: প্লিজ শিলা, আমাকে কথা দে। তুই অভ্রকে বিয়ে করবি।
হাসপাতালের বেডে মৃত্যু পথযাত্রী বান্ধবীর এমন অনুরোধে কিই বা বলতে পারি আমি। প্রচন্ড কান্নায় গলা ধরে আসছিল। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
–তোর ভালোবাসার মানুষকে আমি কেন বিয়ে করব?
: আমি তো মারা যাচ্ছি, শিলা।
–চুপ কর, তনিমা। কিচ্ছু হবে না তোর।
আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিস না। আমি জানি আমার সময় শেষ। কিন্তু অভ্রকে একা ফেলে গেলে আমি কিছুতেই শান্তি পাব না। আমার নীরবতা দেখে তনিমা হয়ত দমে গেল। তাই আর কিছু না বলে পাশ ফিরে কাঁদতে শুরু করল। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তনিমা, আমার প্রানের চাইতেও প্রিয় বান্ধবী।আমি যখন খুব ছোট আমার বাবা-মা তখন এক কার অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তনিমার বাবা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। আমাকে তিনিই বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সেই ছোটবেলা থেকে তনিমা আর আমি স্কুল কলেজ আর এখন ভার্সিটিতে এক সাথে পড়ছি। কলেজ লাইফ থেকে দুজনই হোস্টেলে থাকি।
এত কাছাকাছি থাকার সুবাদে আমদের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বেই সীমাবদ্ধ নেই। আমরা বোনের চাইতেও বেশি কিছু। তনিমা, অভ্র নামের একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ফেসবুকে ওদের পরিচয়। তিন বছরের সম্পর্ক। অথচ ওরা কেউ কাউকে কখনো সামনা সামনি দেখে নি। এমনকি কোন ছবিও না। অদ্ভুত ভালোবাসা ওদের। তনিমার কাছে অভ্রর গল্প শুনতে শুনতে আমি বোর হয়ে যেতাম। তবু শুনতাম। কারন তনিমা বলতে ভালোবাসতো। আমাদের কোন কথাই গোপন থাকত না।দুজনের জানা চাই-ই চাই। আমার প্রেম ভালোবাসায় মোটেও আগ্রহ ছিল না। ওসব মনে হত সময়ের অপচয়। আমি ছিলাম বইয়ের পোকা। বই নিয়েই পড়ে থাকতাম সারা ক্ষন। তনিমা যখন অভ্রর সাথে চ্যাটিং এ ব্যস্ত থাকত তখন হয়ত আমি কোন জটিল প্রবন্ধে মুখ গুজে আছি। তনিমা মাঝে মধ্যে ঠাট্টা করে বলত,
: শিলা, তুই বড়ই অরোমান্টিক!
–কেন? তোর মত প্রেমিকের সাথে অাজাইরা প্যাচাল পাড়ি না এই জন্য!
: ভালোবাসা তোর কাছে আজাইরা? আরে গাধি মেয়ে, ভালোবাসা হচ্ছে স্বর্গীয় অনুভূতি।
–রাখ তোর স্বর্গীয় অনুভূতি। কালকে ক্লাস টেস্ট আছে না? একবার যদি আমার খাতার দিকে তাকাস তোর খবর আছে!
: এ্যাহহ! তোর খাতা দেখতে যাব কোন দুঃখ্খে। আমি কিছু পারি না নাকি?
–কে বলছে পারো না? তুমি তো পারো খালি প্রেম করতে।
তনিমার সাথে এমন সব খুনসুটি লেগেই থাকত আমার। এই তো কয়েক মাস আগের কথা। অভ্রর পড়ালেখা শেষ হয়। ভাগ্য ভাল। পাশ করে বেরোতেই চাকরি। তনিমার খুশি দেখে কে! আজকাল চাকরির বাজারে দুর্ভিক্ষ। অথচ অভ্রর চাকরিটা এত সহজে হয়ে গেল।
: শিলা! শিলা! শিলা! এইবার তো আমার অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। অভ্র এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত। বল বাবা রাজি হবে কিনা?
–অবশ্যই হবে। ছেলে শিক্ষিত, চাকরি করে। সুপাত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায়।
: চালিয়ে দেয়া যায় মানে? অভ্র অবশ্যই সুপাত্র।
–না মানে ওকে তো তুই কখনো দেখিস নি। তো ও দেখতে কেমন কে জানে?
: দেখিনি তো কি হয়েছে। আমি জানি আমার অভ্র রাজপুত্রের মত সুন্দর।
–যদি আফ্রিকান রাজপুত্র হয় তো? তনিমা আমার কথা শুনে ভয়ানক রেগে গিয়েছিল।
: অভ্রর সাথে তোর কিসের শত্রুতা বলতো? সারাদিন শুধু ওর নামে বদনাম করতেই থাকিস। বেশি বাড়াবাড়ি করলে না ওকে তোর গলায়ই ঝুলিয়ে দেব।
–হুহ! দরকার নেই বাবা। তোমার ওই প্রেমিক নিয়ে তুমিই থেকো।
তনিমা খুব খুশি ছিল। ওর খুশি দেখে আমিও ভীষন আনন্দ পেতাম। কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। এখানেই তনিমার সাথে আমার সব থেকে বড় অমিল। তনিমা প্রান দিয়ে ভালোবাসতে পারত। ওর সমস্ত কথায় কাজে ভালোবাসা উপচে পড়ত। কিন্তু আমি কেমন যেন কাটখোট্টা স্বভাবের। ভালোবাসতে পারি কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। অভ্র-তনিমা কল্পনায় ওদের সংসার সাজাতে শুরু করেছিল। চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে অভ্র তনিমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চেয়েছিল। তনিমাই কয়েক মাস অপেক্ষা করতে বলে। মাত্র চাকরি পেলো। সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে তো! তনিমা সর্বদা একটা সাজানো গোছানো জীবন চাইত। অথচ হঠাৎ এক কালবৈশাখী ঝড়ে ওর সমগ্র জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেলো। এতদিন এক সাথে থেকেও বুঝতে পারি নি ও অসুস্থ। কিন্তু যখন সবাই জানল তখন আর কিছুই করার নেই। ব্লাড ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ।
: শিলা? ওয়েটিং রুমে বসে বসে আমি স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। চমকে তাকিয়ে দেখি নার্স দাঁড়িয়ে আছে।
–জ্বি
: রোগী আপনাকে ডাকছেন।
–যাচ্ছি।
কেবিনে ঢুকতেই দেখি তনিমা মন্ত্রমুগ্ধের মত পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ওর পাশে বসে আস্তে ডাকলাম।
–তনিমা তনিমা চমকে উঠল। হঠাৎ যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে।
: কি ভাবছিস?
–অভ্র বলেছিল আমাদের বাসার ছাদে একটা দোলনা থাকবে।
পূর্নিমা রাতে আমরা দুজন হাতে হাত রেখে দোলনায় দোল খেতে খেতে চাঁদ দেখবো। তনিমা যেন এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। তারপর হঠাৎই ব্যাকুল ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
: শিলা, আমার তো সেই সুযোগ হবে না। কিন্তু অভ্রর পাশে দোলনাটায় আমি কিছুতেই অন্য কাউকে বসতে দেব না। শুধু তুই বসবি। তুই চাঁদ দেখবি। তাহলেই আমার দেখা হবে।
–এসব হয় না, তনিমা। তোর স্বপ্নের পৃথিবীতে আমি কিছুতেই নিজেকে হারাতে পারব না। আমি ভালোবাসতে জানি না।
: ভালোবাসতে জানতে হয় না পাগলি। ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যায়।
–তনিমা, এই সব পাগলামী রাখ। তুই অভ্রর মোবাইল নাম্বারটা বল। আমি ওকে আসতে বলি। ও শুধু তোর।
: না। আমার অসুখের কথা জানলে ও পাগল হয়ে যাবে। আমি তো ওকে চিনি। ও আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আমার চলে যাওয়ার আঘাত ও সইতে পারবে না। আমিও ওকে একলা ফেলে মরতে পারছি না। প্লিজ শিলা, তুই রাজি হয়ে যা।
–কিন্তু অভ্র? ও কি ভাববে?
: ও কিচ্ছু জানবে না। ওর চাই তনিমা। ও আমাকে কখনো দেখে নি। তাই তুই হবি অভ্রর তনিমা।
–কিন্তু নাম পাল্টে ফেললেই কি আমি সত্যি অভ্রর তনিমা হতে পারব বল? যে ছেলেটা তোকে এত ভালোবাসে আজ হোক কাল হোক ওর কাছে ধরা তো পড়তেই হবে।
: না। আমি জানি তুই অভ্রকে আমার মত করেই ভালোবাসতে পারবি। তুই আমি আলাদা কেউ নই, শিলা। আর এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি অভ্রকে বিয়ে করলে তুই হারবি না।
–এখানে হার জিতের কোন প্রশ্ন নেই। তুই যাকে ভালোবাসতে পারিস তার যোগ্যতা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
: তাহলে আমার শেষ অনুরোধ রাখ, শিলা। অভ্রকে আমার কথা কখনো বলবি না। ও কষ্ট পাবে।
–বেশ, বলব না।
: এই নে আমার মোবাইল। আজ থেকে তুই তনিমা।
–বেশ। তাই হবে।
: আর একটা অনুরোধ আমি বেঁচে থাকতেই বিয়েটা কর। নিশ্চিন্তে মরতে চাই।
–কিন্তু চাচা-চাচি?
: আমি বাবা-মাকে সব বলেছি। তুই এবার অভ্রকে আসতে বল।
–আচ্ছা। আমি কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। তনিমা আবার ডাকল,
: শিলা
— বল, শুনছি।
: অভ্রকে ককখোনো কষ্ট দিবি না। ও যে ভালোবাসার পাগল। আমি তনিমার কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
–তোর ভালোবাসাকে আমি কখনো হেরে যেতে দেব না।
এবারে আমরা দুই বান্ধবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম। তনিমার কান্নায় নির্ভরতার তৃপ্তি।আর আমার কান্নায় নতুন দায়িত্বের বন্ধন। তনিমার মোবাইলটা নিয়ে সারা রাত আমি অভ্রর সাথে ওর চ্যাট হিস্টোরি পড়লাম। চোখের জলে আমার বালিশ ভিজে যায়। এতটা ভালোবাসাও কি সম্ভব। এখন বুঝতে পারছি কেন তনিমা অভ্রকে নিজের অসুস্থতার কথা জানাতে চায় না। কতটা ভালোবাসা থেকে একজন প্রেমিকা তার ভালোবাসাকে বান্ধবীর হাতে তুলে দেয়। সত্যি তনিমাকে ছাড়া অভ্রর চলবে না। আর তনিমাও অভ্রকে একা ছেড়ে যাবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। ভালোবাসবো। তনিমা হয়েই অভ্রকে ভালোবাসবো। নিজের নামটা বিসর্জন দিতে হবে। তাতে কি! অভ্রকে ভালোবাসার জন্য তনিমা হতে আমার কোন আপত্তি নেই। বরং আমি ধন্য। অভ্রকে ফোন করলাম। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে জবাব এল,
: হ্যালো। আসসালামু আলাইকুম।
–ওয়ালাইকুম আসসালাম। অভ্র?
: জ্বি
–আমি..
আমি তনিমা, এই কথাটা বলতে কেমন দ্বিধা লাগছিল। অভ্রই কাজটা সহজ করে দিল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
: তুমি তনিমা। আমি জানি।
–হুম, আমি তনিমা। কি করে চিনলে?
: বলেছিলাম না তোমাকে, তনিমা কখনো অভ্রকে নাম ধরে ডাকলে অভ্র ঠিক চিনতে পারবে।
আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলাম। আমি তাহলে তনিমা হতে পেরেছি। আমি অভ্রকে দেখা করতে বললাম। হাসপাতালের ঠিকানাটাই দিলাম। অভ্র অবাক হয়ে জানতে চাইল,
: হাসপাতালে কেন?
–ওই যে শিলা। তুমি তো জানো ও আমার খুব ভালো বন্ধু। ও অসুস্থ তাই সবসময় ওর সাথেই থাকি। এ জন্যই তোমাকে হাসপাতালে আসতে বললাম।
: ও আচ্ছা।
–বুঝতেই তো পারছ। ওকে একা রেখে অন্য কোথাও গিয়ে দেখা করা সম্ভব না।
: কোন সমস্যা নেই। কত অপেক্ষার পর তোমাকে দেখতে পাব। তুমি যদি দেখা করার জন্য জাহান্নামেও যেতে বল, যাব। আর ওটা তো হাসপাতাল।
–আচ্ছা রাখছি তাহলে।
: হুম। শোনো
–বল
: তোমার কন্ঠটা খুব মিষ্টি।
–তাই বলে আবার ভেবে বস না যে আমি কন্ঠের মতই সুন্দর।
: তুমি আমার চোখে সর্বদাই সুন্দর।
–আচ্ছা কল্পনায় বিচরন বন্ধ কর। আর সময়মতো চলে এসো।
: যো হুকুম মহারানী।
তনিমার তিল তিল করে গড়ে তোলা ভালোবাসাকে আমি এক মুহূর্তে স্বার্থপরের মত নিজের করে নেব এটা হতেই পারে না। অভ্রর মনে তনিমার জন্য যে সীমাহীন ভালোবাসা তা আমার হতে চলেছে। তনিমা অভ্রর সাথে কখনো ফোনে কথা বলেনি। দিনের পর দিন চ্যাট করে দুজনেরই কন্ঠের প্রতি যে আকর্ষন হয়েছিল তার মাধুর্য আমি উপভোগ করেছি। তনিমাকে দেখার যে ব্যাকুলতা অভ্রকে আজ রাতে ঘুমাতে দেবে না , কাল সকালে সেই ব্যগ্রতা নিয়ে অভ্র আমাকে দেখবে।না চাইতে আমি এত কিছু পাচ্ছি। কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী তনিমাকে অভ্রর মুখ দেখা থেকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যাবে না।তনিমা যতই নিষেধ করুক আমি অভ্রকে ওর সামনে আনবোই।
পরদিন সকাল বেলা আমি নীল রঙের একটা শাড়ী পড়লাম। কপালে পড়লাম কালো টিপ। চোখে হালকা করে কাজল লাগালাম। ব্যস এই রুপেই অভ্র তনিমাকে দেখতে চেয়েছিল। আমি জানি আজকে একটা নীল পান্জাবী পড়া ছেলে আসবে। হাতে থাকবে টকটকে লাল গোলাপ। নিজেদের প্রথম দেখা কেমন হবে এই নিয়ে অভ্র তনিমার অনেক আলোচনা হয়েছে। কাল রাতে এরকম অনেক টেক্সট পড়েছি। দুজন দুজনকে কল্পনায় বহুবার নীল রঙে সাজিয়েছে। দুজনেরই পছন্দের রং নীল। আমার রং নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। তবে আজ থেকে আমার প্রিয় রংও নীল।কারন আজ সেই কল্পনার নীল রং বাস্তবে আকাশের নীলে মিশে যাওয়ার অপেক্ষায়। কারন আজ থেকে আমি তনিমা।
হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম চাচি কাঁদছেন। চাচা অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম আজকে তনিমার অবস্থা খুবই খারাপ। আমি ভেতরে গেলাম না। ওর মলিন মুখটা দেখলে আমি নিজেকে তনিমা সাজানোর দুঃসাহস দেখাতে পারব না। বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে আছি। এই মাত্রই অভ্রর টেক্সট এলো। সে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে।আমিও ফ্লোর নাম্বার বলে দিলাম। বাকিটা ওর কাজ। তনিমাকে খুঁজে বের করা ওর দায়িত্ব।আমি শেষ বারের মত নিজেকে প্রস্তুত করলাম। আমি তনিমা। মিনিট দশেক পেরিয়ে গেলো। অভ্রর তো এত দেরি করার কথা নয়। ভেতরে ভেতরে যখনই উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম তখনই শুনলাম পেছন থেকে কেউ নাম ধরে ডাকল।
: তনিমা?
কলিজা শীতল করে দেয়া ডাক। আমি সহসাই ঘুরে তাকাতে পারলাম না। ধীরে ধীরে অনেকটা সময় নিয়ে ফিরে তাকালাম। নীল পান্জাবী পড়া ছেলেটাকে দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। কি অদ্ভুত সুন্দর আর মায়াবী নীল চোখ। ছেলেদের চোখ এত সুন্দর হতে আমার ধারনা ছিল না। গৌর বর্ন মুখের সাথে মাথাভর্তি কোকড়া চুল। বেশ অনেকটা লম্বা। এক কথায় সুদর্শন। তনিমার ধারনাই ঠিক ছিল। তার অভ্র রাজপুত্রের মতই এবং অবশ্যই সে আফ্রিকান রাজপুত্র নয়। আমাকে কেমন লাগছিল জানি না। তবে সেও খুবই অদ্ভুত মুগ্ধতায় আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার দেখার যদিও বা শেষ ছিল কিন্তু তার চোখের পলক পড়ছিল না। কিন্তু আমার হাতে সময় খুব কম। তাই তার ধ্যান ভঙ্গ করতে হল।
–অভ্র
: হুম
–কি দেখছ এমন করে?
: তুমি মিথ্যে বলেছ?
–কি মিথ্যে বলেছি?
: আমার কল্পনাকে তুমি সীমায় বাঁধতে চেয়েছ।
তুমি বলতে তুমি নাকি মোটেও সুন্দর না। কিন্তু তনিমা, তুমি আমার কল্পনারও বাইরে। তুমি তোমার কন্ঠের চাইতেও বেশি সুন্দর। আমি কিছু না বলে সামান্য হাসলাম। আচ্ছা অভ্রর মুখে এত প্রশংসা শুনলে তনিমা কি করত? লজ্জা পেয়ে হয়ত চোখ নামিয়ে নিত। কিন্তু আমি কেন জানি অভ্রর চোখে চোখ রেখেই হাসলাম। এতে অভ্রর উৎসাহ দ্বিগুন বেড়ে গেল।
: তুমি হাসলে তোমার সৌন্দর্য বহুগুনে বেড়ে যায়।
–আজ কি তুমি আমার সৌন্দর্যের বন্দনা করেই দিনটা কাটিয়ে দিতে চাও নাকি?
: শুধু একদিন কেন সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
হায়রে অভ্র! সে তনিমা নামের আড়ালে থাকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সারাজীবন কাটাতে চায়। কিন্তু সে জানে না যে প্রকৃত তনিমা সে আমার চাইতে বহুগুনে বেশি সুন্দর। আর সেই তনিমা কেবল জীবনের শেষ ক্ষনে অভ্ররই মুখ দেখার অব্যক্ত ইচ্ছায় ছটফট করছে।
–অভ্র, আমার গোলাপ কোথায়?
: এনেছি তো।
অভ্রর একটা হাত যে পেছনে ছিল আমি খেয়াল করি নি। সে হাতটা সামনে নিয়ে আসতেই দেখতে পেলাম তার হাত ভর্তি টকটকে লাল গোলাপ।
–অভ্র, আমি চাই এই ফুলগুলো তুমি আমার অসুস্থ বান্ধবীকে দাও।
: বেশ তো। তুমি যখন বলছ অবশ্যই দেব। কোথায় সে?
–এসো
অভ্রকে আমি তনিমার কেবিনে নিয়ে গেলাম। তনিমার তখন খুব একটা হুশ নেই। আমি ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “তনিমা, তোর অভ্রকে নিয়ে এসেছি।” তনিমার চোখে মুখে মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল। তবু সে চোখ খুলে তাকাল। লাল গোলাপ হাতে নীল পান্জাবী পড়া ছেলেটাকে চিনতে তার এক মুহূর্ত দেরি হয় নি। অভ্র এগিয়ে এসে তনিমার ক্যানোলা লাগানো হাতে গোলাপগুলো দিয়ে বলল,
: আমি অভ্র। এই গোলাপগুলো আপনার জন্য।
তনিমা গোলাপ হাতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হচ্ছিল এই দৃশ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। সময় থেমে গেছে। তনিমা অনন্তকাল এভাবেই তাকিয়ে থাকবে অভ্রর দিকে।
: তনিমা
বেশ কিছু ক্ষন পর অভ্রর ডাকে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। অভ্র আমাকে ডেকেছে কিন্তু তার দৃষ্টি নিবদ্ধ তনিমার খোলা চোখে।
–তনিমা, I think your friend is no more.
–কি বলছ তুমি এসব? অভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার সারা মুখে কে যেন এক ছোপ কালি মেখে দিয়েছে। খুবই মৃদু কন্ঠে বলল,
: ঠিকই বলছি। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আমাকে দেখছে না। তার দৃষ্টি শূন্য আর নিষ্প্রান।
আমি ব্যস্ত হয়ে তনিমার হাত স্পর্শ করতেই হাত থেকে ফুলগুলো পড়ে গেল। সত্যি তনিমা আর নেই? অভ্র এগিয়ে এসে তনিমার চোখদুটো হালকা স্পর্শে বন্ধ করে দিল। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তনিমা চলে গেছে। অভ্রর চোখে চোখ রেখেই তনিমা চলে গেছে।
আমার বুকের ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল। তবু আমি কাঁদতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল আমি পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু দুটি হাত পরম যত্নে আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিল। আমি পাথর চোখে কেবল চেয়ে ছিলাম। ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি, চাচা-চাচীর বুক ফাটানো আর্তনাদ কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করছিল না। আমার চোখের সামনে কেবলই সেই দৃশ্য ভাসছে। তনিমার হাতে লাল গোলাপ আর দৃষ্টি নিবদ্ধ অভ্রর চোখে। একসময় হয়ত সব কোলাহল থেমেছিল। তবু আমি স্থির পাথরের মত মূক হয়েছিলাম। নিজের প্রতি কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। কিন্তু আমি অনুভব করেছি প্রতিটা মুহূর্ত অভ্র আমার সাথে ছিল।
: তনিমা অভ্রর কন্ঠে তনিমার নাম শুনে এই প্রথমবার আমার চোখ জ্বালা করে উঠল। হয়ত দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল । হয়ত পড়ল না।
: তনিমা, তোমার এই বান্ধবীর কথা শুধু তোমার মুখেই শুনেছি। সে আমার সম্পূর্ন অপরিচিত। তবু তার জন্য আমার বুকের ভেতরটা কেমন ব্যথা করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। অভ্রর চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে। মুখে গভীর বেদনার ছাপ। আমার ইচ্ছা করছিল ওকে চিৎকার করে বলে দেই, “যার জন্য তোমার মন কাঁদছে সেই মেয়েটাই তোমার তনিমা।” কিন্তু বলা হয়নি। কারন শোকে দিশেহারা হয়ে আমি কিছুতেই তনিমার শেষ ইচ্ছাটা বিফলে যেতে দেব না। অভ্রকে ভালো রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেছে সে।
: তনিমা, আমি এখানে আর থাকতে পারছি না।প্লিজ, এমন কোথাও চলো যেখানে শুধুই নীল আকাশ আর আমরা দু’জন থাকবো। অভ্র আমার উত্তরের অপেক্ষা করল না। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল সামনের দিকে। আমিও বাঁধা দিলাম না। কারন সে তনিমাকে নিয়ে পালাতে চায়, এই অজানা ব্যথা থেকে অনেক দূরে.. এমন কোথাও যেখানে আকাশ নীল…