হেয় বিপদে পড়া লোকেগো থিকা একটা কিডনি কিন্না লয়। অনেক টাকা দেয়।” “ও। কিন্তু হেয় কিডনি দিয়া কি করে ?” “কি আর করবো ! যাগো দুইডা কিডনি নষ্ট হইয়া যায়, হেগোরে একটা কিডনি লাগায় দিয়া বাঁচাইয়া লায়।” অবাক হয়ে শুনছে চাঁন। রতন ওর ব্রেইনওয়াশ করতে বেশ সফল। সত্য ব্যাপারটা রতন ওর থেকে বেমালুম চেপে গেল যে, কিডনিগুলো নিয়ে উক্ত ডাক্তার বিক্রি করে দেন একটা কিডনি পাচার চক্রের কাছে।
“মানুষের জান বাঁচায় ? এইডা তো ভালা কাম।” বলল চাঁন।
“ভালা কামই তো ! তুই অহন ক, তোর একটা কিডনি বেঁচবি নাকি ?”
“আমার কিডনি লাগাইয়া যদি কারো জান বাঁচে, তাইলে আমি বেঁচুম। কয় টাকা দিবো আমারে ? মায়ের লাইগা শাড়িখান কিনতে পারুম তো ?”
“আরে কয় কি ? অমন পাঁচটা শাড়ি কিনতে পারবি। তোরে পঁচিশ হাজার টাকা দিবো।” টাকার অংক শুনে চাঁন মিয়ার চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল। মাথায় হাত দিয়ে সে বলল,
“কও কি রতন ভাই ! প, পঁচিশ হাজার ?”
“হ। তয় খবরদার। এই কথা আর কাউরে কবি না।”
“আইচ্ছা।”
“তাইলে শোন,
আজকে রাইতে তোর বাসায় গিয়া তোর বাপেরে আমি কমু!” ধীর শব্দে চাঁনমিয়াকে সব প্ল্যান ভালভাবে বুঝিয়ে দিলো রতন। চাঁনও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে ঠিকঠাক বুঝে নিলো পুরো ব্যাপারটা। রাত ৯ টা। নেশা করে বাসায় ফিরেছে মতিন মিয়া। বাবার দরজা ধাক্কানোর ধরণ দেখেই আঁচ করলো চাঁন। ভয়ে ভয়ে এসে দরজা খুলে দিতেই পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেল ওর গালে। চাঁনকে চড় মেরেই খেঁকিয়ে উঠলো মতিন মিয়া।
“বান্দির পুত, দরজা খুলতে এত্তো দেরি করলি ক্যা ?”
“ঘুমায় গেছিলাম আব্বা !” গালে হাত চেপে বলল চাঁন।
“মতিন কাকা বাসায় আছো নি ?” বাইরে থেকে ভেসে এলো রতনের কন্ঠস্বর।
“ক্যাডা ?” বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মতিন মিয়া।
“কাকা আমি, রতন। একটু বাইরে আহো।”
“আমি পারতাম না। তুই ঘরে আয়।”
রতন এসে ঘরে ঢুকলো। মতিন ততক্ষণে চৌকির উপর গা এলিয়ে দিয়েছে। চাঁনকে গাল ডলতে দেখে রতন বলল,
“কিরে চাঁন ! গালে কি হইছে ?” চাঁন কিছু বলার আগেই মতিন মিয়া আবার খেঁকিয়ে উঠলো। “কি হইবো ? সারাদিন টইটই কইরা ঘুরবো, আর আমার ঘরে আহনের সময় হইলে বান্দির পুতে দুয়ার লাগাইয়া দেয় ঘুম। দিছি কানাপট্টি গরম কইরা।”
“ধুরো কাকা, মা মরা পোলাডার গায়ে হাত তুলছো ক্যান ? এক সপ্তাহ পার হইলো না ওর মা মরছে।”
“তুই খাউজাইন্না প্যাঁচাল বন্ধ কইরা এইহানে ক্যান আইসছ, এইডা ক।”
“আমি চাঁনমিয়ারে নিতে আইছি। ফার্মেসীওয়ালা গো একটা সম্মেলন আছে সিলেটে। ৩ দিন পরে আসুম। অনেকগুলা ঔষধ আনুম, সেইজন্য চাঁনরে নিয়া যামু।” অকপটে মিথ্যাগুলো অনর্গল বলে গেল রতন। মতিন মিয়ার এ নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা হচ্ছে না। সে বলল,
“তিন দিনে কত দিবি ?”
“কও কি কাকা, তোমার পোলারে কিনতাছিনা। তিনডা দিন আমার লগে থাকবো।”
“খাটবো তো ? তাইলে ? কত দিবি হেইডা ক।” রতন বুঝলো, এই লোভীকে টাকা ছাড়া হাত করা যাবে না। তাই পকেট থেকে একটা হাজার টাকার নোট বের করে মতিন মিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
“এহন এই একহাজার রাখো। আইসা আরো একহাজার দিমুনে।”
“অইলো। যা, লইয়া যা।”
“চল চাঁন।”
অগত্যা চাঁনমিয়া রতনের পিছু হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চার দিন পেরিয়ে পাঁচদিন চলছে। চাঁনমিয়াকে নিয়ে এখনও ফেরেনি রতন। তা নিয়ে মতিন মিয়ার কোনো ভাবান্তর নেই। যেন চাঁন মিয়া গেছে, ভালোই হয়েছে। যেমন ভালো হয়েছিলো চাঁনের মা মারা যাবার পর। নিজের ব্যবসার জন্য সকালেই গেঞ্জি কিনে এনে ঘর বোঝাই করে রেখে গেছে মতিন। বিকেলে ভ্যান এনে সেটায় তুলে বিক্রি করতে বের হবে।
ভ্যান নিয়ে বস্তিতে ফিরলো মতিন। আর নিজের ঘরের সামনে আসতেই তার পিলে চমকে উঠলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে মতিন মিয়ার ঘরে। আগুনের রেশ কিছুটা পাশের দুটো ঘরও ছুঁয়েছে। বস্তিজুড়ে মানুষের আর্তনাদ, কান্না, চিৎকার আর ছুটোছুটি। এসব দেখেই মতিন মিয়া বেশ ভরকে গেল। তবে আগুনের লেলিহান শিখার সামনে এগুতে সাহস পেল না সে। মাথায় হাত চেপে ধপ করে বসে পড়লো মতিন। তার আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠলো পরিস্থিতি। তার ব্যবসার সব গেঞ্জি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ঘন্টাদুএক পর আগুন নিভিয়ে দিলো দমকল বাহিনী। তারও একঘন্টা পর নিজের ভষ্ম হয়ে যাওয়া ঘরে ঢুকতে পারলো মতিন মিয়া। ঘরের চারপাশের বেড়ার টিনগুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিভাবে এই আগুন লাগলো, তার কোনো সুরাহা করতে পারলো না মতিন মিয়া বা অন্যান্য বস্তিবাসীরা। মধ্যরাত পর্যন্ত সব কোনোরকম পরিষ্কার করে খালি মাটিতেই শুয়ে পড়লো মতিন। চারপাশে পোড়া গন্ধে ঘুমানো বড়ই অস্বস্তির। শুয়ে শুয়ে মতিন ভাবতে লাগলো, এসব তার পাপের শাস্তি না তো ? তবে না খাওয়া ক্লান্ত শরীর কি আর পোড়া গন্ধ মানে ? গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মতিন।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো মতিনের জন্য তখন ওর ঘরে আরো দুটো ধাক্কা অপেক্ষা করছিলো। কেউ ওর ভ্যান গাড়িটা ভেঙে একটা টেবিলের মতো কিছু বানিয়ে ওরই ঘরের ভেতর রেখে গেছে। আর তার উপর রেখে গেছে দু বোতল ভদকা, এক প্যাকেট গাঁজা আর দুই প্যাকেট সিগারেট। এসব দেখে ধরমর করে উঠো বসলো মতিন।
“ক্যাডা ? আমার লগে তামশা করে ক্যাডা ?” চেঁচিয়ে উঠলো মতিন। তবে কারো কোনো সাড়া পেল না সে। কোনোমতে উঠে দরজায় শিকল আটকে দিয়েই বেরিয়ে গেল সে। আজকে শেষ রমজান। মানে আজকের রাতটাই চাঁদরাত। আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব, পবিত্র ঈদুল ফিতর। চারদিকে চলছে উৎসবের আমেজ। সন্ধ্যা হতেই মসজিদের মাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করেছে মসজিদের খাদেম। বস্তিতে জোরালো শব্দে বাজছে ঈদের গান, “ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।”
মতিন মিয়া ফিরে এলো নিজের ছাই হয়ে যাওয়া ঘরে। মোমবাতি জ্বালিয়ে ভ্যানের ভাঙা টুকরা দিয়ে তৈরী টেবিলটার দিকে তাকালো সে। জিনিসগুলো সকালের মতোই আছে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এলো সেখানে। বসেই ঝটপট দুটো গাঁজা বানিয়ে ফেলল। এরপর জ্বালিয়ে টানতে লাগলো গাঁজা। রাজার মতো ভাব ধরে বসে সে গাঁজা টানছে। গিলে ফেলছে সমস্ত ধোঁয়া। এরপরই ভদকার বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে গিলে ফেলল গোটা এক বোতল। মুহুর্তেই নেশার অতলে তলিয়ে গেল মতিন মিয়া। রাত দুটো। পরিচিত একটা কন্ঠ শুনে ধীরে ধীরে চোখ খুলল মতিন। তার সামনে বসে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে চাঁন মিয়া। নিজের বারো বছরের ছেলের চোখে সে দেখতে পেল প্রতিশোধের আগুন। যে আগুন ঘরের মতো তাকেও জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিতে পারে মুহুর্তেই।
“তুই কহন আইলি ? দরজায় তো শিকল লাগাইছিলাম। ঢুকলি ক্যামনে ?” টেনে টেনে বলল নেশায় বুদ হয়ে থাকা মতিন।
“আসমানে চাঁন উঠতে কি কারো অনুমতি লাগে ?” স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই বলল চাঁন।
“তিনদিনের কথা কইয়া গেলি, আর পাঁচদিন পরে আইছস কার বা* ছিঁড়তে ? আগুনে জ্বইলা আমার সব শেষ হইয়া গেছে।”
“কারো বা* ছিঁড়তে তো আহি নাই। আইছি তোরে ছিঁড়তে।”
“কি ? বাপেরে তুই তুই কইরা কইলি ?”
“বাপ ? ক্যাডা বাপ ? কার বাপ ? তুই আমার বাপ না। তুই আমার মায়ের খুনি।” চাঁনের এই কথাটা শোনা মাত্রই মতিনের চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল। তোতলামিয়ে সে বলল,
“ঐ চাঁন, কি কস এগুলা আবোল তাবোল ?”
“আবোল তাবোল না ? তুই জানোস আমি কই গেছিলাম ?”
“কই ?”
“আমি আমার কিডনি বেঁচতে গেছিলাম হারামির বাচ্চা।”
বলেই খালি ভদকার কাঁচের বোতল দিয়ে নিজের সব শক্তি একত্রিত করে মতিনের মাথায় আঘাত করলো চাঁন। পাঁচদিন আগে যখন রতন চাঁনকে নিয়ে কিডনি বিক্রি করাতে নিয়ে যায়, সেদিনই হয় ওর অপারেশন। একটা কিডনি বের করে নেয়া হয় চাঁনের দেহ থেকে। চারদিন পর যথেষ্ট সুস্থ্যতা অনুভব করে চাঁন। ডাক্তার রতনকে বলে ওকে রিলিজ করে দেয়া হয়েছে। রতন চাঁনকে ডাক্তারের রুমের বাইরে বসিয়ে ভেতরে যায় টাকা আনার কথা বলে। রতন ভেতরে যাবার পরই ডাক্তারের সাথে শুরু হয় ওর কথোপোকথন।
“এই নাও তোমার দুই লাখ পঁচিশ হাজার টাকা।” টাকার বান্ডেল এগিয়ে দিয়ে বললেন ডাক্তার। “হ ডাক্তার সাব, ঠিক আছে।” “পোলাপান লইয়া আইছো। মুখ বন্ধ রাখবো তো ?” “আরে রাখবো ডাক্তার সাব, রাখবো। জানেন এইডা কার পোলা ?” “কার পোলা ?” “আরে, দশ বারোদিন আগে নিজের চিকুনগুণিয়ায় আক্রান্ত বউরে আইনা পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভে বউয়ের দুইটা কিডনি বেঁইচা দিয়া, বউটারে মাইরা ফালাইলো, এইটা ঐ মতিন মিয়ার পোলা।” “আরে আস্তে কও মিয়া রতন। দেওয়ালেরও কান আছে।” বলল ডাক্তার। “আরে দেওয়াল হুনলে হুনুক। কান আছে। মুখ তো নাই। কাউরে কইতে পারবো না।” বলে হো হো করে হাসলো রতন।
“তুমি মিয়া ভালই দাইন মারতাছো। প্রতি কিডনি থিকা দুই লাখ নিজে রাইখা রোগিরে দেও পঁচিশ হাজার।” “দোয়া কইরেন ডাক্তার সাব। যাইগা। নতুন কোনো মক্কেল পাইলে আবার আহুমনে।” “আচ্ছা।” বাসে পাশাপাশি সিটে বসে আছে রতন আর চাঁন মিয়া। চাঁন মিয়ার মুখটা ভার। রতন ওকে পঁচিশ হাজার টাকার বান্ডেলটা দিলে ও সেটা প্যান্টের পকেটে রেখে বলল, “রতন ভাই, যদি বাঁচতে চাও, আমার কয়ডা কাম তোমার কইরা দিতে হইবো।” রতন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “বাঁচতে চাইলে ? ঐ কি কস তুই ?” “নাটক দেহার সময় নাইরে রতন। আমি ডাক্তারের দরজায় কান পাইতা সব হুনছি। তুই, ঐ ডাক্তার নামের কসাই আর আমার বাপ কুত্তায় মিল্লা ক্যামনে আমার মায়রে মারছস।”
কথাটা শুনেই রতনের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে ও চাঁনের মুখের দিকে। বাকরূদ্ধ হয়ে গেছে। চাঁন বলল, “আমার কাম কয়ডা কইরা দিলে আমি কাউরে কিছু কমু না। নাইলে পুলিশের কাছে যাইয়া সব কইয়া দিমু।” “না, না, চাঁন ভাই আমার, তুই খালি ক, আমারে কি করতে হইবো।” মতিন মিয়ার মাথা ফেঁটে তীরের বেগে রক্ত ছুটছে। নেশার কারনে উঠতে শক্তি পাচ্ছে না মতিন। গোঙানীতে ভরে গেছে ঘর। মতিন বলার চেষ্টা করলো, “আমারে মাফ কইরা!” “নাহ। মাফ তোর কপালে নাই। রাইতের আন্ধারে বস্তিতে ঢুইকা লুকায় ছিলাম রতনের ফার্মেসীতে। বুইঝা গেছিলাম, ব্যবসা করতে যেই পঞ্চাশ হাজার টাকা তুই আনছিলি, ঐডা আসলে আমার মায়ের কিডনি বেঁচা টাকা আছিলো। এর লাইগা রতনরে দিয়া তোর ঘরে আগুন লাগাইয়া তোর ব্যবসার সব মাল পুইড়া দিছি।”
“বাপ, তুই ?” “হ আমি। রতনরে দিয়াই তোর ভ্যান ভাইঙ্গা এই নেশার জিনিশগুলান আনাইছি আমি। যেন তুই পেট ভইরা নেশা করোস, আর তোরে মন ভইরা আমি মারতে পারি। রতনও আমারে মারতে চাইছিলো। তয় আমিই ওরে ঘুম পাড়াইয়া দিছি। আমার মায়রে মারার পিছনে ওর হাত সবচে বড়। তোর লোভ কামে লাগাইছে। আমি কামে লাগাইছি ওর ডর। লোকজন জানাজানি হওয়ার ডরে আমার কথামত কাম অয় করতাছিল ঠিকই, কিন্তু আমার মুখ একবারে বন্ধ করনের লাইগা তোর ঘরে নেশার জিনিষগুলা রাইখা ফার্মেসীতে যাইয়া আমারে ইনজেকশন দিতে চাইছে এইডা কইয়া যে আমার কিডনি অপারেশনের ওষুদ ঐডা।
ওর মতলব টের পাইয়া ওর ঐ ইনজেকশন ওরেই ঘাড়ের উপরে মাইরা দিছি। অজ্ঞান হওয়ার পরেই সাইজ কইরা ওর গলাডা বডি দিয়া ফাঁক কইরা দিছি। অহন তোর পালা। আজকে তোর কিডনি দুইডা বাইর কইরা আমি কাঁচা চাঁবাইয়া খামু শুয়োরের বাচ্চা।” একের পর এক কাঁচের বোতলের আঘাত চাঁন করতে লাগলো মতিনের মাথায়। বোতল ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। বোতলের ভাঙা টুকরা হাতে নিয়ে অনবিরত মতিনের দেহে পোঁচাতে লাগলো চাঁন। অবশেষে নিস্তেজ হয়ে গেল মতিন মিয়ার দেহ। উঠে দাঁড়ালো চাঁন। ঘৃণার দৃষ্টিতে শেষবার তাকিয়ে থুথু ফেলল মতিনের মুখে। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল চাঁনমিয়া।
আজ ঈদের দিন। মায়ের কবরের সামনে বসে কাঁদছে চাঁনমিয়া। চোখের পানি যখন শুকিয়ে এলো, তখন উঠে দাঁড়িয়ে পাশে রাখা শপিং ব্যাগ থেকে সে বের করলো টুকটুকে সেই লাল শাড়িটা। শাড়িটা দিয়ে সে ঢেকে দিলো মায়ের পুরো কবরটা। থানায় গিয়ে নিজের বাবাকে আর রতনকে খুন করার কথা স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করলো চাঁন। পুলিশকে জানালো ডাক্তারের সব সত্য। পুলিশ এরেস্ট করলো ঐ ডাক্তারকে। বিচারে ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিলসহ যাবৎজীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো। আর চাঁনমিয়াকে পাঁচবছরের জন্য পাঠানো হলো কিশোর সংশোধন কারাগারে।
বছর ঘুরে আজ আবার ঈদের দিন। কিশোর সংশোধন কারাগারেও বইছে ঈদের আমেজ। সব কিশোর অপরাধীদের দেয়া হচ্ছে ভাল ভাল সব খাবার। দেখা করতে দেয়া হচ্ছে পরিবারের সাথে। কিন্তু চাঁন মিয়ার যে কেউ নেই।
এক কোণে বসে চোখের পানি ফেলছে চাঁন। হঠাৎ চাঁন নিজের সামনে দেখতে পেল ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। “মা !” বলে ডাকলো চাঁন। “কিরে বাজান ? আইজ এই ঈদের দিনেও তোর চোখে পানি ?” “ঈদ ? মাগো, তুমি ছাড়া এই চাঁনে যেমন গ্রহন লাগছে, তেমন যতদিন বাঁচি, এই চাঁনের চোখে প্রত্যেকটা ঈদের চাঁদে গ্রহন লাইগাই থাকবো।”