ছেলেটা প্রায় দশমিনিট যাবত আমার পিছু পিছু আসছে। দশমিনিট বললে ভুল হবে! জ্যামের কারণে বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই রিকশা থেকে নেমে পড়েছিলাম। তারপর থেকেই খেয়াল করছি ছেলেটা পিছু পিছু আসছে।অনেকক্ষণ ধরেই বৃষ্টি আসবো আসবো করছে। কিছুক্ষণ যাবত হালকা টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে।এখন সেটা ক্রমেই বাড়ছে।
আমি বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি যদিও আমার কাছে ছাতা আছে। ভিজার তেমন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ছেলেটা এখনো আমার পিছু পিছু আসছে। এই ছেলেটাকে আমি আগে থেকেই চিনি। আমাদের এলাকার ই। আমাকেও হয়তোবা চিনে! কারণ আগে রাস্তায় প্রায় সবসময়ই দেখা হতো যদিও সরাসরি কখনো কথা হয় নি। কিন্তু এই ছেলের এত পরিমাণ প্রশংসা আমি শুনি যে কান পঁচে এবার মস্তিষ্কে পঁচন ধরবে কয়দিন পর। এই ছেলের মত ভদ্র আর ভালো স্টুডেন্ট এলাকাজুড়ে নাই! স্কুল, কলেজ, অ্যাথলেটস সবকিছুতেই সে নাকি টপার বয়! গত বছর ইন্টারমিডিয়েটে বিভাগীয় পর্যায়ে ফার্স্ট হয়েছে।
বুয়েটে সপ্তম ও ঢাকা ভার্সিটিতে চতুর্থ হয়ে চান্স পেয়েছিলো। ইন্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা তাই বুয়েটেই ভর্তি হয়েছে। এখন হয়তোবা কয়দিনের জন্য বাসায় এসেছে। সে যাই হোক আর যত ভালো স্টুডেন্ট ই হোক এভাবে আমার পিছু পিছু আসার কি কারণ! দুইটা বাসার পরেই আমাদের বাসা। কিন্তু ছেলে এখনো পিছু পিছু আসছেই। ওর বাসা তো অন্য গলিতে। এই গলিতে কি চায়?! আমি দাড়িয়ে পড়লাম। মনে মনে ঠিক করলাম ছেলেটাকে কড়াভাবে বলবো, “এই যে শুনেছি আপনি খুব ভদ্র! কিন্তু এভাবে কারো পিছু পিছু আসাটা কি ভদ্রতার লক্ষণ?” কিন্তু আমি পিছনে ফিরে ঘুরে তাকাতেই ছেলেটাও দাড়িয়ে গেলো। কয়েকবার ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো। তারপর সোজা হেঁটে আমার সামনে এসে দাড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো। তারপর আমাকে বললো,”একটা কথা বলার ছিলো!” আমি স্বাভাবিক ভঙ্গীতেই বললাম,”হ্যাঁ বলুন”
“ তোমার নাম তো নিষ্পা। তাই না?!”
“হ্যাঁ আমিই নিষ্পা। বলুন কি বলবেন?”
“তুমি তো তাইবার সাথেই পড়ো! সামনের বছর এইচএসসি দিবা। তাই না?”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। আমি কোন ক্লাসে কার সাথে পড়ি এটা জানার জন্যই পিছু পিছু আসছে নাকি!আজব! তাইবার বাসাও আমাদের এলাকাতেই।আমাদের সাথেই পড়ে। এই ছেলেটা তাইবার ভাই হয়। আমি একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম, “আমি কোন ক্লাসে পড়ি এটা জিজ্ঞেস করার জন্যই এতক্ষণ যাবত পিছু পিছু আসছিলেন নাকি?” ছেলেটা আকাশের দিকে তাকালো। তারপর জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললো,“ আরে না না অন্য একটা কথা বলার ছিলো।” “অন্য একটা কি কথা বলেন শুনি!” “মানে কথাটা যে ঠিক কিভাবে বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি কি না কি মনে করো এভাবে হুট করে এরকম একটা কথা বললে। আসলে আমার নিজেরও লজ্জা লাগছে এভাবে বলতে কথাটা তোমাকে।”
ছেলেটার কথা শুনে আমার মনে হলো এক হাজার ভোল্টেজের শক খেলাম! এবার আর সন্দেহ নেই প্রপোজ যে করবে। মনে মনে বললাম,“বাছাধন এবার টের পাবে কত ধানে কত চাল। তোমার ভদ্রতার মুখোশ বের করছি আমি! ইশ ফোনের রেকর্ড অপশনটা অন করে রাখলে ভালো হতো! সবাইকে প্রমাণসহ দেখাতে পারতাম সবজায়গায় ভদ্র আর ভালোর জন্য এওয়ার্ড পাওয়া ছেলেটার মুখোশের আড়ালে যে কি আছে! আবার হঠাৎ করে আমার এটাও মনে হলো,ছেলেটা হয়তো আমাকেই প্রথম প্রপোজ করতে যাচ্ছে নিজ থেকে। তাছাড়া সবাই যেহেতু বলে ভদ্র, অমায়িক, ভালো স্টুডেন্ট সুতরাং নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে বড় কিছু একটা হবে। সো রিলেশনশিপে গেলে হয়তোবা খুব একটা খারাপ হবে না। তবে সাথে সাথেই প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবো না! কয়দিন পর করবো!” আমি যখন এসব ভাবছিলাম ছেলেটাকে এক্সেপ্ট করবো নাকি সবাইকে তার ভদ্রতার আড়ালের ক্যারেক্টারটা দেখাবো ঠিক তখন ছেলেটা বললো,“ বৃষ্টি বেশি শুরু হয়ে যাচ্ছে। বলবো নাকি কথাটা? “ অবশ্যই বলবেন। বৃষ্টিই তো বলার উপযুক্ত সময়!” “হাহাহা। কথাটা অবশ্য খারাপ বলো নি। বৃষ্টির জন্যই তো কথাটা বলা।”
আমি ছেলটার লাস্টের কথাটার আগামাথা কিছু বুঝলামনা। কিন্তু সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে বললাম,“কথাটা কি তাড়াডাড়ি বলুন!” ছেলেটা আবার আকাশের দিকে তাকলো। “আমি আসলে তোমার” এই বলে একটু কাশলো। আমি কিছুটা উত্তেজিত স্বরে বললাম,“আপনি আসলে আমার! এরপর!” “আমি আসলে তোমার ছাতাটা একটু ধার নিতে চাই! আমার টনসিলের প্রব্লেম আছে। একটু ঠান্ডা লাগলেই সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যায়।” একনাগাড়ে 6G স্পিডে কথাগুলো বলে ছেলেটা একটু থামলো। কয়েকদিন পরেই পরিক্ষা। হালকা সামান্য জ্বর হলেই আমি একটুও পড়তে পারি না। কিন্তু পরিক্ষার জন্য প্রচুর পড়া বাকি আছে আমার বাসা থেকে ছাতা নিয়ে আসতে মনে নাই। ছেলেটার কথা শুনে আমার চোয়াল ঝুলে পড়ার মত অবস্থা হলো। কান দিয়ে যেন ধূয়া বেরুচ্ছে। কোনো কথায় যাচ্ছে না!
ছেলেটা আবার বললো,” আসলে ঠান্ডাও মূল প্রব্লেম না। প্রব্লেম হচ্ছে বইগুলো।” আমি তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটার হাতে তিন/চারটা মোটা মোটা বই। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। “বইগুলো ভিজে যাচ্ছে। আমি আসলে আমার বইয়ের প্রতি একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। বইয়ের প্রতি একটুখানি অযত্ন সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া নতুন আজই কিনেছি মাত্র। বললাম না কয়দিন পর পরিক্ষা। বইগুলো খুব দরকারি। তোমার তো ওই সামনের বাসাটাই। আমাদের বাসাটা এমনিতেই একটু ভিতরে। তারউপর ঐ গলির রাস্তাটা ঠিক করানো হচ্ছে তাই এই গলি দিয়ে অনেক ঘুরিয়ে বাসায় যেতে হয়। এখন তুমি কি দিবেনা একটু ছাতাটা ধার? কিন্তু আমার কান দিয়ে যেন কোনো কথায় যাচ্ছে না। আমি স্ট্যাচু অব লিবার্টির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে এভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছেলেটার কি মনে হলো কে জানে! কিছুটা অভয় দেওয়ার ভঙ্গীতে বললো,”সমস্যা নেই। বৃষ্টি থামলেই আমি ছাতাটা দিয়ে যাব। নয়তো তাইবা বা অন্য কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিব!”
আমার তখন কেন যেন হঠাৎ করে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো! ছাতাটা ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,”এই নিন ছাতা! নিজে এসে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো দরকার নাই। নিজে আসতে যে সময়টা নষ্ট হবে ওই সময়টাতে বাসায় বসে পড়তে পারবেন। আর হ্যাঁ একটা কাজ করবেন! বাসায় গিয়ে মাথাটা গলা থেকে আলাদা করে কেটে ঘাড়ের মধ্যে বইগুলো বসিয়ে দিবেন আর কাটা মাথাটা হাতে রাখবেন সবসময়। যখন ইচ্ছা যেখানে খুশি পড়তে পারবেন শুধু কাটা মাথাটা বইয়ের সামনে ধরলেই হলো।” এই বলে বাসার দিকে চলে আসছিলাম। তারপর আবার পিছনে ফিরে বললাম, আর হ্যাঁ সাথে একটা পলিথিন রাখবেন যেন বৃষ্টি এলে কাটা মাথাটা পলিথিনে ভরে রাখতে পারেন নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে আপনার!”
ছেলেটা এবার এত অবাক হলো যে বাসায় যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলো। আর অবাক দৃষ্টিতে একবার ছাতা আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। ছেলেটাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার কেন যেন আবার মেজাজ খারাপ হলো। বললাম,”হ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাসায় গিয়ে পড়তে বসেন। আর এতক্ষণ আমার সাথে কথা বলে যে সময়টা নষ্ট হলো তার জন্য একটু কান্নাকাটিও করিয়েন!” এরপর আর একমূহুর্তও দাঁড়িয়ে না থেকে হনহন করে বাসার দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু আমি জানি ছেলেটা এখনো আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। উফ! আমি এতক্ষণ ছেলে ছেলে বলছি কেন! ওর নাম মাহিন! কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পাঁচবছর পরে এই ছেলের সাথেই যে আবার শ্রাবণ মাসের এমন বৃষ্টিতে ভিজতে হবে কে জানতো!
হ্যাঁ এতক্ষণ যা বলছিলাম তা পাঁচবছর আগেকার কাহিনি। আমি এ বৃষ্টির দিনের ছাতার ঘটনাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় যদি না আব্বু আজকে ভার্সিটি থেকে ফেরার পর এই ছেলেটার কথা আমায় বলতো! আজকে সারাদিন ধরেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। সেজন্য টিউশনি পড়িয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে কিছুটা দেরী হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বাসায় ফিরে দেখি কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। মেহমানে ভরপুর বাসা। ছোট ফুফি,খালামনি,নানু,মামীরা অর্থাৎ কিশোরগঞ্জের আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তাদের প্রায় সবাই চলে এসেছে। বাসার কেউ অসুস্থ হলে তো এমন রমরমা পরিবেশ থাকতো না। বসার রুম থেকে আব্বুর কথাবার্তার আওয়াজ আসছে।মনে হচ্ছে আরো বেশ ক’জন মানুষ আছে ওখানে। রান্নাঘরে আম্মু কি যেন রান্না করছে। অন্যরা রান্নায় আম্মুকে হেল্প করছে। ছোট ভাই মাসুমকে দেখলাম ফোনে গেমস খেলছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে এত রান্নাবান্নার আয়োজন করা হচ্ছে কেন? বাসায় কেউ আসবে নাকি?” ও ফোনের স্ক্রিনে মাথা রেখেই বললো,
“হুম আসবে তো!”
“ কে?”
“ তোমার বর!”
“কিহ! ফাজলামি করস! না?”
“আরেব্বাস তোমার সাথে ফাজলামি করলে আমার রক্ষা আছে নাকি!
তুমি আমার এক দুই তিন চার পাঁচ বছরের একমাত্রবড় বোন! আমার মত ছোট মানুষের সেই সাহস আছে নাকি!?” “খুব বেশি বড় হয়ে গেছিস! তাই না?! আদব কায়দা তো কিচ্ছুই নাই তোর মধ্যে। তোরে শুক্রবার বিকাল বেলা নিয়ম করে তিনটা থাপ্পড় দেওয়া উচিত! আমার সামনে থেকে যা এখন! ফাজিল কোনখানকার!” “শুক্রবার বিকালবেলা আমার প্রাইভেট আছে। ওই টাইমে থাপড়ানোর সুযোগ নাই। অন্য টাইম বের করো। আর আমি কই যাব?! একটু পরে তুমিই শ্বশুর বাড়ি চলে যাবা। যা কান্নাকাটি করার এখুনি শুরু করে দাও।”
ওর সাথে কথা বলাই বৃথা। আউলফাউল কথা বলে মেজাজ খারাপ করে দেয়। আমি আমার রুমে চলে গেলাম। তার পাঁচ মিনিট পরেই আব্বু এলো। একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, “ কেমন আছিস মা? সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো?” আব্বুর কথা শুনে একটু অবাক হলাম। সকালেও আব্বুর সাথে কথা হলো। আর এখন হঠাৎ এসব জিজ্ঞেস করছে কেন বুঝতে পারছি না। আব্বু অন্য কিছু একটা বলবে বুঝতে পারছিলাম। তাই আমিই সরাসরি বলে ফেললাম, “ সবকিছু ঠিকঠাক ই আছে আব্বু। কিন্তু তুমি কি অন্য কিছু বলতে এসেছো আমায়?” আমি এ কথাটা বলাতে যেন আব্বু কথাটা বলার উৎসাহবোধ করলো। মাথাটা বারকয়েক ঝাঁকিয়ে বললো, “ হ্যাঁ হ্যাঁরে মা। আমি তোকে যে কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম তা হলো আমি যদি কোনোদিন তোকে আগে থেকে না জানিয়েই তোর ভালোর জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি তুই কি তাতে অমত করবি?” কথাটা বলে আব্বু যেন একটু আশার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
আব্বু খুব শান্তশিষ্ট মেজাজের। সহজে কখনো রাগতে দেখিনি আব্বুকে। আমাদের সাথে সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মতই করতে চান কিন্তু বিভিন্ন ব্যাস্ততার কারণে কখনো একটু বেশি সময় দিতে পারেন নি আর কি। তবে আব্বু যে আমাদের দুই ভাইবোনকেই খুব ভালোবাসেন সেটা আমরা দুজনেই বুঝি। তাই আব্বুকে হতাশ করতে আমার কখনোই ভালো লাগে না। আমি আব্বুর আরেকটু কাছে এসে বললাম, “আব্বু তুমি আমার ব্যাপারে কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছো আর তাতে আমি কখনো অমত করেছি?”
আব্বু মাথা নেড়ে বললো, না তা করিস নি। কিন্তু এটা তোর সারাজীবনের ব্যাপার তাই আর কি!” আব্বুর কথা শুনে আমার কেমন যেন খটকা লাগলো। সারাজীবনের ব্যাপার মানে! তাহলে মাসুম যা বলছে তা সত্যি! আমার খটকা দূর করার জন্যই যেন আব্বু বলে উঠলো, “ মাহিন ছেলেটাকে চিনিস তো। খুব ভালো ছেলে। আমাদের এলাকাতেই তো ওদের বাসা। ওর বাবা কয়েকদিন আগে আমার সাথে এই নিয়ে কথাও বলেছিলো। তোর মা’র সাথে এটা নিয়ে আমার কথাও হয়েছে সেদিন। কিন্তু আজকে হঠাৎ মাহিনের বাবা বললো মাহিন নাকি বলছে বিয়ের কাজটা আজই সেরে ফেলতে চায়। সামনের মাসের তের তারিখ থেকে ওর চাকরিতে জয়েনিংয়ের প্রথম দিন। আমরা চাচ্ছিলাম আর কয়দিন পরে হতে কিন্তু ওর নাকি আজকের দিনটাই লাগবে নয়তো আরো একবছর পরে বিয়ে করবে! কিছুটা অদ্ভুত টাইপের ছেলে আর কি। কিন্তু সেটা ব্যাপার না ছেলেটা খুব ভালো স্টুডেন্ট। ভার্সিটিতে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে গত দশ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। আর আমরাও তো ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি খুব ভালো ছেলে। তাই ছেলে যখন চাচ্ছে আমরাও চাচ্ছি আজই বিয়েটা হয়ে যাক কাজী ডেকে। অনুষ্ঠান না হয় পরে হলো! এখন তুই কি বলিস?”
আব্বুর মুখে মাহিন নামটা শুনে আমি যেন বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মত চমকে উঠলাম। পাঁচবছর আগে এরকম ই একটা বৃষ্টির দিনে ছেলেটার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিলো কিন্তু যা কথা হয়েছিলো তা মনে পড়লে এখনো মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে তো বউ যে আছে এটাই কয়দিন পর ভুলে যাবে পড়ার চাপে! এখন হয়তো একটু পড়ার ভূত কিছুক্ষণের জন্য দূর হয়েছে তাই বিয়ে করতে ইচ্ছে হলো। আর সেজন্য আজই করতে চাচ্ছে!
মাহিনের সাথে বিয়েটা রাতেই হয়ে গেলো। যদিও এই বিয়েটার জন্য আমি কোনোরকম প্রস্তুত ছিলামনা হুট করে হয়ে গেছে। বাসা থেকে বেরোবার আগমূহুর্তে মাসুম যেন কোত্থেকে দৌড়ে এসে বললো, “কি আপু নিয়ম করে তো তিনটা থাপ্পড় দিতে চাইছিলা! এখন কি থাপ্পড় খাওয়ার জন্য মাহিন ভাইয়াদের বাসায় যাব নাকি প্রতি শুক্রবারে?” এমন একটা পরিস্থিতিতেও যে মাসুম পাজীটা এ ধরনের কথা বলতে পারে তা ভেবে বেশ অবাক ই হলাম সেই সাথে হালকা একটু রাগও উঠলো ওর প্রতি। ওর কথা শুনে মাহিন পড়ুয়াটা শব্দ করে হেসে উঠলো। কিছু একটা বলেছিলোও মে বি আমি খেয়াল করিনি।
কিন্তু এই পড়ুয়া ছেলেটার মাঝেও যে রোমান্টিকতা বিদ্যমান আছে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি! বিয়ের রাতে প্রথম আমাকে যে কথাটা বললো তা হলো “মনে আছে পাঁচ বছর আগে আজকের এই দিনটাতে এরকমই একটা বৃষ্টির দিনে তোমার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিলো। তুমি আমাকে একগাদা ভয়ঙ্কর টাইপের কথা বলেছিলে! আমি তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে আমি সেদিনই ঠিক করে ফেলেছিলাম বিয়ে করলে এই ডেন্জারাস মেয়েটিকেই মানে তোমাকেই করবো! আর সেদিনটা হবে ঝুম বৃষ্টির দিন এবং তারিখটা হবে তোমার সাথে কথা বলার প্রথম দিনটা! আমার খুব ইচ্ছে করতো এরকম ঝুম ঝুম বৃষ্টির দিনে তোমার সাথে বৃষ্টিবিলাস করবো। আজকেও কিন্তু ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কি ভিজবে আমার সাথে?!
আমার হঠাৎ করে কেন যেন একটু মজা করতে ইচ্ছে হলো। বললাম, “ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে তো! আমার আবার টনসিলের সমস্যা আছে!” ও হয়তো মজাটা বুঝলো। একটু হেসে বললো, “একদিন ভিজলে কিছু হবে না। তাছাড়া আমার এখন আর কোনো পরিক্ষাও নেই। থাকলেও সেটা বাদ! কি খুশি তো?!” এরকম পরিস্থিতিতে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলামনা। তবে বেশ অবাক হয়েছিলাম। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে। আর আমরা দুজন ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করছি।