—- আসতে পারি স্যার?
—- জ্বী, আসুন।
মেয়েটি ভেতরে এলো। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। মেয়েটির দিকে তাকিয়েই আমি থমকে গেলাম।মেয়েটিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, যেনো সে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটাকেতার সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সেই সাথে তার দৃষ্টিতে মিশে আছে একরাশ অবিশ্বাস আর অবাক বিস্ময়!মেয়েটির ভিতর একটা চাপা অস্থিরতা কাজ করছে। কপাল ঘামছে, ঘনঘন ঢোক গিলছে। আমি কি বলবো? কি বলা উচিত আমার? কি বলা যায়?
—- এহেম….এহেম… দাড়িয়ে কেনো, বসুন প্লীজ। (আমি)
—- ধন্যবাদ স্যার।(মেয়েটি)
—- কিছু প্রশ্ন করবো, উত্তর দেবেন।
—- জ্বী,চেষ্টা করবো।
—- আপনার নাম কি?
—- ইরিত্রা ইরি।
—- বাসা কোথায়?
—- গ্রীন রোড।
—- বিবাহিতা?
—- (নিশ্চুপ)
—- আপনি তো জানেন, আমাদের কোম্পানী একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান।
—- জ্বী স্যার।
—- অনেক ধরনের ঝাঁকি ঝামেলা পোহাতে হবে। পারবেন?
—- জ্বী স্যার।
—- কত টাকা বেতন হলে আপনি কাজটা করবেন?
—- আপনারা যত দেবেন।
—- ২৫ হাজার টাকা হলে চলবে?
—- চলবে স্যার।
—- ওকে,আপনি কাল থেকে জয়েন করুন।
—- ধন্যবাদ স্যার।
ইরি বসা থেকে উঠে দাড়ালো। যাবার সময় একটু হাঁসার চেষ্টা করলো। হয়তো কৃত্রিম,তবে সুন্দর! যাবার বেলায় বারবার পেছন ফিরছে। আমাকে দেখছে সে। সেই একই দৃষ্টি। অনেকটা অবিশ্বাস আর অপার বিস্ময়! বের হতে গিয়ে দরজার সাথে একটা হালকা ধাক্কা খেলো। কেমন জানি অপ্রকৃতস্থ হাঁটাচলা।
ইরি বেরিয়ে গেলো। আমি উঠে বারান্দায় চলে এলাম। আমার অফিসে আমার রুম লাগোয়া একটা বাগান আছে। সেখানে গোলাপ,অর্কিড আর ক্যাকটাস এর বসবাস। আমি বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। ব্যাস্ত রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। একা একা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোই লাগে। সবার মধ্যে গতি; কারো গতি দ্রুত,কারো মন্থর, আবার কারো গতি দ্রুতও নয়, মন্থরও নয়- মধ্যম। জীবন তো কোনো না কোনো গতিতে ছুটে চলা। দমকা কাতাস উঠে, সর্ সর্ করে গড়াতে থাকে শুকনো পাতা। সে সাথে তাল মিলিয়ে সময়ও। পাতা ঝরা শুরু হয়েছে বেশ কদিন। গাছগুলো ধীরে ধীরে সন্ন্যাসী হয়ে উঠছে। শীত শীত করছে।এ বছর শীতটা বোধহয় একটু আগেই চলে আসছে।
অনেকদিন আগে, হ্যাঁ,,,,,, অনেকদিন আগে একটা মেয়ে আমাকে তার মায়াজালে জড়িয়েছিলো। মেয়েটার নাম ছিলো ইরি; ইরিত্রা ইরি। মেয়েটা তখন ঢাবি তে পড়তো।ফার্স্ট ইয়ার; ইংরেজী বিভাগ। আমি পড়তাম সরকারী তিতুমীর কলেজে। ফাইনাল ইয়ার; পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। আমি বাসা থেকে রাগ করে চলে এসেছি প্রায় বছর দেড়েক। একটা মেসে এসে উঠলাম। দুটো টিউশনি আর একটা পার্টটাইম জব করতাম। আমার মেসের সামনের বাসাটাতে ইরিরা থাকতো। আমি বারান্দা হতে ইরিকে দেখতাম। সে মাঝে মাঝে আসতো, আমি আগের দিনের না দেখাটাকেও পুষিয়ে নিতাম। এমন করে মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতো। একদিন বাইরে বেরুলাম। ইরি আমাকে ডাক দিলো। আমার হার্ট রীতিমত বিট মিস করতে থাকলো। ইরি আবারও ডাকলো। আমি এগিয়ে গেলাম। ইরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা নীচু করে আছি।
—- এই যে মিস্টার খাম্বা, কি প্রবলেম আপনার?
—- কোনো প্রবলেম নেই।
—- প্রব নেই মানে? প্রতিদিন বারান্দায় কি?
—- কই; না তো, আমি তো প্রতিদিন যাই না।
—- কিন্ত আমি তো প্রতিদিন দেখি।
—- তার মানে?…..
—- তার মানে,তার মানে কি?
—- কিছুনা, আর কিছু বলবেন?
—- জ্বী,আপনার নাম?
—- আল-ফারাবী।
—- নাইস নেম।
—- আমি কি এখন আসতে পারি?
—- হ্যাঁ ; না,এই যে- একটু শুনুন!
—- জ্বী বলুন।
—- ভালোবাসেন?
ভালোবাসেন বলে ইরি আমার দিকে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে আছে। আমি সে চোখের পাসে তাকাতে পারছিনা। কি এক আমোঘ টান সেটা। আমি বলে বোঝাতে পারবোনা। শুধু মনে হলো যে, আমি পেয়েছি। তাহাকেই পেয়েছি। ইহা ছাড়বার নয়। বড্ড বেশী ভালোবাসি যে তারে আমি। বড্ড বেশী! অন্নেক বেশী!! ঠিক এই এই এত্তগুলা। ভালোই চলছে আমাদের উঁকিঝুঁকি প্রেম। একদিন নীচে ইরির সাথে দেখা। বললাম,চলো ঘুরে আসি। ইরি সম্মতি জানালো। আমি আর ইরি রবীন্দ্র সরোবরে গেলাম।
—-ফারাবী,আমাক ে ভালোবাসো?
—- অসম্ভব রকমের।
—- ভালোবাসা কেমন গো?
—- স্বপ্নের মতো।
—- মানে?
—- স্বপ্ন দেখেছো কখনো?
—- হুম,প্রতিদিন দেখি।
—- ফিল করেছো কখনো?
—- হুম করেছি।
—- তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটাও সেরকম। তুমি চাইলেই ছুঁয়ে দিতে পারবেনা, তবে অনুভব করতে পারবে। তুমি চাইতে দেখতেও পারো।
—- ভালোবাসা দেখা যায়?
—- হুম।
—- কোথায়?
—- যাকে ভালোবাসো তার চোখে?
—-তাই নাকি? এতো কনফিডেন্স?!
—- হুম, এত্তগুলা।
—- দেখি,এদিকে আসো। তোমার চোখে দেখবো।
—- হুম,এসেছি। এবার দেখো।
—- ইশ্…
—- কি হলো?
—- কি মায়া গো তোমার চোখে! ছেলেদের চোখে এতো মায়া থাকতে নেই।
—- ও ইরি,মায়া কি গো?
—- মায়া হলো ভালোবাসার আরেক ভাই।
—- তাই? আমার চোখ কি আছে?
—- তোমার এক চোখেতে অপার মায়া, আরেক চোখে প্রেম। কারো দিকে তাকাও যদি, ভেঙ্গে দেবো ঠ্যাং।
—- হা হা হা, বাদাম খাবে?
—- খাবো, তবে শর্ত আছে।
—- কি শর্ত?
—- যদি তুমি বাদাম ছিলে খাইয়ে দাও।
—- খেতে হবে না, টাকা নেই।
—- ওরে অলস রে উল্টোটাও তো হতে পারে।
—- দাড়াও, বাদাম নিয়ে আসছি।
—- লাগবে না, সময় নেই।
আমি আর ইরি দুজনেই জোরে হেঁসে উঠলাম। আশেপাশের অনেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে এই যান্ত্রিক জীবনে তান্ত্রিক আশীর্বাদময় প্রেম জগতে এতো হাঁসি কোথা পেলো?! আমি একবার ইরির দিকে তাকাচ্ছি, ইরি আমার দিকে তাকাচ্ছে। তারপর দুজনে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছি। জায়গায়জায়গায় প্রেমর জুটি। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। যেনো সদ্য ফোটা একেকটা জোঁড়পদ্ম। তবে কতকগুলির দিকে তাকালে মনে হয় সদ্য ফোটা জোড়পদ্মটি ভ্রমর নষ্ট করে দিয়েছে বা দিচ্ছে।
সেদিকে তাকানোর প্রয়াস নেই। বাসায় যেতে হবে। ইরি সন্ধ্যার পর বাইরে থাকেনা। তাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে আমি গ্রীন রোডে চলে এলাম।গ্রীন লাইফ হসপিটালের পাশের মামার দোকানে আমি আড্ডা দেই। পরিচিত কয়েকটা ভাই বন্ধু বসে সেখানে।আজও ভাবছি একটা আড্ডা দেবো। জম্পেশ আড্ডা। আমি মামার দোকানে ঢুকলাম। মামাকে বললাম,”মামা, একটা বেনসন আর এককাপ চা। এভাবে বেশ ভালোই চলছে। একদিন ইরিকে দেখলাম একটা ছেলের সাথে রিক্সাতে বসে আছে। আমি তাদের দেখে আর সামনে যাইনি।হতে পারে ইরির কোনো রিলেটিভ। কিন্ত মাঝে মাঝে ব্যাপারটা ঘটতে লাগলো। তাছাড়া তাদের দুজনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ খুব গা মাখামাখি ছিলো। যা আমাকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছে। আমি একদিন ইরিকে ডাক দিলাম।
—- কিছু কথা বলবো ইরি?
—- বলো।
—- তোমার সাথে যে ছেলেটাকে দেখি, সে কে?
—- আমার ফ্রেন্ড।
—- কোনো রিলেটিভ না তো?
—- না,শুধুই ফ্রেন্ড।
—- বাট বন্ধুদের সাথে এভাবে চলাফেরা?!
—- কিভাবে ফারাবী?
—- এই যে অনেকটা অন্তরঙ্গ!
—-ফারাবী, ঠিকভাবে কথা বলো।
—- আমার সাথে তো কোনোদিন এভাবে চলাফেরা করোনি ইরি।
—- তুমি আর সায়ান কি এক?
—- ওহ্,তাহলে তোমার দোস্ত সায়ান কেমন আলাদা আমার থেকে?
—- ও অনেক আলাদা, ওর কালচার,স্টাডি,স্টাইল সব।
—- ইরি,তুমি কিছু একটা লুকোচ্ছো।
—-ফারাবী,তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?
—- যদি বলি তাই?
—- তাহলে আমি বলবো,তুমি একটা নীচ।
—- আমার সন্দেহ করাটা স্বাভাবিক।
—- সন্দেহ ছোটোলোকেরা করে, তুমি একটা আস্ত ছোটোলোক। ভালোবেসে কি দিয়েছো আমাকে? দশ টাকার বাদাম ছাড়া?
—- ইরি,কি বলছো তুমি এসব?
—- যা সত্যি তাই বলছি। সায়ানের পরিবারের দিকে তাকাও,মস্ত বড় পরিবার। টাকা, পয়সা,প্রভাব সব আছে। তোমার কি আছে?
—- আমারও আছে ইরি।
—- কচু আছে তোমার। আজ অবধি তোমার ফোনে তোমার পরিবারের কেউ কল করেছে?
—- ইরি, আমি বাসা থেকে রাগ করে বেরিয়ে এসেছি। এসে মেসে থাকি।
—- আর বলতে হবে না ফারাবী। আমি বাচ্চা নই। আচ্ছা ফারাবী,তোমার বাবার নামটা মনে আছে তোমার? নাকি তুমি পিতৃপরিচ….
—- ইরি…
আমার মাথাটা ঘুরছে। ছিঃ ছিঃ,,,,, এই কি সেই ইরি? এতো ভালোবাসা আমার যার জন্যে, সে আজ আমার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে?! আমার কি করা উচিত এ মুহূর্তে?! আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। নীল আকাশের শরীরে অসংখ্য নক্ষত্র, আচ্ছা,ধ্রুবতারা কোনটি? ধ্রুবতারা সন্ধ্যা আকাশে উঠে? নাকি ভোরের আকাশে? সে ধ্রুবতারা চিনেনি। তাকে কেউ ধ্রুবতারা চিনিয়ে দেয়নি। ধ্রুবতারা অভিমানে খসে গেছে। ধ্রুবতারা দের অনেক অভিমান হয়, অনেক,,,,,, আমি অভিমানী। বড্ড বেশী অভিমান আজ আমার। চোখের জলে অভিমান,প্রতিটি নিঃশ্বাসে অভিমান, প্রতিটি চাওয়াতে অভিমান। আমার কষ্টে বুকের ভেতর থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। সেটা হলো “বাবা” যার থেকে এতদিন দূরে ছিলাম।
আমি পরীক্ষা শেষে ফিরে গেলাম আমার পরিবারের কাছে। তার আগে মেসেই ছিলাম। ইরি তেমন বারান্দায় আসতো না। আমি কল দিলে কেটে দিতো, মাঝে মাঝে ওয়েটিং পেতাম। সেসব আমার সয়ে গেছে। পরীক্ষার পর পরিবারের নিকট চলে গেলাম। বাবা আমাকে বিজন্যাস দেখাশোনার কাজে লাগিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, আমি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার বাবাও শহরের বড় লোকদের তালিকাভুক্ত। আমি একদিন রাতে গাড়ি নিয়ে ইরিদের বাসায় গেলাম। আমার কোটিপতি বাবার সন্তানের মতই।
সেদিন আমি ইরিকে পাইনি। তবে চমকাতে পেরেছি ইরির পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের। যে ইরির বাবা আমাকে একদিন বকেছেন, সে ইরির বাবা আমাকে এই অবস্থায় দেখে ঘনঘন চশমার কাচ মুছে মুছে আমার দিকে তাকাতে থাকলেন। ইরির মা আদর যত্নে ব্যাস্ত! সবাই আছে,সব আয়োজনও আছে। শুধু নেই ইরি, আমার ইরি নেই। ইরির বিয়ে হয়ে গেছে সায়ানের সাথে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কি কষ্ট! এ কষ্টে চোখে জল আসেনা। তবে ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। চিৎকার করা যায় না, তবে নীরবে চোখের জলে গাল ভেজানো যায়। দাবদাহে আমার হৃদয় পুড়ে ছাই। একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়ুক এই দাবদাহে। ভেতরে অনল ধিকি ধিকি, বাইরে মদের নেশায় চুর নষ্ট রাত।
নেশা গাঢ় হলে, পৃথিবী সরে গেলে সমস্ত নষ্ট বেদনার গাঢ় নীল নিয়ে ইরির কপালে টিপ আঁকতে আঁকতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে সায়ান। আমার নিজের পতিত জীবন হবে ইরির কপালের টিপ! সে টিপ অনুভবে আসবে না ইরির; আর ক্রমাগত রক্তাক্ত হবো আমি। বড় ইচ্ছে; বড় ক্ষোভ, ইরি কেনো আমাকে পুরো মারেনি? সে কি জানে না? আজো গুমরে কাঁদে নির্ভিত্তে আমার অন্তর! আজ চার বৎসর পর সে ইরি আবার ফিরে এলো। একটা চাকরির জন্য। মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরির জন্য। কোথায় আজ তার সায়ান? যার কালচার,স্টাইলের সাথে আমাকে তুলনা করলো, সে স্টাইলিশ বিত্তবানের বউ আজ আমার কোম্পানীর পঁচিশ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী! এটাই হয়তো নিয়তি। জীবনটা আসলেই চক্রাবৃত্ত।
কেন্দ্রের ব্যাস কিংবা ব্যাসার্ধ অথবা জ্যা বলতে কিছুই নেই। সবই কেন্দ্র, তোমাকে কেন্দ্র করে সব। তুমি মুল বিন্দু। শূন্যের মতো আকৃতি তবে অপার ক্ষমতা। রাস্তাটা আজ খুবই ব্যাস্ত। মহাকালের স্রোতে জলজপানার মত ভেসে চলে সময়। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে উঠে বুক। তথাপি আপনার চারদিক উপলব্ধি করে ক্রিয়াশীল হই। ক্যাকটাস আর গোলাপের চারারা বড় হচ্ছে। গোলাপের কাটা গুলো আজ বড় আপনজন মনে হচ্ছে। ক্যাকটাসটা তো হৃদয়ের বন্ধু। একগ্লাস পানি খেলাম। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, কি এমন হলো ইরির জীবনে এই চার বৎসরে? আসুক ইরি কাল। জিজ্ঞেস করে দেখবো। আচ্ছা, জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হবে?
পরদিন-
—- আসতে পারি স্যার? (ইরি)
—- আসুন (আমি)
—- কেমন আছেন?
—- ভালো,আপনি?
—- আমি কেমন আছি ফারাবী? (কথাটা বলেই ইরি আমার দিকে তাকালো,কি প্রখর সে দৃষ্টি! আমি বলে বোঝাতে পারবো না। নিজেকে সংযত করে নিলাম।)
—- সায়ান ভালো আছে?
—- আমি জানিনা।
—- কেনো?
—- সায়ান নষ্ট হয়ে গেছে।
—- কি বলছো?
—- ঠিকই বলছি,বিয়ের মাস দুয়েক পর সে বদলে গেলো। অনেক রাতে বাসায় ফিরে,নেশা করে প্রতিদিন।
—- হুম,উন্নত কালচার!
—- কালচার না ছাই!
—- কেনো? তোমার তো সেরকমই পছন্দ! আমি তো ছিলাম ব্যাকডেটেড!
—- ফারাবী।
—- বলো।
—- এই গ্রুপটা তোমাদের? মুর্তজা চৌধুরী তোমার বাবা?
—- হুম,আমার বাবা।
—- আচ্ছা,আমার কি কাজ করতে হবে?
—- নিজের টেবিলে যাও, বুঝিয়ে দেবে তোমাকে।
—- ওকে।
—- হুম।
—-ফারাবী
—- বলো,
—- নাহ্, আচ্ছা যাচ্ছি।
—- হুম।
ইরি বেরিয়ে গেলো। আমি আনমনে ভাবতে লাগলাম। ইরি সত্যিই ভালো নেই। ইরির মুখের হাঁসিটা আসল হাঁসি নয়। ভালোই চলছে অফিসের কাজ। বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। হয়তো দু একদিনের ভেতর মেয়ে দেখা শুরু করবে। রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকালাম। ইরির ফোন, আমার ভ্রু কুঁচকে গেলো। ফোনটা রিসিভ করলাম।
—- হ্যাঁ, ইরি বলো।
—- আমি সরি ফারাবী।
—- কেনো?
—- তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য।
—- আমার কোনো কষ্ট নেই।
—- আছে,আমি জানি।
—- কিছু জানোনা তুমি।
—- ফারাবী,আমি সরি।
—- ইটস ওকে।
—- ফারাবী,
—- বলো।
—- আমি ফিরতে চাই।
—- মানে?
—- আই লাভ ইউ।
—- আমি নীচ।
—- আই ট্রাস্ট ইউ।
—- আমি ছোটোলোক।
—- আই মিস ইউ।
—- আমি পিতৃপরিচ….
—- ফারাবী,
—- বলো।
—- আমি সায়ানের কাছে সুখী ছিলাম না। আমি দুমাস তার কাছে ছিলাম। তারপর বাবার কাছে চলে যাই।
—- সায়ান কোথায় এখন?
—- আমি জানিনা। ওর নাম আমার সামনে নিবে না।
—- ওকে।
—- ফারাবী,
—- বলো।
—- ভালোবাসো আমাকে?
—- (আমি চুপ)
—- ফারাবী, আমি জানি। তুমি এখনো আমাকে লাভ করো বলো,চুপ করে থেকো না।
—- আমি জানিনা।
—- আজ তোমাকে বলতেই হবে।
—- আমি কিছু জানিনা। পরে কথা বলবো।
—- না,আগে বলো।
—- গুড নাইট।
—- ফারাবী প্লীজ প্লীজ ফারাবী।
আমি ফোনটা কেটে দিলাম। আমি জানালার পর্দার দিকে তাকালাম। মৃদু বাতাসে পর্দাটা হালকা দুলছে। হঠাৎ তেলাপোকা উড়ে এসে বসে জানালার পর্দায়। উড়ে যায়,আবার এসে বসে। ঘোর লেগে যায় আমার। নির্ঘুর শয্যা ভালো লাগেনা আর। বারান্দায় যাবার জন্য নিঃশব্দে দরজার কাছে যাই। সন্তর্পনে ছিটকিনি খুলি। কি উদার নীলিমা! কামিনী ফুলের মতো ফুটে আছে তারারা। আকাসের শরীরে, জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। দুরন্ত মেঘ ছুটছে এখানে সেখানে। ছিটকে আসা আলো আটকে আছে নারকেল গাছের সরু সরু পাতায়। মনটা হু- হু করে উঠে। একদলা কষ্ট বুকের ভেতর। চুর চুর করে ভেঙ্গে পড়ে রাত্রির নিঃস্তব্দতা। আকাশের গা থেকে খসে পড়ে তারা। বারান্দায় দাঁড়াতে ভালো লাগে না আর।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খুঁজতে থাকি ঘুমের ট্যাবলেট। ঘুম,একটু ঘুম,,,,একটু শান্তি! সকেন্ড গড়াতে থাকে মিনিটের গতিতে।বাতাসে কিসের যেনো গন্ধ। সেই স্পর্শ! সেই গন্ধ!! অপূর্ন এই অপূর্বতা কান্নার বেগ বাড়িয়ে দেয়। সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে চলে ইরির জন্য কান্না আমার। এতো গরলের পরেও কেনো এই নারীর জন্য আমার সমস্ত স্বত্ত্বা জুড়ে এতো তৃষ্ণা?! আমার বোধগম্য নয়। আমি আজও বুকের জমিনটা হাতড়াই। কি আছে সেখানে? পূর্ণতা নাকি শূন্যতা? রাতের আকাশের তারারা আমাকে শেখায়, মিটিমিটি করে জ্বলেও কি করে টিকে থাকা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। শূন্যতার কি বিশাল ব্যাপ্তি! আমি প্রতি রাতে রাজা হই। একটা বিশাল কষ্ট রাজ্যের। আমি হাঁসি রাজা হয়ে। একদিন সব হাসির ময়নাতদন্ত হবে, ফরেনসিক রিপোর্টে লেখা থাকবে”সবই মিথ্যা।
বিকেল থেকে রাত কিংবা সকাল হতে দিন, আমি হিসেব কষে যাই জীবনের। কত আসনে অধিষ্ঠিত ছিলাম কতজনের ইচ্ছেয়, আবার আসন থেকে নেমে গেছি অজান্তে অগোচরেই। কোনটা কিছুদিন,কোনোটা কিছুসময় আর কোনোটা ক্ষনিকের। সব হিসেব মিলালে আমি কিছুই না। দিন শেষে এক বিশাল শূন্য। যে শূন্যতা ঘিরে থাকে আমাকে। ঠিক যেমনটা করে আঁকড়ে থাকে বৃত্তের কেন্দ্রের চারপাশে বৃত্তের ব্যাস। আমার পুরোটা সত্ত্বা আজ শূন্য। বিশাল এক শূন্য আমি আজ। শূন্যতায় পরিপূর্ন আমি। সত্যিই শূন্যতায় পরিপূর্ন আমি।